• March 26, 2023

এক গুচ্ছ আঙ্গুর

 এক গুচ্ছ আঙ্গুর

জাপানি সাহিত্যিক তাকেও আরিশিমা এর গল্প বাংলায় অনুবাদ করেছেন শ্রেয়া চক্রবর্তী

ছোটবেলায় ছবি আঁকতে আমার খুব ভালো লাগতো। আমার স্কুল ছিল ইয়াকোহামার ইয়ামানো তে বলে একটি শহরে। শহরটিতে পশ্চিম দেশীয় লোকজনই কেবল বসবাস করত, এমনকি আমার স্কুলেও সকল শিক্ষকই ছিলেন বিদেশি। সমুদ্র তীরের সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা হোটেল আর বিদেশী কোম্পানীর ইমারত পেরিয়ে যেতে হতো স্কুলে।
সাগরের তীর থেকে গাঢ় নীল সমুদ্রের উপর সারি সারি যুদ্ধজাহাজ ও বাণিজ্য তৈরীর চিমনি থেকে অনর্গল বেরোনো ধোঁয়া এবং প্রায় ব্রিজের মতোই এক মাস্তুল থেকে অপর মাস্তুল পর্যন্ত জোড়া জাতীয় পতাকার চোখধাঁধানো অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য দেখা যেত। আমি পাড়ে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখতাম। তারপর বাড়ি এসে আমার মনের সেই দৃশ্য যতদূর সম্ভব ছবিতে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতাম। কিন্তু আমার রঙ পেন্সিল দিয়ে কোনোভাবেই সমুদ্রের জলের ওই ইন্ডিগো রং, কিংবা সাদা সাদা পালতোলা নৌকার নিচের দিকে, জলের ধারে ওই লাল রং সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলতে পারতাম না।
হঠাৎই এক স্কুলের বন্ধুর বিদেশি রং পেন্সিলের কথা আমার মনে পড়ে যায়। সেই বন্ধুও ছিল বিদেশি।এমনকি , আমার থেকে প্রায় দু বছরের বড় হওয়ার জন্য ও এতটাই লম্বা ছিল যে, ঘাড় উঁচু করে তার দিকে তাকাতে হত। জিম নামের সেই বন্ধুটির কাছে বিদেশ থেকে আনানো বেশ চমৎকার একটি রঙ ছিল। শক্ত কাঠের বাক্সের ভিতর বারোটা ছোট ছোট চৌকোনা কালিরং দুই সারিতে পরিপাটি করে সাজানো। যেকোনো রঙই খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা যায়, এমনকি, ইন্দিগো ও ক্রিমসন রঙ দুটি আশ্চর্যজনকভাবে দারুন সুন্দর আসে। জিম আমার থেকে লম্বা হলে কি হবে, ও কিন্তু একেবারেই ভালো আঁকতে পারে না। কিন্তু তবুও ওই রং দিয়ে ছবি আঁকলে খারাপ ছবিও সুন্দর মনে হয়। আমার সব সময় এর জন্য একটু হিংসে হতো। আমার নিজের খারাপ রংগুলো আমার যতই অপছন্দের লাগতো, ততোই আমার মনে হতো জিমের ওই রঙগুলো থাকলে আমি অবিকল আসল সমুদ্রের দৃশ্য ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে পারতাম। তাই জিমের মতো ওই রঙগুলো আমার চাইই । কিন্তু ভয়ে বাবাকে ওই রকম রং কিনে দেওয়ার কথা বলতে না পেরে, আমি দিনের পর দিন মনে মনে ওই রঙের কথা ভেবে কাটাতাম।
আজ আর মনে পড়ে না ঠিক কবে বা কখনকার কথা…তবে, যতদূর সম্ভব তখন ছিল শরৎকাল। কারণ, তখন আঙ্গুরে পাক ধরেছে। শীত আসার আগে শরতের আকাশ যেমন একেবারে ভেতর পর্যন্ত দেখে নেওয়া যায় তেমনি উজ্জ্বল ঝকঝকে মরশুম ছিল তখন। আমরা শিক্ষকদের সাথে দুপুরের টিফিন খাচ্ছিলাম, কিন্তু একসাথে খাওয়ার মজার মধ্যেও কোনভাবেই আমার মনে শান্তি আসছিল না। সেদিনের উজ্জ্বল আকাশটা আমার চোখে কালো মনে হচ্ছিল। আমি একা একা এককোনে যেন ধ্যান করছিলাম। কেউ একটু খেয়াল করলেই হয়তো আমার মলিন মুখ তার নজরে পড়তো। জিমের রং টা আমার চাই। বুকে ব্যথা ধরানো ছিল সেই চাওয়া। আচ্ছ, জিম কি কোনভাবে টের পেল আমার মনে কি চলছে? এই ভেবে আমি ওর দিকে চুপিসারে তাকিয়ে দেখি, কিছুই টের পায়নি, বরং খুব উৎসাহিত হয়ে হাসতে হাসতে পাশে বসে থাকা কারো সাথে কথা বলছে। কিন্তু, আমার মনে হচ্ছিল, ও যেন আমার কথা ভেবেই হাসছে, সে ও যাই বলুক না কেন আমার খালি মনে হচ্ছিল জিম যেন বলছে,
“দেখো, ওই জাপানি ছেলেটা নিশ্চয়ই আমার রঙ নিতে চায়।” আমার আর কিছুই ভালো লাগছিলো না।
হয়তো আমার মুখে একটা সারল্য, একটা নিষ্পাপভাব আছে, কিন্তু আমার হাবভাব, আমার মন, সবই ছিল একেবারে খারাপ, খারাপ , প্রচন্ড খারাপ…. তার উপরে আমার স্বভাব ভীরু প্রকৃতির হওয়ায়, যা বলতে চাই তা ভালো করে প্রকাশ করতে পারতাম না। ফলে আমার খুব বেশি বন্ধুও ছিল না। খাবার খেয়ে অন্য বাচ্চারা সব মাঠে গিয়ে ছুটে ছুটে খেলে বেড়াচ্ছিল, আর এই দিকে সেদিন আমি একা একা ভারাক্রান্ত মনে ক্লাসে গিয়ে ঢুকলাম। বাইরে আলো থাকলেও ক্লাসের ভেতরটা কেমন যেন আমার মনের ভেতরের মতই অন্ধকার হয়ে ছিল। নিজের জায়গায় বসে, থেকে থেকেই আমার চোখ চলে যাচ্ছিল জিমের টেবিলের দিকে। ছুরি দিয়ে খোদাই করা, হিজিবিজি লেখায় ভরা হাতের ছাপে প্রায় কালো হয়ে যাওয়া ওই টেবিলের ডালাটা খুললেই দেখা যাবে, তার ভিতরে বই, নোটবুক, স্লেটের সঙ্গে একসাথেই কাঠের রঙের বাক্সটাও রয়েছে।
এবং ওই বাক্সের ভিতরে রয়েছে ইন্ডিগো আর লাল রং। আমার মুখ লাল হয়ে গেছে, আমি বুঝতে পারি বেখেয়ালে আমি ওই দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। কিন্তু তবুও, আমি আড়চোখে জিমের টেবিলের দিকে না চেয়ে থাকতে পারিনা। বুকে যেনো কে হাতুড়ির বারি মারছে। স্বপ্নে কোন দৈত্য তাড়া করে বেড়ালে মনের অবস্থা যেমন হয় ;বসে থাকতে থাকতে আমার মনের অবস্থা ঠিক তেমনি অস্থির হয়ে উঠেছিল।
ক্লাসের ঘন্টা বেজে উঠলো। আমি আনমনে উঠে দাঁড়ালাম, অন্যান্য বাচ্চারা সব উচ্চকণ্ঠে হাসছে, চিৎকার করছে। এদিকে হঠাৎই আমি অনুভব করলাম আমার মাথার ভিতরটা একেবারে বরফের মত ঠান্ডা আর ভারী হয়ে গেছে। টলতে টলতে জিমের টেবিলের কাছে গিয়ে আমি অর্ধস্বপ্নাচ্ছন্নের মত টেবিলের ডালাটা খুলে ফেললাম। যেমনটা ভেবেছিলাম, ঠিক তেমনিভাবেই সেখানে নোটবুক, স্লেটের সাথে রঙের বাক্সটাও রাখা আছে। কেন জানিনা, কিন্তু, কেউ দেখছে কিনা ভেবে আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে ঝট করে রঙের বাক্সটা খুলে ইন্ডিগো আর লাল রংটা তুলে পকেটে ভরে ফেললাম। তারপর যেখানে দাড়িঁয়ে আমরা শিক্ষকদের জন্য অপেক্ষা করি তাড়াতাড়ি সে দিকে দৌড়ে গেলাম।

আমার প্রিয় দিদিমনির ক্লাস ছিল তখন। আমরা সবাই যে যার নিজের নিজের জায়গায় বসে। জিমের মুখটা ঠিক কেমন লাগছে তা দেখার জন্য আমি অস্থির হয়ে উঠেছিলাম, তবুও আড়চোখে সেদিকে তাকাতে পারছিলাম না। কিন্তু আমি যা করেছি তা কারো নজরে পড়েনি দেখে খারাপ হলেও অদ্ভুতভাবে আমি খুব নিশ্চিন্ত অনুভব করলাম। আমার সবচেয়ে প্রিয় দিদিমনির কথা আমার কানে ঢুকলেও আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। দিদিমণিও মাঝেমধ্যেই কেমন অদ্ভুত ভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন।
বিশেষ করে সেই দিন দিদিমনির চোখের দিকে তাকাতেও আমার ভালো লাগছিল না। ওই রকম অবস্থার মধ্যে এক ঘন্টা কাটালাম। কেউ কি কিছু বললো?? কেন সবাই ফিসফিস করছে ?ভাবতে ভাবতে এক ঘন্টা কেটে গেল। ক্লাস শেষের ঘন্টাটা পড়তেই আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। দিদিমণি চলে যাওয়ার পর ক্লাসের সবচেয়ে বড় সবচেয়ে চটপটে ছেলেটি আমায়, ” একটু এদিকে আসো তো” বলে আমার কুনুই ধরে টানলো। স্কুলের কাজ না করে আসলে স্যার নাম ধরে ডাকলে যেমন মনে হয়, আমার মনের অবস্থাটা তখন ঠিক তেমনই ছিল।
যাইহোক, আমাকে যতটা সম্ভব না জানার ভান করতে হবে ভেবে, যেন কিছুই হয়নি এমন শান্তমুখে আমি খেলার মাঠের কোনার দিকে চললাম।
“তোমার কাছে বোধহয় জিমের রং আছে। বের করো তো দেখি”– বলে ছেলেটি আমার সামনে তার হাত মেলে ধরল। আমি খুব শান্তভাবে বললাম,
” আমার কাছে ওমন কোনো জিনিস নেই।”
এমন সময় জিম তার তিনজন বিদেশি বন্ধুকে নিয়ে আমার কাছে এসে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
” দুপুরে টিফিনে ছুটির আগে আমি আমার রঙের বাক্স দেখেছিলাম। তখন একটাও রং হারায় নি। আর টিফিনের ছুটি শেষ হওয়ার পরেই দেখি দুটো রং নেই। আর ছুটির সময় একমাত্র তুমি ছাড়া তো ক্লাসে আর কেউ ছিলনা।”
না, কোনোমতেই না, ভাবতে ভাবতে মাথার মধ্যে সব রক্ত ভিড় করে এসে আমার মুখ একেবারে টকটকে লাল হয়ে উঠলো। ওখানে দাঁড়ানো কেউ একজন আমার পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল। আমি যতই চেষ্টা করি না কেন ওদের অত জনের সাথে আমার পেরে ওঠা অসম্ভব। দেখতে দেখতে আমার পকেটের ভিতরে থেকে মার্বেলের বল, খেলার ক্যালকুলেটরের সাথে রং দুটোও বেরিয়ে পড়ল। তা দেখে ছেলেগুলো আমার মুখের দিকে রাগে ঘৃণায় কটমট করে তাকালো। আমি ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। আমার চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো।
কি সুন্দর আবহাওয়া, ছুটির সময় সবাই কি সুন্দর আনন্দ খেলছে, শুধু আমার মনটাই কেমন নির্জীব হয়ে আছে, কেন এমন একটা কাজ করলাম? এমন একটা কাজ করে ফেলেছি যা চাইলেও ফেরানো যাবে না। নিজেকে একেবারে অসহায় লাগছিল। দুঃখে ও একাকিত্বে আমি অনবরত কাঁদতে লাগলাম।
” কেঁদে, ভয় দেখিয়ে কোন লাভ হবে না”— ওই ছেলেটা এমন ঘৃণা নিয়ে কথাগুলো বলল যে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। আমি সামান্য নড়তে না চাইলেও তারা সকলে মিলে জোর করে আমায় দোতালায় নিয়ে গেল। আমি আমার সবটুকু দিয়ে প্রতিরোধ করতে চাইলেও তারা জোরজবরদস্তি আমায় সিঁড়ি দিয়ে উঠলো। সেইখানেই আমার সবথেকে প্রিয় দিদিমনির ঘর। জিম দরজায় টোকা দিয়ে ভিতরে ঢুকবে কিনা জিজ্ঞেস করতেই, আমি শুনতে পেলাম দিদিমণি ভেতরে আসতে বললেন। তার ঘরে ঢোকার সেসময়ের ওই মুহূর্তটি আজও আমার কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় মুহূর্ত। দিদিমণি তখন কিছু একটা লিখছিলেন। এতগুলো পায়ের শব্দ পেয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে তিনি অবাক হলেন। ছেলেদের মত ঘাড়ের কাছে ছোট ছোট করে কাটা চুলগুলোকে হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে তিনি তার স্বভাব সিদ্ধ কোমল মুখটি তুলে আমাদের দিকে তাকলেন।ঘাড় হেলিয়ে আমাদের কথা বলতে ইশারা করলেন। সবচেয়ে চটপটে ছেলেটি সামনে এসে আমি যে জিমের রং নিয়েছি তা সবিস্তারে বর্ণনা করলো। দিদিমণি থমথমে মুখে একবার সকলের গম্ভীর মুখের দিকে একবার আমার কাঁদো-কাঁদো মুখের দিকে চেয়ে দেখলেন। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“এটা কি সত্যি?”
আমার সবচেয়ে প্রিয় দিদিমনির সামনে এই কথা কোন মুখেস্বীকার করব? আমি সত্যি সত্যি কেঁদে ফেললাম। আমার দিকে বেশ খানিকক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থাকার পর তিনি আমার সহপাঠীদের দিকে ফিরে বললেন ,
“ঠিক আছে, এখন তোমরা আসতে পারো।”
ওরা সকলে একটু ক্ষুন্ন হলেও একতলায় ফিরে গেল।
তিনি কিছুক্ষণ কোন কথা বললেন না। আমার দিকেও চাইলেন না। নিজের হাতের নখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে অবশেষে খুব শান্তভাবে উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধ জড়িয়ে ধরে ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলেন,
” রংটা কি ফেরত দিয়েছে?”
উনার উত্তরে আমি উপর নীচে মাথা দোলালাম।
উনি আবার কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি যে কাজটা করেছো ,সেটা যে ঠিক নয়, তা কি তুমি বুঝতে পেরেছ?”
দিদিমণি আবার যখন শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন তখন আমি আর সামলাতে পারলাম না। থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। তবুও কান্না বেরিয়ে আসলো, অসংযত ভাবে আমার চোখের জল ঝরে পড়তে লাগলো।
দিদিমণিকে জড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই আমার মরে যেতে মন চাচ্ছিল।
“আর কান্নাকাটি করোনা, তুমি ভুল বুঝতে পেরেছ এটাই তো ভালো কথা। এবার কান্না থামাও, কেমন? তোমার যদি মনে হয় তবে পরের ক্লাসে না গিয়ে আমার এই ঘরেতেই থাকতে পারো। শান্ত হয়ে এখানে এসো, আমি ক্লাস থেকে না ফেরা পর্যন্ত এখানেই থেকো, কেমন?” —বলে তিনি আমায় একটা বেঞ্চের উপর বসিয়ে দিলেন। তখন ক্লাসের সময় ছিল বলে ডেস্কের উপরে রাখা লেখার সামগ্রী নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। দোতলার জানালা পর্যন্ত লতিয়ে ওঠা আঙ্গুর লতা থেকে একগোছা বিদেশি আঙ্গুর তুলে নিয়ে সেটা অনবরত কাঁদতে থাকা আমার কোলের উপর রেখে দিয়ে তিনি শান্তভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আমার একা লাগার থেকেও বেশি দুঃখ হচ্ছিল। আমি কি আমার সবচেয়ে প্রিয় দিদিমণিকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি? এটা ভাবতেই আমি সত্যি কতটা খারাপ কাজ করেছি তা আমি বুঝতে পারলাম ।আমার আঙ্গুর খেতে ইচ্ছা করছিল না। আমি শুধু কাঁদছিলাম।
হঠাৎ আমার কাঁধে হালকা চাপ পড়ায় আমি জেগে উঠলাম। কখন জানি আমি দিদিমনির ঘরেই কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দেখলাম তিনি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ঘুমানোর ফলে মন হালকা হয়ে যাওয়ায় তখনো পর্যন্ত যা যা ঘটেছিল তা ভুলে গিয়ে আমিও একটু লাজুক ভাবে তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। তখনই আমার কোল থেকে প্রায় পড়ে যাওয়া আঙ্গুরের গোছাটা সামনে নিয়ে তুলে ধরতেই আবার আমার সব মনে পড়ে গিয়ে মুখের হাসিটা নিভে গেল।
“এমন কান্না কান্না মুখ আর করে না। এতক্ষণে সকলে ফিরে গিয়েছে ,তাই তুমিও এখন বাড়ি যাও। আর যাই হোক না কেন, তুমি কিন্তু কাল স্কুলে আসবেই। তোমায় না দেখতে পেলে আমার খুব খারাপ লাগবে। অবশ্যই আসবে কিন্তু।” বলে ,তিনি আমার ব্যাগে আঙ্গুরের থোকা টা ভরে দিলেন।
আমি প্রতিদিনের মতোই সমুদ্র সৈকত পার হওয়ার সময় সমুদ্র জাহাজ দেখতে দেখতে নিরুৎসাহিত হয়ে বাড়ি ফিরলাম। তারপর সেই সুস্বাদু আঙুলগুলো খেলাম।
কিন্তু পরের দিন আমার স্কুলে যেতে একেবারেই ইচ্ছে করছিল না। আমি ভাবছিলাম যদি আমার পেটে ব্যথা হয়, কিংবা মাথাব্যথা হয় তাহলে খুব ভালো হয়, কিন্তু বিশেষত সেইদিনই এমনকি একটা দাঁতে পোকার ব্যথাও পর্যন্ত হলো না। কোন উপায় না পেয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভাবতে ভাবতে হাঁটতে লাগলাম। আমার মনে হল কোনভাবেই স্কুলের গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু গতকালকে দিদিমনির কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময়ের কথা মনে পড়তেই, যে করেই হোক ওনার মুখটা দেখার ইচ্ছা হল আমার। আমি না গেলে উনি নিশ্চয়ই কষ্ট পাবেন। আমি আবারও উনার চোখে ভালো হতে চাই। এই একটা কথা মনে হতেই আমি স্কুলের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম।
তারপর প্রথমেই আমার অপেক্ষায় থাকা জিম একপ্রকার উড়ে এসে আমার হাত ধরল। তারপর যেনো কালকের সব ঘটনা সে ভুলে গেছে, এমন করে বিহ্বলিত আমায় হাত ধরে দিদিমনির ঘরে নিয়ে চলল। আবার কি হলো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না আমি। স্কুলে ঢোকার পর থেকেই সবাই দূর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে,
“দেখো !দেখো ! চোর, মিথ্যেবাদী জাপানিজ ছেলেটা এসেছে!” বলছিলো। কিন্তু এমন এক পরিস্থিতিতে পড়ে আমার সত্যিই খুব খারাপ লাগছিল।
দুজনের পায়ের আওয়াজ শুনেই জিমের দরজায় টোকা দেওয়ার আগেই দিদিমণি দরজা খুলে দিলেন। আমরা দুজনে ঘরের ভিতরে ঢুকলাম। তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল হাসিমুখে বললেন,
“জিম, তুমি খুব ভালো ছেলে। আমার কথা তুমি বুঝতে পেরেছ। জিম বলেছে তোমাকে ওর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে না। এখন থেকে তোমরা দুজন ভালো বন্ধু হবে। নাও, তোমরা সুন্দর করে হাত মেলাওতো দেখি।”
আমার কিন্তু কিন্তু ভাব দেখে জিম নিজে থেকেই উৎফুল্ল ভাবে হাত বাড়িয়ে শক্ত করে আমার হাত ধরল। আমি কি বলে যে আনন্দ প্রকাশ করব তা বুঝতে না পেরে, লাজুক ভাবে হাসলাম। জিমও মন খুশি করা হাসি হাসলো। দিদিমণি ও হাসতে হাসতে আমায় জিজ্ঞেস করলেন, “গতকালকের আঙুলগুলো ভালো ছিল খেতে?”
আমিও কোন উপায় না পেয়ে লজ্জারাঙা মুখে বললাম “হ্যাঁ”
আমার উত্তর শুনে উনি , “তাহলে পরে আবার দেব” বলে , তার সাদা কিমোনো পড়া শরীরটা একটু ঝুঁকিয়ে জানলা দিয়ে বের করে এক থোকা বেগুনি আঙ্গুর তুলে নিয়ে মাঝখান থেকে সেটা দুভাগ করে কেটে আমাকে আর জিমকে দিলেন। তার ধবধবে সাদা হাতের ওপর রাখা বেগুনি রঙের আঙ্গুরের ওই সুন্দর দৃশ্য আমার এখনো মনে পড়ে। সেই দিনের পর আমি আগের থেকে আরেকটু ভালো মানুষ হয়েছি, এখন আর আমি ওরকম লাজুক স্বভাবের নই।
কিন্তু তারপরে আমার প্রিয় দিদিমণি কোথায় যে গেলেন টা আর জানি না। আর দ্বিতীয়বার আমায় ওভাবে বোঝানোর দরকার নেই জেনেও, আমি এখনো ওই দিদিমনিকে দেখতে চাই। শরৎকাল এলে যখন আঙ্গুরের থোকা গুলো বেগুনি হয়ে উপরে একটি সুন্দর আস্তরণ পরে, তখন সেগুলি তোলার জন্য ওমন সুন্দর মার্বেলের মতো ধবধবে সাদা হাত আমি আর খুঁজে পাইনা।

শ্রেয়া চক্রবর্তী :বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী এবং রাজনৈতিক কর্মী।

1 Comments

  • সুন্দর গল্প,সুন্দর অনুবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Related post