ফিরে দেখা আফগানিস্তান, পর্ব-৩

সংগ্রাম চক্রবর্তী
তালিবান কে বুঝতে আমাদের দুটো বিষয় কে অবশ্যই আলোচনায় আনতে হবে- প্রথমত পাখতুন জাতীয়তাবাদ ও ডুরান্ড লাইন, দ্বিতীয়ত ক্যাসপিয়ান গ্যাস বেসিন।
আফগান জাতীয়তাবাদের মুল চালিকা শক্তিই হল পাখতুন জাতীয়তাবাদ(জনসংখ্যার ৪০%). উত্তরে সিন্ধু ও দক্ষিণে আমুর দরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত পাখতুন ভূমি বা পাখতুনখোয়া, এর এক প্রান্ত পাঞ্জাব ও অপর প্রান্তটি বর্তমান উজবেকিস্তানের ফরগানা উপত্যকা, বাবর বাদশাহের জন্মস্থান।পাখতুন জাতীয়তাবাদের জনক হলেন ষোড়শ শতকের পীর বায়োজিদ রৌশন এবং সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত কবি ও যোদ্ধা খুশল খান আটক। ষোড়শ শতকে এসে পাখতুনখোয়া তৎকালীন দুই শক্তিশালী সাম্রাজ্যের ভেতর ভাগ হয়ে যায়-পুবে সাফানীদ ও পশ্চিমে মোঘল সাম্রাজ্য এবং পাখতুন জাতীয়তাবাদের ইতিহাস এই দুই সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেই অন্তহীন যুদ্ধের ইতিহাস।
ধর্ম এই জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক শর্ত নয়, বরং উপজাতীয় প্রাচীন রীতিনীতি কোড বা “পাখতুনওয়ালী” হল এই জাতীয়তাবাদের চালিকাশক্তি। ধর্মই যদি অনুপ্রেরণা হত তাহলে শিয়া ইসলামী সাফানীদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হত না যেখানে ১৭০৯ সালে কান্দাহার কে কেন্দ্র করে দক্ষিণ আফগানিস্তানে প্রথম স্বাধীন সরকার গড়ে ওঠে. আবার এই রাজধানী ১৭৩৮ মোঘল সেনা দ্বারা ধ্বংস ও লুন্ঠিতও হত না, গোড়া সুন্নীমতালম্বী ঔরঙ্গজেবের কারাগারে খুশল খান কে আটকে থাকতে হত না, এমন কি ১৭৪৭ সালে আমমেদ শাহ দুরানীর হাতে কাবুল কেন্দ্রীক যে আফগান রাস্ট্রের স্থাপন হয় ধর্ম তার অনুপ্রেরণা ছিল না। শতাধিক বছর পরেও আফগান জাতীয়তাবাদের অন্য দুই আইকন হবিবুল্লা (১৯০১-১৯১৯) ও তার পুত্র আমানুল্লা খানের (১৯১৯-১৯২৯) আর যাই হোক ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ছিল না, বরং আমানুল্লা খান কে সিংহাসনচ্যুত হতে হয় গোড়া মোল্লাদের দ্বারা যার বর্ণনা আপনারা পাবেন সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশেবিদেশে। ১৯৪৭ সালে এসে একমাত্র রাস্ট্র আফগানিস্তান যে রাষ্ট্র সংঘের পাক-ই-স্থানের অন্তর্ভুক্তির বিরোধীতা করে।সর্দার দাউদ খানের সময় অবস্থা এমন পৌছায় যে পাকিস্থান ও আফগানিস্তান যুদ্ধের উপক্রম হয়। ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠা একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বেরই বিরোধীতা করছে আরেক টি মুসলিম রাষ্ট্র একমাত্র কারণ ডুরান্ড লাইন।১৯৪৭ যে খন্ডিত স্বাধীনতায় দুই নতুন রাষ্ট্র তা আসলে অ্যাংলো স্যাক্সন সাম্রাজ্যবাদেরই উত্তরাধীকার ও অনুসরনকারী এটা বুঝতে কাবুলের কোন অসুবিধা হয়নি। কারণ আর যাই হোক হবিবুল্লার হাতে একটি স্বাধীন জাতীয় বুর্জোয়া বুরোক্র্যাট শ্রেণীর নির্মাণ হয়েছিল আফগানিস্তানে।১৯১৯ সালে তৃতীয় আফগান যুদ্ধে যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রটেক্টরেট থেকে সার্বভৌমত্ব লাভ করে কাবুল,এই জাতীয়তাবাদী চেতনা কে আরো পুষ্ট করে, ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশন ভারতে এলে কাবুল সরকার তার প্রতিবাদ পত্র পাঠিয়ে বারবার সতর্ক করে যে ভারতের স্বাধীনতার বিষয়ে সিধান্ত নেওয়ার আগে যেন আফগানিস্তান তথা পাখতুনখোয়ার বিষয়টি অগ্রাধীকার দেওয়া হয়।কিন্তু ডুরান্ড লাইন কেই নব গঠিত পাকিস্থানের পশ্চিম বর্ডার হিসাবে স্বীকৃত দেওয়া হয়, পাক আফগানের মাঝে কালাতের স্বাধীন রাজ্যে পাক আর্মি অনুপ্রবেশ করে দখল নেয় কাশ্মীর ও জুনাগড়ের অজুহাত দিয়ে।
ডুরান্ড লাইন,ম্যাকমোহন লাইনের মতই উপনিবেশিকতার উত্তরাধীকার ও গোটা ভারতীয় মহাদেশের জাতীয় চেতনার উপর এক কালো দাগ। ঠিক যেমন আমাদের বাংলা কে ভাগ করা হয়েছিল ৪৭ ঠিকই একইভাবে পাখতুনদের ভূমি কেই ১৮৯৩ সালে দুইভাগে ভাগ করা হয়। আসলে ভাগ করো শাসন করো যে নীতি আজ মোদী নিয়ে চলেছে হিন্দু মুসলমানের নামে তা আসলে ব্রিটিশ উপনিবেশিকতার উত্তরাধীকার, যে কোন ধর্ম বা ভাষা বা বর্ণ নামে আর এই উপাদান যেখানে নেই সেখানে প্রয়োজনে যুদ্ধ করে এই সীমানা নির্মাণ করা হবে– এটাই সাম্রাজ্যবাদী কৌশল.
১৭৪৭ সালে যে স্বাধীন আফগান রাষ্ট্র গড়ে ওঠে তার পূর্ব সীমান্ত পাঞ্জাবে,পশ্চিমে আমুর, উত্তরে কাশ্মীর ও দক্ষিণে বেলুচিস্থান।প্রথমে রঞ্জিৎ সিং শিখেদের কাছে তারা পেশোয়ার অঞ্চল ও কাশ্মীর হারায়, শিখেরা ব্রিটিশের কাছে পরাজিত হয়ে সেই অঞ্চলে ব্রিটিশ কে হস্তান্তরিত করে ক্ষতিপূরণ স্বরুপ, কিন্তু দ্বিতীয় ইংগো-আফগান যুদ্ধে আফগানিস্তান শোচনীয় ভাবে পরাস্ত হয়ে ১৮৭৯ সন্ধিতে কোয়েটা, কোহট,শিবি,পিশিন ব্রিটিশ কে ছাড়তে বাধ্য হয়। ১৯ শতকে ব্রিটিশ ও রাশিয়ান সাম্রাজের গ্রেট গেমের মাঝে পড়ে তার ভূমি আবার বিভক্ত হয় ১৮৯৩ মর্টিম ডুরান্ডের হাতে।এই ডুরান্ড লাইন পাখতুনখোয়া কে বিভক্ত করে আমাদের বাংলা ভাগের মতই। ওয়াজিরিস্তান,নর্থওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রদেশ বা খাইবারস্তান,চিত্রল, সোয়াট কে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ভেতর নিয়ে আসে,অর্থাৎ আজ কে পাকিস্তানের এক বড় অংশ আসলে স্বাধীন আফগানভূমির অংশ যা জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া, যাকে পাখতুনরা কোনদিনই মেনে নেয়নি, ওয়াজিরিস্তান ও খাইবারে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জারী থাকে গোটা ব্রিটিশ শাসনকাল জুড়ে, এমন কি পাকিস্তান গঠনের পরেও অব্যহত গতিতে।কিন্তু এই লাইন আরো মারাত্মক যেটা করে উত্তর বালুচিস্তান কে ব্রিটিশ সাম্রাজের ভেতর নিয়ে এসে ভবিষৎ আফগানিস্তান কে আরব সাগর থেকে বঞ্চিত করে, ৪৬ সালের কাবুলের অন্যতম দাবীই ছিল উত্তর বালুচিস্তান কে ফিরিয়ে দিয়ে আফগানিস্তানের জন্যে আরব সাগরে পৌছানোর জন্যে ব্যবস্থা করা।পাক -আফগান বিরোধের মুল কারণ টাই এটা।পাকিস্থান কখনই চায়নি যে আফগানিস্তানে এক শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী সরকার গড়ে উঠুক, বরং যখনই কাবুলে কোন স্বাধীন সরকার গড়ে উঠেছে সে যে ফর্মেই হোক পাকিস্থান অন্তর্ঘাতের চেস্টা করেছে, কারণ খাইবারতুয়া ও বালুচিস্তানের এক বড় অংশ তাকে দিয়ে দিতে হবে।শুধু পাঞ্জাব আর সিন্ধ নিয়ে পাকিস্থানের তাহলে আর কোন অস্তিত্বই থাকবে না, অন্যদিকে ভারতের অন্যতম কৌশলই হল অখণ্ড পাখতুনিস্তানের দাবী কে হাওয়া দিয়ে শত্রুর পিছনে আরেকটা ফ্রন্ট খোলা, স্বাধীন বালুচিস্তানের দাবী কে সমর্থন দিয়ে পাকিস্তান কে চাপে রাখা, পাখতুনখোয়ার পাক অংশে হিংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত তেহরীক-ই- তালিবান কে অনেকে “র” এর কাজ বলে দাবী করে।
কিন্তু এই অবস্থা টার পুরো পরিবর্তন হয়ে যায় ১৯৭৯ সালে এসে যখন সোভিয়েত সেনা আমুর দরিয়া পেরোয়।নুর মহম্মদ তারাকীর আফগান সমাজ ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লীব পরিবর্তন দেখে পাকিস্থান শংকিত হয় যে অচিরেই সেই পুরোনো দাবী তুলবে কাবুল এবং আরব সাগর তথা ভারত মহাসাগরে পৌছাতে মস্কো এই সরকার কে ব্যবহার করে বালুচিস্তান কে দখল নেবে/মুক্ত করবে. তৎকালীন পাক বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী শ্রেণীর মধ্যে বালুচ ও পাঠানরা ছিল মস্কোপন্থী এবং সিন্ধ ও পাঞ্জাবী নেতৃবৃন্দ মুলত পিকিং পন্থী।১৯৭৯ সালে সোভিয়েত অনুপ্রবেশ আফগানিস্তানের উপজাতীয় সম্পর্কগুলোর মাঝে আমূল-পরিবর্তন ঘটায়, সি.আই.এ , এম.৬ পাঠানো অর্থ ও অস্ত্রের স্রোত ডুরান্ড লাইন কে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, ইরানের আভ্যন্তরীন রাজনীতির টালমাটাল পরিস্থিতির কারণে পাকিস্থানই হয়ে ওঠে পাঠান জাতীয়তাবাদের একমাত্র ঠিকানা, একদা শত্রু হয়ে ওঠে পরম মিত্র ও আশ্রয়দাতা।অর্থ ও অস্ত্রের স্রোতের পাশাপাশি আরেকটি দর্শনও আমদানী হয় এই অঞ্চলে ওয়াহাবীইজম।আফগান শরণার্থী শিবিরের শিশুদের লেখাপড়ার জন্যে সৌদি অর্থায়নে যে মাদ্রাসাগুলো গড়ে ওঠে তা হয়ে দাড়ায় ওয়াহাবীইজমের আখড়া, এই যে নতুন একটা ধারা যুক্ত হল তা কিন্তু প্রচলিত পাখতুন জাতীয়তাবাদী ধারার থেকে আলাদা।এরাই আজকের তালিবানের পিতৃপুরুষ। কিন্তু তালিবান শব্দ টি তখনও আসে নি তালিবান গঠিত হয় ১৯৯৪ সালে কান্দাহারে।ফার্সী এই শব্দ টির অর্থ হল শিক্ষার্থী।মনে করে দেখুন এই সেই কান্দাহার যেখানে ১৭০৯ সালে পাখতুন জাতীয়তাবাদীরা সাফানীদদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীন সরকার গঠন করে।কিন্তু কেন তালিবান এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে ক্যাসপিয়ান গ্যাস বেসিনে।আবার এখানেই আছে আজকের চীন তালিবান সম্পর্কের রসায়ন।
সংগ্রাম চক্রবর্তী ঃ পেশায় কৃষক। কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে কৃষিকাজ করেন।