জিওরদানো ব্রুনো—সত্যনিষ্ঠার এক অনির্বাণ মশাল

অশোক মুখোপাধ্যায়
জিওরদানো ব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০) মানব ইতিহাসের এক বিস্ময়কর চরিত্র। সময়ের নিরিখে, সংগ্রামের নিরিখে, চিন্তা ঘোষণার নিরিখে, নিশান এবং নিশানার নিরিখে এমন আর একটি মানুষকে খুঁজে পাওয়া বড়ই কঠিন। শুধু ইতালির ইতিহাসে নয়, শুধু ইউরোপের ইতিহাসেও নয়, সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসেই তাঁর সমতুল্য আর একজনও মানুষকে আমরা দেখতে পাই না, যিনি সত্যের জন্য বিজ্ঞানের একটা তত্ত্বের সপক্ষে এবং সর্বোপরি বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের স্বার্থে এত নির্ভীকভাবে সংগ্রাম করে গেছেন, মিথ্যা এবং ইতিহাসের ফসিল-তুল্য শক্তির হাতে এত নৃশংসভাবে প্রাণ দিতে বাধ্য হয়েছেন। একদিকে, ইতালির প্রগতিশীল জনসাধারণের কাছে, এবং সারা পৃথিবীর যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষদের কাছে তিনি বিজ্ঞান-শহিদ-এর মর্যাদা পেয়েছেন। আবার অন্যদিকে, কূটতার্কিক বিচারপতিদের অণুবীক্ষণ-দূরবীক্ষণের তলায় ফেলে করা নিখুঁত মূল্যায়নে তিনি বাচাল, তর্কচঞ্চু, ধর্মবিরোধী, ঈশ্বরবিদ্বেষী, পোপ-নিন্দুক, গির্জাবিধ্বংসক, কালাযাদু-প্রচারক, ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত হয়ে অসম্মানের পাদটীকায় নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। আমি আমার সীমিত সাধ্য নিয়ে এই প্রবন্ধে চেষ্টা করব, তাঁর একটা বাস্তবসম্মত পরিচয় তুলে ধরতে, ইতিহাসের কাছে তাঁর গুরুত্ব কোথায়, স্থান কোথায়, আমাদের মতো বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির শিবিরের কাছেই বা তিনি কেন এত শ্রদ্ধার্হ¾সে সম্পর্কে একটা যথোপযুক্ত বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন উপস্থাপন করতে।

কাজটা কঠিন।
পুরনো ইতিহাসের বহু তথ্যই এখন আর তর্কাতীতভাবে সংগ্রহ ও প্রতিষ্ঠা করা সহজ নয়। যাঁরা ব্রুনোর পক্ষে বলেছেন, তাঁদের কথা না হয় বাদই দিলাম। যাঁরা তাঁর বিরূপ-মূল্যায়ন করেছেন, তাঁদের সকলেই যে একেবারে রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টীয় গির্জার ধামাধরা দালাল গোছের লোক তা কিন্তু নয়। অনেকেই তাঁরা চার্চের বিজ্ঞান বিরোধী ভূমিকার কঠোর সমালোচক। স্বাধীন বিজ্ঞান চর্চার পক্ষেই তাঁরা। যেমন, বাংলায় প্রথম বিজ্ঞানের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখক সমরেন্দ্র নাথ সেন। তিনি যথা সম্ভব তথ্যনিষ্ঠভাবেই লিখেছেন, কোপারনিকাস বা গ্যালিলেওর কাজ গভীর আবেগের সাথে বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। সেই তিনিও কিন্তু ব্রুনোকে পছন্দ করেননি। ব্রুনোর কথা ও সমালোচনা একটি মাত্র বাক্যে সাঙ্গ করে ফেলেছেন। [সেন ১৯৯৪, ২য়, ৩০৬] এই সব তথ্য সামনে রেখেই আমাদের খুব সাবধানে এগোতে হবে।
ব্রুনো বিজ্ঞানী নন, পরিপূর্ণ অর্থে দার্শনিকও নন। তিনি বিজ্ঞানের একজন লোকপ্রিয় প্রচারক হিসাবে আসলে সেই সময়ের ইতিহাসে একটি জরুরি হাইফেন-ভূমিকা পালন করে গেছেন। কোপারনিকাস আর গ্যালিলেওর মাঝখানে এক হাইফেন; আবার, গ্যালিলেও-কেপলারের মাঝখানেও তাই। সেই জায়গাটাই আমাদের বুঝে নিতে হবে।
[১] জানার বিপদ
সংসারে কিছু কিছু ব্যতিক্রান্ত মানুষের দেখা মেলে। ১৫৪৮ সালে ইতালির নেপল্স রাজ্যের ছোট জনপদ নোলা নগরে জিওভান্নি ব্রুনো এবং ফ্রাউলিসা সাভোলিনোর ঘরে ফিলিপ্পো নামে যার জন্ম হয়েছিল, সেও ছিল এই রকম একজন ব্যক্তিক্রমী শিশু। পড়াশুনায় ভালো, মেধাবী, জটিল জিনিস সহজে এবং সহজ করে বুঝতে পারে, স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। পনের বছর বয়সে তখনকার রীতি অনুযায়ী খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা নিয়ে সে গেল এক ডমিনিকান মঠে পড়াশুনা করতে। আর ইতিমধ্যে যে শিক্ষকের কাছে সে দর্শনের পাঠ নিয়েছিল, শ্রদ্ধা বশত তাঁর নাম (জিওরদানো ক্রিস্পো) থেকে একটা অংশ সে নিজের নামের সঙ্গে স্থায়ীভাবে জুড়ে দিল। এইভাবেই সে একদিন হয়ে উঠল জিওরদানো ব্রুনো। বাবা-মায়ের দেওয়া ফিলিপ্পো নামটা ক্রমশ হারিয়ে গেল।
নাটক তখন থেকেই জমে উঠতে শুরু করল। ভালো ছাত্র বলে মঠের গ্রন্থাগারে ছিল তাঁর অবাধ অধিকার। আর সেই সুযোগে তিনি ভক্তিরসের বইগুলিকে যতটা নাড়াচাড়া করতেন, তার চেয়ে অনেক বেশি হাতড়াতেন সেই সব গ্রন্থ যাদের সম্পর্কে মঠ কর্তৃপক্ষের ছিল বিরূপ মনোভাব। ১৫৭২ সালে নবিশি (ধর্মীয় শিক্ষার আনুষ্ঠানিক প্রথম ধাপ) শেষ করে পরিপূর্ণ পাদ্রি হওয়ার প্রশিক্ষণ নিতে নিতেই তিনি খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে কখন এবং কোথায় কে বা কারা বিশ্বাসের পরিধির বাইরে বেরিয়ে এসে পার্থিব যুক্তিতর্ক তোলার চেষ্টা করেছেন, সেই সব তথ্য খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলতে লাগলেন। এই যেমন আলেক্সান্দ্রিয়ার এক প্রাচীন চিন্তাবিদ ও পাদ্রি আরিউস (২৫০-৩৩৬)-এর কথা, যিনি ঈশ্বর মানলেও যিশুকে ঈশ্বরের পুত্র হিসাবে স্বীকার করেননি, একজন বিশিষ্ট নশ্বর মানুষ হিসাবে মানতে চেয়েছিলেন এবং সেই মতো প্রচার করেছিলেন। অথবা ধরুন হল্যান্ডের সেই ক্যাথলিক পাদ্রি মানবতাবাদী ও ইউরোপীয় নবজাগরণের একজন আদি ফসল দেসিদারিউস ইরাসমুস (১৪৬৬-১৫৩৬)-এর কথা, যিনি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভেতরে থেকেই তার বহু গোঁড়ামির সমালোচনা এবং নানা ভ্রান্ত আচার-বিচারের সংস্কার সাধন করতে চেয়েছিলেন। যাঁর থেকে পরবর্তীকালে মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৪৬) অনেক কিছু শিক্ষা ও প্রেরণা নিয়ে আরও দু ধাপ এগিয়ে যাবেন প্রোটেস্টান্ট ধর্মসংস্কারের পথে। চার্চের গ্রন্থাগারে এই সব পূর্বসূরিদের রচনা থাকলেও মঠের গুরুরা চাইতেন না, কেউ এসব নিয়ে পড়াশুনা বা গবেষণা করুক। কিন্তু ওই যে বললাম, জিওরদানো ব্যতিক্রমী মানুষ। তাঁর কাজের ধারা অন্যদের সাথে মিলবে কেন?
একই ভাবে তাঁকে যখন মঠের পক্ষ থেকে ১৫৬৯ সালে রোমের ভ্যাটিকানে কিছু কাজে পাঠানো হয়, সেখানকার গ্রন্থাগারেই তিনি সন্ধান পেয়েছিলেন আরও একখানা বৈপ্লবিক পুস্তকের। লেখক নিকোলাস কোপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩)। বইটির নাম De Revolutionibus Orbium Coelestium (স্বর্গীয় গোলকদের আবর্তন)। সদ্য বেরিয়েছে। পোপের নামে উৎসর্গীকৃত। কিন্তু, ওরকম একখানা ভালো বইকে বড় সাধুরা কেন জানি না উঁচু তাকেই ফেলে রেখেছে। কাউকে পড়তে বলছে না। শিক্ষক বা ছাত্রদের কেউ পড়ছেও না। মই বেয়ে উঠে তিনি ধুলো ময়লা ঝুল ঝেড়ে সেই বইটিকেও নিচে নামিয়ে আনলেন। পড়তে শুরু করে দিলেন। লাতিনে তাঁর তখন যে দক্ষতা তাতে বইখানা আদ্যপান্ত পড়ে ফেলতে কোনোই অসুবিধা হল না। বইটিতে কিছু অঙ্ক-টঙ্কের হিসাব আছে। তাও তাঁর কাছে কোনো বাধার কারণ হল না। গণিতশাস্ত্রে তিনি বরাবরই ধীশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। আর যত তিনি পড়েন ততই তিনি মুগ্ধ হন।

আজ আমরা জানি বইটির বিষয়বস্তু কী ছিল। তখন অবধি গির্জার কর্তারা একে নিষিদ্ধ পাঠের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেনি। কিন্তু এর সম্পর্কে তাদের বেশ একটু অস্বস্তি ছিল। এতে এমন কিছু বিষয় উত্থাপিত হয়েছে এবং এমনভাবে যে তা খ্রিস্টীয় ধর্মতন্ত্রের সনাতন ও প্রচলিত শিক্ষার সাথে খাপ খায় না। চার্চের জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞানের সঙ্গে ঠিক যেন মেলে না। প্রকাশক, লেখকের এক বন্ধু আন্দ্রেয়াস ওসিয়ান্দার, ভূমিকায় লিখেছেন যে এই বইতে পৃথিবীর যে আবর্তন গতির কথা বলা হয়েছে সেটা নেহাতই একটা কাল্পনিক প্রস্তাব (hypothesis)। এর সাথে বাস্তব গ্রহনক্ষত্রের গতিবিধির কোনো সম্পর্ক নেই। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নানা রকম গাণিতিক প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে হয়। কোপারনিকাসও এখানে সেরকমই করেছেন।
একজন গড়পরতা পাঠক এতে সন্তুষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু জিওরদানোর এটা একেবারেই বিশ্বাস হয়নি, মনঃপুতও হয়নি। তিনি ভাবলেন¾এটা কী রকম কথা? নিছক কাল্পনিক একটা তত্ত্বকথার জন্য এত বড় একখানা বই লেখার দরকার কী? এত অঙ্ক-টঙ্ক কষার দরকারই বা কোথায়? হয়ত তিনি এও তখন জেনে গিয়েছিলেন: আরও আগে (১৫০৮ থেকে ১৫১৪ সালের মধ্যে কোনো এক সময়) কোপারনিকাস একটা ছোট পুস্তিকা লিখেছিলেন, মন্তব্যরাজি (Commentariolus), যার হাতে লেখা কিছু কপি তিনি খুব অল্পসংখ্যক ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের পড়তে দিয়েছিলেন। তার মধ্যেও সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা ছিল। [Joshi 1974, 14-24] সুতরাং এই বড় বইটা পড়তে পড়তে জিওরদানো নিশ্চিত বুঝলেন, প্রকাশক সত্য কথা বলেননি। তিনি তখন তাঁর পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের কাছে বলতে লাগলেন, এত বড় যুগান্তকারী একটা আবিষ্কার শুধুমাত্র এই ভূমিকাটির জন্য সমাজে স্বীকৃতি পাচ্ছে না। যিনি এটা লিখেছেন এবং যাদের উদ্দেশে লিখেছেন তারা সকলেই এক একটি আস্ত গর্দভ [উদ্ধৃত, Davies 1959, 43]।
নোলা ইতালির বড় শহর নেপল্স বা ভেনিস থেকে এমন কিছু দূরে নয়। ফলে পাঁচকান হতে হতে ধর্মগুরুদের কানে এসব আপত্তিকর কথা পৌঁছতে খুব বেশি দেরি হল না। তারাও সকলেই রে-রে করে উঠল। কোথায় সেই অবিশ্বাসী পাষণ্ড খ্রিস্টবিদ্বেষী? তলেমির শিক্ষাকে চ্যালেঞ্জ করছে মানে ও ঈশ্বরের বিশ্ববিধানকেই চুনোতি জানাচ্ছে। ওর আর যাজক হবার যোগ্যতা নেই। ওকে ধরে বেঁধে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারো। ব্রুনোর বন্ধুরা তাঁকে বললেন, “তোমার আর এখানে থাকা বা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানো এবং খোলাখুলি নিজের মতবাদ প্রচার করা নিরাপদ নয়।” জন্মস্থান, প্রিয় নোলা শহর, তাঁকে ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হল। চিরকালের মতো। আর কোনো দিন তিনি সেখানে ফিরে যেতে পারবেন না। বয়স তখন তাঁর আঠাশ বছর মাত্র। সাল ১৫৭৬।
নোলা ছেড়ে বেরিয়ে খ্রিস্টীয় পাদ্রিদের শ্যেন চক্ষুকে এড়িয়ে ইতালির নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতেই ব্রুনো তাঁর মনের বিভিন্ন সংশয়গুলি ব্যক্ত করতে লাগলেন: কোপারনিকাসের তত্ত্বটা ঈশ্বর বা তাঁর বিরুদ্ধে যাচ্ছে বলে কেন ধরা হবে? তিনি নিজেও ঈশ্বরবিশ্বাসী, বিশ্ব চরাচরের সর্বত্র এক কল্যাণময় ঈশ্বরের উপস্থিতিতে তিনি আস্থা রাখেন। দার্শনিক অবস্থানে তাঁর মতবাদ অনেকটা সর্বেশ্বরবাদ (pantheism)-এর কাছাকাছি। কিন্তু তাঁর বক্তব্য হল, ভূকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বও তো মানুষেরই ধারণার ফসল। সেই প্রাচীন কালে আলেক্সান্দ্রিয়ায় বসে দ্বিতীয় শতাব্দের এক প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ, ক্লদিয়াস তলেমি (৯০-১৬৮) এই তত্ত্বের গাণিতিক কাঠামো প্রস্তাব করেছিলেন। তাতে তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে পৃথিবীকে রেখে তার চারপাশে সূর্য চন্দ্র বুধ শুক্র মঙ্গল বৃহস্পতি ও শনিকে আবর্তনশীল গ্রহ হিসাবে দেখিয়েছিলেন। তারপর নব্যপ্লাতোবাদী দার্শনিকরা তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শতাব্দে এথেন্সের প্রথম বিশপ দিওনিসিয়াসের নামে এই তত্ত্বটিকে প্রথম খ্রিস্টীয় মর্যাদায় ভূষিত করে। তার অনেক কাল পরে, পারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক খ্রিস্টান অধ্যাপক, পেতর লোম্বার্দ (১০৯৬-১১৬৪) দাবি করে বসলেন: “মানুষকে যেমন ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন যাতে তারা ঈশ্বর ভজনা করতে পারে, তেমনি ঈশ্বর এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন মানুষের কাজে লাগানোর জন্য। তাই তিনি মানুষকে ব্রহ্মাণ্ডের ঠিক মাঝখানে স্থাপন করেছেন যাতে সে একই সঙ্গে সেবা দিতেও পারে, পেতেও পারে।” [উদ্ধৃত: White 1960, I, 117] তারপরে, ত্রয়োদশ শতাব্দে এলেন মধ্যযুগীয় লাতিন ইউরোপের সর্বপ্রসিদ্ধ দার্শনিক তমাস অ্যাকুইনাস (১২২৫-৭৪)। খ্রিস্টীয় পরিমণ্ডলে তিনি একজন সন্ত হিসাবে বিবেচিত ও পূজিত হন। বিরাট ও ব্যাপক তাঁর বিদ্যাচর্চা। গির্জার সুবিধার্থে তিনি “ধর্মতন্ত্রের বিশ্বকোষ” (Summa Theologica) নামক একটি মহাগ্রন্থ লিখে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় বিষয়ের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক নির্দেশ করে গেলেন। তিনিও বলে গেছেন: পৃথিবীই জগতের কেন্দ্রে বিরাজমান। এরপর কার এত সাহস হবে একে বিরোধিতা করার?
কিন্তু ব্রুনোর চিন্তা অন্য খাতে বইছে। মানুষের কি ঈশ্বরের বিধান বুঝতে ভুল হতে পারে না? একবার ভুল করে যা সে ভাবল, পরে বুঝলেও তা সে সংশোধন করতে পারবে না? ঈশ্বর মানুষকে কি শুধু ভুল করার অধিকারই দিয়েছেন? তিনি কি চান না¾মানুষ তার ভুলগুলি শুধরে নিতেও শিখুক? ইতালির প্রান্তে প্রান্তে ঘুরে ঘুরে তিনি বক্তৃতা দিতে লাগলেন আর এই জাতীয় প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আবেদন জানালেন।
খ্রিস্টীয় ধর্মতন্ত্রের ধারক-বাহকরা দেখল¾এ এক মহা সর্বনেশে কাণ্ড! যারা এই সমস্ত প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামাবে, তারা আর শুধু মাত্র সেইটুকুতেই থেমে থাকবে না। তারা শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর আছে কিনা, ঈশ্বর থাকতে পারে কিনা¾তা নিয়েও চিন্তা করতে শুরু করবে। ব্রুনোর বিরুদ্ধে পোপের পক্ষ থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হল। তাঁকে ধর্মীয় কাঠামো থেকে বহিষ্কার করা হল। ব্রুনো বুঝলেন, ইতালি আর তাঁর পক্ষে নিরাপদ নয়। নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের খোঁজে তিনি ১৫৭৮ সালে প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে দেশান্তরে গমন করলেন।
কিন্তু¾হায়! ব্রুনোর মাপের মানুষদের আশ্রয় দেবার জন্য ইউরোপে তখন তেমন বড় একটা জায়গা কোথাও ছিল না!!
[২] গুরু-প্রণাম
কোথায় যাবেন জিওরদানো? মন স্থির করতে সময় লেগেছিল কিনা আমরা কেউ জানি না। কিন্তু দেখা গেল, ব্রুনো প্রথমে চললেন পোল্যান্ডের দিকে, থর্ন শহরে।
কেন? হঠাৎ সেখানে কেন? কী আছে সেখানে?
আছেন একজন। আছেন সেই মানুষটি যাঁর বিখ্যাত সেই গ্রন্থ ব্রুনোকে দেশান্তরী করেছে। নিকোলাস কোপারনিকাস। সমস্ত কর্ম জীবন ইতালিতে কাটিয়েও এই মানুষটি ফিরে এসেছিলেন তাঁর স্বদেশে শেষ বারের মতো ভূমিশয্যা নিতে। তাঁরই সমাধিতে ব্রুনো এসেছেন দু মুঠো ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে।
খুঁজে খুঁজে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে সমাধিস্থল দেখে তাঁর চোখ কপালে উঠে গেল। বাঁধানো ফলকের গায়ে উৎকীর্ণ প্রার্থনা বাক্যটি এই রকম: “হে ভগবান! তুমি সন্ত পলকে যে করুণা দান করেছ তা আমি আমার জন্য চাই না; পিটারকে যা দিয়েছ তাও আমার যাচঞা নয়। আমাকে তুমি শুধু সেইটুকুই করুণা দিও যা তুমি ক্রুশবিদ্ধ চোরকে দিয়ে থাক।” [উদ্ধৃত: White 1960, I, 124]
এই অপূর্ব বাণী পাঠ করে জিওরদানো ব্রুনোর ঘর ছাড়ার দুঃখ সেদিন অনেকটাই কেটে গিয়েছিল।
[৩] দিন বদলের পালা
ব্রুনোর মানসলোক, তাঁর সংগ্রাম ও সাধনাকে বুঝতে হলে আমাদের শুরু করতে হবে ইতিহাসের একটু পেছনের অধ্যায় থেকে। ইউরোপের অটল গম্ভীর সামন্তী সংসারে বিগত দু তিনশ বছর ধরেই ফাটল ধরতে শুরু করেছে। কিছু কিছু নতুন জিনিস জানতে পেরে মানুষের মনে তখন বহু ব্যাপারেই সন্দেহ দেখা দিয়েছে। নবজাগরণের ঢেউ তখন ইতালি থেকে স্পেন পর্তুগাল হয়ে ইংল্যান্ড হল্যান্ড জার্মানি সুইডেন সুইজারল্যান্ড ফ্রান্সের বুকে আছড়ে পড়েছে। প্রাচীন কালে আমাদের দেশের লোক যেমন সসাগরা পৃথিবী বলতে বুঝত জম্বুদ্বীপ (আসলে উত্তর-পশ্চিম ভারত ও আফঘানিস্তান), তেমনি ইউরোপের লোকেরাও ইউরোপকেই পৃথিবীর সীমা বলে মনে করত। এমনকি খ্রিস্টধর্মের জন্মস্থান মধ্য প্রাচ্য সম্পর্কেও তাদের কোনো সঠিক ধারণা ছিল না।
সেই সীমানা তখন ভাঙতে শুরু করেছে।
নতুন কথাও উঠতে শুরু করেছে। ত্রয়োদশ শতকে রজার বেকন (১২১৪-৯৪) এমন কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন, এমন কিছু কথা বলেছেন, যা ধর্মশাস্ত্রগুলিতে নেই। অসুখ-বিসুখ মহামারীর কারণ “শয়তানের কারসাজি” নয়, প্রাকৃতিক; এবং জীবনযাত্রায় পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখলে তা অনেকটা কাটানো যেতে পারে¾এরকম মতামত দেবার অপরাধে যাজকদের কোপে পড়ে তাঁকে শেষ জীবনের অনেকটা সময় কারাগারে কাটাতে হয়েছিল। আসলে ধর্মমতে শুধু ভগবান নয়, শয়তানের ক্ষমতাকেও কমিয়ে দেখা চলত না। বিজ্ঞান দর্শন ভাষা ব্যাকরণ তর্কশাস্ত্র¾জ্ঞান জগতের নানা শাখাতেই তিনি এমন কিছু কথা বলতে পেরেছিলেন যে তাঁর মৃত্যুর সাতশ বছর পরেও তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়ে বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ ও সমাজতত্ত্ববিদদের মধ্যে মতান্তর ও বিতর্ক চলছে। মধ্যযুগীয় ইসলামি ধর্মনিস্পৃহ দার্শনিকদের চিন্তাগুলিকে তিনিই অনেকটা ধরে রেখে রেনেশাঁসের দরজার চৌকাঠের কাছে রেখে গিয়েছিলেন।
সেদিন যাঁরাই নতুন কথা বলতে চেয়েছে, খ্রিস্টধর্মের মাতব্বররা তাঁদের হত্যা করেছে, জেলে পুরে রেখেছে। তবে অসংখ্য মূল্যবান প্রাণ ধ্বংস করলেও খ্রিস্টীয় ধর্মতন্ত্র সেদিন একটা বিরাট উপকার করেছিল ক্রমাগত অধিকতর সংখ্যায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এর বিরুদ্ধে বিবেক বুদ্ধি জ্ঞান চর্চার আগ্রহ জাগিয়ে দিয়ে। এযাবতকাল গির্জা বা মঠই ছিল মানুষের সামাজিক মেলামেশার একমাত্র জায়গা। এখন সাধারণ মানুষও এর বাইরে গিয়ে নতুন ধরনের সভাসমিতি গঠন করে মুক্ত মনে নতুন বিষয়ে মনোনিবেশ করে এক ভিন্নতর জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ব্যবস্থা করতে লাগল। সেই সব নতুন কথা একে অপরের কাছে বলতে এবং একে অপরের থেকে শুনতে চাইল তারা। ব্রুনোর নিজের দেশ ইতালিতেই ১৫৬০ সালে গড়ে উঠেছিল Academia Secretorum Naturæ (Academy on the Secrets of Nature)। সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য যাজকতন্ত্র বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভয় দেখিয়ে, আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই সব সমিতির দু একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে কোনো অনুমোদিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে উঁচু পদ এবং/অথবা সুযোগ সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে এই জাতীয় প্রচেষ্টাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিচ্ছিল। এই অ্যাকাদেমিয়াকেও তারা ১৫৭৮ সালে ভয় দেখিয়ে বন্ধ করে দেয়। এই সমস্ত প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের গায়ে প্রায়শই তারা লাগিয়ে দিত কিছু ভয়ঙ্কর শব্দ-ছাপ¾নাস্তিকতা (atheism), অবিশ্বাস (infidelity), শাস্ত্রদ্রোহ (heresy), ধর্মবিদ্বেষ (blasphemy), ইত্যাদি। তখন এর মোকাবিলা করে তাদের বেঁচে থাকা দুরূহ হয়ে উঠত।
তবু সে এক সন্ধিক্ষণ। এক ঐতিহাসিক সামাজিক টানাপোড়েনের রঙ্গকাল। ইউরোপে তখন মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রের ধ্বংসকাল এগিয়ে আসছিল। ব্যবসাবাণিজ্যের পরিধি যত বাড়ছিল, ততই সামন্তী সমাজপতি ও উদীয়মান ধনপতিদের মধ্যে বিরোধ ঘনীভূত হচ্ছিল। ইউরোপের বড় বড় শহরের যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি (burghers), যাদের মধ্য থেকেই পরবর্তীকালের বুর্জোয়াদের উদ্ভব ঘটেছিল, তাদের তখন গৎ-বাঁধা শাস্ত্র দিয়ে আর নিত্য-নতুন কাজকারবার চলছে না, বিজ্ঞান চাই। তাদের তখন দরকার ছিল, দুনিয়া সম্পর্কে সঠিক তথ্যানুগ জ্ঞান ও অনুসন্ধান পদ্ধতি। আবার বিজ্ঞান যতটুকু এগোচ্ছিল, তাকে ভিত্তি করে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ আরও বেশ কয়েক কদম এগিয়ে যাচ্ছিল। কোপারনিকাস থেকে ব্রুনোতে উত্তরণই তার একটা বড় সাক্ষ্য। মানুষের চিন্তাধারায়ও ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। দুনিয়ার সব কিছুই এক অমোঘ ঐশ্বরিক বিধান, যা কিছু যেমন আছে তেমনই থাকবে চিরকাল¾এই অটল বিশ্বাসে তখন চিড় ধরেছে। মানুষ নিজেকে আর ঈশ্বরের খামখেয়ালিপনার ভৃত্য হিসাবে দেখতে চাইছে না। নিজেই নিজের অধীশ্বর হতে চাইছে। পঞ্চদশ শতাব্দের একজন মহান শিল্পী (এবং আরও অনেক কিছু), লেওন ব্যাতিস্তা আলবের্তি (১৪০৪-৭২), যে কথাটা উচ্চারণ করেছিলেন¾“মানুষ ইচ্ছা করলে সব কিছুই করতে পারে”¾সেটাই ছিল সেদিনকার বহু মানুষের নিরুচ্চার ভাবনা। তার থেকেই তখন রাজতন্ত্র, বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার, জমিদারি প্রথা, ভূমিদাস প্রথা, ইত্যাদির যৌক্তিকতা নিয়েও মানুষের মনে প্রশ্ন ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিল।
সমগ্র মধ্যযুগ ধরে ইতিহাসে রাজতন্ত্র আর যাজকতন্ত্র পৃথিবীর সব দেশেই এবং সব ধর্মগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই একে অপরের দোসর। কিছু না হলেও তখনই প্রায় দু হাজার বছরের আত্মীয়তা তো বটেই। পশ্চিম রোম সাম্রাজ্যের সাথে খ্রিস্টীয় ধর্মতন্ত্রের ঘনিষ্ঠতা সেদিনই এক হাজার বছরের বেশি পুরনো। তাই ধর্মীয় শিক্ষায় কিংবা ধর্মগ্রন্থে ভুল বেরলে এবং তা নিয়ে জনসাধারণ চর্চা করলে শেষ পর্যন্ত রাজতন্ত্রও আর উদাসীন থাকতে পারে না। বিপদের গন্ধ পায়। রাজারা নাকি সব ঈশ্বরের ইহলোক-প্রতিনিধি। সেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়েই যদি প্রশ্ন জেগে ওঠে, তাহলে রাজার অস্তিত্ব এবং রাজতন্ত্রের যৌক্তিকতা নিয়েও তো প্রশ্ন উঠবেই মানুষের মনে। তাই দুই পক্ষই খুব হুঁশিয়ার হয়ে ঘটনার গতিপ্রকৃতির দিকে লক্ষ্য রাখছে। তার উপর তখন আবার ইউরোপের সমস্ত স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি বিশপদের অধীনস্থ বা তাদের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে চলত। আর মহামান্য পোপের অধীন ক্যাথলিক চার্চ তখন সারা পশ্চিম ইউরোপেই তার নজরদারির নিশ্ছিদ্র জাল পেতে রেখেছিল। ফলে ইতিহাসে বাতিল হয়ে সেই সামন্ততন্ত্রকে রক্ষা করার মহান দায়িত্ব নিয়েই পবিত্র ধর্মতন্ত্র তখন উদীয়মান নব্য বিজ্ঞানের পায়ে রাশ পরিয়ে রাখতে চাইছিল। নতুন যুগের প্রতিনিধি, নতুন মূল্যবোধ ও বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বৈতালিক, সত্যসাধক জিওরদানো ব্রুনো সেই বেড়িগুলিকেই ভাঙতে চেয়েছিলেন। এ প্রায় একজন ব্যক্তির তরফে একটা কঠিন অচলায়তনকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান!
[৪] অসীম বিশ্বকথা
ব্রুনো ভেবেছিলেন, জার্মানি সুইডেন সুইজারল্যান্ড যেহেতু ক্যাথলিক প্রভাব মুক্ত দেশ, প্রোটেস্টান্টরাই সেখানে প্রধান শক্তি, এই সব দেশে গেলে হয়ত তিনি একটু নিশ্চিন্তভাবে থাকতে পারবেন। সার্ভেতোর বিচার ও হত্যাকাণ্ড যে ক্যালভিনপন্থী প্রোটেস্টান্টরাই করেছিল, এটা বোধ হয় তাঁর খেয়াল ছিল না। অথবা, সম্ভবত নিজেও ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ায়, ধর্ম মাত্রই যে তখন গোঁড়ামি ও অন্ধতার পঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে আছে, সত্য ও যুক্তির পথে চলার সামর্থ্য তার আর নেই, চার্চের ধ্রুবিশ্বাস (dogma)-গুলিকে রক্ষা করতে গিয়ে সমস্ত নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিসর্জন দিতেও যে সে আর দ্বিধান্বিত নয়¾এই উপলব্ধি তখনও তাঁর হয়নি। কিন্তু জেনেভায় পা দিতেই প্রোটেস্টান্টপন্থীরা তাঁকে বুঝিয়ে দিল, তারা তাঁর বন্ধু নয়। সেখানে থাকতে হলে তাঁকে প্রোটেস্টান্ট মত গ্রহণ করতে হবে এবং ক্যালভিনীয় গির্জায় যোগদান করতে হবে। শুধু তাই নয়, কোপারনিকাসের মতবাদ একদম প্রচার করা চলবে না।
ঘটনা হল, প্রোটেস্টান্ট আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার ইতিমধ্যেই কোপারনিকাসের মতবাদ সম্পর্কে তাঁর সুচিন্তিত রায় জানিয়ে দিয়েছেন: “লোকজন এক জ্যোতিষশাস্ত্রীর কাছে গিয়ে শুনছে, তিনি দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে পৃথিবী ঘুরছে; স্বর্গ বা আকাশ, সূর্য, চন্দ্র ঘুরছে না। যারাই বুদ্ধিমান সাজতে চায়, তারাই একটা করে নতুন তত্ত্ব আমদানি করে। আর বলে, এটাই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ তত্ত্ব। এই মূঢ় লোকটা সমগ্র জ্যোতিষশাস্ত্রকেই উলটে দিতে চায়। অথচ পবিত্র ধর্মগ্রন্থে আমরা পড়েছি, জোশুয়া সূর্যকেই থামতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, পৃথিবীকে নয়।” [উদ্ধৃত: White 1960, I, 126; আরও দ্রষ্টব্য: বাইবেল, নিউ টেস্টামেন্ট¾জোশুয়া ১০/১২-১৩] লুথার ভক্ত এক অধ্যাপক তখনকার দিনের সবচেয়ে অকাট্য যুক্তি তুলে ধরে বাজিমাত করতে চাইলেন, “The eyes are witnesses that the heaven revolve in the space of twenty four hours”, ইত্যাদি। [উদ্ধৃত: White 1960, I, 126-27] সত্যিই তো! খালি চোখেই তো দেখতে পাচ্ছি যে . . .
মনের দুঃখে ব্রুনো সুইজারল্যান্ড ছেড়ে গেলেন ফ্রান্সে, ক্যাথলিকদের দাপট সেখানে তখন একটু কম। সেখানে লিয়ঁ, তুলুজ, মঁতপলিয় এবং পারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দু বছর ধরে ঘুরে ঘুরে তিনি দর্শনে অধ্যাপনা করলেন। তাঁর ছাত্রপ্রিয়তা সেই যুগে ফ্রান্সের বিভিন্ন কোনায় এক গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছিল। সেই খ্যাতির খাতিরে তিনি ফরাসি রাজ দরবারে একটা চাকরিও পেয়ে গেলেন। তিন বছর সেই পদে কাটিয়ে ১৫৮৩ সালে তিনি গেলেন রাজার প্রতিনিধি হয়ে ইংল্যান্ডে। দু বছর ধরে সেখানে বসবাস করা কালীন তিনি বিভিন্ন কলেজে দর্শন ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর ভাষণ দেন। এই ইংল্যান্ডেই তিনি তাঁর ঝঞ্ঝাসঙ্কুল জীবনের মাঝে দুই বছরের জন্য খানিকটা স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করতে পেরেছিলেন।
এই সময় তিনি ওখানে বসে ইতালী ভাষায় সংলাপের ঢঙ-এ অনেকগুলো পুস্তিকা রচনা করলেন: (১) Cena de la Ceneri; (২) De la Causa, principio e Uno; (৩) Del infinito Universo e Mondi; (৪) Spaccio de la bestia trionfante; ইত্যাদি। এই সমস্ত বইতে তিনি শুধু যে কোপারনিকাসের তত্ত্বকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করলেন তাই নয়, এমন বেশ কিছু নতুন কথা বললেন, যেগুলো পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের দরবারে সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
যেমন, তিনি ‘অসীম বিশ্ব’ পুস্তিকায় বললেন, “আমার মনে হয়েছে, ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারীর পক্ষে যখন একটা কেন, আরও একটা বা আরও অসংখ্য বিশ্ব সৃষ্টি করা সম্ভব, তখন মাত্র একখানা সীমিত বিশ্ব তৈরি করাটা নিতান্তই বেমানান; তাই আমি বলতে চাই, আমাদের পৃথিবীর মতো আরও অনেক বিশ্ব আছে। . . .” [উদ্ধৃত, Jeans 1947, 139] এর ভিত্তিতে তিনি ঘোষণা করলেন গাণিতিক জ্ঞান-সংপৃক্ত এক অসাধারণ যুগান্তকারী দার্শনিক উপলব্ধি: “বিশ্বজগত যখন অসীম, এর উপরে কোনো বস্তুকেই প্রকৃতপক্ষে এর কেন্দ্র বা সীমানা বলে নির্দিষ্ট করা যায় না।” [উদ্ধৃত, ঐ, ঐ] গ্রিক দার্শনিক দেমোক্রিতাস ও এপিকিউরাস এবং রোমান দার্শনিক লুক্রেতিয়াস প্রমুখর মতবাদ অনুসরণ করে প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তুকে এক আদি একক সচেতন সত্তা থেকে উদ্ভূত বলে তিনি এমন এক ব্যাখ্যা উপস্থিত করলেন যা ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও ভূমিকা সম্পর্কেও সংশয় জাগিয়ে তোলে: “বস্তুর যে এত রকম অসংখ্য রূপ আমরা দেখি, এর কোনোটাই বাইরে থেকে বা অন্য কোনো কিছু থেকে আসে না, বস্তু থেকেই বস্তুর জন্ম হয় বিকাশ হয়। . . . ফলে বস্তু আছে মানেই সে নানান রূপে আছে, সব কিছুই তার ভেতরেই লুকানো আছে; এই হচ্ছে সমগ্র প্রকৃতি এবং সমস্ত জীবন্ত বস্তুর জন্মধাত্রীস্বরূপ।” [উদ্ধৃত, Roy 1943, 62-63]
আবার সমস্ত গ্রহ নক্ষত্রই যেহেতু একই রকম মোনাড দিয়ে তৈরি, তাই পৃথিবীর বস্তুগুলি পার্থিব (terrestrial) আর আকাশের বস্তুগুলি স্বর্গীয় (celestial)¾এরকম ভাগাভাগি করে রাখাও যুক্তিহীন। [উদ্ধৃত, Jeans 1947, 140]
তাঁর আর একটি পুস্তিকা, De la Causa, principio et uno-তে তিনি যা বললেন তার মধ্যে বিস্ময়করভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের স্বরধ্বনি শোনা যায়: “This entire globe, this star, not being subject to death, and dissolution and annihilation being impossible anywhere in Nature, from time to time renews itself by changing and altering all its parts. There is no absolute up or down, as Aristotle taught; no absolute position in space; but the position of a body is relative to that of other bodies. Everywhere there is incessant relative change in position throughout the universe, and the observer is always at the center of things.” [উদ্ধৃত, Kessler, on-line]
সংক্ষেপে তাঁর বিশ্বতত্ত্ব সংক্রান্ত বক্তব্যগুলি এইরকম: (ক) বিশ্বজগত অসীম ও অনন্ত, তাই কে তার কেন্দ্র, কোথায় তার প্রান্ত¾এসব বলার কোনো মানে নেই; (খ) সূর্য একটি নক্ষত্র, এর চতুর্দিকে আবর্তনরত গ্রহমণ্ডলিকে নিয়ে গড়ে উঠেছে সৌরজগত; (গ) অন্যান্য নক্ষত্রগুলিরও সূর্যের মতো গ্রহ-পরিবার থাকার সম্ভাবনা আছে; (ঘ) গ্রহ এবং নক্ষত্র¾সকলেরই দু রকমের গতি রয়েছে: নিজের অক্ষের চারদিকে ঘূর্ণন এবং কক্ষ পথে আবর্তন; (ঙ) গ্রহ নক্ষত্র উপগ্রহগুলি নিয়ত পরিবর্তনশীল; (ছ) মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুর অবস্থান আপেক্ষিক ও অন্য বস্তু সাপেক্ষে নির্ধারিত; (ছ) এই বিশ্বের উপর-নিচ, ডান দিক-বাঁদিক, সম্মুখ-পশ্চাৎ, ইত্যাদিও নির্বিশেষভাবে নির্ধারিত নয়, বিভিন্ন বস্তুসাপেক্ষে আলাদা আলাদাভাবে বুঝতে হবে; ইত্যাদি।
এ তো গেল, ঈশ্বর কী কী করতে পারেন, তার কথা। ব্রুনো এখানেই থামলেন না। ঈশ্বরের পক্ষে কী কী করা সম্ভব নয় তাও তিনি এর পর বলে দিতে চাইলেন! অর্থাৎ, খ্রিস্টধর্মের অনেকগুলি মৌল অলৌকিক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কামান দাগলেন। তাঁর মতে¾কুমারী অবস্থায় তথাকথিত ‘পবিত্র আত্মা’র প্রভাবে মাতা মেরির গর্ভে যিশুর ভ্রূণ-সঞ্চার সম্ভব নয়। প্রাচীন কালে মানব সন্তান যিশুর উপর দৈবী মাহাত্ম্য চাপাতে গিয়ে সেকালের মানুষ এই সব অলৌকিক কাহিনির জন্ম দিয়েছিল। এখন আমাদের বুঝতে হবে, অন্য সব মানব শিশুর জন্ম যেভাবে হয়ে থাকে, যিশুর জন্ম তার থেকে আলাদা কোনো রাস্তায় হয়নি। যিশুর মহত্ত্ব জন্মের অলৌকিকতায় নয়, তাঁর লৌকিক মহান কর্মে। আবার ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার পর অবিশ্বাসীদের মনে বিশ্বাস উৎপাদন করার অভিপ্রায়ে কবরের উপরে যিশুর পবিত্র আত্মার পুনরুত্থান (resurrection)–এর পল্লবিত কাহিনিও সত্য হতে পারে না বলে তিনি প্রচার করে গেলেন।
তাঁর De triplici minimo et mensura প্রবন্ধে তিনি ঘোষণা করলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের মূল মর্মবাণী: “যিনি জ্ঞানচর্চা করতে চান তাঁকে প্রথমে সব কিছুতে সংশয় প্রকাশ করতে হবে। কোনো বিষয়ে বিভিন্ন মতামত শোনার আগে এবং পক্ষে ও বিপক্ষে উত্থাপিত যুক্তিগুলি দেখে শুনে বিবেচনা করার আগে তিনি ঐ বিতর্কে কোনো মত দেবেন না। কানাঘুসোয় কী শোনা গেছে, অধিকাংশ লোক কী বলছে, বা যে বলছে তার বয়স বিদ্যা বা সামাজিক প্রতিপত্তি কেমন, তার ভিত্তিতে কোনো মতামত বিচার বা গ্রহণ করবেন না। যুক্তি দিয়ে যে সত্য যাচাই করা যায়, বাস্তব জগতের সঙ্গে যে চিন্তাধারা মেলে, তিনি তার ভিত্তিতে অগ্রসর হবেন।” [উদ্ধৃত, Gaglioti 2000, on-line]
সেই কারণেই তাঁর মুখ থেকে এক তিক্ত মন্তব্য বেরিয়ে আসে: “The fools of the world have been those who have established religions, ceremonies, laws, faith, rule of life. The greatest asses of the world are those who, lacking all understanding and instruction, and void of all civil life and custom, rot in perpetual pedantry; . . .” [Cabal of the Cheval Pegasus (1585)]
আজ থেকে চারশ বছরেরও আগে একজন দেশ-দেশান্তরে বিতাড়িত চিন্তানায়কের কণ্ঠে উচ্চারিত ও কলমে লিপিবদ্ধ এই সব কথা শুনলে আজও আমরা বিস্ময়ে শ্রদ্ধায় চমকে উঠি।
চমকে উঠেছিল খ্রিস্টীয় ধর্মতন্ত্রও। ঐশ্বরিক ক্ষমতায় সন্দেহ প্রকাশ করলে যেমন তারা অসন্তুষ্ট হত, ঈশ্বরের চার্চ-প্রদত্ত ক্ষমতা কেউ বাড়িয়ে দিলেও তাদের রাগ হয়ে যেত। তার উপর লোকটা বলে কী? স্বর্গ মর্ত্য পাতাল বলে যদি আলাদা করে কিছুই না থাকে, তাহলে ভগবানকে কোথায় বসানো হবে? নরকের অধিষ্ঠানই বা কোথায় হবে? আর, নরকে জ্বলে পুড়ে মরার ভয় না থাকলে আম জনতা পাদ্রিদের দাপট মানবে কেন? এত সাহস ওর যে খালি বলছে, কারোর কথা যাচাই না করে মানবে না¾সে আরিস্ততল তলেমি অ্যাকুইনাস বা অন্য যেই হোন না কেন। এই ধর্মদ্বেষীর বিরুদ্ধে এক্ষুনি কিছু ব্যবস্থা না নিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এবার ওর ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত ফয়সালা কিছু করা দরকার।
এবং তাঁকে ইতালিতে ফিরিয়ে আনার জন্য যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল তা বোধ হয় একমাত্র ধর্মীয় নৈতিকতাতেই সম্ভব!!
[৫] ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ
ইংল্যান্ডের আবহাওয়াও তখন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ইংরেজ জনসাধারণের তখন প্রচণ্ড বিক্ষোভ। তারা একদিন ফ্রান্সের দূতাবাস আক্রমণ করেই বসল। ফলে বাধ্য হয়ে ব্রুনো অন্যান্যদের সঙ্গে ১৫৮৫ সালে ফিরে গেলেন পারিতে। সেখানে কিছু দিন থাকার পর পরের বছর চলে গেলেন জার্মানির ভিটেনবার্গে। তারপর প্রাগ (১৫৮৮), হেল্মস্টাট (১৫৯০) হয়ে আবার জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে (১৫৯১)। কিন্তু কোথাও তিনি কাজ পান না, পেলেও বেশি দিন থাকে না। কোথাও তিনি শান্তিতে থিতু হয়ে থাকতে পারছেন না। পারতেন যদি মুখ বন্ধ করে চলতেন। কিন্তু যিনি বৈজ্ঞানিক সত্যের প্রচার করবার জন্য সারা পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে এত ছোটাছুটি করছেন, তিনি চুপ করে থাকেন কী করে? পারিতে এসে ১৫৮৫ সালে লিখলেন De gli eroici furori । ১৫৮৬ সালে ভিটেনবার্গে বসে লাতিনে লিখলেন আরিস্ততলের মতবাদের বিরুদ্ধে ১২০টি প্রস্তাব বিশিষ্ট এক বড় প্রবন্ধ: “Centum et viginti articuli de natura et mundo adversus Peripateticos”। ফ্রাঙ্কফুর্টে বসে কবিতার ছন্দে লাতিন ভাষায় লিখে ফেললেন বিশ্বতত্ত্বের উপর আরও তিনখানা বই। আর যাই তিনি লেখেন, সবই যেহেতু শেষ অবধি প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস অনুমোদিত ধ্যান ধারণার বিরোধী হয়ে যায়, প্রত্যেক জায়গা থেকেই তাড়া খেয়ে তাঁকে বেরিয়ে পড়তে হয়। নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে। কিন্তু কে দেবে তাঁকে আশ্রয়? অত বড় ইউরোপ মহাদেশ, ব্রুনোর জন্য ক্রমাগত ছোট হয়ে আসতে থাকে।
অবশেষে ১৫৯১ সালের গোড়ায় ফ্রাঙ্কফুর্টের এক পুস্তক প্রদর্শনীতে সাক্ষাতকালে ভেনিসের একজন পুস্তক বিক্রেতা, জিওভান্নি বাতিস্তা সিওত্তো, তাঁকে প্রস্তাব দেন ইতালিতেই ফিরে আসতে। সেখানে একজন সম্ভ্রান্ত অভিজাত পরিবারের শিক্ষানুরাগী যুবক, জুয়ান মোসেনিগো, তাঁর কাছে পড়াশুনা করতে ইচ্ছুক। [Garvin 2012, on-line] ব্রুনো চাইলে হয়ত কোথাও একটা স্থায়ী চাকরিও তাঁকে যোগাড় করে দিতে পারবে সে। আর তার কাছে থাকলে গির্জার লোকেরাও তাঁকে বিরক্ত করতে সাহস পাবে না। চোদ্দ বছর ধরে দেশ ছাড়া ব্রুনো তখন পলাতক জীবনে প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছেন। প্রিয় স্বদেশের মাটিতে পা রাখার জন্য মনে মনে তিনি অস্থির, ব্যাকুল। আর তাতেই তিনি ফাঁদে পড়ে গেলেন। লুকিয়ে লুকিয়ে চলে এলেন প্রথমে পাদুয়ায়, সেখানে গণিতের একটা অধ্যাপক পদ ফাঁকা ছিল। আবেদনও করলেন, কিন্তু পেলেন না। হতাশ হয়ে তখন গেলেন ভেনিসে। সেখানে মোসেনিগোর অট্টালিকায় আশ্রয় নিয়ে তাকে নতুন বিশ্বতত্ত্ব পড়াতে শুরু করলেন। তারপর, খবর পেয়ে, যথাসাব্যস্ত ওরা এল। যাজক বাহিনী এবং রাজার কোতোয়ালরা। ধর্মীয় বিচারসভা (Inquisition)-এর নামে তাঁকে গ্রেপ্তার করে ধরে নিয়ে গেল। প্রথমে ভেনিসে, পরে রোমে পোপের প্রশাসনের কাছে।
শুরু হল বিচারের নাটক।
ব্রুনোর বিরুদ্ধে পোপতন্ত্রের অভিযোগ অনেক। একশ তিরিশটি। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে সবচাইতে গুরুতর অভিযোগ হল ইতালী ভাষায় লেখা তাঁর “বিজয়ী পশুদের বিতাড়ন” (Spaccio de la bestia trionfante) শীর্ষক পুস্তিকার বিষয়বস্তু। সেখানে নাম ভূমিকায় আছেন মহামান্য পোপ স্বয়ং, আর লেখক দেখিয়েছেন¾চার্চের মতান্ধ লোকদের না আছে ধর্মবিশ্বাস না আছে নৈতিক চরিত্র! এরকম যাঁর কাণ্ডকারখানা তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিচারের ফল কী হতে পারে সহজেই অনুমেয়। অপরাধীই তো এখানে বিচারকের আসন দখল করে নিয়েছে। সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত জেল হয়ে গেল তাঁর। রোমের ভ্যাটিকান প্রাসাদ সংলগ্ন ‘পবিত্র দপ্তর’–এর কারাগারে। তাঁর জন্য বরাদ্দ কামরাটিও সুন্দরভাবে তৈরি করে রাখা হল। আলোবাতাসহীন বদ্ধ প্রকোষ্ঠের মাথায় সীসার ছাদ। গ্রীষ্মে ঘরটা হয়ে উঠত একটা গরম চুল্লি। আর শীতকালে সাইবেরিয়ার কাঠের ঝুপড়ির মতো। সঙ্গে প্রতিদিন সামান্য খাদ্য ও জল এবং প্রচুর পরিমাণে দৈহিক নির্যাতন।
যিনি সারা বিশ্বের মানুষদের কাছে এত দিন মহাবিশ্বের অসীমতার কথা প্রচার করে গেলেন, আজ তাঁর বিশ্ব চার হাত বাই ছ হাতে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল।
মাঝে মাঝে বিচারকদের তরফ থেকে বার্তা আসত¾“ভুল স্বীকার কর, ক্ষমা প্রার্থনা কর। জীবন ফিরে পাবে। ঈশ্বর করুণাময়।” ব্রুনো নির্বিকার থাকেন। সত্যের উপলব্ধি, যুক্তির শক্তি তাঁকে দিয়েছে সমস্ত অত্যাচার সহ্য করবার মতো এক অপরিসীম মানসিক বল।
১৫৯৩ সাল থেকে এক টানা সাত বছর ধরে অত্যাচার চালিয়েও ব্রুনোর দৃঢ়তাকে টলানো গেল না। কোনো ভাবেই তিনি মাথা নত করতে সম্মত হলেন না। অবশেষে ১৬০০ সালের ২০ জানুয়ারি প্যাপাল ধর্মীয় বিচারসভা আবার মিলিত হল। এবার বসে পোপের অনুমতিক্রমে তারা সিদ্ধান্ত নিল¾এই দুর্বিনীত অবিশ্বাসীকে চরম শাস্তি দিতে হবে। একে আর বাঁচিয়ে রেখে লাভ নেই। এর জন্য বরাদ্দ হল, বাইবেলের নির্দেশ অনুযায়ী, “যতদূর সম্ভব আরামদায়কভাবে এবং বিনা রক্তপাতে” (with possible clemency and without shedding blood) মৃত্যুদণ্ড। অর্থাৎ, জীবন্ত অবস্থায় বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে মারো। সেই বাইবেল, যাকে বাংলা অনুবাদে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে “প্রেমের বাণী”। ইংরেজিতে ওনারা স্নেহভরে বলেন The Gospel of Love!! যার প্রধান শিক্ষাই হল নাকি “প্রতিবেশীকে ভালোবাসতে হবে”। Love thy neighbour!!! ভালোবাসাই বটে। জেনেভায় সার্ভেতো প্রায় চল্লিশ বছর আগে তা টের পেয়েছিলেন। এবার এও তার স্বাদ পাবে।
৮ ফেব্রুয়ারি জীর্ণ শীর্ণ কঙ্কালসার-দেহ ব্রুনোকে যখন কারাগার থেকে বের করে আনা হল এবং বিচারকের রায় পাঠ করে শোনানো হল, তিনি অতি কষ্টে খ্রিস্টীয় বিচারকদের দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসলেন, বললেন: “Maiori forsan cum timore sententiam in me fertis quam ego accipiam” (আমি তোমাদের রায় শুনে যতটা না ভয় পাচ্ছি, তোমরা দেখছি রায় দিতে গিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি ভয় পাচ্ছ)।
বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই বাক্যটি চার শতক পার করেও এক অমর সংলাপ রূপে বিরাজমান!
[৬] শেষ যুদ্ধজয়
১৭ ফেব্রুয়ারি ১৬০০। বিজ্ঞানের ইতিহাসে, শুভ বুদ্ধির ইতিহাসে, মানুষের মুক্তবুদ্ধির ইতিহাসে এক মসীকৃষ্ণ দিন। নির্বোধ ধর্মান্ধ জহ্লাদদের আনন্দের সময়; আর সত্যসন্ধ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের মর্মবেদনার কালবিন্দু!
আর, হ্যাঁ, এই দিনটিই ছিল একজন মহান বিজ্ঞান-শহিদের জন্মদিবস!
বন্দি জিওরদানো ব্রুনোকে রোমের তখনকার একটা খোলা বাজার সংলগ্ন এলাকায় (ক্যাম্পো দেই ফিওরি) নিয়ে আসা হল। সেখানে তৈরি করে রাখা ছিল এক বিশাল উঁচু মঞ্চ, যাতে চারপাশের জড়ো হওয়া সমস্ত মানুষ এই বর্বর হত্যাকাণ্ড দেখতে পায়। তার উপর ব্রুনোকে তুলে দিয়ে শিকলে বেঁধে তলা থেকে দাউ দাউ আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হল। মুখের ভেতরে জিহ্বাও তাঁর কাঠের একটা টুকরো ঢুকিয়ে চাপা দেওয়া আছে, যাতে মরণ যন্ত্রণায় তিনি আর্ত চিৎকারও করতে না পারেন; অথবা, শেষ মুহূর্তেও যেন কৌতুহলী দর্শকদের কাছে বিজ্ঞানের কোনো নিগূঢ় সত্যের উচ্চারণ করে যেতে না পারেন। তথাপি এক দৃঢ়চিত্ত সত্যনিষ্ঠ চরিত্র হিসাবে জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও তিনি এই কঠিনতম পরীক্ষায় হেলায় উচ্চতম আসনটি দখল করে নিলেন। তাঁর নীরব নিথর মুখের অভিব্যক্তিতে এক চিলতে হাসির অবিচল সেই স্থিরছবি জীবনযুদ্ধের শেষ সংগ্রামটিতেও ধর্মভিরুদের পরাস্ত করে গেল।
অসহ্য অপমানে যাজকতন্ত্র ব্রুনোর নামোচ্চারণ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করে দিল। ১৬০৩ সালে তাঁর সমস্ত বইপত্র চার্চের নিষিদ্ধ পুস্তকের তালিকায় লিপিবদ্ধ করে সকলকে জানিয়ে দেওয়া হল। সেই সব বইয়ের যত কপি পাওয়া গেল, ক্যাথলিক প্রভাবিত প্রতিটি দেশে চারদিক থেকে খুঁজে এনে তা খোলা জায়গায় জড়ো করে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হল। আট বছরের বিচারের সমস্ত তথ্য লুকিয়ে ফেলা হল কিংবা নষ্ট করে দেওয়া হল, যাতে ভবিষ্যতে কেউই কিছু বুঝতে না পারে। এইভাবে ওরা চেষ্টা করে গেল, ব্রুনো সম্পর্কে কোনো তথ্যই যেন ইতিহাসে না থাকে।
কিন্তু হায়! কোনো কিছু করেই কিছু লাভ হল না। সেই মূঢ় অন্ধ বোধ-বিচারহীন ধর্মশাস্ত্রে সুপণ্ডিত বিচারকদের নাম লোকে অচিরেই ভুলে গেছে। সেদিন কে পোপ ছিল আজ আর কেউ মনে রাখে না বা জানতেও চায় না। জিওরদানো ব্রুনো ইতিহাসে চিরস্থায়ী সম্মান পেয়ে গেলেন। সত্যসন্ধ বিজ্ঞানীরাই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখলেন। তাঁরই সমসাময়িক এক বিজ্ঞানী উইলিয়াম গিলবার্ট (১৫৪০-১৬০৩) ছিলেন ইংল্যান্ডের রাণি এলিজাবেথের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। বিজ্ঞানের ছাত্ররা জানেন, তিনি প্রথম চুম্বক ও বিদ্যুৎ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান আরম্ভ করেন এবং De Magnete নামক একটি গ্রন্থে এতদ্সংক্রান্ত গবেষণার ফলগুলি লিখে রেখে যান। আর ১৬০০ সালেই এটি প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের শেষ অধ্যায়ে তিনি সংক্ষেপে আলোচনা করেন ব্রুনোর বিশ্বতত্ত্ব। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর রচিত আর একখানা বইয়ের পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয়েছিল, যা ১৬৫১ সালে প্রকাশিত হয় On Our Sublunari World, A New Philosophy নামে। এতে দেখা যায়, গিলবার্ট নাম করেই ব্রুনোর মতবাদের বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়ে যান।

আমরা এও জানি, ব্রুনোর জীবনকালেই ইতালির বিজ্ঞান মঞ্চে এসে গিয়েছিলেন গ্যালিলেও গ্যালিলি (১৫৬৪-১৬৪৩)। তিনি পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ ও গাণিতিক পদ্ধতিতে কোপারনিকাসের তত্ত্বকে আরও ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন, গ্রহ নক্ষত্র উপগ্রহ সম্পর্কে টেলিস্কোপের সাহায্যে আরও বহু নতুন তথ্য আবিষ্কার করলেন এবং পাশাপাশি পদার্থবিজ্ঞানের জন্ম দিলেন। একই সময়ে প্রকাশিত হয় জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহান কেপলার (১৫৭১-১৬৩০)-এর বিখ্যাত বই Astronomia Nova (১৬০৯), যাতে তিনি তাঁর শিক্ষক টাইকো ব্রাহের রেখে যাওয়া দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে খালি চোখে আকাশ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বিপুল তথ্য ভাণ্ডারকে ব্যবহার করে সূর্যের চারদিকে গ্রহদের উপবৃত্তাকার কক্ষপথ ও তাদের ঘূর্ণন সংক্রান্ত নিয়মাবলি আবিষ্কার করে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এই সবের মধ্য দিয়ে বিশ্বজগত সম্পর্কে আমাদের কাছে একটা স্পষ্ট ছবি উঠে এল। খ্রিস্টীয় ধর্মতন্ত্র সেদিন গ্যালিলেওকেও রেহাই দেয়নি; নির্যাতন করেছে, চূড়ান্তভাবে অপমান করেছে, লাঞ্ছনা দিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রুনোর ভবিষ্যদ্বাণীই সঠিক প্রতিপন্ন হল¾“বিজয়ী পশুদের” জয় স্থায়ী হল না, বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক সত্যেরই জয় হল। বিজ্ঞানের সরস্বতী চলে গেল সেই সব দেশে যেখানে রোমের পোপের হাত আর পৌঁছায় না।

শুধু এটুকু বললেও হবে না। ব্রুনো তো বিজ্ঞানী নন, পর্যবেক্ষকও নন। তিনি একজন বিজ্ঞান ভাষ্যকার, একজন দার্শনিক। আমরা গোড়াতে তাঁর যে হাইফেন ভূমিকার কথা বলেছি তার এখান থেকেই শুরু। বিজ্ঞানের নির্বাধ অগ্রগতির জন্য যে সামাজিক মনন-মহলটির দরকার হয়, বুদ্ধিমুক্তি ও যুক্তিবাদের যে রসায়নের প্রয়োজন, ব্রুনো ছিলেন তারই এক অভীক উচ্চকণ্ঠ প্রবক্তা। গ্যালিলেও কেপলার নিউটনের জন্য, আরও অসংখ্য ভাবী বিজ্ঞানসাধকের জন্য অষ্টপদী-ধর্মতন্ত্রের হাতগুলো ছেঁটে দেওয়ার দুঃসাহসী উদ্যোক্তা। একক এবং একাকী।
[৭] শেষ কথা
ব্রুনোর শহিদত্ব বরণের পর চারশ বছর কেটে গেছে। বিজ্ঞান তারপর অনেক দূর এগিয়ে গেছে এবং বিকশিত হয়েছে। বৈজ্ঞানিক মতবাদ হিসাবে ব্রুনোর কথাগুলির ঐতিহাসিক মূল্য যা-ই হোক না কেন, প্রামাণ্য জ্ঞান হিসাবে আজ আর তার কোনো মূল্য বা গুরুত্ব নেই। অন্যদিকে বিজ্ঞানের বিকাশে বাধা দেবার মতো শাসকীয় ক্ষমতাও প্রতিটি ধর্ম অনেক দিন আগেই হারিয়ে ফেলেছে। বিজ্ঞান যুক্তিবাদ বিজ্ঞানমনস্কতা আজ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। অতএব প্রশ্ন উঠতেই পারে, এতদিন পরে ব্রুনোকে স্মরণ করার, চর্চা করার, বিশদভাবে আলোচনা করার সত্যি আর কোনো দরকার আছে কিনা। অন্য ভাষায় বলতে গেলে, আমাদের কালেও ব্রুনো চর্চা কতটা প্রাসঙ্গিক।
আমার মনে হয়, এই প্রয়োজন অবশ্যই আছে।
আমাদের দেশের প্রসঙ্গে তো আরও বেশি করেই আছে।
প্রথমে আমাদের দেশের প্রসঙ্গই আলোচনা করি। এটা বোঝার জন্য আমাদের প্রথমেই মহান বিজ্ঞানী আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪)-র গ্যালিলেও সম্বন্ধে লেখা একটা ছোট অথচ মূল্যবান প্রবন্ধের মধ্যেকার কয়েকটা বাক্য স্মরণ করতে হবে: “সনাতনী ধার্মিকেরা বিজ্ঞানের শ্বাসরুদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন যথারীতি। ফলে ইতালী দেশই পেছিয়ে পড়ল। ফ্রান্স, ইংলন্ড ও অন্যান্য দেশে গালিলিওর আজন্ম সাধনা সুফল প্রসব করল।” [বসু ১৯৯২, ১৭৫]
কথাটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি, ইতালিতেই প্রথম ইউরোপীয় নবজাগরণের সুগম সঙ্গীত বেজে উঠেছিল। মাত্র দুশ বছরের মধ্যে জন্ম নিয়েছিলেন সাহিত্যে শিল্পে বিজ্ঞানে পেত্রার্ক, বোক্কাচিও, রাফায়েল, মিকেলেঞ্জেলো, লিওনার্দ দ্য ভিঞ্চি, ব্রুনো, গ্যালিলেও, তরিসেলি, প্রমুখ অসংখ্য শিখর স্পর্শী প্রতিভা। একের পর এক। কখনও এক সঙ্গে। অথচ খ্রিস্টীয় ধর্মতন্ত্রের অশিক্ষা প্রসূত দাপটে বিজ্ঞানের সত্যকে অস্বীকার করে করে, সত্যের পূজারীদের মুখ বন্ধ করার চক্রান্ত করতে করতে সেই দেশ জ্ঞানে বিজ্ঞানে অর্থনীতিতে শিল্প বিকাশে ইংল্যান্ড ফ্রান্স হল্যান্ড বেলজিয়াম জার্মানির থেকে ধীরে ধীরে অনেক পেছনে পড়ে গেল। রেনেশাঁসের সোনার ফসল পরবর্তী অন্তত দুশ বছরের জন্য ইতালির হাতছাড়া হয়ে গেল।
ইতিহাসের এই শিক্ষাটা বোধ হয় ভারতবর্ষে খুব কম লোকই বুঝতে পেরেছেন। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে এবং বিজ্ঞানচর্চায় ধর্মকে সজ্ঞানে বাদ দিয়ে চলার মতো ধর্মনিস্পৃহ নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি এদেশে গৃহীতই হয়নি। আর ইদানিংকালে তো সরস্বতী বন্দনা, দেশমাতৃকা পূজা, বৈদিক গণিত¾নানা নামে বেনামে ধর্মীয় সনাতন অন্ধবিশ্বাসগুলিকে জবরদস্তি শিক্ষার আঙ্গিনায় গুজে দেবার চেষ্টা চলছে। যে সব দেশ কোনো দিন সরস্বতী পুজো করেনি তাদের সঙ্গে আমাদের দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানে মৌলিক আবিষ্কারের পরিমাণগত তুলনা করলে বরং এক দুঃখজনক ছবিই ফুটে উঠবে। সরস্বতী বন্দনার সাথে সারস্বত কৃতিত্বের যেন এক অতিস্পষ্ট বিপ্রতীপ ও ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক। অথচ মানুষের সরল বিশ্বাস ও ধর্মীয় আবেগে স্রেফ সুড়সুড়ি দিয়ে এই জলজ্যান্ত তথ্যগুলিকে তাদের দৃষ্টিপথ থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা জ্ঞান ও যুক্তির শক্তিতে বলীয়ান হয়ে সামনের দিকে পা ফেলতে না পারে। আমরাও সময় থাকতে থাকতে সাবধান হতে পারিনি বলে জ্ঞানে বিজ্ঞানে সাহিত্যে শিল্পে খালি পিছিয়েই যাচ্ছি। নকলনবিশিতে হয়ত দু-চার পা এগিয়ে যেতে পেরেছি, কিন্তু সৃজনশীলতায় চলছে গ্যালিলেও-উত্তর ইতালির মতোই ধ্রুব অধোগমন। ব্রুনো চর্চা এই জন্যই আমাদের প্রয়োজন। সতর্ক বার্তা হিসাবে। ইতিহাসের শিক্ষা হিসাবে।
এখানে আর একটা স্বল্পজ্ঞাত তথ্যও সকলের গোচরে আনতে চাই।
সার্ভেতো ব্রুনো প্রমুখকে পুড়িয়ে মারা, গ্যালিলেওকে নির্যাতন ও হেনস্থা করার ফলে খ্রিস্টীয় গির্জার দুই তরফেরই মর্যাদা বিশ্বের দরবারে অনেকখানি তলায় চলে যায়। বিশেষ করে ক্যাথলিক চার্চের প্রতি শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মাত্রই বিরূপ হয়ে ওঠেন। বিশ শতকে এসে তাদের হৃত মর্যাদা পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে ধর্মপ্রাণ কিছু খ্রিস্টান লেখক এক নতুন গবেষনা শুরু করেছেন। তাঁরা ব্রুনোর চরিত্র ও বুদ্ধিতে কিছুটা কালির দাগ ছিটিয়ে তাদের পূর্বসূরিদের অপরাধের বোঝা কমাতে চাইছেন। তাঁদের বক্তব্য হল, ব্রুনো আসলে কোপারনিকাসের মতবাদ প্রচারের জন্য চার্চের কোপে পড়েননি। তিনি নাকি মিশরীয় প্রাচীন গুপ্তবিদ্যা শিখে মানুষকে কালা যাদু দেখিয়ে মোহগ্রস্ত ও বিভ্রান্ত করতেন, তিনি চার্চ, খ্রিস্টীয় নানাবিধ মৌল-ধারণা এবং মহামান্য পোপ সম্বন্ধে প্রচুর গালাগাল করতেন, ইত্যাদি।
যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে এই অভিযোগগুলি সত্য, তার জন্য তাঁকে আট বছর ধরে জেলে পুরে নির্যাতন করা এবং অবশেষে প্রকাশ্যে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করাটা ন্যায়সঙ্গত হয়ে যায় নাকি? বরং এটাও মনে রাখতে হবে, গ্যালিলেওর ব্যাপারে অনেক দিন ধরে ধীরে ধীরে পিছু হঠলেও ২০০০ সালের আগে অবধি ক্যাথলিক চার্চ ব্রুনো-হত্যার জন্য ন্যূনতম ভুল স্বীকার বা দুঃখ প্রকাশ পর্যন্ত করেনি। ব্রুনোর মৃত্যুর চতুর্শতবার্ষিকীতে এসে আগুনে পুড়িয়ে হত্যাকে অনভিপ্রেত বললেও একই বিবৃতিতে তারা ব্রুনোর বিচারকদের পক্ষেও সাফাই গেয়ে রাখে। [Seife 2000] এর অর্থ হল, মুখ ফুটে না বললেও তারা এখনও সেই হত্যাকাণ্ডকে মনে মনে সমর্থনই করে। দ্বিতীয়ত, কথাগুলি যে সত্য নয়, তা বোঝা যাবে তাদের আসল¾এবং আজ অবধি জীবন্ত¾ক্ষোভের কারণটি থেকে, যা কিছুদিন আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনায় তারা মুখ ফস্কে বলেই ফেলেছে: “. . . his system of thought is an incoherent materialistic pantheism. . . . His attitude towards religious truth was that of a rationalist. Personally, he failed to feel any of the vital significance of Christianity as a religious system.” [Catholic Encyclopaedia 1999, III] ব্রুনোর চিন্তাধারার সাথে সনাতন ধর্মবিশ্বাসের পার্থক্য এবং আধুনিক যুক্তিবাদী মননের নৈকট্যই তাদের এই অকপট উষ্মার কারণ।
আজ আবার মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞান-বোধের উপরে আক্রমণ নেমে আসছে। শুধু তো ভারতে নয়, সারা পৃথিবীতেই তার চেষ্টা চলছে ধর্মের নামে¾কোথাও খ্রিস্টধর্ম, কোথাও ইসলাম, কোথাও হিন্দুধর্ম¾যাই হোক না কেন। সর্বত্রই সে ধর্ম, বক্তব্য তার একই: ব্যবহারিক জীবনে যত খুশি বিজ্ঞান নিয়ে চল, মেশিন বানাও এবং চালাও, মারণাস্ত্র তৈরি কর, খনিজ সম্পদ জৈব সম্পদ নিঃশেষ কর, আপত্তি নেই। কিন্তু মস্তিষ্কে চিন্তার প্রক্রিয়ায় যেন বিজ্ঞান যেতে না পারে। সেখানে ঢুকবে এবং বসবাস করবে ঈশ্বর, ব্রহ্ম, আত্মা, পরকাল, স্বর্গ-নরক, নিয়তি, কর্মফল, অলৌকিকতা, বাইবেল-কোরান-গীতা, মাদুলি-আংটি-লাল সুতো, দস্তা-লোহা-তামা, পান্না-নীলা-চুনি, আর টিয়া পাখি। এরাই বলে দেবে¾কী ভাবব, কীভাবে ভাবব। বড় ব্যবসায়ী, একচেটিয়া মালিক, বহুজাতিক সংঘ, ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র¾সকলেই ধর্মকে এখন আর শুধু আফিং-এর মতো ঝিম-ধরানো মাদক হিসাবে নয়, হিংস্র উত্তেজনায় তাতানো মাদক হিসাবে কাজে লাগাতে চায়। এবং এই কাজ শুরু হয়েছে বেশ অনেক কাল আগে থেকেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষার পাঠ্য বিষয়ের মধ্য দিয়েও যুক্তি বিরোধী ধ্যান ধারণা ও নানা অসত্য কথা প্রচার করা হচ্ছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, উন্নত দেশগুলিতেও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আমেরিকার বিশিষ্ট প্রগতিশীল ইতিহাসবিদ জেম্স রবিনসন (১৮৬৩-১৯৩৬) ইউরোপ আমেরিকার মতো জ্ঞানেবিজ্ঞানে শিল্পে অগ্রসর দেশগুলিতে এই জাতীয় ঘটনা লক্ষ করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। [Robinson 1934, Chapter 14] পরবর্তীকালে দেখা গেল, দেশে দেশে সরকারি ক্ষমতায় যারা বসে আছে, সংবাদপত্র, রেডিও, টিভির বিভিন্ন চ্যানেলের মালিক যারা¾সকলেই এই দায়িত্ব কম বা বেশি পালন করে যাচ্ছে। লক্ষ একটাই¾বর্তমান শোষণমূলক শাসনব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত ও নিরাপদ রাখা।
বিজ্ঞানীদের অধিকাংশই এই সব ব্যাপারে উদাসীন বা নীরব। কিন্তু যাঁরা সোচ্চার হতে চান তাঁদেরও লিখতে বা বলতে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। ধর্মকে সমর্থন করে লিখলে অত্যন্ত নিম্ন মানের লেখাও প্রতিষ্ঠিত পত্র-পত্রিকায় বেরিয়ে যাবে। ধর্মকে বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদকে আশ্রয় করে কিছু লিখলে তা যত উঁচু মানেরই হোক না কেন, সহজে কোথাও প্রকাশিত হবে না। রেডিও বা দূরদর্শনের বিভিন্ন চ্যানেলের বিজ্ঞান বিষয়ক অনুষ্ঠানের বক্তা নির্বাচনেও একই রকম বিষম মাপকাঠি। এমনকি লোকপ্রিয় বিজ্ঞানের বইপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা দেখা যাচ্ছে। এই সব পরিকল্পনার সাহায্যে সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে এরকম একটা ধারণা ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা চলছে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীই ধর্মের হয়ে ওকালতি করেন, কেন না তাঁরা বুঝেছেন যে ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের কোনো বিরোধ নেই। তাদের বেশিরভাগই জানতেই পারছে না যে আর একদল সমকক্ষ বড় মাপের বিজ্ঞানী আবার ধর্মবিশ্বাসকে সম্পূর্ণভাবেই জ্ঞানরহিত যুক্তিবিরোধী ও অনৈতিক বলে মনে করেন। এবং সুযোগ পেলে তা প্রমাণ করে দেখাতে পারেন। অর্থাৎ, আজকের দিনে ব্রুনো গ্যালিলেওদের দৈহিক দিক থেকে আঘাত না করেও গণমাধ্যমের নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্বের আড়ালে তাঁদের মুখ বন্ধ করে দেবার ব্যবস্থা হচ্ছে। এই ঘটনাই ঘটছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ইংল্যান্ড ফ্রান্স জার্মানিতে, জাপানে কিংবা ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে এই বিপজ্জনক প্রবনতা লক্ষ করে একজন বিশিষ্ট গ্যালিলেও-গবেষক গভীর উদ্বেগে বলেছিলেন: “Recent events have created a new alarm concerning the unchecked progress of scientific knowledge. This time it is not the church but the state which feels morally obliged to impose external limitations upon the freedm of scientific inquiry and the communication of knowledge and opinion.” [Drake (ed.) 1957, 6] বিগত দশকগুলিতে এই প্রবণতা কমা তো দূরের কথা, ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
বিজ্ঞানের উপর, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর, যুক্তিবাদের উপর এই যে বিশ্বব্যাপী বহুদৃশ আক্রমণ চলছে, এই পরিস্থিতিতে ব্রুনোর জীবন সংগ্রাম, সেই সময়কার ইতিহাস আজ আবার আমাদের উপযুক্ত গুরুত্ব সহকারে স্মরণ ও চর্চা করা দরকার। তার মধ্য থেকে আমরা হয়ত অনেকটাই প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রেরণা লাভ করতে পারি।
সহায়ক গ্রন্থসূত্র
সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৯৯২), “গালিলিও”; সত্যেন্দ্রনাথ বসু রচনা সঙ্কলন; বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা।
সমরেন্দ্র নাথ সেন (১৯৯৪), বিজ্ঞানের ইতিহাস (অখণ্ড); শৈব্যা, কলকাতা।
The Holy Bible, King James Version.
Catholic Encyclopaedia (1999), Vol. III, “Bruno, Giordano”; New York.
Stillman Drake (ed. 1957), Discoveries and Opinions of Galileo: Anchor Books, Doubleday, New York.
James Jeans (1947), The Growth of Physical Science; Cambridge University Press, Cambridge.
S. C. Joshi (1974), “Nicolaus Copernicus and the ‘Commentariolus’”, Indian Journal of History of Science; 9 (1), 14-24
James Harvey Robinson (1934), The Mind in the Making; Watts and Co., London.
M. N. Roy (1943), From Savagery to Civilisation; Renaissance Publishers, Bombay.
A. D. White (1960), A History of the Warfare of Science with Theology; Vols. I-II; Dover Publications, New York.