শ্রীলঙ্কা ধ্বংসের কারণ কি লুকিয়ে আছে বিশ্ব-মন্দার মধ্যে?

তারাশঙ্কর ভট্টাচার্য
ব্রিটিশরা এই দেশটিকে বলতেন “জুয়েল অফ ক্রাউন”। মাত্র ২২ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ শ্রীলঙ্কা ,শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক ঋণের বোঝায় হিমসিম খাচ্ছিল। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া, প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দে রাজাপক্ষে। পারিবারিক শাসন শ্রীলঙ্কায়। গতকাল দুজনেই দেশ ছেড়ে ভাগলবা। আগামী ২০ শে জুলাই নির্বাচনের মাধ্যে শাসক দলের বিক্রম সিংঘে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে চলেছেন। জনগণ এই নির্বাচনের বিরোধিতা করছে।
বিভিন্ন কারণের ফল হিসেবে বিশ্বজোড়া মহামন্দাকে তো ধরাই যায়। তাছাড়া অভ্যন্তরীন কিছু কারণ তো আছেই শ্রীলঙ্কার এই দুরাবস্থার পিছনে। যেমনঃ-
করোনারা ফলে –
১) ট্যুরিজম বন্ধ। জিডিপির ১০ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে পর্যটন শিল্প বন্ধ হয়ে যায়, রাজস্ব আদায় মার খায়, পর্যটন শিল্পে দু’লক্ষ মানুষ বেকার হয়ে যায়।
২) ১৪ বিলিয়ন ডলার লোকসান হয়।
৩) ২০২১ এর নভেম্বরে দেশে মূদ্রাস্ফীতি ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ৫০ লক্ষ মানুষ তখনই দারিদ্রসীমার নীচে নেমে যায়। কারেন্ট একাউন্ট ডেফিসিট বড় কারণ।
৪) আমদানি মূল্য মেটাতে না পারায় দ্রব্যমূল্য আকাশ ছুঁয়ে ফেলে।
৫) বিদেশী ঋণ বাবদ প্রিমিয়াম ৬৯০ কোটি ডলার বাৎসরিক পরিশোধ করতে হবে। অথচ রিজার্ভ মাত্র তখন ২৩১ কোটি ডলার। প্রুডেনশিয়াল নর্মস অনুযায়ী নন-পারফর্মিং এসেটে পর্যবসিত হয় দেশের এসেট।
৬) এরপর কর কমানোর সিদ্ধান্তে গলায় ফাঁসটা শক্ত হয়ে যায়।
৭) গত দু’বছরে এলাচ আর দারুচিনি উৎপাদন মার খাওয়ায় রপ্তানি থেকে আয় বন্ধ হয়ে যায়।
এছাড়াও ১৯৮৩ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশ। এই ২৬ বছর ধরে চলা তামিল বিদ্রোহীদের সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শ্রীঙ্কা সবচেয়ে বেশী বিধ্বস্ত হয়। প্রায় ৪০ হাজার প্রতিবাদীকে হত্যা করা হয়।
গত ফেব্রুয়ারিতে দেশের রিজার্ভ ছিল ২৩০ কোটি ডলার মাত্র। এই দিয়ে বৈদেশিক ঋণশোধ, আমদানি মূল্যব্যয় মেটানো সম্ভবই ছিল না।
ঋণের বোঝাঃ-
১) চীনের কাছ থেকে ঋণ শ্রীলঙ্কার কাছে একটি ফাঁদ হয়ে দাঁড়ায়।
২) এদিকে চীন শ্রীলঙ্কার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বুঝে ‘বেল্ট এ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পে হাম্বারটোটায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ
এবং কলম্বোয় চাইনিজ সিটি নির্মাণ সহ বিভিন্ন প্রকল্প নেয়। হাম্বারটোটা বন্দর থেকে আয় না হওয়ায় শ্রীলঙ্কা চীনকে এই বন্দরটি ৯৯ বছরের লিজে দিয়ে দেয়। কলম্বোয় সিটি পোর্ট নির্মাণের উদ্যোগে শ্রীলঙ্কান সরকারের জিভ বেরিয়ে যায়। দেড় বিলিয়ন ডলার এবাবদ ঋণ নিয়েছিল চীন থেকে। মোটমাট গত দশ বছরে চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল ৫ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক এবং জাপানের কাছ থেকেও ঋণ নিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। অবকাঠামো নির্মাণ এবং আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ড বিক্রি করে শ্রীলঙ্কা ১২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের ফাঁদে আটকা পড়ে যা নিয়োজিত হয় অথচ আয় রিটার্ন পায় না।
এখন চলছে বিশ্ব-মহামন্দার সময়। বরিস জনসন ইংল্যান্ডের গদি থেকে সপার্ষদ পদত্যাগ করেছেন। সেদেশের ৪০ শতাংশ মানুষ আয়ের নিম্ন সীমায় নেমে গেছে। আমেরিকায় মূদ্রাস্ফীতি ৭.৪ শতাংশে পৌঁছে গেছে। জার্মানীতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি অসহনীয় হয়ে উঠছে। জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে আততায়ীর হাতে খুন হতে হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার ডলার রিজার্ভ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। পাকিস্তান বেঁচে আছে নাকি কাঠামোটুকু বেঁচে আছে তাও আমরা জানি না।
ইস্তাম্বুল তুরস্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। রাজধানী আঙ্কারা। ইস্তাম্বুলের মেয়র বিরোধী দলের নেতা। সে চিৎকার করছে যে এরদোগান তার ব্যবসায়ী বন্ধুদের সাহায্য করছে। অথচ মূল্যবৃদ্ধির হার ৮০ শতাংশ বেড়েছে।শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, তুরস্ক, ইউক্রেনই, ইংল্যান্ডই শুধু ধ্বংস হয়নি,আর্জেন্টিনার অবস্থাও খারাপ। সেখানকার অর্থনীতিমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন।বিষয়টি সামাল দেওয়া যায়নি। নতুন কেউ আসতে না চাইলেও কোথাও থেকে কাউকে ধরে আনা হয়েছে। আর্জেন্টিনার মুদ্রা পেসোও ডলারের বিপরীতে কমে গেছে। ভারতের মুদ্রার তুলনায় ডলারের দাম বেড়ে ৮০ টাকা।
জাপানের অবস্থাও খারাপ। এর মুদ্রা ইয়েনও দুর্বল হয়ে পড়েছে। মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে।
লেবানন, রাশিয়া, সুরিনাম এবং জাম্বিয়া ইতিমধ্যেই বিপদসীমার অনেক উপরে রয়েছে, বেলারুশ দ্বারপ্রান্তে রয়েছে এবং কমপক্ষে আরও এক ডজন দেশ বিপদ অঞ্চলে রয়েছে। এটাই নি নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার?
২০০১ এ সেই যে পুঁজিবাদের মহামন্দা শুরু হয়েছে, ২০০৮ এর সাব-প্রাইম ক্রাইসিস হয়ে মন্দা এখন বিশ্বজুড়ে দানবীয় আকার নিয়েছে। এদিকে ফসিল ফুয়েলের ভান্ডার অন্তিম লগ্নে। পুঁজিবাদ অন্তিম লড়াই চালাচ্ছে উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার বিকল্প ফুয়েলের আবিষ্কারের জন্যে। এদিকে ২০০ টি রাষ্ট্র সহ প্রতিবাদী জনগণ আওয়াজ তুলেছে বিশ্ব-উষ্ণায়ন রোধে, প্রকৃতি মেরামতের উদ্যোগ পুঁজিবাদকেই নিতে হবে। এযাত্রায় পুঁজি তার মহামন্দার তসলা থেকে গলাটা কি বের করে আনতে পারবে?
তারাশঙ্কর ভট্টাচার্য : প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী।

3 Comments
ভালো বিশ্লেষণ
খুব ভালো
বিশ্ব অর্থনীতির হাল হকিকত ভালো বোঝা গেল।