ভাওতার রাজনীতি

সুমনা রহমান :- নতুন নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন বা সিএএ-এর মাধ্যমে হিন্দু বাঙালিদের নাগরিকত্ব ও সুরক্ষা প্রদানে বিজেপি সরকার প্রতিশ্রুতবদ্ধ – নির্বাচনী প্রচারে এমনটা বলেই গলা ফাটিয়েছেন অথবা রাজ্যভেদে এখনো এমনটাই প্রচার চালাচ্ছেন বিজেপি বড় থেকে মাঝারি নেতারা। অথচ বাস্তবটা আসামে প্রায় কুড়ি লাখ এনআরসি থেকে বাদ পড়ে যাওয়া মানুষের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ হিন্দু বাঙালি। তাদের কাউকে সিএএ বা নাগরকত্ব (সংশোধনী) আইনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব দেওয়া তো দূর, উপরন্তু তাদের পাঠানো চলছে ‘বিদেশি নোটিশ’। গতবছরের ভয়াবহ বন্যায় যখন আসামের জনজীবন বিপর্যস্ত, তখনো বিদেশী নোটিশ পাঠানো হয়েছে বন্যাক্রান্তদের দুয়ারে। কোবিড-কালীন লকডাউনেও ছাড় মেলেনি। বিদেশী শণাক্তকরণ আদালতে হাজিরা দেবার শমন এসে হাজির হয়েছে আসামের হিন্দু বাঙালিদের বাড়িতে। নির্বাচন চলাকালীন সময়েও একই বিষয় ঘটে চলেছে। এনআরসিছুট অথবা সন্দেহযুক্ত ভোটার বা ডি-ভোটারদের যেমন বিদেশী নোটিশ পাঠানো হচ্ছে, তেমনই বিদেশী ট্রাইব্যুন্যালের বিচারে ‘বিদেশী’ ঘোষিত লোকদেরও খোঁজ করা হচ্ছে। কারন তাদের ধরে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে।
দশবছর আগেই বিদেশী মামলা নথিভুক্ত হয়েছিলো ঢালিগাঁওয়ের পালপাড়ার বাসিন্দা শান্তি সাহার নামে। তাঁকে বিদেশি সংশয় করে মামলা করেছিলো চিরাং জেলা পুলিশ। মাঝখানে কেটে গেছে দশবছর। অনেক কঠিন প্রক্রিয়ায় উতরে গিয়ে শান্তি সাহার নাম উঠেছে এনআরসি’র ফ্যাইনাল তালিকায়। কিন্তু দশবছর আগের সেই বিদেশী মামলায় এখন চিরাং বিদেশী ট্রাইব্যুনাল থেকে নোটশ এসেছে শান্তি সাহার নামে।
অমলা দাস গোয়ালপাড়া ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী। স্বামী গোপেশ দাস অনেক চেষ্ঠা করেও তাঁকে মুক্ত করাতে পারেননি। মূলত এই শোকেই গত ১৬ ই ডিসেম্বর ২০২০ তে মারা যান গোপেশ দাস। স্ত্রী যে স্বামীর শেষবারের মতো মুখ দেখবেন এরও সুযোগ মেলেনি। শাখা-পলা ভাঙা কিংবা সিঁদুর মোছার মতো হিন্দু ধর্মীয় রীতিনীতিও তিনি পালন করতে পারেননি। কী করেই বা পারবেন! তিনি তো ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী। পুলিশ তাঁকে সেই সুযোগটুকুও দেয়নি।
৭০ বছর বয়সী পার্বতী দাস। কোকড়াঝড় ডিটেনশন ক্যাম্পে রয়েছেন ২ বছর ৮ মাস ধরে। তিনি তার বাবার সাথে নিজের সম্পর্ক প্রমাণ করতে পারেননি। তাকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ঘোষণা করে দেওয়া হয়। আসাম হাইকোর্টে তার বেলের জন্য আপিল করা হলেও কোনো লাভ হয়নি। ডিটেনশন ক্যাম্পে প্রবল অসুস্থতা নিয়েই দিন কাটাচ্ছেন। তার টোটো-চালক সন্তান এখন অবধি উকিল বাবদ খরচ করেছে ৭০,০০০ টাকা। গৌহাটি হাইকোর্ট ও ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল কোর্টে দৌড়াদৌড়ি করতে আরও প্রায় ১ লক্ষ টাকা তার যাতায়াত বাবদ খরচ হয়৷
লকডাউন চলাকালীন সবকিছুই বন্ধ ছিলো। শুধু বন্ধ ছিলো না ফরেণার্স ট্রাইব্যুনালের সাধারন মানুষের উদ্দেশ্যে বিদেশী নোটিশ পাঠানোর প্রক্রিয়া। যার ফাঁদে পড়লেন কাছাড় জেলার বড়খলা অঞ্চলের ভোলানাথপুর এলাকার ৮১ বছর বয়েসী মহিলা ভান্ডারি দাস। ভান্ডারি দাসের নাম ১৯৬৬ সলের ভোটার তালিকায় রয়েছে, তারপরও তাঁকে বিদেশী নোটিশ পাঠিয়ে আদালতে হাজিরা দিতে আদেশ করা হয় অতিমারির সময়েই।
গত ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ফরেণার্স ট্রাইব্যুনাল ১০২ বছরের ভারতীয় নাগরিক চন্দ্রধর দাসকে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার নোটিশ পাঠায়। তাঁকে বিদেশী আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেয়। শারীরিক অসুস্থতার জন্যে তিনি নির্ধারিত দিনে আদালতে পৌঁছাতে পারেননি। এরফলে একতরফা রায়ে তাঁকে বিদেশী ঘোষনা করে দেওয়া হয়। তিন মাস ডিটেনশন ক্যাম্পে কাটান তিনি। তারপর দুইবছর লাগাতার আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর নাগরিকত্ব প্রমাণ হয়নি। ততোদিনে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনও লাঘু হয়ে গেছে। চন্দ্রধর দাসের শেষ স্বপ্ন ছিলো ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ভারতের মাটিতেই মারা যাবেন। কিন্তু অবৈধ বিদেশী নাগরিক তকমা মাথায় নিয়ে ১০৪ বছর বয়েসে মারা যান তিনি।
কাটলিছড়া এলাকার কানু পাল ডি-ভোটার বা সন্দেহযুক্ত ভোটার তকমা মাথায় নিয়েই মারা যান গতবছর নবমীর সকালে। আট মাস ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে বাড়ি এসেছিলেন তিনি। কানু পাল তো তাও জামিনে ছাড়া পেয়ে বাড়ি আসতে পেরেছিলেন, ডিটেনশন ক্যাম্পে ‘অবৈধ নাগরিক’ ‘বিদেশী’ তকমা মাথায় বন্দি থেকেই মৃত্যু হয় দুলাল চন্দ্র পাল, ফালু দাসদের।
কাজলবালা দেব, ২০১৯ সালে শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্প (পড়ুন শিলচর সেন্ট্রাল জেল) থেকে মুক্তি পেয়েছেন৷ ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল তাকে বিদেশি ঘোষণা করে ক্যাম্পে পুরে দিয়েছিল৷ কাজলবালা’র ছেলে দিনমজুর বাপন দেব হাইকোর্টে আপিল করে তারপর অনেক দৌড়ঝাঁপ শেষে মা’কে কারাগার থেকে মুক্ত করে। কিন্তু ভারতে জন্মানোর পরও কেন তাকে বিদেশি বলা হচ্ছে, কেন ডিটেনশন ক্যাম্প নামের জেলে দিন কাটাতে হচ্ছে, ওই সব ভাবতে ভাবতে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন কাজলবালা! মুক্তির সময় জেল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয়, তাকে শিলচর মেডিক্যাল কলেজের মানসিক চিকিৎসা বিভাগে দেখানো হয়েছে৷ চিকিৎসা চলছে৷ তা যেন তারা অব্যাহত রাখেন৷ দিনমজুর বাপন তারপর থেকে মায়ের চিকিৎসা করিয়ে যাচ্ছেন। কাজলবালা ছেলেকেও চিনতে পারেন না এখন আর। অস্পষ্ট ঘোলাটে চোখে দিনরাত কী যেন খুঁজে চলেন। সম্ভবত নিজের দেশের সাকিন।
নির্বাচনের সময়েও সেই একই বিষয় ঘটে চলেছে। অমিত শাহ বলেছিলেন নির্বাচনের সময় এনআরসিছুটদের হয়রানি করা হবে না। তিনি আরোও বলেছিলেন, “এনআরসি প্রক্রিয়া চলাকালীনকোনো নাগরিককে ডি-ভোটার তকমা সেঁটে দেওয়া হবে না। কারুর হাতে নথি না থাকলে তার জন্যে কোনো ধরনের তথ্য দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়।” প্রধানমন্ত্রীও এবারে বরাক উপত্যকায় নির্বাচনী প্রচারে এসে বলে গেছেন সমস্ত বাঙালি হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে শিলচরে এসেও মোদি বলেছিলেন, ‘ক্ষমতায় এলে ডিটেনশন ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেবো’। কিন্তু সেসব আশ্বাসন যে ভোট উতরানোর কূটনীতি ছাড়া আর কিছুই নয় তার প্রমাণ এই নির্বাচনের সময়েই বাছা বাছা হিন্দু বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় ডি-ভোটার বা সন্দেহযুক্ত ভোটারের নোটিশ দেওয়া চলেছে। লাইটপোষ্ট বা দেওয়ালে টাঙিয়ে দিয়ে আসা হয়েছে বিদেশী নোটিশ। ওদালগুড়ি, বঙ্গাইগাঁও, বিজনি, কাছাড়, করিমগঞ্জ সর্বত্রই একই চিত্র। কাছাড় জেলার কালাইন এলাকায় শিলচরের চার নম্বর ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে তারাপুরের নুরু দাস এবং বিজয় দাসের নামে দুটি নোটিশ কালাইন গ্রাম পঞ্চায়েত কার্য্যালয়ের নোটিশ বোর্ডে লাগিয়ে দিয়ে যায় বর্ডার পুলিশ গত ১৭ই মার্চ। নোটিশে লেখা ছিলো আগামী ৩০ মার্চ ২০২১ তাদের ভারতবাসী হওয়ার সাক্ষ্যপ্রমাণের নথিপত্র সহ শিলচরের চার নম্বর বিদেশী শণাক্তকরণ আদালতে উপস্থিত থাকতে হবে। জিপি অফিস থেকে কালাইন তারাপুর এলাকায় খোঁজ কথা হলে জানা যায় নুরু দাস ও বিজয় দাস নামে ওই এলাকায় কেউ নেই। এলাকাবাসীরা বলছেন যেহেতু ওই দুই নামের ব্যক্তিদ্বয় এই অঞ্চলে নেই, সম্ভবত বর্ডার পুলিশ অন্য কোনো জায়গার মানুষের নামের নোটিশ এখানে লাগিয়ে গেছে। ঠিক এইভাবে কালাইন এলাকার কোনও মানুষের নামের বিদেশী নোটিশ অন্য কোনোও এলাকায় যে লাগানো হচ্ছে না তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। এভাবে নোটিশ না পেলে কেউ ই ঠিক সময়ে ট্রাইব্যুনালে যেতে পারবেন না। ফলত ট্রাইব্যুনালের একতরফা রায়ে তাদেরকে বিদেশী সাব্যস্ত করে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে।
এনআরসি আর ‘ডি ভোটার’ একে অন্যের পরিপূরক। দুইয়ের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে পড়ে আসামের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় জনসাধারণের মৃতপ্রায় অবস্থা। নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন হিন্দু বাঙালিদের দেওয়া একটি ভাওতা ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ বিষয় হলো মেইনস্ট্রিম মিডিয়া মোদী সরকার বা সর্বানন্দ সরকারের ‘আচ্ছে দিনে’র সুগন্ধে এতোটাই মশগুল যে তারা সাধারন হিন্দু বাঙালিদের এই কান্না দেখেও দেখতে পান না। এদিকে এই আসাম রাজ্যেই অসম সরকার এবং ভারত সরকারের যুগলবন্দিতে গোয়ালপাড়ার মাটিয়া অঞ্চলে প্রায় ২.৫ হেক্টর জুড়ে প্রায় তৈরি নতুন ডিটেনশন ক্যাম্প। ক্যাম্পটি তৈরী করতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪৬ কোটি টাকা। তিন হাজার মানুষের থাকার জন্য তৈরি হয়েছে এই আধুনিক নাৎসি ক্যাম্প। সেখানে থাকবে একটি প্রাথমিক স্কুল, একটি হসপিটাল, নবজাতক এবং মায়েদের জন্য একটি নার্সিং সেন্টার। ১৫টি চারতলা বিল্ডিং-এ বন্দিরা থাকবেন এবং তাতে ১৮০টি বাথরুম থাকবে। আর থাকবে একটি কমন রান্নাঘর। গোটা বন্দিশালাকে ঘিরে রেখেছে ২২ ফুট উচ্চতার কংক্রিট পাঁচিল। ভোটের পরই এই সুবিশাল আধুনিক নাৎসি ক্যাম্পের ‘শুভ উদ্বোধন’ করবে সরকার।
সিএএ বা নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন হিন্দু-মুসলমান কাউকেই সুরক্ষা দেওয়ার আনা হয়নি। এই আইন বিজেপির জুমলাবাজী ছাড়া আর কিছুই নয়। আসামে বিজেপি অসমীয়াদের বলছে তাদের সুরক্ষা দেবে, আসাম চুক্তির ছয় নং ধারা বাস্তাবায়িত করবে এবং তা করছেও। ওদিকে বাঙালি হিন্দুদের বলছে মুসলমানদের দেশ থেকে তাড়ানো হবে, হিন্দুদের কোনো ভয় নেই সিএএ দিয়ে তোমাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে হিন্দু বাঙালির কপালে সেই বিদেশী নোটিশ, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল এবং ডিটেনশন ক্যাম্প। এনআরসি আর ডি-ভোটারের কবলে পড়ে মুসলমানরা যত না ভুগছে তার থেকে তিনগুণ বেশি ভোগান্তি হচ্ছে হিন্দুদের ।
এইরকম এক সংকটের মূহূর্তে দেশের সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দুদেরই বুঝতে হবে খবরের কাগজ, টিভি নিউজ, হোয়াট্স অ্যাপ, ফেইসবুকের ফেক নিউজের ভিত্তিতে, চাটুকারীতার নিউজের ভিত্তিতে, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, রামমন্দির, হিন্দুরাষ্ট্র আর সেনাতে ভুলে যদি তারা ভাবেন “এবার মোদী সরকার এনে সোনার বাংলা” গড়বেন তবে তাদের সামনেও দেশহীনতার, বিদেশী তকমার নোটিশ অপেক্ষা করছে। কে শত্রু, কে বন্ধু, কোন দল কিসের স্বার্থে কাজ করছে সেটা বুঝতে না পারলে তাদের সমূহ বিপদ। তাদের বুঝতে হবে আর এস এস আর বিজেপির ভাওতা দেওয়া স্লোগান “হিন্দু খতরে মে হ্যা” নয় – তারা সত্যি বিপদে আছেন। সমস্ত রুজি রুটি নাগরিকত্ব হারিয়ে সত্যি সত্যি বিপদে আছেন তারা। যেখানে ভবিষৎ শুধুই ভুখা পেটে দেশহীন বেনাগরিকের মতো মৃত্যু।