প্ল্যাটফর্ম ক্যাপিটালিজম ও গিগ অর্থনীতি

তারাশঙ্কর ভট্টাচার্য
গিগ ইকোনমি বোঝার আগে, গিগ ওয়ার্ককে বুঝতে হবে।
সবাই জানি যে প্রায় প্রতিটি ব্যবসার জন্য কিছু স্থায়ী এবং কিছু অস্থায়ী কর্মী প্রয়োজন। অর্থাৎ ব্যবসা পরিচালনার জন্য স্থায়ী কর্মচারীদের মাসিক বেতন দেওয়া হয়।
যেখানে অস্থায়ী কর্মচারীদের একটি নির্দিষ্ট কাজ বা প্রকল্প সম্পূর্ণ করার জন্য নিয়োগ করা হয় এবং প্রকল্পটি সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে তাদের কাজ থেকে ছুটি দেওয়া হয়।
সহজ কথায়, এই ধরনের কর্মচারীদের যারা একটি নির্দিষ্ট প্রকল্প সম্পূর্ণ করার জন্য নিয়োগ করা হয় তাদের গিগ ওয়ার্কার বলা হয়।
অতএব, গিগ ইকোনমি সম্পর্কে বলতে গেলে, এটি একটি মুক্ত বাজার ব্যবস্থা যেখানে অস্থায়ী পদে কর্মচারী নিয়োগ করা হয় এবং কোম্পানিগুলি একটি নির্দিষ্ট প্রকল্পের জন্য স্বল্পমেয়াদী ভিত্তিতে কর্মচারী নিয়োগ করে।
অর্থনীতিতে গিগ নামক এই শব্দটির উৎপত্তি সঙ্গীত শিল্প থেকে শুরু হয়েছে।
কারণ এখানে গায়ক, সুরকার বা অন্য যে কেউই হোক, তাদের কোনো গান ইত্যাদি লঞ্চ হলেই পারিশ্রমিক পান। একইভাবে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এই একই ধরনের অর্থনীতি আধিপত্য বিস্তার করে আছে, কারণ অভিনেতা, অভিনেত্রীদের প্রতি ফিল্ম, প্রতি পর্ব পিছু অর্থ প্রদান করা হয়। আর আজকে যখন আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনেক কিছু করতে পারছি, এমন পরিস্থিতিতে যখন যে কোন পেশাজীবী মানুষ, সে ডাক্তার, আইনজীবী, প্রকৌশলী, প্রফেসর, ডাক্তার, ফ্রিল্যান্সার বা কোম্পানি/ব্যক্তি যাকে টাস্ক বা প্রোজেক্ট সম্পূর্ণ করার জন্য অস্থায়ীভাবে নিযুক্ত করা হয়েছে এমন পরিস্থিতিতে, এই সমস্ত পেশাদার ব্যক্তিরাও গিগ অর্থনীতির অংশ।
কোন কোন কর্মচারীরা গিগ ইকোনমিতে যোগদান করে…
আমরা উপরোক্ত বাক্যে স্পষ্ট করেছি যে এই ধরনের সমস্ত কর্মচারী যারা অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করছেন। তারা কোম্পানি বা প্রকল্পের সাথে যত দীর্ঘ বা স্বল্পমেয়াদী যুক্ত থাকুক না কেন, তাদেরকে গিগ ওয়ার্কার বলা হয়। এই কর্মচারীদের নিম্নলিখিত বিভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে।
*চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক যারা অস্থায়ী ভিত্তিতে স্বাধীনভাবে কাজ করে।
*ফ্রিল্যান্স বিজ্ঞানী , দাপুটে অভিনেতা, ব্লগার, অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং ( যথা উবের, আমাজন, ফ্লিপকার্ট, এআরবিএনবি ইত্যাদির মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কর্মরত কর্মীরা।
*সেই ধরনের লোকেদেরকে যাদের সময় কাজ করার জন্য যে কোন সময় ফোনে ডাকা যেতে পারে অর্থাৎ তারা তখনই কাজ করে যখন তাদের গ্রাহকরা ফোন করে এবং অর্থ উপার্জন করে।
*রাস্তা নির্মাণ, নির্মাণ ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা।
*অন্যান্য সেক্টরের সাথে সংযুক্ত সকল অস্থায়ী কর্মচারী।
ভারতে গিগ অর্থনীতি…..
ভারতে যদিও সংগঠিত ক্ষেত্রে এখনও স্থায়ী কর্মচারীদের আধিপত্য রয়েছে কারণ সংগঠিত খাত তাদের কার্য সম্পাদনের জন্য বৃহৎ পরিসরে স্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন অনেক কাজ রয়েছে যার জন্য অস্থায়ী কর্মচারী নিয়োগও প্রয়োজন।
আজকের সময়ে, কোম্পানিগুলিও চায় যে তারা শুধুমাত্র যে কাজটি সম্পন্ন করা হচ্ছে তার জন্য অর্থ প্রদান করবে, তাই গিগ ওয়ার্কার তাদের জন্য একটি ভাল মাধ্যম।
অর্থাৎ কোম্পানি হোক বা ব্যবসায়ী, সবাই শুধু নিজের সুবিধার কথাই চিন্তা করে, তাই যখনই মনে হয় এই কাজটা অস্থায়ী কর্মচারী দিয়েও করা যায়, তখনই তারা সেই কাজের জন্য স্থায়ী কর্মী নিয়োগ করতে পছন্দ করে না। .এই কারণেই ভারতেও গিগ অর্থনীতি খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে বহুল জনসংখ্যা, ব্যাপক বেকারত্বের কারণে তরুণরা তাদের সামর্থ্য এবং দক্ষতা অনুযায়ী উপার্জন করতে খুব পছন্দ করে কারণ তারা এই ধরনের কাজ করে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের জন্য কিছু সময় পায়।
স্থায়ী চাকরিতে একজন ব্যক্তিকে কমপক্ষে আট ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়, তাই সাধারণত সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত মানুষের সময় অফিসেই কাটে।
যেখানে গিগ অর্থনীতিতে, কর্মীদের একটি একক কাজ বা প্রকল্প সম্পূর্ণ করার জন্য দেওয়া হয়, কাজ অনুযায়ী রোজগার। তাই এতে খুব বেশি সময় লাগেনা কিন্তু কিছুটা ফ্লেক্সিবিলিটি থাকে। কিন্তু গিগকর্মীদের সময়ের বাধ্যবাধকতা যদিও বা কম থাকে কর্মক্ষেত্রের দায়বদ্ধতা চরম। গিগ অর্থনীতি পরিবারের ডমেস্টিক ওয়ার্ককে কমোডিফাই করছে জোমাটো ইত্যাদি সংস্থা। বাড়ির কর্তা গিগকর্মী হওয়ায় আয় মাত্র ১০ হাজার টাকা। বেশি রোজগারের জন্যে তার স্ত্রীকেও রোজগার করতে যেতে হয় কোন গিগ সংস্থায় তবেই কোনরকমে সংসার চলে। ঘরের সব কাজ তখন কমোডিফাই হয়ে যায়। একদিকে গিগ প্ল্যাটফর্মের যত মনোপলি বা একচেটিয়াকরণ হয় অন্যদিকের শ্রমিকদের ইউনিটি চূর্নবিচূর্ন হয় ততই।
আন্তর্জাতিক মনোপলি গিগ সংস্থার কাছে ব্যক্তি শ্রমিক অসহায় আত্মসমর্পন করে থাকে সবসময়।
এ ছাড়াও যখন থেকে ভারতে অনলাইন ব্যবসার বৃদ্ধি ঘটেছে, এর বৃদ্ধির সাথে সাথে, ভারতে গিগ কর্মীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে । তাই এখানে গিগ অর্থনীতিতেও একটি গতি এসেছে। একটি পরিসংখ্যান অনুসারে, ভারতে প্রায় ১২-১৩ কোটি গিগ কর্মী পাওয়া যায় এবং তারা সংখ্যায় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গিগ ইকোনমির সুবিধাঃ-
১। যেহেতু গিগ ইকোনমিতে, কর্মচারীদের একটি কাজ বা প্রকল্প সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাই অনেক আছেন যারা মনে করেন যে তাদের কাজের সময় অনেক নমনীয়তা দেওয়া হয়। তাই কিছুক্ষেত্রে নমনীয়তা ( ফ্লেক্সিবিলিটি) গিগ অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সুবিধাগুলির মধ্যে একটি।
২। গিগ অর্থনীতিতে, কর্মচারীদের আরও স্বাধীন হয়ে তাদের কাজ করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়। গিগ কর্মীদের সাধারণত একটি অনুভূতি থাকে যে তাদের কোম্পানি, সংস্থা বা ব্যক্তিদের দ্বারা কাজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং এটি সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তারা স্বাধীনভাবে কাজ করে।
৩। যেহেতু তারা অস্থায়ীভাবে কাজ করে সে জন্য বিভিন্ন কোম্পানি বা ক্লায়েন্টের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের কাজ পায়, যার কারণে তারা একই ধরনের কাজ করার ফলে উদ্ভূত একঘেয়েমি বা নিস্তেজতা থেকে রক্ষা পায়। মানে বোরড হয় না।
৪। গিগ অর্থনীতির অধীনে কর্মরত কর্মচারীদের অর্থের জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয় না, প্রকল্পটি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তারা অর্থ পায়।
৫। কর্মচারীরা তাদের সুবিধার ভিত্তিতে তাদের কর্মক্ষেত্র, কাজের সময় ইত্যাদি বেছে নিতে পারে এবং এর সাথে অন্য কিছু কাজ করতে পারে।
গিগ অর্থনীতির অসুবিধাঃ-
১। যেহেতু কর্মচারীরা অস্থায়ী ভিত্তিতে নিযুক্ত হন, তাই তারা স্বাস্থ্য বীমা, বোনাস,ছুটি, মহার্ঘ্যভাতা ইত্যাদির মতো কোম্পানি কর্তৃক প্রদত্ত অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।
২। অস্থায়ীভাবে চাকরি করায় নিয়মিত কাজ বা চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই, তাই তাদের নিয়মিত আয়ের কোনো উপায় নেই।
৩। গিগ অর্থনীতিতে গিগ কর্মীকে প্রতিটি কাজ বা প্রকল্প শেষ হওয়ার পরে একটি নতুন প্রকল্প বা কাজ খুঁজে বের করতে হয়। যার কারণে তাদের মধ্যে মানসিক চাপের মাত্রা বেড়ে যায়।
৪।এই অর্থনীতির অধীনে, সাধারণত তারাই কাজ পেতে সক্ষম হয় যারা তাদের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ। অর্থাৎ একজন দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তির পাশাপাশি তার কাজে পারদর্শিতাও থাকতে হবে। অনেক গিগ ওয়ার্কে দক্ষ স্কিলড কর্মী লাগে, তার অভাব যথেষ্ট।
৫) যেহেতু শ্রম আইনের বাইরে এই গিগ ওয়ার্কাররা তাই মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাবার ফোরাম নেই।
৬) অনেক ক্ষেত্রে ডেলিভারি ঠিক সময়ে দিতে না পারার জন্যে ওয়ার্কাররা পেনাল্টির ঝুঁকিতে পড়ে।
পারিশ্রমিক যথেষ্ট কম, তাই ভিন্ন ভিন্ন কাজে গিগ ওয়ার্কারদের নিয়োজিত রাখতে হয় তাই রোজগার করতে যথেষ্ট চাপে থাকতে হয়।
সারা পৃথিবীর নানা স্থানে বৃহৎ পুঁজির মালিকেরা উৎপাদনের ঝুঁকি নিতে চায় না। কেবলমাত্র উৎপাদিত পণ্য ডিজিটাল নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করে বাজারজাত করে মুনাফা করে। পুঁজিবাদের উদ্ভবের যুগে মার্কেন্টাইল ক্যাপিটালিজম বিকশিত হয়েছিল প্রত্যক্ষ উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে। এখনকার যুগে বৃহৎ কয়েকটি একচেটিয়া বণিক সম্প্রদায় ডিজিটাল ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা বিশ্বজুড়ে পণ্য সংগ্রহ করে বাজারজাত করে বিনিময়ের মাধ্যমে মুনাফা কামাচ্ছে। এই পদ্ধতির অর্থনৈতিক পারিভাষিক নাম “প্ল্যাটফর্ম ক্যাপিটালিজম”।
‘GAFAM’ অর্থনীতির এই ধারকেরা উৎপাদনের বেশীর ভাগটাই সংগ্রহ করে থাকে সারা বিশ্বের SME sector, Start up business, SEZ গুলির উৎপন্ন পণ্য ভান্ডার থেকে। বিশ্বের প্রায় ৫০ শতাংশের কাছাকাছি উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি হয় এইসব সেক্টর থেকে। ভারতে প্রায় ৭৯ লক্ষ MSME unit আছে যেখান থেকে রপ্তানি হয় ভারতের মোট রপ্তানির প্রায় ৪৫ শতাংশ। ভারতের ৪০ শতাংশ শিল্প-উৎপাদন হয় এইসব সংস্থা থেকে।
ভারতবর্ষে “স্টার্ট আপ” সংস্থা মোট প্রায় ৬১,৪০০ টি। এগুলিকেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী “আত্মনির্ভর নির্ভর ভারত প্রকল্প” বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই MSME প্রকল্পে ২০২২ এর মার্চ অব্দি কর্ম সংস্থান হয়েছে প্রায় ৯৪ লক্ষ। ইতোমধ্যেই ভারতবর্ষে ১০০ টির বেশী স্টার্ট আপ ‘ইউনিকর্ন ‘ স্ট্যাটাস পেয়ে গেছে । ইউনিকর্ন শব্দটি শুধুমাত্র ‘স্টার্টআপ’দের দেওয়া হয় যাদের মূল্য এক বিলিয়ন ডলারের বেশি। যে স্টার্টআপগুলি ১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের মূল্য ছাড়িয়েছে তাদের ডেকাকর্ন (একটি সুপার ইউনিকর্ন) নামক শব্দটির অধীনে গোষ্ঠীভুক্ত করা হয়েছে। ড্রপবক্স, স্পেসএক্স এবং ওয়েওয়ার্ক হল ডেকাকর্নের কিছু উদাহরণ।
যাই হোক আগামি দিনে বৃহৎ পুঁজিপতিরা নিজেদের ব্যবসার সাথে উৎপাদন থেকে বাজারকে বিচ্ছিন্ন করে কেবলমাত্র বাজারে এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে উদ্বৃত্ত পুঁজি সংগ্রহ করে নেবে, সেরকমই ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে।
লড়াই কোন পথে ভেবে দেখুন। ১৯৪৩ সালে তৃতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে দেওয়া হল। পুঁজিবাদ আন্তর্জাতিক হয়ে উঠল রাষ্ট্রপুঞ্জ, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, আই এম এফ ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের মাধ্যমে। আর কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ভেঙে ক্রমান্বয়ে শ্রমিক জাতীয় থেকে আঞ্চলিক স্তরে সব শেষে ব্যক্তিস্তরে নেমে গেল। আন্তর্জাতিক একচেটিয়াবাদের বিরুদ্ধে আবার লড়তে গেলে শ্রমিকদের সংহতিকে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে হবে । আপনাদের মতামতের অপেক্ষায় রইলাম।
তারাশঙ্কর ভট্টাচার্য : প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী।

8 Comments
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লেখা।
ektu shear kore deben
thanks
তৃতীয় বিশ্বের দেশে লকডাউন পরবর্তী সময়ে গিগস কর্মী সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
thik bole6en
অসাধারণ ভাবনার বাণীরূপ। সবার জানার মত বিষয়।
thanks
গিগ অর্থনীতি সংক্ষেপে খুব সুন্দরভাবে লেখা হয়েছে। এটাই এখন বর্তমান বাস্তবতা।
thanks