স্ট্যান স্বামী হত্যার প্রতিবাদে কবিতাগুচ্ছ

কবিতা এখনই লেখার সময় কারণ আমার স্বদেশ আজ বধ্যভূমি।আজ যদি আমি প্রতিবাদ না করি,নিরপেক্ষতার মুখোশে মুখ ঢেকে শিল্প শুধু শিল্পের জন্য — এই সংকীর্তনে কণ্ঠ মেলাই তাহলে বৃথা আমার কাব্য রচনা।রাষ্ট্রের হেফাজতে এই খুনের বিরুদ্ধে নীরবতা আজ অপরাধ। এই বিশ্বাসে স্থিত থেকে কবিরা আজ কলম ধরেছেন বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়ে।পূর্বাঞ্চলের পাতায় ধরা থাকল সেই রকম কিছু কবিতা।সঙ্গে থাকল স্বয়ং স্ট্যান স্বামীর এক কবিতার ভাষান্তর,যার প্রতিটি আখরে লেগে আছে রক্তের দাগ।
অশোক চট্টোপাধ্যায়ের দু’টি কবিতা
লাশ
কে কার মাড়িয়ে লাশ পথ করে নেবে
তার হিসেব তো বাকি রয়ে গেছে
এখন অগ্নিকোণে সেজে উঠছে মেঘ
মাতন জাগছে বাতাসে
অন্ধকারে শব্দ করে ফুটে উঠছে ফুল
আর রাতপ্রভাতের গান গাইছে পাখি
কলমের আয়ুধ হাতে রাত জাগছে কবি
লাশগুলি সারিবদ্ধ হয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে
একে অপরের দিকে চোখ রেখে একবার
ফিসফিস করে কী যেন বলছে
কেঁপে কেঁপে উঠছে ইতিহাসের পাতা
শহিদের স্বপ্নগুলি
পলাশ পলাশ রঙ জামা পরে
তুলে ধরছে রক্তনিশান
আপনি নিশ্চিন্তে নিদ্রা যান, ফাদার
পথের লড়াইয়ে একদিন মিলে যাবে
উত্তর হিমালয় থেকে দক্ষিণের কন্যাকুমারিকা
আপনার কালো কালো মানুষেরা একদিন
লাল আলোর সকালে ইন্টারন্যাশনাল গাইবে
জুলাই ৬, ২০২১
আইনি সন্ত্রাস
তাঁর চশমার কাচে ছিল মস্ত এক ভয়ের আকাশ
অশক্ত শরীরে ছিল বিদ্যুতের জাগ্রত আগুন
ক্ষুধায় কাতর প্রাণ স্বপ্নে তবু ভেসেছে হাওয়ায়
জেলের গরাদ ভেঙে উড়িয়ে দিয়েছে সব গানের ফাগুন
সামনে দাঁড়িয়ে ছিল মূর্তিমান রাষ্ট্রের দীর্ঘতর ছায়া
ছায়ার পেছনে সব উঁকি মারে সারিসারি ব্যবস্থার দাস
আজ তিনি মুক্ত সব কানুন আর বিচারের বাইরে দাঁড়িয়ে
ফুৎকারে উড়িয়ে দেন রাষ্ট্রের আইনি সন্ত্রাস
জুলাই ৯, ২০২১
অরুদ্ধ সঙ্গীত
সমীর ভট্টাচার্য্য
A caged bird can still sing – Stan Swami
I know why the caged Bird sings – Maya Angelou
মৃত্যু এসে মুক্তি দিল জীর্ণ রোগের শরীরটাকে,
বন্ধ কারার আগল ভেঙে জুলাইয়ের এই দুষ্প্রভাতে।
বুকের পাটা বিরাট ছিল, অনেক ছিল ভালোবাসা,
দরিদ্র আর বঞ্চিতদের মমতাতে হৃদয় ঠাসা।
সইতে ওরা পারেনি যে, ঐ যে যারা রক্তচোষা – বাগিয়ে লাঠি করলো তাড়া, রাজার ভারি হল গোঁসা।
“দলিত যত আদিবাসীর অধিকারের কথা বলিস –
আরে, ওরা নীচু জাতি, ওদের কেন মাথায় তুলিস?
ওদের বনে ওদের রাইট, মাটির নীচে খনিজ যত
সে সব নাকি ওদের – উল্টোপাল্টা বকিস কত!
বুঝি আমি, এসব কেবল শহুরে নকশালি চাল –
জেলে ভরো” রাজা বলেন, রেগেমেগে ফুলিয়ে গাল।
আইন এবং সংবিধানের অধিকারের লড়াই ছিল,
রাষ্ট্রদ্রোহী তকমা গায়ে গারদখানায় ভরে দিল।
অশক্ত সে শরীরখানা বয়স এবং রোগে শীর্ণ,
ঘাড়টা ঠিকই শক্ত ছিল, মনের জোরও হয়নি দীর্ণ।
জারি ছিল পাঞ্জা লড়া, জারি ছিল যোঝাযুঝি –
শেষের দিনেও কোমর বাঁধা, নজর ছিল সোজাসুজি।
একটা স্বামী গেছেন, তবু অযুত নিযুত উঠবে জেগে,
লক্ষ কণ্ঠে মুক্তির গান, জয়ের তুফান ছুটবে বেগে।
পরাশর ভট্টাচার্য
–জেল জীবন – প্রকৃত সাম্য
- স্ট্যান স্বামী
জেলের অবদমিত দরজার ভেতর
তোমার নিজস্ব কিছু নেই।
সামান্য যেটুকু প্রয়োজন তাতে
“তুমি” প্রথমেই আসে
“আমি” আসে পরে
“আমরা” ই সে বাতাস, আমাদের সবার নিশ্বাস।
আমার কিছু নয়
তোমারও কিছু নয়
সবটুকু আমাদের এখানে।
উচ্ছিষ্ট ফেলা যায়না এখানে
স্বাধীন বিহঙ্গের সাথে বাঁটোয়ারা হয় তার
তারা উড়ে আসে, ক্ষুন্নিবৃত্তি করে ফের
স্বাধীন আকাশে উড়ে যায়।
এতো তরুন মুখগুলি বড়ো দুঃখ দেয়
“তোরা কেন এখানে” –
প্রশ্নের জবাবে
তাদের নির্মেদ উত্তর-
“প্রত্যকের থেকে তার ক্ষমতা অনুসারে,
প্রত্যেককে তার প্রয়োজন অনুসারে”
- এটাই সমাজভাবনার শেষ কথা।
ওহে, জেলের সাম্য তো নিরুপায়,
যেদিন মানবসমাজ সহজে, স্বেচ্ছায় এই ভাবনাকে জড়িয়ে ধরবে, কেবল সেইদিনই ধরিত্রীমায়ের প্রকৃত সন্তান হয়ে উঠবো আমরা।
কৈফিয়তের ইশতেহার
শোণিতকনায় জমাট বাঁধছে গলিত ক্ষরণকাল
হত্যার রং গেরুয়া,এখনো,জীবনের রং লাল
পুড়ে যেতে যেতে অস্থিমজ্জা আগুনবর্ণ হলে
প্রস্তুত থেকো!দেখা হবে,কোনো প্রতিরোধ অঞ্চলে
গেরিলাছন্দে জবাবদিহি’র আগ্রাসী কনভয়
ভেঙে দিতে পারে,পিঠ ঠেকে যাওয়া,ধূসর রঙের ভয়
পরিকল্পিত এই হত্যায়,জমলো না যার ঘৃণা
বেছে নিতে হবে,দহনদিনে,সে,আমার সঙ্গী কি না
যে চেতনাপথ মুখর হলো না অগ্নিভ প্রতিশোধে
ধিক্কার থাক!তার আপোসের বিক্রীত হতবোধে
মুঠো ভরে নিয়ে কৈফিয়তের চরম ইশতেহার
আলোর উৎস খুঁজে নিক,মুছে,কুয়াশা অন্ধকার
প্রতি অক্ষরে লিখুক সে লিপি ক্রোধের বর্ণমালা
চৌচির হোক হত্যাকারীর জীর্ণ বিচারশালা
কারামুক্তির দুর্বার স্রোত হোক রাজধানীগামী
দ্রোহদিন হয়ে গর্জে উঠুক সহস্র স্ট্যান স্বামী
জীবিতে’র দেশে আজও কিছু মৃত পাহাড়ের চেয়ে ভারী
দেখে নিক,যারা,শাসনের নামে’সন্ত্রাস রাখে জারী
নবারুণ রাগে মৃত্যুবিজয়ী ছিঁড়ুক তমসাজাল
ধ্বংসের রং গেরুয়া,এখনো,সৃষ্টির রং লাল
কবির নাম- অতনু মজুমদার