• March 25, 2023

চিত্রকলার উপনিবেশায়ন : উন্মেষপর্ব (পর্ব-১)

 চিত্রকলার উপনিবেশায়ন : উন্মেষপর্ব (পর্ব-১)

ফকরুল চৌধুরী :- কালজয়ী ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, আজও সজীব ও প্রাণবন্ত। তার ‘ইছামতি’ উপন্যাসে তৎকালীন গ্রামসমাজ, রাজনীতি এবং ঔপনিবেশিক শক্তির কর্মকাণ্ডের প্রামাণ্য দলিল বিশেষ। এ উপন্যাসে মূল আখ্যানের পাশাপাশি কিছু মুগ্ধকর অনুআখ্যান এবং চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। আমরা এমনই একটি স্বল্পপরিসরের চরিত্র নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করব।
ইছামতি’র যে অংশ নদীয়া ও যশোর জেলার মধ্যে অবস্থিত, সে অংশটুকুর রূপ, লেখকের ভাষায় ‘সত্যিই এত চমৎকার, যাঁরা দেখবার সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা জানেন।’ আর এই ইছামতির পারের মোল্লাহাটি নীলকুঠি ঘিরে তৎকালীন সমাজের সামগ্রিক রূপচিত্র অংকিত হয়েছে উপন্যাসে। উপন্যাসে রয়েছে অতিজ্জ্বল কিছু চরিত্র- কুঠিয়াল শিপ্টন সাহেব, গয়ামেম, দেওয়ান রায়মশায় ওরফে রাজারাম রায়, নালু পাল, ভবানী বাঁড়ুয্যে, রামকানাই কবিরাজ, তিলু, ডাকাত হলধর। আরো রয়েছে স্বমহিমায় প্রকাশিত কিছু ছোটখাটো চরিত্র। আশ্চর্যজনকভাবে প্রতিটি চরিত্র অত্যন্ত প্রাণবন্তু, সজীব এবং যথাযথ। একই উপন্যাসে এতগুলো চরিত্রের সমাগম আমাদের প্রাণীত করে। একটি জনপদের যাপন, সময়ের ভাঙন, উপনিবেশায়নের বিকাশের ধারা উপস্থাপনের মাধ্যমে উপন্যাসটি ইতিহাসচর্চার প্রতিরূপের ভূমিকায় অবতীর্ণ। ফিকশন যে কখনো কখনো ইতিহাস হয়ে উঠতে পারে ‘ইছামতি’ তার স্বাক্ষ্য বহন করে।
ইছামতি উপন্যাসটি ইতিহাসের সে-সময়ের একটি খণ্ডচিত্র, যে-সময়টাতে ব্রিটিশ কোম্পানীর শাসন-শোষনে উপনিবেশায়নের প্রক্রিয়া বারোআনা সম্পন্ন, এটা তখনকার আখ্যান। শুধু শাসকশ্রেণী নয়, ইংল্যাণ্ডের আমজনতার কাছে ভারতীয় উপনিবেশ ছিল সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস। এদেশে এলে অনায়াসে ‘নবাব’ হওয়া যায় এই বিশ্বাস ছিল তাদের প্রগাঢ়। ফলে ভাগ্যান্বেষে এদেশে ছুটে আসেন অনেক বেকার ও হতাশাগ্রস্ত তরুণ-যুবা। বখাটে, উড়নচণ্ডি, জীবনযুদ্ধে পর্যদস্তুরা। গ্রাম্য ইংল্যাণ্ডের চাষাভুষো পরিবার থেকে এসে বনে গেছে রীতিমতো নীলকুঠির বড় ম্যানেরজার, কুঠিয়াল সাহেব। দরিদ্র কালা আদমীদের ওপর এখানে রাজা সেজে চেপে আছে। অথচ দেশে থাকলে হয়তো কোন জমিদারের ফার্মহাউসে লাঙল চষতো।
বিভূতিভূষণ উপন্যাসে যে-ব্যপ্তি তুলে ধরেছেন তা এ লেখার আলোচনার বিষয় নয়। আমরা উপন্যাসের ছোট্ট একটি চরিত্রকে উপলক্ষ করে কিছু কথা বলব। তিনি কোল্সওয়ার্দি গ্রান্ট। ‘বয়েস ত্রিশ থেকে পয়ঁত্রিশের মধ্যে, পাদ্রিদের মতো উঁচু কলার পরা, বেশ লম্বা দোহারা গড়ন।’ বিলেত থেকে নতুন এসেছেন, ‘দেশভ্রমণ করতে ভারতবর্ষে এসেচেন।’ গ্রান্ট যা করেন, ‘খুব ভালো ছবি আঁকেন এবং বইও লেখেন। সম্প্রতি বাংলার পল্লীগ্রাম সম্বন্ধে বই লিখছেন।’ মি. গ্রান্ট দেওয়ান রায়মশায়কে দেখে এই ‘Bengalee Gentleman’ -কে স্কেচ করার বিষয় হিসাবে লুফে নিলেন। গ্রান্ট সাহেব এক টুকরো রঙিন পেন্সিল হাতে নিয়ে শিপ্টম মেমের সহযোগিতায় দেওয়ানকে সুবিধামতো দাঁড় করিয়ে ঘন্টা খানেক আঁকলেন। তবে চোখ মুখ তখনো দেয়া হয়নি। এ অবস্থায় রাজারামের অনুভূতি, ‘বা রে, কি চমৎকার করেচে সাহেবটা।’ যেন অবিকল তিনি দাঁড়িয়ে আছেন।

রাজারামের ভগ্নী তিনটির বয়স যথাক্রমে ত্রিশ, সাতাশ ও পঁচিশ। ভবানী বাঁড়ুয্যে, বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছি। গ্রামের চন্দ্র চাটুয্যের দূর সম্পর্কের ভাগ্নে। ‘সন্নিসি হয়ে গেইছিল।’ বেশ সুপুরষ। ভবানীর সঙ্গে শুভ গোধূলি-লগ্নে তিন বোনেরই একসঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল।
বাড়ির মধ্যে তিনটি স্ত্রীকে নিয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়া অবস্থা থেকে বেরিয়ে ভবানী নদীর ধারে এক বটতলায় গিয়ে বসেন। পাশে একটি সন্ধ্যামনি ফুলগাছের খুব কাছেই ধ্যানে বসেন। এটা তার সন্ন্যাসী জীবনের বহুদিনের অভ্যাস। হঠাৎ অপরিচিত ও বিজাতীয় কণ্ঠস্বরে তিনি চমকে উঠেন, ‘দেখেন একজন সাহেব গাছের গুঁড়ির ওদিকে একটি মোটা ঝুড়ি ধরে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে বিস্ময় ও শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।’ ধ্যানরত ভবানীকে দেখে সাহেব গ্রান্ট থমকে দাঁড়িয়ে বলে উঠেন, ‘An Indian Yogi!’ সাহেব ভবানীর স্কেচ করলেন। সাহেবের ফরমাস মতো ঠায় চার দণ্ড দাঁড়িয়ে বাড়ি ফিরলেন ভবানী। তিলুকে দেখে তার উপলব্ধি হল, ‘নিখুঁত সুন্দরী নয় বটে, কিন্তু অপূর্ব রূপ ওর। যেমন হাসি-হাসি মুখ, তেমনি নিটোল বাহুদুটি। গলায় খাঁজকাটা দাগগুলি কি চমৎকার তেমনি গায়ের রং। সন্ধেবেলা দেখাচ্ছে ওকে যেন দেবমূর্তি।’ তিলুকে বললেন, ‘তোমার একটা ছবি আঁকতো সাহেব, তবে বুঝতো যে রূপখানা কাকে বলে।’ পরের দিন তিলুকে ঢাকাই শাড়ি পরিয়ে ভবানী বটতলায় গেলেন, সাহেব ছবি আঁকবেন। তারপর গ্রান্ট সাহেব ‘Queenly beauty’ ‘তিলুর সলজ্জ ও অপূর্ব কমনীয় ভঙ্গির একটা আল্গা রেখাচিত্র আঁকতে চেষ্টা করলেন।’
এরপর উপন্যাসে একটি তথ্য, “১৮৬৪ সালে প্রকাশিত কোলস্ওয়ার্দি গ্রান্টের ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান লাইফ ইন রুরাল বেঙ্গল’ নামক বইয়ের চুয়ান্ন পৃষ্ঠায় ও সাতান্ন পৃষ্ঠায় ‘এ বেঙ্গলি উম্যান’ ও ‘অ্যান ইন্ডিয়ান ইয়োগী ইন্ দি উড্স’ নামক দুখানা ছবি যথাক্রমে তিলু ও ভবানী বাঁড়ুয্যের রেখাচিত্র।” (প্রথম পর্ব, চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Related post