সমকালীন ভাবনায় পরিবেশ সমাজ বিজ্ঞান

ডক্টর মানস কুমার পণ্ডিত– (অধ্যাপক ও গবেষক, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মোহনপুর, নদীয়া।)
বঙ্কিম দত্ত – (গণবিজ্ঞান আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক এবং পরিপ্রশ্ন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক।)
বিশেষজ্ঞ নয়, সাধারণ পাঠকের উপযোগী বিজ্ঞান লেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন খুব কম লেখকই। বিশেষত তা যদি আঞ্চলিক ভাষায় হয়। সেটা সম্ভবত এই কারণে যে এই জাতীয় লেখার পাঠক কম। বিজ্ঞান শুনলে পাঠকরা কিছু সমীকরণ আর লেখচিত্র ভাবেন, কিংবা ভাবেন একগাদা অচেনা শব্দের সমাহার, যার অর্থ দুর্ভেদ্য। বিজ্ঞান ভাবনার বীজ এদেশে সাহিত্যের মাটিতে সহজে শেকড় চালান করে দিতে পারে না। একটা পুরোনো সমাজে বহু প্রাচীন, কালের বিচারে অপ্রয়োজনীয় এমন
স্তরে-স্তরে জমা ভাবনাগুলো শক্ত হয়ে চিন্তার এই পাথুরে জমি তৈরি করে। সেখানে জল- হাওয়ায় উপস্থিতি নেহাতই কম। বিজ্ঞানের বীজ অঙ্কুরোদগমে এই জমি প্রধান বাধা।
এদেশের বিজ্ঞানীরাও পেশার অতিরিক্ত ভূমিকা নিয়ে বিজ্ঞান প্রসারে খুব কমই আগ্রহী। জগদীশ, প্রফুল্লচন্দ্র, সত্যেন্দ্রনাথ, মেঘনাদ ও এরকম আরো কয়েকজন স্মরণীয় ব্যতিক্রম। অন্যরা অলসতা ও অনাগ্রহের চূড়ান্ত নিদর্শন। ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে’।
কলম ধরতে হয় তাই বিজ্ঞান কর্মীদের, যাঁরা বিজ্ঞানকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে সংস্কৃতিরই একরূপ হিসেবে প্রসারিত করতে চান। বিজ্ঞানের সামাজিক বার্তাটাই তাই মুখ্য হয়ে যায় সেসব লেখায়। সেটা প্রয়োজনীয়ও বটে, বিশেষত এই সময়ে।
বিজ্ঞান এখন পণ্য উৎপাদনের সেবায় নিবেদিত প্রাণ। বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য কম। বরং স্পষ্টতই বিজ্ঞানী ছোট-বড় নানা প্রজেক্টের বেড়াজালে বন্দী এবং তাঁর শ্রমের উৎপাদ থেকে বিচ্ছিন্ন একজন ‘নলেজ ওয়ার্কার’। পণ্য উৎপাদন সর্বস্বতায় আক্রান্ত আজকের বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের গতিমুখ প্রকৃতি বিমুখ, বিধ্বংসী তার প্রয়োগ।
এই বইয়ের দুই মলাটের মধ্যেকার লেখাগুলির মধ্য দিয়ে লেখক প্রকৃতি বিধ্বংসী এই প্রয়োগের সঙ্গে আমাদের পরিচিত করিয়ে দেন– শুধু আনুভূমিক বিস্তারের চরাচরে নয়, আমরা প্রত্যক্ষ করি প্রকৃতি হননের গভীর গোপন আর্থ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। প্রবন্ধগুলি কলেবরে ছোট হলেও ধারণ করে থাকে বিজ্ঞান সমাজ ও পরিবেশের আন্তঃসম্পর্কের বিস্তৃত আখ্যান। শুধু আখ্যানই বা বলি কেন, বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে তা আবার হয়ে ওঠে বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগজনিত, প্রকৃতি বিনাশের বিরুদ্ধে, প্রকৃতি ও পুঁজির দ্বন্দ্বের তত্বায়নের আভাসপত্র।
যে আন্দোলন বিজ্ঞানকে সমাজমুখী এবং সমাজকে বিজ্ঞানমুখী করতে চায়, গণবিজ্ঞান বা জনবিজ্ঞান আন্দোলন নামে তার পরিচিতি। এই বইয়ের উপপাদ্যগুলি গণবিজ্ঞান আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে ওঠার সম্ভাবনা যথেষ্ট। এবং তা জনপ্রিয় উপস্থাপনার আঙ্গিকেই যে সম্ভব, লেখকের মুন্সিয়ানায় বইটি তারই একটি নিদর্শন হয়ে রইল।

পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তিত। উন্নয়নের নামে এক ভয়ঙ্কর ভোগবাদী সমাজ গড়ে তোলার প্রতিযোগিতা চলছে– গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে জেলা- রাজ্য-দেশ-বিশ্ব জুড়ে। মানুষকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে একা করে ভেঙে দেওয়ার খেলা চলছে। এই খেলা এখন ঘটমান বর্তমান। উন্নয়ন গৃহহীন হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। মুখ আর মুখোশ উভয়ই ঢেকে যাচ্ছে ছদ্ম ও সর্বনাশা উন্নয়নের বিজ্ঞাপনে।
মানুষ বিজ্ঞানকে অবলম্বন করেই এতদূর এসেছে। অথচ এখন বিজ্ঞান– পুঁজিবাদ, লোভের রাজনীতি, জাতপাত, ধর্মীয় মেরুকরণের করাল ছায়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। উষ্ণায়ন, কোভিড-১৯, জলবায়ু-উদ্বাস্তু সমস্যা, কৃষির ক্রম অধোগতি ও কৃষি বাস্তুতন্ত্রের সামগ্রিক সংকট, হিমালয়ের ভঙ্গুর পরিবেশ ও জনজীবনে বাস্তবোচিত মূল্যায়ন হয়ে উঠেছে এই বইটি। কৃষি বিল ও কৃষকদের অদম্য লড়াই এক মূল্যবান সম্পদ এই বইটির। তথ্য সহযোগে এই সমস্ত সময়োপযোগী বিষয়গুলির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ নিশ্চিতভাবেই পাঠকের ভাবনার খোরাক যোগাবে বলে আমাদের দৃঢ় ধারণা।
আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অগাধ বিশ্বাসে অপেক্ষা করে আছে যে, আমরা তাদের জন্য রেখে যাব এক বাসযোগ্য পৃথিবী। আজ সে বিশ্বাস টলে গেছে। তাই বিশ্বজুড়ে কচিকাঁচারা রাস্তায় নেমেছে। তাদের প্রশ্নবান বিঁধে চলেছে বিশ্ব নেতৃত্বকে। এই লড়াইতে আমরা বড়রাও আসুন সামিল হই। যে যেখানে আছি, সেই অবস্থান থেকেই আওয়াজ তুলতে হবে এখনই। উন্নয়নের নামে পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনা চলবে না। উন্নয়নের বাঘ ক্রমশঃ সভ্যতা ও বিশ্ব পরিবেশের খাদকের ভূমিকায় দানবীয় আস্ফালন করছে সর্বত্র। অযোগ্য রাজনীতিক ও নেতৃত্বের হাতে আমাদের, আমজনতার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত নয় একেবারেই। মনে রাখতে হবে, এই মহাবিশ্বে আমাদের একটিই বাসযোগ্য ঘর আছে, যা হলো আমাদের অতি প্রিয়– এই নীল গ্রহটি।
এই বইয়ের লেখক বিজ্ঞানের শিক্ষক এবং বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। বর্তমান বিপর্যস্ত প্রকৃতি পরিবেশ নিয়ে তিনি অত্যন্ত বিচলিত। সংবেদনশীল মন আর ‘কিছু একটা করা উচিত’ এই মননের ফসল বর্তমান বইটি। উদার বিজ্ঞান মনস্কতার বলীয়ান রৌদ্রে সমাজের অন্ধকার মুক্তির দিশা এই বইটিতে দেখতে পাচ্ছি। বইটির সমাদর হবে এই আশা রাখি।
“সমকালীন ভাবনায় পরিবেশ সমাজ বিজ্ঞান” বইয়ের ১৫৫ ও ১৫৬ পৃষ্ঠাতে লেখক লিখছেন:
নয়া উদার অর্থনীতির সুযোগ নিয়ে পুঁজির আধিপত্য সারা বিশ্ব সহ এশিয়ার আকাশ বাতাস কার্বন-ডাই-অক্সাইডের চাদরে ঢেকে দিল, বাতাসে কার্বন নিঃসরণের পরিমান বেড়ে গিয়ে দাঁড়াল ২৫ বিলয়ন মেট্রিক টনে। অন্যদিকে উৎপাদনের জন্য প্রকৃতির অর্থাৎ কাঁচামালের ব্যবহার বেড়ে গেল। এখন শুধুমাত্র প্রয়োজনের জন্য ভোগ নয়, পুঁজির বিকাশের জন্য ভোগ। মধ্যবিত্ত সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা হলো পন্যসর্বস্ব ভোগবাদের জগতে। যতবেশি নিঃশেষণ, ততবেশি প্রকৃতির শোষণ। বেড়ে গেল প্রকৃতির বিপাকীয় ফাটল। পরিবেশ দূষণ, ভুউষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তন রাষ্ট্রীয় সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসাবে পরিগনিত হলো। বঙ্গোপসাগরের জলের উষ্ণতা ২৬.৫°C অতিক্রম করার ফলে ঘন ঘন নিম্নচাপ এবং ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, টাইফুন হচ্ছে বছরভর। যত দিন অতিবাহিত হচ্ছে ঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতাও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ২০২১-২২ সালের শীতকালেও নিম্নচাপের কারণে শীত আসতে দেরি হয়েছে, নেমে এসেছে অসময়ের অতিবৃষ্টি, যার হাত ধরে চাষবাসের ব্যাপক ক্ষতি ও চাষীদের সর্বস্বান্ত হওয়া আমাদের নাড়িয়ে দিয়ে গেল। কোথাও মেঘভাঙ্গা বৃষ্টি-প্লাবন, কোথাও তীব্র দহন ও একের পর এক দাবানল। যে আরবসাগরে ঘূর্ণিঝড় কদাচিৎ দেখা দিত সেখানে বছরের দু-তিনটি নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড় এখন পরিলক্ষিত হচ্ছে। কম সময়ে অত্যধিক বৃষ্টিপাতের কারণে বারবার প্লাবিত হচ্ছে কলকাতা, মুম্বাই, চেন্নাই ও দিল্লির মতো মেট্রো শহরগুলি। হিমালয়ের পাহাড় চূড়ায় বরফ গলছে, মেঘভাঙ্গা বৃষ্টিতে পাহাড়ি গ্রামগুলি ধ্বংস হচ্ছে। সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা ও উষ্ণতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। সুজলা সুফলা ভারতবর্ষ আজ প্রকৃতির প্রতিশোধে ক্ষতবিক্ষত। এক কথায়, মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের পাহাড়প্রমান মুনাফা তৈরি ও পুঁজিকে আরো বেগবান করার কারণেই ষষ্ঠ গনবিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে মানবসভ্যতা। তাই আন্তর্জাতিক স্তরেই লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী, কিশোর-কিশোরী, বিজ্ঞান ও পরিবেশ কর্মীরা বিগত কয়েক বছর ধরে রাজপথ কাঁপিয়ে আওয়াজ তুলছেন–”We don’t need Climate change, we need System change”. সমুদ্রের জলস্ফীতির সাথে সাথে এই জনজোয়ারও বেড়ে চলেছে। যার ঢেউ ইউরোপ, আমেরিকা ছাড়িয়ে আছড়ে পড়ছে স্ক্যান্ডিভনিয়া, লাটভিয়া সহ এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। গ্রেটা থুনবার্গ, ভানিশা নাকিতে, বিনিশা উমাশঙ্কর, দিশা রবিদের হাত ধরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমাদের মতো প্রাজ্ঞ বড়দের কাছে বারবার কাতর আর্জি জানাচ্ছে–” শুধু টাকা রোজগার ও ভোগবাদের পিছনে অন্ধভাবে ছুটে এ কী পৃথিবী রেখে যাচ্ছ আমাদের জন্য? আমরা চাই দূষণহীন-নির্মল-সুনীল আকাশ, আমরা চাই বিশুদ্ধ পানীয় জল, বুকভরা শ্বাস নিয়ে আমরা বাঁচতে চাই এই নীল গ্রহে। তোমরা আমাদের হাতটা ধর”। তাই আজ সময়ের দাবি– প্রকৃতির পুনরুদ্ধার ও পুনরুৎপাদনের দাবিকে সজোরে সামনে আনা। এই কাজে হাত লাগাতে হবে সমাজ সচেতন প্রতিটি মানুষ, বিজ্ঞান-পরিবেশ-মানবাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি কর্মীকে। সামনে এগিয়ে আসতে হবে কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদেরও। পরিবেশ বাঁচানোর লড়াইয়ে সকলকে দরকার খুব বেশি করে। আগামী প্রজন্ম সহ তামাম মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে এটাই হওয়া উচিত প্রথম ও প্রধান কর্তব্য-দায়িত্ব।
এই বার্তা ছড়িয়ে পড়ুক ক্ষেতে খামারে, গ্রাম থেকে গ্রামাঞ্চলে, পাড়া থেকে মহল্লায়, শহর থেকে বিশ্ব দরবারে। সব আন্দোলনের অগ্রভাগে উঠে আসুক প্রকৃতি মেরামতির দাবি। পরিবেশ রক্ষার প্রতিটি লড়াই আছড়ে পড়ুক আন্তর্জাতিক আঙিনায়।
সময়ের এই মূল্যবান বইটি সংগ্রহ করে পড়ুন, অন্যদের পড়ান। লেখাগুলোর বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা ও মত বিনিময়ের এক মুক্ত পরিসর তৈরি হোক। আসুন সকলে মিলে প্রকৃতি পরিবেশের লড়াইয়ে সামিল হই। তাহলেই সমকালীন ভাবনার পথ চলা সার্থক হবে।
বই : সমকালীন ভাবনায় পরিবেশ ও সমাজ , লেখক : সন্তোষ সেন ,প্রকাশক : ভুবনডাঙা প্রকাশনা।
বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিষয়ক ২০ টি প্রবন্ধ সংকলনের ১৬৮ পৃষ্ঠার বইটির
বিনিময় মূল্য: ১০০ টাকা।