• June 1, 2023

আমি ও আমার মওলানা ভাসানী

 আমি ও আমার মওলানা ভাসানী
no title has been provided for this book
তার পরিচয় বিবিধ। তিনি কারো চোখে লাল মওলানা, কারো চোখে ধর্মীয় পীর, কারো কাছে আপোষহীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আবার কারো কারো কাছে 'Prophet of Violence'।

উপমহাদেশের মুজলিম জননেতা মওলানা ভাসানী

ওহিদ রেহমান :- তার পরিচয় বিবিধ। তিনি কারো চোখে লাল মওলানা, কারো চোখে ধর্মীয় পীর, কারো কাছে আপোষহীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আবার কারো কারো কাছে ‘Prophet of Violence’। তিনি উপমহাদেশের অবিসংবাদি মুজলিম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তাঁর বর্ণময় জীবন বৃত্তান্ত এই বাংলায় প্রথমবারের মতো দুই মলাটে বন্দী করেছেন বিশিষ্ট তথ্যচিত্র নির্মাতা, সাংবাদিক সৌমিত্র দস্তিদার। মওলানা ভাসানীর সংগ্রামী জীবন কেন্দ্রীক, এই গবেষণা গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে এই বছরের মার্চ মাসে আবিষ্কার প্রকাশনী থেকে।

লেখক আদন্ত নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে মওলানার সংগ্রামী জীবনের প্রতিটি পরতকে যত্নকরে লিপিবদ্ধ করেছেন পুরো গ্রন্থজুড়ে। তিনি লিখেছেন, ” খুব কাছের লোকের পক্ষে সমালোচনা করা বা তাঁকে নিয়ে নির্মোহ হয়ে লেখাটা কঠিন। আমার একটা সুবিধা আছে। আমি ঘটনাচক্রে সেই অর্থে মওলানা ভাসানীর ভক্ত বা মুরিদ নই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমার কোনো ভূমিকা নেই। ফলে একজনকে ছোট করে অন্যজনকে টেনে নামানোর দায় নেই।” লেখকের কথায়, ” মওলানা প্রকৃত অর্থেই ছিলেন গণমানুষের নেতা। অবিভক্ত ভারতে একমাত্র মহাত্মা গান্ধী ছাড়া জনমনে অত প্রভাব অন্য কোন নেতার ছিল না।” আদতেই তাই। মহাত্মা গান্ধীর থেকে বয়সে ১১ বছরের ছোট চেকা মিঞা (মওলানা ভাসানীর ডাকনাম) ছিলেন উপমহাদেশের কৃষক, শ্রমিক, মুটে মজুর সর্বপরি মেহনতি জনতার এক এবং অদ্বিতীয় কন্ঠস্বর। রাজনৈতিক আগ্রাসন হোক কিংবা সামাজিক আধিপত্যবাদ, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা থেকে বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ-বিগ্রহ, মওলানা ভাসানী সোচ্চার হয়েছেন অবিভক্ত বাংলার প্রতিটি জনপদ থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে। আসলে, মওলানার মানবিক শেকড় প্রোথিত ছিল গভীরে। শৈশবে পিতৃহীন আবদুল হামিদ সঙ্গ পেয়েছিলেন সুফি ধর্মগুরু নাসিরুদ্দিন বোগদাদির। তাঁর হাত ধরেই তিনি পরিচিত হন বৃহত্তর পৃথিবীর সঙ্গে। এসে উপস্থিত হন আসামে। বোগদাদির ইচ্ছেতেই তিনি দেওবন্দে পুনরায় তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু করেন ১৯০৭ সালে। এখানে তিনি ধর্মীয় জ্ঞান লাভের পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে আগ্রহী হয়ে পড়েন। সেই সূত্রেই, কাছাকাছি আসেন তৎকালীন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের। মওলানা ভাসানী তাকে রাজনৈতিক গুরু রূপে গ্রহণ করেছিলেন। আবার মওলানার জীবন দর্শনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তাঁর একজন অনুজ; নাম মোখলেচুর। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, মওলানা ছিলেন বাঙালি জাতিসত্ত্বার ইতিহাস এবং ঐতিহ্য রক্ষার্থে নিবেদিতপ্রাণ। মওলানা ভাসানী নিষ্ঠাবান ধার্মিক অবশ্যই ছিলেন, কিন্তু সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। ভাসানচর এবং আদাবাড়িতে কাটানো দিনগুলোতে মওলানার সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন গোরাচাঁদ। তাঁর তৈরিকৃত স্কুলের দায়িত্বে ছিলেন মানিক সরকার। তিনি স্বপ্ন দেখতেন একটি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের। পূর্ব পাকিস্তান শুধুমাত্র মুসলমানদের আবাসভূমি হবে- এই ভাবনার তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। তিনি বলতেন, পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দুরা চলে গেলে বাঙালি কালচার নষ্ট হয়ে যাবে।

লেখক সৌমিত্র দস্তিদার এই গ্রন্থে মূলত ভাসানীর সংগ্রামী জীবন আখ্যান কে তিনটি অংশে বিভক্ত করে আলোচনা করেছেন। প্রথম অংশ: ভাসানী অবিভক্ত ভারতবর্ষে গণ আন্দোলনের হোতা, যা মূলত আসাম থেকে পরিচালিত হয়। ১৯৩৭ সালে, তিনি দক্ষিণ ধুবড়ি নির্বাচনী অঞ্চল থেকে আসাম প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। আসামের তদানীন্তন জোতদার-জামিদার, সামন্তবাদের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলেন। আসামে ‘লাইন-প্রথা’র বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াইয়ের প্রাণপুরুষ ছিলেন মওলানা ভাসানী। দ্বিতীয় অংশ: স্বাধীনতাত্তোর পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক আত্মমর্যাদার প্রশ্নে, ১৯৪৯ সালে তিনি ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ'(বর্তমানে আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠা করেন। এবং শেষাংশে, ১৯৫৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগ (ইতিমধ্যেই তাঁর উদ্যগেই ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়) ত্যাগ করেন এবং প্রতিষ্ঠা করেন ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ সংক্ষেপে ন্যাপ। ভাসানী ছিলেন প্রকৃত অর্থেই স্বাধীনচেতা , আত্মমর্যাদায় বলীয়ান একজন বাঙালি। পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার যুক্তফ্রন্ট সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করলে, দেওবন্দের এই প্রাক্তনী তদানিন্তন পাক শাসকদের উদ্দেশ্যে হুঙ্কার দিয়ে উচ্চারণ করেন, ‘আলাইকুম সালাম’। মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রখর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জননেতা। ১৯৫৭ সালের ঐতিহাসিক কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনেই তিনি ভবিষ্যতবানী করেন স্বাধীন বাঙালি জাতিরাষ্ট্র শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।

‘আমি ও আমার মওলানা ভাসানী’ আদতে লেখক সৌমিত্র দস্তিদারের সশরীরে দুই বাংলায় বছর দুয়েকের নিরলস পরিশ্রমের সার্থক উপস্থাপন। সমগ্র গ্রন্থজুড়ে ইতিহাসের রীতি মেনে পাতার পর পাতা ছড়িয়ে আছে ‘প্রাইমারি সোর্স’। ফলে, প্রতিটি পাতার সাথে পাঠকের সাবলীল একাত্মতা অজান্তেই গড়ে ওঠে। বহুমাত্রিক চরিত্রের এই মওলানার ব্যক্তিত্বের খামতিও লেখকের কলমে আঁচড় কেটেছে। তিনি তাকে অস্থিরচিত্ত, সামান্য একগুঁয়ে এবং ঈষৎ অহমিকা সম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী বলে উল্লেখ করেছেন। তবে, একথা ও সত্যি যে, তাঁর বিরুদ্ধে আনা অধিকাংশ অভিযোগ ক্লিশে, পরশ্রীকাতরতার উৎকৃষ্ট নমুনা। উপমহাদেশের রাজনৈতিক সচেতন যেকোন পাঠক এই গ্রন্থ পড়ে সহজেই অনুমান করতে পারবেন যে, আসলে মওলানা ভাসানী স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার। শেখ মুজিব তাঁর নিখাদ ভাবশিষ্য। সঙ্গত কারণেই, মুজিবের ব্যবহারে মওলানা ভাসানীর প্রতি চূড়ান্ত সৌজন্যতা প্রকাশিত হয়েছে সবসময়। মওলানা ভাসানী আদতে কখনোই ক্ষমতার অলিন্দে ঘোরাঘুরি করতে চান নি, তিনি চেয়েছিলেন একটি পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থা, জালেম শাসকের কবল থেকে মেহনতি মানুষের প্রকৃত মুক্তি। তাই তো, তাঁর কন্ঠে ধ্বনিত হয়,
‘তুমি খাবে আর আমি খাব না, তা হয় না তা হবে না।’

আমি ও আমার মওলানা ভাসান
সৌমিত্র দস্তিদার
আবিষ্কার প্রকাশ
প্রথম প্রকাশ : মার্চ ২০২১
মূল্য : ৩০০ টাকা

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Rate this review

Related post