• June 1, 2023

বাজার, মৎস ও একটি পরিবার

 বাজার, মৎস ও একটি পরিবার

হাসান আজারকাত

জলাশয় ঘেরা একটি কাল্পনিক গ্রাম। জলাশয় ভর্তি মাছ। সেই গ্রামে যদি নিয়ম করে দেয়া হয় গ্রামের যে কেউ, যে কোনো পরিবার মাছ ধরে খেতে পারবে কিন্তু বিক্রি নিষিদ্ধ তাহলে দেখা যাবে সেই গ্রামের বাসিন্দারা ঠিক যতটুকুতে তাদের প্রয়োজন মিটছে/উদরপূর্তি হচ্ছে ততটুকুই জলাশয়গুলো থেকে মাছ তুলছে। বাড়তি মাছ তোলার কথা তারা চিন্তাই করছে না কারণ তাতে তাদের কোনো বাড়তি উপযোগিতা নাই। এখন একই ধরণের অন্য একটি গ্রামে আসি যেখানেও প্রয়োজন অনুযায়ী মাছ তুলতে বাঁধা নেই কিন্তু বিক্রি নিষিদ্ধ। তবে এই গ্রামটি অন্য একটি গ্রাম দ্বারা শোষিত। শাসক গ্রামের মোড়লরা এসব নিয়ম বেঁধে দিয়ে তারাই এখান থেকে মাছ তুলে নিজেদের গ্রামে বিক্রি করছে। এই গ্রাম থেকে একটি পরিবার তাদের আত্মীয় ও আশপাশের প্রতিবেশী মিলে মাছ বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়ার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগলো, গ্রামের অন্যান্য মানুষকে চটদারি কায়দায় বুঝাতে থাকলো এগুলা বিক্রি করলে লাভের নানা দিক। তারা মাছ বিক্রির স্বাধীনতা চায়। এই স্বাধীনতার সংগ্রাম করতে হবে। সেগুলো বুঝিয়ে গ্রামের অন্যান্য বাসিন্দাদের মাছ বিক্রির স্বাধীনতায় নামিয়ে দিয়ে নিজেরা নিরাপদে দূরত্বে থাকলো। মাছ বিক্রির স্বাধীনতা অর্জন করার পর সেই পরিবার, পরিবারটির আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা নিরাপদ জোন থেকে ফেরত এসেই প্রথমে যে ব্যাপারটি ঘটালো তা হলো প্রতিযোগীতা। প্রথম প্রতিযোগীতাটি শুরু হলো মালিকানার প্রশ্নে। গ্রামের জলাশয়ের অধিকাংশ সীমানা জোর খাটিয়ে দখলে নিয়ে নিলো স্বাধীনতা এনে দেয়ার দাবী করে এই গ্রামের মোড়ল সাজা পরিবারটি। বাদবাকী যেটুকু জলাশয় সেগুলা ছেড়ে দিল বাকীদের জন্য। অন্যরা তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। যেহেতু এখন মাছ বিক্রির স্বাধীনতা এসেছে, মাছ এখন থেকে মার্কেটে যাবে সেহেতু যতবেশি জলাশয়, ততবেশি মাছ উত্তোলন, ততবেশি লাভ। ফলে বাকীটুকু জলাশয়ের মালিকানাটা পেতেও অন্যদের ক্ষমতা প্রদর্শন বাদে অন্যকোনো রাস্তা নাই। এবং এই ক্ষমতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও যে ক্ষমতাটি প্রদর্শন করা হচ্ছে সেটি সেই পরিবারেরই। ফলে যারা পরিবারটির সাথে ঘেঁষছে তারা কিছুটা হলেও জলাশয়ের মালিকানার প্রশ্নে সকল অপরাধ থেকে দায়মুক্ত হচ্ছে ও ছাড় পাচ্ছে। এরপরের প্রতিযোগিতা হলো বাজারজাতকরণ বা মার্কেটিং প্রক্রিয়ায়। এই প্রতিযোগিতা নানামুখি। যে পরিবারের মালিকানায় সর্বাধিক জলাশয় ও মাছ আছে তারা অন্যদের তুলনায় কম দামে বাজারে মাছ ছাড়া শুরু করলো। যেহেতু তারা মাছ বিক্রির স্বাধীনতা এনে দিয়েছে দাবী করছে সেহেতু ভোক্তাদের বুঝালো তারা ভোক্তাদের কথা ভেবেই বাজারে সবচেয়ে কম দামে মাছ ছাড়ছে। ভোক্তাও খুশি। যাদের হাতে রিসোর্স কম ও পরিবারটির সাথে সুসম্পর্ক নাই তারা লাভ করতে চাইলে স্বাভাবিকভাবেই কম দামে মাছ বাজারে বিক্রি করতে পারবে না৷ দাম কম না হওয়ায় ভোক্তা সে মাছ কিনবে না। স্বাধীনতা এনে দেয়া বয়ান শোনানো পরিবারটির অবৈধ উপায়ে অর্জিত রিসোর্স বেশি থাকায় গ্রামের অন্যান্য বাসিন্দারা পরিবারটির সাথে বাজারে টিকে থাকতে পারলো না। ফলে যে রিসোর্সের (জলাশয় ও মাছ) এডভান্টেজ খাটিয়ে দাম কমিয়ে অন্যান্য প্রতিযোগীদের বাজার থেকে ছিটকে ফেলে দিতে পারে, সেই মূলত পুরা বাজার একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। পরিবারটিও তাই শুরু করলো। মার্কেট/বাজারে আর কোনো প্রতিযোগী থাকলো না। ফলে সে কয়েকগুণ চড়া দামে মাছ বিক্রি শুরু করলো যা অধিকাংশ ভোক্তার সাধ্যের বাইরে কারণ সে যে দামেই মাছ বিক্রি করুক না কেন ভোক্তা কিনতে বাধ্য। প্রায় সবধরণের নিত্যপ্রয়োজনীয় মাছের ক্ষেত্রে মার্কেট মনোপলি বা একচেটিয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করলো পরিবারটি। কিন্তু এভাবে বেশিদিন একচেটিয়া ব্যবসা করলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হতে পারে। সেটা ভেবে সেই পরিবার তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করে যারা বাদবাকী জলাশয়গুলো দখল করেছিল এবং যারা নতুন করে সুবিধাভোগের জন্য পরিবারটির ছায়াতলে আসতে চায় তাদের সাথে মিলে মাছের সেগমেন্টেশন করে দিলো যে কে কোন পদের মাছ বাজারে কোন জায়গাটায় সর্বোচ্চ কত লাভে বেঁচবে সিন্ডিকেট করে। শর্ত হলো, যে মাছের দাম বাড়বে সে মাছের দাম কমানো যাবে না। বহু কষ্টে মাছ বিক্রির স্বাধীনতা তারা গ্রামবাসীকে দিয়েছে। কার এত সাহস! বিরুদ্ধাচারণ করবে? সিন্ডিকেট করার ফলে ভোক্তা ব্যতীত সকলেই টুপাইস পাবে এবং ভোক্তা বিদ্রোহ করে বসলেও বাকীরা মিলে ভোক্তাকে থামিয়ে দিবে। এভাবেই পরিবারটি পুরো গ্রামেই একচেটিয়া সিন্ডিকেট রাজত্ব কায়েম করতে থাকলো। ভোক্তারাও তাদের সাধ্যের মধ্যে মাছ খেতে না পেয়ে ক্ষুধার জ্বালায় একে একে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে যেতে থাকলো।

এটি একটি কাল্পনিক ছোটগল্প। বাস্তবের সাথে কেউ কোনো মিল খুঁজে পেলে লেখকের কোনো দায় নাই।

হাসান আজারকাত কলামিস্ট ও রাজনৈতিক কর্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published.