পরিকল্পনাহীন সবুজ প্রযুক্তি আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন থেকে বাঁচাতে পারবে না

অমিতাভ আইচ
পরিকল্পনাহীন সবুজ প্রযুক্তি আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন থেকে বাঁচাতে পারবে না, আর তা বাঁচানোর জন্য নয়ও শুধুমাত্র মুনাফার জন্য; রাজস্থান ও গুজরাটের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্টকারী হাওয়াকল ও সৌরবিদ্যুত প্রকল্প তা প্রমান করেঃ
থড় মরুভূমির মধ্যে রয়েছে প্রায় ২৫০০০ আশ্চর্য সব প্রাকৃতিক বনভূমি, যা শত শত বছর ধরে মানুষ, প্রকৃতি ও তার ধর্মের এক অপূর্ব মরুদ্দান। এই কাটা ঝোপ, ঘাসভূমি, খেজরি, একাসিয়া ও অন্যান্য পর্ণমোচী উদ্ভিদ, জলাশয়ে ঢাকা অঞ্চলগুলো প্রকৃতপক্ষে একেকটি পবিত্র বনভূমি (sacred groves) যাকে বলা হয় ওরান (Oran)। জয়শালমিরের ডেগরাই মাতা মন্দির ট্রাস্টের অধীনে এমনই রয়েছে ডেগরাই ওরান। শতশত বছর ধরে যেখানে গাছ কাটা হয় না, কেই কাটে না। গাছের শুকনো ডালপালাই শুধু ব্যবহার হয়। যে বিশ্নই সম্প্রদায়ের মানুষেরা এখানে থাকেন তারা পশুপালন করেন, রক্ষা করেন বৃক্ষ, জলাধার। এই অসামান্য মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থানের বাস্তুতন্ত্রে বহু বিপন্ন প্রাণীর আবাসস্থল, যেমন চিঙ্কারা, কৃষ্ণশার হরিণ ও গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড। শেষোক্ত প্রাণীটি একটি অতি বিপন্ন প্রজাতির পাখি যা এই ওরানের ঘাসবনে বসবাস করে ও যাদের স্ত্রী পাখি বছরে একটি মাত্র ডিম পাড়ে। জীববিজ্ঞানীরা বলছেন ভারতে আপাতত ১৫০ এরও কম এই পাখি প্রাকৃতিক পরিবেশে বেঁচে আছে।
এই অসামান্য প্রাকৃতিক পরিবেশকে একই রকম ভাবে থাকতে দেওয়া ও তাকে রক্ষা করাই যখন একমাত্র দরকার ছিলো তখন বাধ সেধেছে সরকার, অর্থনীতি, উন্নয়ন ও প্রযুক্তি। রাজস্থানের এই অঞ্চলগুলি হাওয়া বিদ্যুৎ ও সৌরবিদ্যুত প্রস্তুতির আদর্শ ক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে গত কয়েক বছরে। আর সাথে সাথে শুরু হয়ে গেছে গাছ, ঘাসভূমি কেটে হাওয়া কল ও সৌরবিদ্যুতে প্লেট বসানোর কাজ। এই নিয়ে গ্রামবাসীরা প্রতিবাদ করেছে, বলেছে এসব বিদ্যুৎ আমাদের চাই না। কিন্তু বিদ্যুৎতো এই এলাকার জন্য নয়, তা বিরাট বিরাট গ্রীড লাইন দিয়ে চলে যাচ্ছে শহরে, কলকারখানার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে গ্রীড লাইন মাটির তলায় ঢোকাও, কারন এলাকার লোক বলছে পাখি মড়ছে তারে ধাক্কা খেয়ে। তাই শুনে অপ্রচলিত শক্তি দপ্তর বলছে সম্ভব নয়, তাহলে ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে যাবে আর তাহলে টন টন কয়লা পোড়ানোতে ফিরে যেতে হবে। অতয়েব দিন গুনছে ওরান, বিশ্নই আর তার গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড রা। ঘটনা এখানেই একমাত্র ঘটছে তা নয় গুজরাটের কচ্ছে অপ্রচলিত শক্তি কম্পানিগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর বিরাট আঘাত নামিয়ে আনছে যা এতোদিন পর্যন্ত ছিলো সুরক্ষিত।

এখানেই এই আসল কথাটা বলার। জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের উপর আজ যেভাবে ঝাপিয়ে পড়েছে তা শুধুমাত্র শত বছরের জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো, শিল্পবিপ্লব ও তার থেকে তৈরী বিপুল দূষনের কারনে ঘটেনি ও তা কোন সবুজ ও পরিস্কার জ্বালানি (green & clean energy) বা পূনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির ব্যবহারের মাধ্যমেই থেমে যাবে না। জলবায়ু পরিবর্তন কোন সাধারণ প্রযুক্তিগত সমস্যা নয় যা কোন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করলেই ঠিক হয়ে যাবে। উন্নত প্রযুক্তি বড়জোর নতুন পুঁজি বা ব্যবসার সম্ভবনা বাড়াবে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনকে হ্রাস বা কার্বনমুক্ত শক্তি উৎপাদনের মাধ্যমে কিছু লাভজনক সংস্থা গড়ে উঠবে যা কিছু লোককে রোজগার দেবে। কিন্তু সেই উন্নয়ন বা সবুজ শক্তির যদি প্রাকৃতিক পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র, জল, মাটি, অরন্য, পাহাড়, সমুদ্র, তটরেখার স্থিতিশীলতা কে বিপন্ন করে তবে সেই পরিবর্তন কখনই সুস্থায়ী হতে পারে না। সুস্থায়ী উন্নয়নের মুল শর্তই হলো প্রাকৃতিক পরিবেশ ও তার বাস্তুতান্ত্রিক অবদান (#ecosystemservices) কে রক্ষা করা। কারন প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রই হলো জলবায়ু পরিবর্তন থেকে বাঁচতে পারার জন্য আমাদের কাছে একমাত্র রক্ষা কবচ। প্রাকৃতিক পরিবেশ শুধু কার্বন শোষন ও ভূ-রাসায়নিক চক্রের স্থিতিশীলতাকে রক্ষাই করে না, জল ও ভূমিক্ষয় রোধ করে এবং সবচেয়ে বড় বিষয় হলো তা বিপুল মানুষকে খাদ্য ও রোজকার দেয়। আমাদের যাবতীয় কার্বন উৎপাদক কর্মকান্ড প্রকৃতপক্ষে এই প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রকে বিপুল ভাবে ধ্বংসের মাধ্যমেই জলবায়ু পরিবর্তন ঘটিয়েছে, আর যার সবচেয়ে বড় খেসারত দিতে হবে ও হচ্ছে উপকুল, দ্বীপ রাষ্ট্র, খরা প্রবণ ও হিমালয়ের মতো পাহাড়ে বসবাসকারী জনপদের মানুষদের। বস্তুত এর থেকে কারুরই নিস্তার নেই।
এবং তাই জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়ার ও গরীব প্রান্তিক মানুষকে বাঁচানো ও মাইগ্রেশান আটকানোর একটাই অস্ত্র আর তা হলো প্রানপ্রনে আমাদের বাকী প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করা, আমাদের যাবতীয় প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে বাস্তুতন্ত্র মুখি করা (Ecosystem based approach or nature based solution) এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার শিল্প বা বানিজ্যের আগে প্রান্তিক মানুষের (biorights) তা সুনিশ্চিত করা।
আগ্রহী পাঠক কি ওয়ার্ড সার্চ করলেই এসব বিষয় অন্তরজালে খুঁজে পাবেন। কথা হলো তাহলে বিদ্যুৎ আমরা কিভাবে উৎপাদন করবো। এ নিয়ে কম কাজ হয় নি ও হচ্ছে না। সৌরবিদ্যুত উৎপাদন করতে গেলে বাড়ি ও সরকারি/ বেসরকারি কম্পেক্সের ছাদ যে সবচেয়ে ভাল জায়গা তা কিন্তু জানা। কিছু কিছু কৃষি জমিতে সোলার প্লেট বসানো হয়েছে এমন ভাবে যার তলায় চাষ করা যায় আবার প্লেট গুলো ঠান্ডা থাকে। ক্যানেলের উপর দিয়ে সৌর প্লেট তো করা হয়েইছে যাতে জলের বাষ্পীভবন কম হয়। পাখির পরিযানে বাধাদান করে না এমন হাওয়া কল তৈরী আছে। তবে এসবই করতে হবে স্থানীয় ভাবে। একজয়গায় তৈরী করে অন্য জায়গায় নেওয়ার পুরো পরিকল্পনাটাই অসুস্থায়ী ও জলবায়ু অসাম্য সৃষ্টিকারী একটি পরিত্যায্য বিষয়। তাই ইচ্ছেটা জরুরি আর জরুরি এটা মানা যে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রকে বিনষ্ট করে কোন কিছু করলে তা অর্থহীন উন্নয়ন ও সর্বনাশের সূচক এই কথাটা মানা ও তার সাথে যাবতীয় প্রযুক্তিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ মানানসই করে তোলার চ্যালেঞ্জটা নিতে আমরা তৈরী কিনা এই প্রশ্ন করা।
সূত্র ও ছবিঃ ডাউন টু আর্থ, রাউন্ড গ্লাস, কনসারভেসন টাইমস
অমিতাভ আইচ : পরিবেশ গবেষক ও পরামর্শদাতা
