• May 30, 2023

পুঁজির সর্বগ্রাসী হানায় আজকের বাঞ্ছারামের বাগান লুঠ।।

 পুঁজির সর্বগ্রাসী হানায় আজকের বাঞ্ছারামের বাগান লুঠ।।

শ্রীমন্ত রাউত ও সন্তোষ সেন।

ঝাড়গ্রামের সন্নিকটে ৫ নম্বর রাজ্য সড়কের পাশে ‘সাধু রামচাঁদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ ঠিক উল্টো দিকে জিতুশোল মৌজায় রশ্মি সিমেন্ট কোম্পানি বে-আইনি ভাবে স্পঞ্জ আয়রন কারখানা গড়ে তুলেছে। অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিম্নমানের কয়লা ব্যবহার করার ফলে কারখানার দূষণে সন্নিহিত জিতুশোল, গাড়রো, বাঘমুন্ডি, ঘৃতখাম , চিঁচুরগেড়িয়া, বরিয়া, শালবনি প্রভৃতি গ্রামগুলির মানুষের জীবন ও জীবিকা মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। বেশ কয়েক বছর ধরে কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের ব্যবসা আরো বিস্তারের লক্ষ্যে বে-আইনি ভাবে রায়তি, পাট্টা প্রাপ্ত, সরকারি খাসজমি, বনভূমি জবর-দখল করে চলেছে। এই জবর-দখলের ক্ষেত্রে সরকারি প্রশাসনের একাংশ সক্রিয় মদত ও সহযোগিতা করে আসছে। এই বে-আইনি জবর দখলের বিরুদ্ধে এলাকার মানুষ বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের পোষা গুণ্ডা দিয়ে গ্রামবাসীদের মারধর ও মিথ্যা মামলার মাধ্যমে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করে আসছে।

বেআইনি স্পঞ্জ আয়রন কারখানার নামে কি চলছে এলাকায়?

“বে-আইনি ভাবে গঠিত স্পঞ্জ আয়রন কারখানার” জন্য জীবন – জীবিকা ও এলাকার পরিবেশের স্বাস্থ্যহানি কিভাবে ঘটছে তা একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
১) জনবহুল এলাকায় ও বনাঞ্চল এলাকায় “স্পঞ্জ আয়রন কারখানা” গড়ে তোলার অনুমতি পাওয়া যায় না। তাই কর্তৃপক্ষ মিথ্যা র আশ্রয় নিয়ে অনুমতি নিয়েছে।
২) দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আলোচনা সভায় নিজেদের পেটোয়া বাহিনী ভরে দিয়ে জনগণের অভিযোগ জানানোর চেষ্টাকে বানচাল করেছে।
৩) কারখানা চালানোর জন্য বেআইনিভাবে দৈনিক প্রচুর পরিমাণে ভূগর্ভস্থ জল তুলে নিচ্ছে, অথচ খাতায় কলমে দেখিয়ে চলেছে যে তারা নাকি কংসাবতী নদী ও ঝাড়গ্রাম পৌরসভা থেকে জল নিয়ে কারখানা চালাচ্ছে।
৪) কারখানায় নিযুক্ত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও জীবন রক্ষার বিষয় চরম রূপে অবহেলিত।
৫) দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নির্দেশকে কারখানা কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণভাবে অবহেলা করে আসছে। বছর তিনেক আগে ‘দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ’
কর্তৃপক্ষকে ১৯ দফা নির্দেশ পালনের গাইডলাইন দেয় এবং সেগুলো পালিত হচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব জেলা শাসককে দিলেও সেই নির্দেশগুলো শুধুমাত্র খাতায় কলমে থেকে গেছে–বাস্তবায়িত হওয়া আকাশ কুসুম কল্পনা!
৫) কারখানা থেকে উড়ে আসা কয়লার গুঁড়ো ও নানান দূষিত বস্তুতে সংলগ্ন গ্রাম ও শালজঙ্গল গুলো লাল ধূলোর আস্তরণে ঢাকা পড়ে গেছে। ফলে ফসল উৎপাদন, জনগণের স্বাস্থ্য, গোচারণ ভূমি, শালপাতা সংগ্রহ প্রভৃতি মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। গ্রামের মানুষ বিষাক্ত করে দেওয়া কুয়োর জল ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন, এমনকি তাদের বাড়ির চালায় তৈরি শাকপাতাও আজ কারখানার দূষণে দূষিত। সরকারি তরফে পরিমাপের কোন ব্যবস্থা না থাকলেও এটা বলা বাহুল্য যে এলাকায় বায়ুদূষণ ও তার কুপ্রভাব বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
৬) সর্বত্র প্রচার করা হয়– কারখানা তৈরি হলে স্হানীয় মানুষের কর্মসংস্থান হয়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে। কিন্তু এখানে স্থানীয় মানুষদের কাজ দেওয়া হয় না,পরিবর্তে গ্রামবাসীদের আগের জীবীকা কৃষিকাজ, ছাগল-ভেড়া ও
হাঁস – মুরগি প্রতিপালন, শালপাতা সংগ্রহ করে থালা – বাটি তৈরি ইত্যাদি সম্পূর্ণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ।
৭) ঝাড়গ্রাম থেকে লোধাশুলি যাওয়ার ৫ নম্বর রাজ্য সড়কের উপর দিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের ভারী ভারী গাড়ি বিপজ্জনকভাবে চলাচল করায় ছাত্রছাত্রী সহ সাধারন মানুষের চলাচলে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি লেগেই আছে।
৮) সিমেন্ট ও স্পঞ্জ আয়রন কারখানার গুঁড়োয় রাস্তা ভরে থাকে, সন্ধ্যে হলেই যাত্রীবাহী গাড়ি ও বাইক চালকরা কিছুই দেখতে পায় না, প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে ও জীবনহানি হয়।

ফলের বাগানও পুঁজির হানায় ক্ষতবিক্ষত:

খাস মৌজার প্রায় ষাট বিঘা জমির ওপর রয়েছে এক বিশাল ফলের বাগান। সেখানে আছে অসংখ্য আম, লিচু, পেয়ারা ও কাজুবাদামের গাছ। যেটা “গড় শালবনি সমাজ উন্নয়ন মহিলা সমিতি” দীর্ঘ ৩০/৩৫ বছর ধরে রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছেন। এই ফলের বাগান থেকে যা আয় হয় তাতে সমিতির ৯৫ জন মহিলার পরিবারের অন্ন সংস্থানে সাহায্য করে। রশ্মি সিমেন্ট কোম্পানির নির্মিত “ক্রিস গার্ডেনের” ঠিক উল্টো দিকেই এই ফলের বাগান। ফলে এই ফলের বাগানের ওপরও ওদের শ্যেন দৃষ্টি পড়েছে কয়েক বছর আগেই। বহুদিন ধরে কারখানা কর্তৃপক্ষ এই ফল বাগান জবর-দখল করার চেষ্টা করে আসছে। আগস্টের শেষদিনে কারখানা কর্তৃপক্ষের গুণ্ডা বাহিনী ও দালালরা জবর-দখলের জন্য প্রাচীর নির্মাণের কাজ করতে এসেছিল। ওদের এই পরিকল্পনায় বাধ সাধলেন এলাকার মানুষ। “গড় শালবনি উন্নয়ন মহিলা সমিতি” র ঐক্যবদ্ধ বাধাদানের ফলে ওরা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। এর আগেও বহুবার, এমনকি রাতের অন্ধকারে প্রাচীর নির্মাণের চেষ্টা করেছে এই হামলা বাহিনী। কিন্তু স্থানীয় মানুষ, বিশেষ করে মহিলাদের প্রবল প্রতিরোধে বারবার কারখানা কর্তৃপক্ষ পিছুটান দিয়েছে। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা সব জেনেশুনেও নীরব, অথবা তলে তলে কারখানা কর্তৃপক্ষকে মদত দিচ্ছে। এখন সমিতির মহিলারা এককাট্টা। তাঁদের কথায় –” আমরা প্রাণ দিতেও প্রস্তুত, তবুও জমি ছাড়বো না”। সমিতির মহিলারা ফলের বাগান থেকে আয়ের জন্য স্থানীয় পঞ্চায়েতকে ট্যাক্স দেয়। যদিও গত কয় বছর অজানা কারণে পঞ্চায়েত ট্যাক্স নিচ্ছে না। এই জমি জবর দখলের বিরুদ্ধে এলাকার পুরুষ-মহিলা, জাতি – ধর্ম নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। মালিকের দালাল ও গুন্ডাদের হাত থেকে বাগান বাঁচানোর জন্য তাঁরা রাত – পাহারা দিচ্ছেন। জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে দলবেঁধে স্মারকলিপি ও দাবিপত্র জমা দেওয়ার পাশাপাশি ধারাবাহিক ও ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের জন্য গ্রামবাসীরা কোমর বাঁধছেন। বলে রাখা দরকার – স্পঞ্জ আয়রন কারখানার দূষণ সহ ‘অরণ্য সুন্দরী ‘ ঝাড়গ্রামে তথাকথিত উন্নয়নের নামে ও রেল লাইন সম্প্রসারণের অজুহাতে নির্বিচারে শতাব্দী প্রাচীন বৃহৎ শাল গাছ কাটা এবং ঝাড়গ্রামের সামগ্রিক পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে ‘ ঝাড়গ্রাম নাগরিক উদ্যোগের ‘ ব্যানারে এলাকাবাসী দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিক আন্দোলনের পথে হাঁটছেন। স্বভাবতই এই উদ্যোগ সহ ঝাড়গ্রামের বিশিষ্ট নাগরিকরা জিতুশোল সংলগ্ন গ্রামবাসীদের বর্তমান লড়াইয়ের পাশে সামিল হয়েছেন, সমর্থন ও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আপনিও এই লড়াইয়ে সাথী হয়ে উঠুন।

বাঁচতে ও বাঁচাতে জোট বাঁধুন বন্ধু:

বিশ্বজুড়েই আজ ভূউষ্ণায়ন, বরফের অতি দ্রুত গলন, কোথাও খরা – তীব্র তাপপ্রবাহ, দাবানল, কোথাও আবার অল্পসময়ে মেঘভাঙা প্রবল বৃষ্টিপাত, বন্যা, হড়পা বাণ, ধস এবং অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ও সর্বনাশ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের নানান প্রান্তে একই সময়ে আমরা এইসব এক্সট্রিম ঘটনাগুলো বারবার ঘটতে দেখছি। এককথায় পরিবেশ বিপর্যয়, জলবায়ু ও ঋতুচক্রের পরিবর্তন আজ আর শুধু পরিবেশ ও বিজ্ঞান কর্মী ও বিজ্ঞানীদের উদ্বেগের বিষয় নয়। বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসে এসবই আজ ঘটমান বর্তমান। পুঁজির অন্ধগতি ও মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের পাহাড় প্রমাণ মুনাফার স্বার্থে বিনষ্ট ও নিষ্পেষিত করে দেওয়া পরিবেশকে মেরামত করতে হলে ওদের এই সর্বগ্রাসী আক্রমণের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ প্রতিরোধের রাস্তায় নামতেই হবে নিজেদেরকে বাঁচাতে ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দুষণহীন এক সুস্থ সুন্দর পৃথিবী রেখে যেতে হলে, যেখানে প্রকৃতির সন্তান, বিশ্বের প্রতিটি শিশু বুকভরা বিশুদ্ধ বাতাস টেনে নিয়ে প্রকৃতির কোলে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে।
আমাদের আবেদন – প্রতিটি পরিবেশপ্রেমী, গণতান্ত্রিক মানুষ ও অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলা প্রাণ প্রকৃতি ও জীবন – জীবিকা বাঁচানোর এইসব লড়াইয়ে সামিল হয়ে ওদের মদত দিন। এই নীল গ্রহে মানবসভ্যতার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে পরিবেশ মেরামতির দাবিকে একটি প্রধান কর্তব্য ও দায়িত্ব হিসেবে সব কর্মসূচির অগ্রভাগে নিয়ে আসুন। আজ আগুন লেগেছে ঘরে, জল নিয়ে প্রস্তুত থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। নাহলে অনতিবিলম্বে মানবসভ্যতা পৌঁছে যাবে ‘ পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন ‘ র দেশে। অন্য আর কোন গ্রহ যে নেই, যেখানে মানবপ্রজাতি শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশের এই দুর্দিনে আপনার অংশগ্রহণ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এই আশা আমরা পোষণ করি।

শ্রীমন্ত রাউত ও সন্তোষ সেন:শিক্ষক ও পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক

Leave a Reply

Your email address will not be published.