জীবনের জন্য লড়াই

মিলন মালাকার
“স্বাধীনতা হচ্ছে এমন একটা অধিকার যা প্রতিদিনই প্রতিটি ব্যক্তিকে তার নিজের স্বার্থেই রক্ষা করার ব্যাপারে সজাগ থাকতে হয়। কারণ, প্রজাদের ঐদাসীন্য ও ভীরুতা যদি স্বৈরাচারকে উৎসাহিত করার মতো হয় তবে অত্যন্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও অত্যাচারী হয়ে উঠতে চায়।”
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৭ অক্টোবর, ১৯৩৭ লণ্ডনের এক জনসভায় প্রেরিত চিঠি)
কথিত আছে, এ দেশে মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের পুত্র হুমায়ুন একবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং কোনো চিকিৎসায় তাঁর রোগের উপশম হচ্ছিল না, তিনি ক্রমশঃ মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছিলেন। একমাত্র পুত্রের সম্ভাব্য বিয়োগব্যথায় কাতর হয়ে রোগশয্যার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে সম্রাট বাবর খোদার কাছে প্রার্থনা জানান, পুত্রের রোগমুক্তির কামনায় বলেছিলেন, “তুমি আমার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ নিয়ে আমার পুত্রকে রোগমুক্ত করো।” তারপর দিন থেকে হুমায়ুন নাকি একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠতে থাকেন এবং সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু বাবর অসুস্থ হয়ে মারা যান।
নিকোলাই অস্ত্রভস্কির বিখ্যাত উপন্যাস ‘ইস্পাতে’ আমরা পেয়েছি এই উক্তি যে, “মানুষ সবচেয়ে ভালবাসে তার নিজের জীবনকে।”
নিজেরাও বাস্তবে দেখেছি, দেখছি যে মৃত্যু অবধারিত জেনেও মুমূর্ষু বৃদ্ধও বেঁচে থাকতে চাইছেন। সব প্রাণী তো জীবন একবারই পায় এবং সেই জীবনকে সে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, ভালবাসে। মানুষের জীবন ও কিছু লুপ্ত প্রায় প্রজাতির প্রাণী বাঁচিয়ে রাখার জন্য বা তার অস্বাভাবিক মৃত্যু আটকানোর জন্য সব দেশেই নির্দিষ্ট কিছু আইন ও চিকিৎসা পরিকাঠামো আছে। আমাদের দেশের সংবিধানে অযথা প্রাণ না হারানোর মৌলিক অধিকার দেওয়া আছে ২১ নং অনুচ্ছেদে। একই ধারায় প্রত্যেক ব্যক্তিকে জীবনের নিরাপত্তা ও অবাধ চলাচল, জীবন যাপনেরও অধিকার দেওয়া আছে। দেশের প্রচলিত আইনে নির্দিষ্ট কিছু অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিই কেবল অবাধ চলাচল ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকার হারাতে পারেন।সংবিধানের মৌলিক অধিকার ঘোষণা সম্বলিত তৃতীয় অধ্যায়ের ২২ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তাৎক্ষণিক তার বিরুদ্ধে আনিতো অভিযোগ জানাতে হবে এবং চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে নিকটবর্তী আদালতে হাজির করাতে হবে বিচারের জন্য এবং ধৃত ব্যক্তিকে তাঁর পছন্দের আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে।। পুলিশ ছাড়া আর কাউকে গ্রেপ্তার করার অধিকার দেওয়া হয়নি। আবার গ্রেপ্তারকারী পুলিশ বা সংস্থা গ্রেপ্তার ও তদন্ত করতে পারে আনিতো অভিযোগের প্রমাণ আদালতে পেশ করার জন্য। নিরপেক্ষ বিচার প্রক্রিয়ার পর অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে বিচারকের রায়ে শাস্তি পেতে পারেন ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী, যা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা প্রাণদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু পুলিশ বা অন্য কেউ অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কোন রকম শাস্তি(শারীরিক/মানসিক/আর্থিক)দিতে পারবে না।
আবার জীবনের অধিকার মানে তো শুধুই কোন মতে বেঁচে থাকা নয়, বাঁচাটা হতে হবে মানবিক মর্যাদার সঙ্গে বাঁচা। অর্থাৎ ব্যক্তির শিক্ষা, চিকিৎসা, আবাস, পরিধান, খাদ্য, বিনোদনের ন্যূনতম চাহিদা পূরণের সুবিধা থাকতে হবে। নইলে মানুষ কেন বনে বা পাহাড়ে খাদ্য-আহরণকারীর ভূমিকা ত্যাগ করে খাদ্য ও অন্যান্য আবশ্যিক সামগ্রী উৎপাদন, মজুত, ভোগ করবে? অবশ্য এই মজুত ও ভোগই মানুষের সমাজে আমদানি করেছে এক সময় অসাম্য, বৈষম্য যার জন্যই গড়ে ওঠে বঞ্চিতদের মধ্যে অধিকার বোধ, অধিকারের জন্য লড়াই। আইন, আদালত, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন, নিরাপত্তারক্ষীদের নিয়ে গড়া আধুনিক রাষ্ট্র তার সব নাগরিকদের মানবিক মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য কিছু সুবিধার ব্যবস্থা করে। নইলে নাগরিকেরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে। ১৯৪৮ সালের ১০ই ডিসেম্বর রাষ্ট্রসংঘের প্যারিস অধিবেশনে যে ত্রিশ দফার মানবাধিকার সনদ গৃহীত হয়েছিল তার প্রারম্ভিক ভাষ্যে নাগরিকদের বিদ্রোহ করা থেকে বিরত রাখার জন্যই ত্রিশটি অধিকার নিশ্চিত করার পরামর্শ দেওয়া আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, সহ-নাগরিকদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ রাষ্ট্রের বা তার মদতপুষ্ট বাহিনীর আচরণ রাষ্ট্রসংঘকে বাধ্য করেছিল মানুষে মানুষে ধর্ম, লিঙ্গ, বর্ণ, মুখের ভাষা বা অন্য কোনো কারণে বৈষম্যমূলক আচরণ করা থেকে বিরত থাকার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে পরামর্শ দিতে। আমাদের দেশের সংবিধানে ও বিভিন্ন আইনে এই পরামর্শগুলো লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।
বাস্তব কিন্তু অন্য রকম বলে। অসাম্য, বৈষম্য সৃষ্টি করা বা সৃষ্ট অসাম্য, বৈষম্য বজায় রাখাই রাষ্ট্র নায়কদের, তার অনুগত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অঙ্গগুলোর কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃটিশ শাসকেরাই তো আমাদের দেশে আধুনিক ব্যক্তি-রাষ্ট্র ব্যবস্থা আমদানি করেছিল। আইন-আদালত, পুলিশ, কারাগার, প্রশাসনিক দপ্তর, নির্বাচন প্রক্রিয়া ইত্যাদি তৈরি করেছিল। কিন্তু তারাই আবার জোর করে তাদের পছন্দের নীল চাষ করতে চাষীদের বাধ্য করেছিল। অনিচ্ছুকদের জমিহারা করতে, শারীরিক নির্যাতন করতে, পরিবারের মহিলাদের যৌন নির্যাতন করতে দেখা গিয়েছে বারবার। এই আচরণের বিরুদ্ধেই আমাদের দেশেও অধিকার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। স্বাধীনতা পিয়াসিদের উপর ‘সুসভ্য’ বৃটিশ শাসক তার বর্বরতার স্বাক্ষর রেখেছে বারবার অধীনস্থ দেশগুলিতে। তার বিরুদ্ধেও অধিকার আন্দোলন হয়েছে। কারণ স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। নৃশংস জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড রাওলাট আইনের বিরোধীদের দমন করার জন্যই। মানবতাবাদী কবি রবীন্দ্রনাথ তার প্রতিবাদে বৃটিশদের দেওয়া নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন, কংগ্রেসের কোনো নেতার কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে একক উদ্যোগে কলকাতার অক্টারলনি মনু্মেন্টের(আজকের শহীদ মিনার) তলায় বিক্ষোভ সভা করেছিলেন। কিন্তু এই সমস্ত প্রতিবাদ বা প্রতিবাদী প্রক্রিয়া সবই ছিল মূলত কয়েক জনের ব্যক্তি উদ্যোগ। ১৯৩৬ সালে প্রথম সংগঠিত উদ্যোগ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সাম্মানিক সভাপতি ও সরোজিনী নাইডুকে কার্যকরী সভাপতি করে ইন্ডিয়ান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন গড়ে উঠল।(যদিও তার আগেই মাদ্রাজ শহরে এমন এক উদ্যোগ দেখা গিয়েছিল। ১৯৩৬ সালেই গঠিত হয়েছিল মাদ্রাজ সিভিল লিবার্টিজ এ্যাসোসিয়েশন। এটি ১৯৭৬ সালে উঠেও যায়।) ইউনিয়নের প্রথম ঘোষণা পত্রে(২৪-০৮-১৯৩৬, জহরলাল নেহেরু) লেখা হয়েছিল, “রাজনীতি বা অন্য অনেক ব্যাপারে লোকে ভিন্নমত পোষণ করতেই পারেন, কিন্তু নাগরিক অধিকারের জন্য লড়াইয়ে তাঁরা সহজেই ঐক্যমত হতে পারেন।” এই সংগঠন কংগ্রেসী বন্দিদের মুক্তির দাবিতেই সোচ্চার থেকেছে এবং চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি তার সক্রিয়তা হারাতে হারাতে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
১৯৪৭ সালে বিশাল আয়তন ও জনসংখ্যার দেশ ভারতবর্ষকে ভেঙ্গে বৃটিশরা প্রত্যক্ষ শাসকের ভূমিকা থেকে বিদায় নিলেও তার ১৮৬১ সালে গঠিত পুলিশ বাহিনী(যাকে এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের বিচারপতি এ এন মোল্লা ১৯৬১ সালের এক মামলার শুনানিতে দেশের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী সংগঠিত সমাজবিরোধী বাহিনী আখ্যা দিয়েছিলেন; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও পুলিশের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন “উহাদের লালায় বিষ আছে”), তার বিচার ব্যবস্থা, বিচার প্রক্রিয়া ইত্যাদি অবিকৃতই থেকে গেল। শুধু আইনের বইয়ের পাতায় মহারানির জায়গায় ভারত সরকার কথাগুলো বসল, এবং কোনো কোনো দমন-পীড়ন ব্যবস্থা কঠোরতর হল। ১৯৪৯ সালেই(এপ্রিল মাসে) কলকাতায় গণ মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে পাঁচ অগ্রণী মহিলা নেত্রী খুন করেছিল। তার আগে ও পরেও পুলিশের বন্দুক যখন তখন গর্জে উঠেছে প্রতিবাদীদের দিকে। ১৯৫১তে কোচবিহারে রাজপরিবারের বিরুদ্ধে জনতার সমাবেশে, ১৯৫৩তে ছাত্রদের ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে, ১৯৫৯ সালে খাদ্যের দাবিতে কলকাতার জন-সমাবেশে, ১৯৬৬ তে খাদ্য ও কেরোসিনের দাবিতে ছাত্র বিক্ষোভে পুলিশ নির্বিচার গুলি চালিয়েছে, বিক্ষুব্ধদের খুন করেছে, মারাত্মক জখম করেছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত জমায়েত বারবার সাবধান করে দেওয়া সত্বেও সরে না গেলে ছত্রভঙ্গ করার জন্য ন্যূনতম শক্তি প্রয়োগের বিধান আছে। কিন্তু কখনোই তাতে যেন প্রাণহানি বা মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি না হয়, সে ব্যাপারে পুলিশকে সজাগ থাকারও নির্দেশ আছে।কার্যক্ষেত্রে পুলিশই যেন শেষ কথা বলে। এমনকি আদালতও পুলিশের হাজির করা বয়ানকেই অধিক গুরুত্ব দেয়। ১৯৫০ সাল থেকেই বিভিন্ন নামে দমন-পীড়ন-আটক আইন তৈরি হয়। তার নাম কখনও পিডিএ, পিভিএ, ডিআইআর, মিসা, আফস্পা, এসমা, নাসা, টাডা, পোটা, অবৈধ কার্যকলাপ দমন আইন, সাম্প্রতিক কালের বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণ আইন ইত্যাদি। এই সমস্ত আইনগুলো পুলিশকে সাহায্য করেছে যথেচ্ছ গ্রেপ্তার করতে, আটকিয়ে রাখতে, শাসক বিরোধী সমাবেশ, ভাষণ বন্ধ করে দিতে। আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বা প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব হ্রাস করার চেষ্টার নামে সংবিধানের ২২, ১৯ নং অনুচ্ছেদের বিভিন্ন উপঅনুচ্ছেদগুলো অনায়াসে ব্যবহার করা যায়। ৩৫২ নং অনুচ্ছেদের সাহায্যে দেশে ভয়ঙ্কর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বা আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে বা প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এই ধরণের কিছু কারণে গোটা দেশে বা দেশের কোন অংশে জরুরি অবস্থা জারি করা যায়। তখন যথেচ্ছ গ্রেপ্তার, যথেচ্ছ আটক, মতপ্রকাশের অধিকার, সংগঠন, সভা-সমাবেশ করার অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় গোটা দেশেই বা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে। ১৯৭০ সালের পর থেকে গোটা দেশে যথেচ্ছ গ্রেপ্তার, অন্যায় আটক, থানা বা জেল হাজতে বিচারাধীন বন্দিদের হত্যা, হেফাজতের বাইরেও সন্দেহভাজনদের ‘এনকাউন্টারে’র নামে হত্যা ইত্যাদি চলতে থাকে। বিশেষতঃ ‘সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে’ পরিণত করতে চাওয়া যুবক-যুবতী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদরাই ছিলেন পুলিশের লক্ষ্য। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে মেদিনীপুর জেলে দশ জন বিচারাধীন নকশালপন্থী বন্দিকে মেরে ফেলার পর এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটতে থাকে। তবে প্রতিবাদী শ্রমিক, রেল, খনি, সরকারি কর্মচারীরাও পুলিশের রোষানল থেকে রেহাই পাননি। বিচারাধীন বন্দি,আত্মগোপনকারী রাজনৈতিক/সমাজ কর্মী, কাজ হারানো শ্রমিকদের সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছিল। থানা হাজতে, জেলখানায় বন্দিদের উপর নিদারুণ অত্যাচার চালানো হত। নারী ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন প্রায়ই ঘটত। জেল বা থানা হাজতের বাইরেও এমন সব ধিক্কৃত ঘটনা ঘটত। জেলখানার মধ্যেই বেশি ঝামেলা এড়ানোর যুক্তিতে আন্তর্জাতিক পরামর্শ অগ্রাহ্য করে নকশালপন্থী বন্দিদের লোহার বেড়ি(ডাণ্ডা বেড়ি বা শিকলবেড়ি) পরিযে রাখা হয়েছে, সারা দিন এমন ঘরে আটকে রাখা হয়েছে যেখানে শৌচ কাজের ব্যবস্থা নেই। চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হয়নি অসুস্থ হয়ে পড়লেও। অথচ রাষ্ট্রসংঘের নির্দেশ, পায়খানা ইত্যাদির ব্যবস্থা এমন ভাবে তৈরি করতে হবে যাতে বন্দিরা প্রয়োজনে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে ব্যবহার করতে পারেন, বন্দিদের স্বাস্থ্য ও শক্তি রক্ষার্থে যথাযথ পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে এবং একজন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত চিকিৎসক চব্বিশ ঘন্টার জন্যই জেলে রাখতে হবে। মহিলা বন্দিদের উলঙ্গ করে গোটা শরীরে জ্বলন্ত সিগারেটের ছেঁকা দেওয়া হয়েছে, পায়ুদ্বারে ও যোনির ভিতর গরম ডিম, লোহার রড ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ নির্দিষ্ট বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে কোন শাস্তি দেওয়া যাবে না। শুধু পুলিশই নয়, তাদের মদতে বা তাদেরই উপস্থিতিতে শাসক দলের লোকেরাও নানাবিধ নৃশংসতার কাণ্ড ঘটিয়েছে। গোটা দেশ জুড়েই এমন চলতে থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে অন্য সব রাজ্যের চেয়ে মাত্রায় ও সংখ্যায় অনেক বেশি ঘটেছিল। ১৯৭৩ সালে গোটা দেশে নকশালপন্থী বন্দির সংখ্যা যখন প্রায় বত্রিশ হাজার, তখন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বিধানসভায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এই রাজ্যেই ছিল ১৭৭৮৭ জন নকশালপন্থী বন্দি। প্রকৃত পক্ষে কোনো রাজনৈতিক দলও এসবের বিরুদ্ধে মুখ খুলছিল না। জেল ফেরৎ ২/১ জন বামপন্থী কিছু একটা করার ভাবনা নিয়ে পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। সঞ্জয় মিত্র, সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায় পেয়ে গেলেন কপিল ভট্টাচার্য, প্রমোদরঞ্জন সেনগুপ্ত প্রমুখ বেশ কয়েক জনকে। ১৯৭২ সালের ২৫ জুন ১৮ মদন বড়াল লেনের বাড়িতে(কপিল ভট্টাচার্যর বাড়ি) সভা বসলো। গড়ে উঠল গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি(এ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অফ ডেমোক্রাটিক রাইটস বা এপিডিআর)। প্রথমে কিন্তু নাম ঠিক হয়েছিল গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা কমিটি। পরে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ঘোষণা দেওয়া হল, বাইশ দফা দাবি সম্বলিত প্রচারপত্র বিলি হল। প্রথম দিকে, রাজবন্দিদের স্বীকৃতি, তাঁদের মুক্তি, বিচার, অত্যাচার বন্ধ করার দাবিই ছিল। ১২-০২-১৯৭৩ তারিখে এপিডিআরের উদ্যোগে অত্যাচারিতদের মা-বোনেরা মিছিল করলেন, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে স্মারক জমা দিলেন। রাজ্যে তখন কংগ্রেসের সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, আর কেন্দ্রে ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৭৩ সালের জুন মাসে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নামের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন(১৯৬১ সালে তৈরি, লণ্ডনে প্রধান কার্যালয়, বর্তমানে দেড়শোর বেশি দেশে প্রায় এক কোটি সদস্য-কর্মী) আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের তথ্য দিয়ে আবেদন জানায় যে ভারতীয় দণ্ডবিধির ফৌজদারি আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে যাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে কেবল তাদের বিরুদ্ধেই মামলা করা হোক, তাদের বিনা বিলম্বে বিচার শুরু করে শেষও করা হোক, অন্যথায় মুক্তি দেওয়া হোক, তাঁদের স্বাস্থ্যসম্মত ও লেখাপড়া করার মতো সহায়ক পরিবেশ দেওয়া হোক, আত্মীয়-বন্ধুদের সাথে নিয়মিত সাক্ষাৎ এর ব্যবস্থা বজায় রাখা হোক, উপযুক্ত খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা জেলে রাখা হোক। স্বভাবতই রাষ্ট্র প্রধানেরা এই আবেদনে সাড়া দেননি, বরং ওই সংস্থার তথ্যগুলিকে অপপ্রচার আখ্যা দিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে অন্ধ্রপ্রদেশে গড়ে উঠল অন্ধ্রপ্রদেশ সিভিল লিবার্টিজ কমিটি, ১৯৭৬ সালে তামিলনাডুতে অর্গানাইজেশন ফর সিভিল এ্যান্ড ডেমোক্র্যাটিক রাইটস, ১৯৭৪ সালে দিল্লিতে পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ এ্যান্ড ডেমোক্র্যাটিক রাইটস ইত্যাদি নামের বহু নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সংগঠন। মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, নাগাল্যান্ড, আসাম প্রভৃতি রাজ্যেই অনুরূপ সংগঠন গড়ে উঠেছে। আমাদের রাজ্যে এপিডিআর-এর পাশাপাশি লিগাল এইড কমিটি নামের একটি সংগঠনও বন্দিদের স্বার্থে কাজ করতো। ১৯৭৫ সালে দেশে আভ্যন্তরীন জরুরি অবস্থা জারির প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এপিডিআরকে বেআইনী ঘোষণা করা হল, নেতৃ স্থানীয় কয়েক জন গ্রেপ্তার হলেন, ছাপাখানা থেকেই তাদের ‘ভারতীয় গণতন্ত্রের(?) স্বরূপ’ নামের বইটির পাণ্ডুলিপি, হরফ বাজেয়াপ্ত করা হল। ১৯৭৮ সালে ফের এপিডিআর নতুন উদ্যোমে সক্রিয় হয়ে ওঠে। পরে তাদের কর্মসূচিতে আন্তর্জাতিক ত্রিশ দফা মানবাধিকার সনদকে নিয়ে আসে। ফলে শুধুই রাষ্ট্র বিরোধীদের উপর রাষ্ট্র্রীয় নিপীড়ন নয়, আম-জনতার বিভিন্ন মৌলিক চাহিদা নিয়ে কাজও এপিডিআর চালিয়ে যাচ্ছে।কারণ ১৯৭৭ সালের জুনে জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী হয়েই প্রাক নির্বাচনী ছত্রিশ দফা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির ঘোষণা করলেও অচিরেই বামফ্রন্ট সরকারের কাজে, ভাষায়, আচরণে পুরনো শাসকদেরই খুঁজে পাওয়া গেল। পুলিশ ও আমলাদের বাড়াবাড়ির তদন্তে কমিশন গঠন করলেও তাকে পরিণতি পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়নি। থানা হেফাজতে খুন, বিরোধী সমাবেশে পুলিশের হামলা, লাঠি ও গুলি চালানো, যথেচ্ছ গ্রেপ্তার, নকশাল ও পরবর্তীতে মাওবাদীদের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার পক্ষে ভয়ঙ্কর আখ্যা দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সুরে সুর মিলিয়ে মুখ্যমন্ত্রী, পুলিশমন্ত্রী কঠোর হাতে তাদের দমন করার নির্দেশ দিলেন। ২০০০ সালের ২৫ ডিসেম্বর মুখ্যমন্ত্রী পুলিশদের নির্দেশ দিলেন ডাকাত দেখলেই গুলি করতে, হিউমান রাইটস ফাইটস তিনি সামলে নেবেন(সবাই জানেন, শাসকেরা বরাবর রাজনৈতিক বিরোধীদেরও ডাকাত নামেই ডেকেছে)। তার আগেই ঘেরাও আন্দোলন নিষিদ্ধ হয়েছে, শ্রমিক-কর্মচারিদের আন্দোলনেও বিধি নিষেধ আরোপ হয়েছে। অবৈধ কার্যকলাপ দমন আইনের প্রয়োগ করল, শিক্ষা, পরিবহন ও স্বাস্থ্যে বেসরকারিকরণের উপর জোর দিল। উন্নয়নের নামে বলপূর্বক উচ্ছেদ শুরু হল। পুলিশের পাশাপাশি শাসক দলের যুবা বাহিনী অবাধ্যদের শায়েস্তা করতে মাঠে নেমে পড়ল যেমনটা করেছিল সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে প্রিয়-সুব্রতর অনুগামীরা সত্তর দশকের প্রথম দিকে। হুগলির সিঙ্গুরে টাটদের মোটর গাড়ি নির্মাণ ও মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে শিল্প তালুকের নামে কৃষি ও বাস্তু জমি দখল করা, লালগড়ে পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনগণের কমিটির উপর নির্দয় দমন-পীড়ন চালানোর সময় মানুষ আর ধৈর্যের বাঁধ ধরে রাখতে পারেননি। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে পশ্চিমবঙ্গে জীবন ও মর্যাদা রক্ষায় বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
২০১১ সালে বামফ্রন্ট সরকারের বিদায় হলে নতুন যে ‘মা-মাটি-মানুষের’ সরকার এলো রাজ্যে তাদেরও এখন আর পৃথক করা যাচ্ছে না। যথেচ্ছ গ্রেপ্তার, অত্যাচার, থানা হাজত ও জেলে অস্বাভাবিক মৃত্যু, নারী ধর্ষণ, বিবিধ হুমকি, বিরোধীদের জন-সমাবেশে বাধা, বিরোধীদের মৌলিক অধিকার, ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চনা অব্যাহত আছে। পুলিশ, শাসক দলের বিভিন্ন নেতারা বিচার বিভাগকে এড়িয়ে নিজেরাই দণ্ডদাতা হয়ে উঠেছে। রাজবন্দিদের বিচার না করে দীর্ঘ দিন ‘সংশোধনাগার’(১৯৯২ সালের আইন অনুযায়ী রাজ্যের জেলখানাগুলো তারাপদ লাহিড়ী কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক জেলখানাগুলো এমন নাম পেয়েছে) আটকে রাখা হচ্ছে, বন্ধু-সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ, উপযুক্ত চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না। দুষ্কৃতীদের মাধ্যমে মুনাফাবাজদের স্বার্থে জল,জমি,জঙ্গল জোর করে বা লোভ দেখিয়ে দখল ইত্যাদি সমস্ত অপকীর্তিই বজায় আছে। নির্বাচনে অসামাজিক কাণ্ড পুলিশি মদতেই ঘটছে। তাই অধিকার রক্ষার আন্দোলনের পরিধি ও ধরণ বদলাতে হয়েছে, হচ্ছে। এপিডিআর-এর কর্মসূচিতে সংযোজিত হয়েছে ভারতের সংবিধানের ৩৫২(জরুরি অবস্থা জারি করার ক্ষমতা), ৩৫৬(রাজ্যপালের সুপারিশে নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে খারিজ করার ক্ষমতা) অনুচ্ছেদ, দণ্ডবিধি থেকে মৃত্যুদণ্ড ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইন বাতিল, জল-জঙ্গল-জমির উপর থেকে স্থানীয় মানুষদের অগ্রাধিকারের দাবি। এই সংগঠন কোন রাজনৈতিক দল, বা নির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক মতাদর্শর অনুগামী বা প্রভাবিত নয়, কোন সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করে না, নীতিগত প্রশ্নে সহমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কোন অংশে যায় না, যেতে চায় না।
১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে বহরমপু্রে দীপঙ্কর চক্রবর্তীর উদ্যোগে অনন্ত ভট্টাচার্যকে আহ্বায়ক করে এপিডিআর মুর্শিদাবাদ কমিটি গড়ে ওঠে। তার আগে ১৯৭১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ও তার পরের বছর একই দিনে বহরমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিরাপত্তা রক্ষীরা বন্দুক দিয়ে মোট দশ জন বন্দিকে খুন করেছে। ১৯৭৪ সালের জুন মাসে এপিডিআর মুর্শিদাবাদ কমিটির প্রথম সম্মেলন হয়। সিপিএমের নেতারা ছাড়া অন্য বামপন্থী দলগুলির প্রায় সমস্ত স্থানীয় নেতাই এই সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৮৫ সালের মে মাসে জেলার খড়গ্রাম থানার ঝিল্লি গ্রাম পঞ্চায়েতের কেলাই গ্রামের পশ্চিমবঙ্গ কৃষক সমিতির দুই স্থানীয় নেতা(সেজাম্মেল ও নিয়ামত) কংগ্রেস ও সিপিএম দুষ্কৃতীদের আচমকা হামলায় খুন হন। সেই ঘটনার বিরোধিতায় এবং দেশে জরুরি অবস্থা জারির দশ বছর পূর্তিতে ধিক্কার জানাতে ওই বছরের ছাব্বিশ জুন বহরমপুরে কালেক্টরেট ক্লাব হলে এক কনভেনশনের আয়োজন করেছিল এপিডিআর মুর্শিদাবাদ কমিটি। আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক, সিপিআই দলের জেলা স্তরের নেতারা যোগ দিয়েছিলেন, প্রস্তাবের পক্ষে ভাষণ দিয়েছিলেন। ১৯৯২ সালে হরিহরপাড়ার গণ মিছিলে পুলিশের ঘটনার তদন্ত করে, রাজ্য সরকার ও পরবর্তীতে ওই ঘটনার তদন্তের জন্য গঠিত দাস কমিশনের কাছে তার প্রতিবেদন পেশ করে জোর দিয়েই জানায় যে পুলিশ(ইস্ট ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস) গুলি চালিয়েছিল এবং তারা গুলি চালাতে গিয়ে দেশের প্রচলিত আইন মানেনি। এখন তাদের কাজে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর অত্যাচার, ওই বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতিবাদে, নদী ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্তদের(২০০০ সালের জুলাইয়ে মুর্শিদাবাদের আখেরিগঞ্জে পুলিশ গুলি চালিয়ে বন্যা ভাঙন প্রতিরোধ কমিটির একজনকে মেরে ফেলেছিল) যথাযথ পুনর্বাসনের দাবিতে আন্দোলনও যুক্ত হয়েছে। এখন জেলার ১৫/১৬টি থানাতেই এপিডিআর-এর শাখা কমিটি গড়ে উঠেছে এবং জেলা স্তরে ১৯৯০ সালে সমন্বয় কমিটিও তৈরি হয়েছে। প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরনো হয়ে যাওয়ার পর কিছু শৈথিল্য তথা নিজ নীতির প্রতি অবহেলা কারও কারও মধ্যে দেখা যাচ্ছে। কোন কোন সদস্যর মধ্যে ব্যক্তি ঝোঁক দেখা যাচ্ছে বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের মতই আচরণ করছে। এপিডিআর তৈরি হওয়ার আগে মুর্শিদাবাদ জেলায় গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ব্যক্তি স্বাধীনতা সংঘ গড়ে উঠেছিল। সভাপতিদের মধ্য অন্যতম ছিলেন শশাঙ্কশেখর সান্যাল এবং সম্পাদক ছিলেন বিজয় কুমার গুপ্ত। ওই সংগঠনও রাওলাট আইনের অনুরূপ দমন ও আটক আইনের বিরোধিতা এবং রাজনৈতিক কর্মীদের নিঃশর্তে মুক্তির দাবি করেছিল, রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নিতে গ্রেপ্তার হওয়া কর্মীদের আইনী সহায়তা দেওয়ার কাজ করেছিল। তবে এই সংঘ সম্ভবতঃ বছর দুয়েকের বেশি নিজ অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখতে পারেনি। বন্দি মুক্তি কমিটি ও পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজের শাখা এই মুর্শিদাবাদ জেলাতেও আছে। বিচারপতি দিলীপ বসুর উদ্যোগে জেলায় লসওয়েব(লিগাল এইড সোসাইটি ওয়েস্ট বেঙ্গল)-এর শাখা গড়ে উঠলেও এখন তার কোন অস্তিত্ব নেই। অতি সম্প্রতি কমিটি ফর প্রোটেকশন অব ডেমোক্রাটিক রাইটস এ্যান্ড সেকুলারিজম(কলকাতায় ১৯৮৪ সালে গঠিত) নামের এক মানবাধিকার সংগঠনের জেলা সম্মেলন বহরমপু্রে হয়েছে। তাছাড়া সরকার বা তার অনুমোদিত কোন সংস্থার সাহায্য ও মদতপুষ্ট কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠনও জেলায় রয়েছে। কিন্তু মানুষের জীবনের অস্বাভাবিক ইতি ঘটছেই। সীমান্ত এলাকায় বিশেষত চোরাচালান রোখার নামে যথেচ্ছ ক্ষমতাপ্রাপ্ত আধা সেনা বাহিনী যখন তখন গুলি চালিয়ে বা বেধড়ক পিটিয়ে খুনের অভ্যাস বজায় রেখেছে। নীতিহীন বা নীতিবান, দিশাহীন দিশাযুক্ত সব শাসকই শুধুই ক্ষমতা ধরে রাখা বা পুনর্দখলের জন্য একই কৌশল সেই ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি, দান খয়রাত, হুমকি, প্রলোভন, দুর্নীতি, ফাঁকা প্রতিশ্রুতির আশ্রয় নিয়েছে, নিচ্ছে। অথচ, নাগরিক জীবনে অনিশ্চয়তা, পারস্পরিক অবিশ্বাস, শ্রদ্ধাহীনতা বাড়ছে। মানবিক মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার শর্তই হল নিজ শ্রমে অর্জিত আয়ে ভয় ও অভাবমুক্ত জীবনযাপন। কিন্তু, যোগ্যতা দক্ষতা অনুযায়ী কাজ পাওয়ার অনিশ্চয়তা, কাজ পেলেও ন্যায্য মজুরি পাওয়া, কাজের স্থায়িত্ব, অবসর পরবর্তী প্রাপ্য নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। চাষের খরচ বাড়লেও উপযুক্ত দাম মিলছে না, ফসলের ন্যূনতম মূল্য সরকারি ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ। বৃহৎ ধনী গোষ্ঠীর সঙ্গে নীচু তলার গরীবদের আয় ও ধনে বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। ফলে নাগরিক সমাজে হতাশা বাড়ছে। প্রতিদ্বন্দ্বী দৃশ্যমান দলগুলোর প্রতি আনুগত্য বিশ্বাস বজায় রাখতে পারছে না নাগরিক সমাজ। অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা রাজনৈতিক নেতাদের উপেক্ষা অগ্রাহ্য করে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জহরলাল নেহেরুর ঘোষণা পত্রে উল্লিখিত বাণী ‘নাগরিক শিক্ষা ছাড়া স্বাধীনতার মূল্য নেই’ নিছক প্রচারে থেকে গেলেও অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা বোঝাচ্ছেন যে বুর্জোয়া গণতন্ত্রেই তথা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেই শাসকদের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার তথা আম-জনতাকে উপেক্ষা করার ঝোঁক লুকিয়ে আছে। অধিকার আন্দোলন এত দিন রাজনৈতিক আন্দোলনের অনুসারী হয়েই থেকেছে। স্বল্প পরিধি ও ব্যাপ্তির মধ্যে কখনও কখনও স্বাধীন সামাজিক আন্দোলন অধিকার সংগঠন গড়ে তুললেও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পালাবদলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেনি। নির্দিষ্ট কোন আর্থিক বা ধর্মীয় বা জাতিগত শ্রেণি বা সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব অধিকার সংগঠন করেনি। এখন কি এপিডিআর বা ভিন্ন নামের কোনো অধিকার সংগঠন কাজের ধারা, সাংগঠনিক চরিত্র বদলাবে?
- মিলন মালাকার : মানবাধিকার কর্মী।
