• June 1, 2023

ঊনিশের উদযাপন

 ঊনিশের উদযাপন

“এই যে শুনুন আজ “ঊনিশ মে” নিয়ে আমাদের একটা অনুষ্ঠান। অনেকেই থাকছেন। কবিতা গান এবং কথা দিয়ে আমাদের অনুষ্ঠানের ডালি আমরা সাজাতে চলেছি। অনেকক্ষন থেকে আপনাকে ফোনে চেষ্টা করছি। হ্যাঁলো শুনতে পাচ্ছেন।
-ও,আচ্ছা আপনারা তো কলকাতায় অনুষ্ঠান করছেন।
-হ্যাঁ, না মানে এবার তো লকডাউন তাই অনলাইনে আমরা অনুষ্ঠান করবো। এই যেভাবে প্রতি বছর করি আমরা। তা এবার বরাক উপত্যকা থেকে আপনাকে চাইছি।৷ ৷
-না না আবার আমায় কেন। আমি কোন কেউকেটা নই, না আমি কবিতা লিখি, বলিও না, না গান গাই, তাছাড়া আমি হোমরাচোমরা নই, নেতা টেতাও নই, না বিশেষ কোন সংস্থার কিছু আমি।
-না না সে আমরা আগেই খবর নিয়েছি, জানি আপনি পারবেন। আমরা আপনার মত একজন সাধারণকেই চাই। আপনি আপনার মত করে যা খুশি বলবেন।আমরা খুব খুশি হবো যদি থাকেন সাথে।
এত সময় ফোনে কথোপকথন চলছিল। একটি অনলাইন লাইভ অনুষ্ঠানের জন্য। লকডাউনে এই হয়েছে খুব সুবিধে। চট করে অনুষ্ঠান পেতে ফেলা যায়।

এই রকম একটি অনলাইন লাইভ অতঃপর শুরু হলো। সব বেশ বিশিষ্ট শিল্পী, লেখক,কবি সাথে সেই সাধারণ ব্যক্তি তাও আবার বরাকের। যারা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছেন, সঞ্চালিকার সাথেও আলাপ করিয়ে দিলেন এবং বুঝিয়ে দিলেন শহীদের শহরের আপনি কবিতা ও গানের ফাঁকে ফাঁকে অল্প অল্প করে গল্প করবেন। আমরা আপনাকে নিয়ে নেব আমাদের সুবিধা মত।
বাহ বাহ কি দারুণ, সঞ্চালিকা তারিফ করছেন কখনো গানের, কখনো কবিতা শোনানোর জন্য আবার কখনো বা কবিকে শহীদ নিয়ে কবিতা লেখার জন্য। মনে মনে সেই সাধারণ চটে লাল। কারণ সাধারণের জানাই ছিল, সাধারণ বলেই তাকে এখানে শহীদের প্রেমে গদগদ হয়ে লাইভে এনে পুতুলের মত মুখ দেখাতে আনা হয়েছে এবং কবিতা গানে ঊনিশে মে সেলিব্রেশন বা পালন যাই বলুন না তাই হচ্ছে, হবে এবং আগেও তাই হয়ে এসেছে।
যাইহোক অবশেষে সেই সাধারনের মুখ দেখানোর সুযোগ ঘটলো। সঞ্চালিকা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ঊনিশ নিয়ে কিছু বলুন। আপনাদের ওখানে কিভাবে উনিশ উদযাপন করা হয়।
সেই সাধারণ বরাকবাসী বলতে শুরু করলো, দেখুন আমাদের কাছে বিশেষ করে ষাট বছর পর, ১৯ শুধু আর গান কবিতা নয়, ১৯ যে আবেগ, ১৯ এর যে ইতিহাস সেই ইতিহাস বিস্মৃত হয়ে এই যে উদযাপন তাকে সমর্থন করি না। আমরা তো পারিনি, কিন্তু যে বৃহত্তর বাঙালী সমাজ বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গও পারেনি ১৯কে পৌঁছে দিতে ঘরে ঘরে। সেই ইতিহাসকে ধরে রাখতে, তাকে সেই উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেনি বাঙ্গালীরা। ১৯ এখনো রয়ে গেছে প্রান্তিক বরাকের এক আঞ্চলিক ঘটনা হয়ে। এই ব্যর্থতা নিয়ে আমরা বাঙ্গালী হিসেবে উদযাপন না করে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ ও তার কারণ অনুসন্ধান করা উচিত। তা না করে আমরা কি করছি ১৯কে মাত্র একটি বিশেষ দিনের উদযাপনে সীমাবদ্ধ করে রেখেছি।
খুব শীগগিরই বোঝা গেল যে এই কথাগুলো বাকিদের ঠিক হজম হলো না। তার পরে আবারও আরেক প্রস্থ গান, কবিতা শেষে আবার একটু অল্প করে সেই সাধারণের কাছে যেই সুযোগ এলো বলার মানে উগড়ে দেবার, সেই সাধারণ আবার বলে উঠলো- আমাদের বুঝতে হবে আসলে ১৯ কি এবং কেন? ১৯৬১ তে ১৯৪৭ এর পরেই কেন এত বড় দাঙ্গা ১৯৫২ তে, কেন আবার ১৯৬১, তারপর কেনই ১৯৭১, কেন বাংলাদেশ, যাহোক বাংলাদেশকে বাদ দিলেও কেন একে একে ১৯৭২, কেন ১৯৮৬ তারপর কেনই আজ এন আর সি এবং “বাংলাদেশি” শব্দটি কেন ন্যাক্কারজনক ভাবে এত প্রচলিত আসামের বাঙালিদের জন্য।
সঙ্গে সঙ্গেই সঞ্চালিকা কথার মাঝেই সাধারণকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন আপনি কিন্তু বিষয়ের বাইরে চলে যাচ্ছেন। খেয়াল করুন আজকের বিষয় ১৯ শে মে। বাকি বিষয়গুলো আজকের নয়।
যাবাব্বা, এতো যা ভেবেছিলো তার চেয়েও বেশিই কেলো। এই ভেবেই সাধারণ রাগে ও খুশিতে একটু ব্যালেন্স হলো আর কি, সে যা ভেবেছিলো তাই। এরা ১৯শের কিস্যুই আজও জানে না আর জিগীষাও নেই। “
উপরোক্ত ঘটনাটি দুবছর আগের একটি লাইভ অনুষ্ঠানের ধারা লিপি।

লকডাউনের আগে কোন এক সন্ধ্যায় শিলচর শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে বিপিনচন্দ্র পাল উদ্যানে বইমেলায় মুক্ত মঞ্চে এক আলোচনা সভা চলছে। আলোচনার বিষয় “বৈচিত্র্যময় আসাম”। বেশ কয়েকজন বক্তা। কিন্ত সেই বৈচিত্র্যময় আসামের বক্তব্য রাখতে তেমন কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের ব্যক্তি বিশেষদের মঞ্চে দেখতে পেলাম না। যাহোক শুরু হলো, একে একে অনেকেই বক্তব্য রাখলেন। সবাই বেশ বাঘা বাঘা বক্তা। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য এমন আলোচনা সভায় বা অনুষ্ঠানে অন্তত আমি আমাদের আসামের সবার বৈচিত্র্যময় আন্তরিকতা ও ভালোবাসায় আপ্লুত বক্তাই বেশি পাই। খুব কমই আছে যে বেড়ালের গলায় ঘন্টা পরায়। একটু ভালো ভালো গম্ভীর কিছু টোকাটুকি লেখা মাইকে বলে সুবক্তা হওয়াই বেশির ভাগেরই উদ্দেশ্য ও বিধেয়। মঞ্চে তো যা শুনছি শুনছিই, এবারের সবাইকে তো আর মঞ্চে ডাকা যাবে না, তাই একজন বয়োজ্যেষ্ঠ প্রাক্তন স্কুল বা কলেজের শিক্ষক বা অধ্যক্ষ ছিলেন হয়তো, তিনি দর্শকাসন থেকে মাইক নিয়ে এই আলোচনায় ভাগ নিলেন। এই আলোচনাকে সবার জন্য মনোগ্রাহী করার উদ্দ্যশ্যে দর্শকাসন থেকে আলোচনায় সরাসরি ভাগ নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। তা তিনি বলে যাচ্ছেন, এই তো কয়েকদিন আগেই আমি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে এলাম, অমুক দেশ তমুক দেশে ঘুরে এলাম। বাংলা ভাষার আসলে কোন সঙ্কট নেই। এই পৃথিবী থেকে কেউই কোনদিনই বাংলাকে দুর্বল করতে পারবে না। এই বলেই তিনি পৃথিবীর কোন কোন দেশে কত বাঙালী আছে, কোন কোন দেশে রাষ্ট্রীয় ভাবে বাংলাকে ব্যবহার করা হচ্ছে তারও এক বিস্তারিত পর্যালোচনা করে ফেললেন। সবাই ধড়াধর হাততালি দিয়ে বক্তাকে অভিবাদন করলেন। তারপরে আরও একজন বলে উঠলেন কার ক্ষমতা বাংলার চুল বাঁকা করে। লণ্ডনে, আমেরিকায়, আমাদের গোটা দেশে এত ভারতীয় আছেন যারা মনে প্রাণে বাঙালী। বাংলা ভাষার অস্তিত্ব, সঙ্কট, এই অঞ্চলের বাংলা ভাষায় পড়াশোনা নিয়ে অসুবিধা, বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষদের কর্মসংস্থান এসব নিয়ে তেমন কিছু শুনতে পেলাম না। একটু পরে নতুন প্রজন্মের একটি মেয়ে বক্তা তার বক্তব্য শুরু করলো। সে বলে উঠলো এত যদি বাংলা নিয়ে আপনারা এই মঞ্চে বসে এত আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন, বাংলা ভাষার কেউ একচুলও বাঁকা করতে পারবে না, তাহলে এই আসামে এত আত্মহত্যা কেন, এন আর সি’র নামে বাংলাভাষীদের এত হেনস্থা কেন, কেন এই আসামে এত ডিটেনশন ক্যাম্প। কেন শুধু মাত্র বাংলা ভাষায় কথা বলার অপরাধে এই রাজ্যে হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষ জেলে বন্দী বাংলাদেশী তকমা নিয়ে। এই কেন গুলোর জন্য কারা প্রশ্ন করবে?
একটু পরেই একটা লম্বা মত লোক দর্শকাসন থেকে বার বার হাত দেখিয়ে অনুনয় করতে থাকলো আমি দুটি কথা কইতে চাই। আমি গোয়ালপাড়া থাইক্যা আইছি। অবশেষে সব বিশেষ ব্যক্তিগণের বক্তব্য শেষে সেই অতি সাধারণ দর্শককে মাইক দেওয়া গেল।
তিনি বলে উঠলেন, স্যার আমি এই পাশ দিয়া যাইতে আসলাম। আপনাগো কথা শুইন্যা ভেতরে আইলাম। আমগো অইখানে বাংলায় এভাবে কথা কওনের স্বাধীনতা নাই। আমরা ঘরেও মন খুইল্লা বাংলায় কথা কইবার পারি না…বলেই লোকটা হঠাৎ ঝরঝর করে মাইকের মধ্যেই কেঁদে ফেললো। বলে চলেছে আইজ এইখানে বাংলায় কথা কইতে পাইরা মনডা এমন শান্তি পাইতাসে গো। আপনারা আমাগো লাইগ্যা অল্প ভাইব্যেন। আপনাগো দেইখ্যা প্রাণটা জুড়াইয়া গেল।
আবার ঊনিশ এসেছে। ঊনিশের মহা পথ চলায় সবাই সেজেগুজে হাঁটছে। এবারও আমরা মহা ধুমধাম করে ঘটা করে ঊনিশে মে পালন করবো।
ওহো একটা কথা লিখতে ভুলে গেছি, এই সেদিন শহীদ বীরেন্দ্র সূত্রধরের ভাঙ্গা ঘরের চাল ঝড়ে উড়ে গেছে। খুব চেষ্টা চলছে যদি একটা পাকা ঘর অন্তত শহীদের পরিবারের জন্য কোনক্রমে ব্যবস্থা করা যায়, হ্যাঁ সবাই মিলে চেষ্টা করছে।

জয়শ্রী ভূষণ,শিলচর,আসাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Related post