রাজনৈতিক দলগুলোতে মুসলিম নেতাদের প্রকৃত দশা

শাহনওয়াজ আলী রায়হান
আগে যখন হুগলি শিল্পাঞ্চলের চটকলগুলোতে শ্রমিক আন্দোলন হত, সেগুলোতে তখন প্রায়ই দেখা যেত একজন শ্রমিক নেতা তাঁর নেতৃত্বগুনে সবাইকে এক ছাতার তলায় এনে মালিকপক্ষের সামনে দাবীদাওয়া পেশ করছে, জনপ্রিয় হচ্ছে। অনলবর্ষি বক্তব্য দিয়ে সবার মন জয় করছে। পরে একদিন উপরমহল নমনীয় হওয়াই মালিকদের সঙ্গে বসার কথা হল, গেটের বাইরে শ্রমিকদের রেখে সে তাঁদের প্রতিনিধি হয়ে ঝাঁ চকচকে অফিসটার বাতানুকূল ঘরে কথা বলতে ঢুকল। এদিকে গেটের ওপারে শ্রমিকদের মনে উৎকন্ঠা মিশ্রিত আশা ভরসার অবস্থা। ফিরে এসে শ্রমিক নেতা জানাল যে, মালিকপক্ষকে তাঁরা যতটা খারাপ ভাবত, আদতে ততটা না। মালিকেরা শ্রমিকদের যে দাবিটা মেনেছে সেটা জানিয়েই সঙ্গে আরও হাজারটা শর্ত যে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের দিয়েছে এবং সেটা মানা যে উচিৎ–সেটাও জানিয়ে দিত। কারও আর বুঝতে বাকি রইল না কালকের আগুনঝরানো শ্রমিক নেতা নিজেকে বিক্রি করে এসে এখন মালিকপক্ষের প্রতিনিধি হয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে আপোষরফা করতে এসেছে। এসব দৃশ্য সিনেমাতেও অনেক দেখে থাকবেন।
বাংলার মুসলমানদের দশা ঠিক এরকমই । যে নেতাটা কাল সংখ্যালঘুরা বঞ্চিত বঞ্চিত করে মুখ দিয়ে ফেনা তুলে, বড় বড় রাজনৈতিক দলেরই ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্রান্তের পর্দা ফাঁস করে, পিছিয়ে পড়া জাতিকে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়– সেই নেতাই পরদিন তার সামনের জনসমাগমকে পুঁজি করে ওইসব বামুন দলগুলোর নিপীড়কদের একটু পায়ের ধুলো, একটা ভোটের টিকিট, একটা লালবাতির গাড়ি, মন্ত্রিসভায় একটি নাম কা ওয়াস্তে পদ পেলেই কেমন ঘুরে যায়। গ্রামের যে মুসলিম ছেলেটা একটু সাহিত্য পড়ে, লিখতে পারে, সে জুতোর শুকতলা ক্ষয় হওয়ার পর একদিন কলকাতার বড় পত্রপত্রিকায় তার একটা লেখা বেরোলই তখন লেখার গুনগত মান উন্নয়নের জন্য আরও পড়াশোনা করার বদলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠর মানদন্ডে নিজের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমানে — তার সম্প্রদায় কত ধর্মান্ধ আর সে কতটা প্রগতিশীল এইসব গালগল্প দিয়ে শর্টকাটে জনপ্রিয় হতে। ফুটেজ পায়ও, বাম-ডানের কাছ থেকে অল্টারনেট করে পিঠ চাপড়ানি । মনের রোগ বাড়তেই থাকে। লেখার মান পড়তে থাকলেও সংখ্যালঘুর প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠর পুষে রাখা বিদ্বেষগুলোকে নিয়ত কনফার্মেশন দেয়ার ফলে সার্কিটে টিকে থাকে।
লেখকের মত নেতাটাও টিকে থাকে কোটা আর টোকেনের ফলে। তার সেই মুসলিম পরিচয় পার্টিগুলোর নির্বাচনের সময় সম্পদ। যে নেতার সেই মুসলিমত্ব দলগুলো মনে করে সংখ্যলঘুরা তেমন খাচ্ছে না , তাকে একবার রাজ্যসভা বা রাজ্য সরকারের কোনও অখ্যাত সংস্থায় চেয়ারম্যান-প্রেসিডেন্ট করে সাইডলাইন করে দেয়া হয় ! অনুগত ভৃত্য সেটা পেয়েই খুশি–লাল বাতির গাড়িটা তো সঙ্গে থাকবে কিছু বছর ! তারাই আবার মুসলিমদের সামনে এলে নানা বক্তব্যে, টুইটার-ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে, পলিটিক্যাল নসবনামা টেনে প্রমান দেয়ার চেষ্টা করবে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সে কতটা আপন। অথচ কাজের সময় এলে লবডঙ্কা। এদের যত হুংকার জেলায়—মুসলিমদের সামনেই । কলকাতা এলেই , দলের অভ্যন্তরে সব ভেজা বেড়াল। দলও জানে এরা তাদের না, তারাও জানে দলটা আমাদের না। একে অপরের স্বার্থ পূরণে একটা ফ্রেন্ডশিপ উইথ বেনিফিটস টাইপ সাময়িক হাত না ছুঁয়েই হাত মেলানো !
এইসব আজকের গল্প না, যে দলই বাংলায় ক্ষমতায় থাক পশ্চিম বাংলার মুসলিম সমাজে এইসব সবদিনেরই গল্প। এই গল্প সিনেমায় দেখেননি হয়তো, কিন্তু আমরা রোজ দেখি। করবেন নাকি এগুলো নিয়ে একটা সিনেমা ? পার্টিতে যতই নগণ্য হোক– এদের গল্পের সঙ্গে কিন্ত ‘নায়ক’-এ উত্তমকুমারের ‘অরিন্দম’ চরিত্রের মিল আছে ! রোজ এখানে একটা করে অরিন্দম জন্মাচ্ছে,মারা যাচ্ছে, আবার একটা উঠতি যুবক অরিন্দম হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। যে কিছুটা নায়ক হয়ে গেছে বড় নায়কদের আলোয় আলোকিত হয়ে, সে কিন্তু স্বল্পখ্যাতির আড়ালে তার মনের মধ্যে থাকা একাকিত্বের গল্প শুনাবে এমন কোনও অদিতির (শর্মিলা ঠাকুর) মত সাংবাদিক খুঁজে পাচ্ছে না। কারণ কাগজের অফিসগুলোর তো চায় সন্ত্রাস,বোম, আল কায়দা,খুন এইসব গরম গরম টপিক। নইলে খামোখা গেঁয়ো মোসলমানের মনের খবর তারা ছাপবে কেন ? পাবলিক খাবেও না । আর কেউ তা ছাপলেই নেতাটির লালবাতির গাড়ি পরদিন ভ্যানিশ !
তোমার মন নেই কুসুমুদ্দিন, আছে গোলামী — মানসিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সব!
শাহনওয়াজ আলী রায়হান : গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
