জাতীয়তাবাদের একাল ও সেকাল

পাপ্পু মাঝি
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রকৃত অর্থে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। এই জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কারন ছিল ইউরোপিয়ানরা। তাদের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সেসময় অখণ্ড ভারতে নব কলবরে সৃষ্টি হয় ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদের ধারনা, যা সমাজের সর্বস্তরের মানুষকেই প্রভাবিত করেছিল। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সৃষ্ট জাতীয়তাবাদ। ডঃ এ. আর. দেশাই এর কথায় “স্বার্থের সংঘাতের ফলেই জন্ম নেয় ভারতীয় জাতীয়তাবাদ। ব্রিটেনের স্বার্থ হল ভারতকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তার অধীনস্থ করে রাখা, আর ভারতীয় জনগণের স্বার্থ হল ভারতীয় সমাজের অবাধ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তন ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে নির্বিঘ্নে রাখা।“ যার পরিপূর্ণ রূপ পায় সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আবির্ভাব ঘটে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস, ঋষি অরবিন্দ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের। যাঁরা প্রতিনিয়ত এই জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের রসদ জোগান দিয়ে গেছেন। আর এই আন্দোলনের ফসল হল “নবজাগরণ”। একটি রাষ্ট্রের জনগণ একত্রিত হলে সমাজে তার কি প্রভাব পড়তে পারে তা বর্তমান যুগের প্রায় সকলেই অবগত।
জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষাপট পরিবর্তন করে যদি আরও কয়েক শতক পূর্বে ভারতীয় সমাজের অবস্থা পর্যালোচনা করা হয়, তখনও আমরা জাতীয়তাবাদের উদাহরণ দেখতে পাই। স্বভাবতই আধুনিক জাতীয়তাবাদের সঙ্গে তার পার্থক্য ছিল বিস্তর। সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির কুটবুদ্ধি ও ক্ষমতার দ্বারা সমগ্র সমাজ ব্যবস্থাকে দমিয়ে রাখাই ছিল সেযুগের জাতীয়তাবাদ। যাকে এক কথায় বলা যায় বিকৃত জাতীয়তাবাদ। যারা নিজেদের সম্পর্কে গর্ববোধের পাশাপাশি অন্য জাতির প্রতি ঘৃণার মনোভাব পোষণ করতেন। অর্থাৎ, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীতে সৃষ্ট নিম্ন বর্গের মানুষের নিপীড়ন পূর্বক দমিয়ে রাখার প্রবণতা। আজ এক বড় সংখ্যক ভারতবাসীরই ধারনা যে তারা প্রথম পরাধীনতায় শৃঙ্খলিত হয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয়দের কাছে। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই ধরা দেবে এই পরাধীনতার আগে আরও এক পরাধীনতার করুণ কাহিনী; বহিরাগত ভারতীয়দের দ্বারা ভূমিপুত্রদের লাঞ্ছিত, অপমানিত হওয়ার এবং অস্পৃশ্যতার এক ভয়াবহ ইতিহাস। জাতীয়তাবাদের মূল মন্ত্র “নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচাও”- এই ভাবধারা থেকে সরে এসে জন্ম নিয়েছিল হিংসাত্বক জাতীয়তাবাদ বা বিকৃত জাতীয়তাবাদের। সমাজের এই অচলাবস্থার করুণ সময়ে প্রয়োজন পড়েছিল নিপীড়িত নিম্ন বর্গের মানুষদের একত্রিত করে উচ্চ বর্গের দ্বারা সৃষ্ট বিকৃত জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং তাঁদেরকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে নিয়ে এসে মানবিকতার ভিত্তি স্থাপন করা। এই সময়ে উচ্চ বর্গের দ্বারা নিপীড়িত মানুষদের পাশে ত্রাতারূপে আবির্ভূত হন মানবতার পূজারি গৌতম বুদ্ধ এবং মহাবীর। যাঁদের দেখান পথে নিম্ন বর্গের মানুষরা আবার বাঁচার রসদ খুঁজে পান। দলে দলে মানুষ অহিংস জাতীয়তাবাদের আদর্শে দীক্ষিত হয়ে বৌদ্ধ ধর্ম এবং জৈন ধর্ম গ্রহণ করতে থাকেন।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালেও জাতীয়তাবাদ কথাটির সাথে আমরা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ভাবধারার পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। আসলে কোন একটি শব্দের অর্থ তার স্থান, কাল ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে সর্বদা পরিবর্তনশীল। সেই কারনেই জাতীয়তাবাদ কখনও নিপীড়িতের আশ্রয় বা আধিপত্য বিরোধী রাজনীতির বাহন হতে পারে আবার এর বিপরীত স্রোতেও প্রবাহিত হতে পারে। আমরা সকলেই জানি স্বাধীনতা অর্জনের প্রাক মুহূর্তে দেশ ভাগের যন্ত্রণা। এরই সঙ্গে আরও একটি যন্ত্রণাদায়ক অধ্যায় যুক্ত হয়েছিল হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। যা এই একবিংশ শতকেও প্রবাহমান। এসবই হল বিকৃত জাতীয়তাবাদের ফসল। খেলার মাঠে যেমন নিজেদের দেশের জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে সমর্থনের ধ্বজা উড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়, সেরকমই আমরা একটু চেষ্টা করলেই হয়ত পারতাম, জাতিধর্ম ও রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে “ 1946 এর The Great Culcutta killings” কিংবা “2002 এর Gujrat Danga”-র মতো অসংখ্য জাতি ভিত্তিক দাঙ্গা বন্ধ করার শপথ নিতে। ধর্ম অস্তিত্ব রক্ষার জাতীয়তাবাদ মূলক ভাবধারা মানুষের মনে প্রথিত না হলে ভারতবর্ষের সামাজিক চিত্রপটই পালটে যেতে পারত। ভারতবাসী এখনও যে অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বপ্নে বিভোর তা বাস্তবেই অনুভব করতে পারত। জাতীয়তাবাদের ধারনা যদি থেকেই থাকে তবে তা হওয়া উচিত ভারত গঠন ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ।
বর্তমান সময়ে জাতীয়তাবাদ ক্ষুদ্র অঞ্চল কেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। সেই কারনে দক্ষিণ ভারতীয় জনগণ আজও ভারতীয় হিন্দি বলয়ের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, এক বিশেষ শ্রেণির জনগণ নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবে রাজ্য বা দেশ ভাগের দাবি তোলে, উপেক্ষিত হয় দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা ও একাত্মতা। আবার মানবিক নিদর্শনের উদাহরণও পাওয়া যায়। যেমন, সম্প্রতি মানবিকতার খাতিরে রহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান এবং পুনরায় তাদের নিজ জন্মভূমিতে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা, কিংবা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানুষদের আশ্রয় ও নাগরিকত্ব প্রদানের প্রচেষ্টা। তবে একটি কথা স্বীকার্য যে জাতীয়তাবাদ এখন জনসাধারণ কেন্দ্রিক না হয়ে রাজনীতি কেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। আর কিছু রাজনীতিবিদদের এই প্রচেষ্টা যত সফল হবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ তত সংকীর্ণ হতে থাকবে। ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার সুসংহত মান উন্নয়নের লক্ষে ভারতরত্ন ডঃ বি. আর. আম্বেদকরের চিন্তা-ভাবনাকে রাষ্ট্র বিরোধী তকমা দিতে একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মানুষ সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে আঁকড়ে তাঁর অবদানকে অস্বীকার করে সামাজিক বিভাজনের বিষবৃক্ষ রোপণ করে চলেছেন। ক্ষুদ্র স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়াই না করে সকলের প্রয়োজন, বৃহৎ স্বার্থে নিজেদেরকে অর্পণ করা। উনিশ শতকের বৃহত্তর জাতীয়তাবাদকে অনুসরণ করে দেশ ও দেশবাসীর বৃহৎ স্বার্থে নিজেকে নিয়োজিত করা। জাতীয়তাবাদ অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতে থাকবে। সমাজের প্রতিটি মানুষের উচিত তাকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। জাতীয়তাবাদ ইতিহাস কেন্দ্রিক না হয়ে সময়োপযোগী হওয়া উচিত যা একটি দেশ বা জাতিকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। তা বলে কি আমরা অতীতকে ভুলে যাব? অতীতের যা কিছু সুন্দর ও মানবিক তা আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠুক।
পাপ্পু মাঝি , ছাত্র ,,বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়