জয়দেব ঘোষঃ কি ভাবে বিদেশি সাজানো হলো!

কমল চক্রবর্তী :- জয়দেব ঘোষ। থাকেন বদরপুরের এসটি রোডে। জেলা করিমগঞ্জ। যখন আসামে ১৯ লক্ষ এনআরসি ছুটদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে বলা হয়েছিল, ঠিক সেই সময় এনআরসি ছুটদের কীভাবে সাহায্য করা যায়, বদরপুরে রেলওয়ে কলোনিতে “ঝিনুক সাংস্কৃতিক সংস্থা” এনআরসি হেল্প ডেস্ক সেন্টার খুলে। সেখানেই পরিচয় জয়দেব ঘোষের ভাই দীপক ঘোষের সাথে। সেই সময় অর্থাৎ ২০ সেপ্টেম্বর,২০১৯ আমাদের সাথে দেখা করে মা বাবার সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে হাজির। ঝিনুক থেকে আমাকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল জয়দেব ঘোষের কেসটি দেখভাল করার জন্য। ওর ভাইয়ের কাছে করিমগঞ্জ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে দেওয়া ‘জাজমেন্ট অর্ডারের কপি ছিল না। আশ্চর্য ! একজনকে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো,অথচ আইনজীবী জয়দেব ঘোষ বা তার পরিবার কে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে ইস্যু করা জাজমেন্ট অর্ডার কপি দেয়নি ! শুধু বলল,২০১৯ সালের মে মাসের দুই তারিখ ওর দাদা কে শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় এবং কেসটি এখন গৌহাটি হাইকোর্টে।
বেশিরভাগ আইনজীবী নিরক্ষর অসহায় মানুষকে অন্ধকারে রেখে কাজগুলো করে, অথচ প্রয়োজনীয় পারিশ্রমিক পকেটে ভরে নেয়। ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে জাজমেন্ট অর্ডারের কপি তখন পর্যন্ত পায় নি জয়দেবের পরিবার। অথচ আইনজীবীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে এই কাজটি।
পরবর্তীতে জয়দেব ঘোষের ভাই দীপক ঘোষ করিমগঞ্জের আইনজীবী হিমাদ্রী দাস এবং গোস্বামীর মারফত কেসটি হাইকোর্টে পাঠানোর বন্দোবস্ত করে। করিমগঞ্জের বন্ধু ছোটভাই নীলাঞ্জন ভট্টাচার্যের সহযোগিতায় গৌহাটি হাইকোর্টের কেস নং পাওয়া গেল। কেস নং বের করে দেখলাম, গৌহাটি হাইকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী হাফিজ রশিদ চৌধুরী ‘জয়দেব ঘোষ’-এর কেস লড়ছেন। তারপর থেকে অনবরত চাপ সৃষ্টি করে যাওয়া হাফিজ রশিদ চৌধুরী মহাশয় কে।
২০১৮ সালে নোটিশ পেয়ে বিভিন্ন তারিখে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে হাজিরও হয়েছিলেন জয়দেব ঘোষ। শেষের দুটো তারিখে হাজির হতে পারে নি,কেন না তার সতেরো বছর ছেলের ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত একমাত্র ছেলের চিকিৎসার জন্য বাধ্য হয়ে বাইরে যেতে হয়েছিল জয়দেবকে। আইনজীবীর কাছে এ সংক্রান্ত লিখিত আবেদন দিয়ে গেলেও ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল জয়দেব ঘোষকে একতরফা রায়ে বিদেশি ঘোষণা করে।২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দশ তারিখ তার একমাত্র ছেলেটির ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে জয়দেব। ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের সদস্য(বিচারক) জয়দেব কে একতরফা রায়ে বিদেশি ঘোষণা করে শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেন।
মজার ঘটনা হচ্ছে, জয়দেব ঘোষ ২০১৯ সালে এপ্রিল মাসে লোকসভা নির্বাচনে ভোটও দিয়েছিল !! প্রশ্ন হচ্ছে, ২০১৯ সালে যে ভোট দিতে পারে, তাকে কীভাবে ডি – ভোটার বা সন্দেহজনক নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে পরবর্তীতে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়!! আসলে আসামে হিন্দু বাঙালিদের ওপর নির্যাতন বহু যুগ ধরে চলে আসছে। প্রচুর পরিমাণে গরিব নিরক্ষর হিন্দু বাঙালিদের নামে ডি ভোটার নোটিশ পাঠানো হয়ে থাকে।
জয়দেব ঘোষ এর মা-র নাম বীণা রানী ঘোষ। মায়ের নামেও বিদেশি নোটিশ এবং পরবর্তীতে এক তরফা রায়ে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ২০১৫ সালের চার নভেম্বর বীণা রানী কে ভারতীয় ঘোষণা করেন। একই ঘটনা ঘটে তার আরেক ভাই সুবোধ ঘোষের নামে। যেখানে মা – বাবা – ভাই ভারতীয়, সেক্ষেত্রে আরেক ভাই জয়দেব ঘোষ “বিদেশি”ঘোষিত হয় কীভাবে? করিমগঞ্জ কোর্টে কেস চলাকালীন জয়দেব ঘোষের আইনজীবী বদরপুরের রাজু দাস খুব সহজেই তার মা এবং ভাইয়ের “ভারতীয়’ হওয়ার অর্ডারটি কোর্টে জমা দিলেই জয়দেব কে ভারতীয় প্রমাণ করতে পারতেন। কিন্তু এই সহজ কাজটি করলেন না। আইনজীবীরা গরিব মানুষের নিরক্ষরতার সু্যোগ নেন এবং রোজগার করেন। জয়দেব ঘোষের স্ত্রীর নাম নির্মলা ঘোষ এবং মৃত ছেলের নাম বিশাল ঘোষ।
যাই হোক, হাফিজ রশিদ চৌধুরী হাইকোর্টে কেস ঠুকলেন। কেস নং ডব্ল্যুপি(সি)৪২১৫/২০১৯ । হাফিজ রশিদ চৌধুরী মহাশয় হাইকোর্ট থেকে নির্দেশ আনলেন, এই (২০২০) বছরের মার্চ মাসের তিন তারিখে আবার করিমগঞ্জ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল নং থ্রী’তে হাজির হতে। সেই সঙ্গে আপাতত জামিনে মুক্তি পাওয়ার আবেদন করতে। হাফিজ রশিদ চৌধুরী ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের রায়ে এবং কোর্টের রেকর্ড যা পাঠানো হয়েছিল হাইকোর্টে, তার মধ্যে গড়মিল পেয়ে তিনি অবাক হলেন। গৌহাটি হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের মেম্বাররা বললেন, জয়দেব ঘোষ কে ভারতীয় প্রমাণ করতে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়নি। তাই, হাইকোর্ট নির্দেশ দিলেন যে তিন মার্চ, ২০২০ সালে জয়দেব ঘোষকে করিমগঞ্জ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল কোর্টে তোলার জন্য সঙ্গে জয়দেব ঘোষকেও। তিন তারিখ দীপক ঘোষ তার মা’কে সঙ্গে নিয়ে সময়মতো করিমগঞ্জ কোর্টে গিয়ে হাজির, কিন্তু জয়দেব ঘোষ কোর্টে আসলেন না! করিমগঞ্জের এসপি (বর্ডার) জয়দেব কে শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে আনতে ভুলেই গেলেন!! আসলে মানুষ মাত্রেই ভুল হয়। আবার তারিখ দেওয়া হলো পাঁচ মার্চ।
পাঁচ মার্চ, ২০২০ সালে জয়দেব ঘোষ ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে জামিনে মুক্তি পেলেন দশ মাস পর। জয়দেবের মা ছেলেকে পেয়ে খুব খুশি।
হাইকোর্টে এই মামলা লড়তে গিয়ে হাফিজ রশিদ আহমেদ চৌধুরী বলেছেন, এই রাজ্যে ট্রাইব্যুনালগুলো কীভাবে চলছে, কিছু মেম্বার কতটা অনুভূতিহীন হলে পর জয়দেবের পিঠে বিদেশি তকমা বসিয়ে দিতে পারেন এবং তার জেড়েই ডিটেনশন ক্যাম্পে। আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার একটা নতুন নাম দিয়েছে – HOLDING CENTRE!! এই হচ্ছে আমাদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের উৎকৃষ্ট নমুনা। এখানেই শেষ নয়!! আরো আছে! করিমগঞ্জের তিন নং ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের বিচারক চূড়ান্ত রায়ে তাঁকে বেমালুম মহিলা বানিয়ে দিয়েছিল! আসাম রাজ্যে কিছু এফটি মেম্বার ( বিচারক) কতটা দায়িত্বশীল, নিষ্ঠাবান ও মনোযোগী সেটা বেশ টের পাওয়া যায় ওই রায়ের প্রতিলিপিতে চোখ বোলালেই! কারন, এতে একেবারে স্পষ্ট করে লেখা হয়েছে, নোটিশ পেয়ে জয়দেব একবারও এফ-টি তে হাজির হননি। আবার কী অদ্ভুত, অর্ডার শিটে রয়েছে এর উল্টো বয়ান! কী না, তিনি কোর্টে হাজির হয়েছিলেন। এই ধরনের উদ্ভোট বিচারে গৌহাটি হাইকোর্টের দুই বিচারপতি মনোজিত ভূঁইয়া এবং পার্থিবজ্যোতি শইকিয়া বাধ্য হয়ে করিমগঞ্জের ৩ নং ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের রায় খারিজ করে দিয়ে জয়দেব কে আবার করিমগঞ্জ কোর্টে হাজির হয়ে জামিনে মুক্তি দেওয়ার আদেশ দিলেন।
ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পাওয়ার পর লক গাউনের জন্য জয়দেব ঘোষের কেস করিমগঞ্জ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবার উঠতে সময় নিল। পরবর্তীতে ২৭ নভেম্বর, ২০২০ সালে শুনানি হয়ে যাওয়ার পর আবার শুনানির তারিখ পড়লো ২০২১ সালের পাঁচ মার্চ। সেদিন জয়দেবের অসুস্থ মা’কে সাক্ষীর জন্য করিমগঞ্জ কোর্টে হাজির হতে হলো। পরবর্তীতে আবার কোভিডের জন্য করিমগঞ্জ কোর্ট বন্ধ থাকায় পরবর্তী তারিখ নেওয়া সম্ভব হলো না। তবে এটা নিশ্চিত যে জয়দেব ঘোষ’কে ভারতীয় ঘোষণা করা হবেই।
একটি লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে যে সিএএ হওয়ার পরও আসামে হিন্দুদের নামে অনবরত বিদেশি নোটিশ আসছে। এমনকি এনআরসি’তে নাম থাকা সত্ত্বেও তাদের নামে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে বিদেশি নোটিশ পাঠানো হচ্ছে!!
কমল চক্রবর্তী বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী। আসামে ডি ভোটার ও ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দীদের মুক্তির জন্য তার নিরলস উদ্যোগ আজ সর্বত্র আলোচিত।
1 Comments
আমার লেখা এখানে দেওয়ার জন্য আপনাদের কাছে আমি আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞ। আপনাদের সুচিন্তিত পরামর্শ এবং মতামত আমার কাছে বাড়তি প্রাপ্তি।