নবারুণ ভট্টাচার্য প্রসঙ্গে

অশোক চট্টোপাধ্যায়
‘সংস্কৃতি সংসদ’-এর এক শারদ সংখ্যায় প্রয়াত কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের পিতা বিজন ভট্টাচার্য লিখেছিলেন :
আমরা এমন একটা সময়ের ভেতর দিয়ে চলেছি যে, কোন মুহূর্তই আর কারও জীবনে সেরকম সুখাবহ হয়ে উঠছে না।… বলা যায় বঙ্গোপসাগরে কতকটা ডিপ্রেসান-এর অবস্থাঃ ঝড়ের সংকেত দিচ্ছে। আমাদের নিরাপত্তা এক রেড সিগনাল-এ। তার বাইরে আমাদের আর কোন বিপত্তারণ পুজোপাঠ নেই। নির্ঘণ্ট অনুযায়ী ঘণ্টা বাজানো ছাড়া আমাদের আর কোন কার্যক্রম নেই।
এই উচ্চারণ আজও সমান প্রাসঙ্গিকতাকে সামনে নিয়ে আসে। ‘সেরকম সুখাবহ’ হয়ে উঠতে না-পারা এই অনির্বচনীয় সময় জুড়ে একটা ডিপ্রেসান ঝড়ের সংকেত দিয়ে আমাদের সামনে লাল আলো জ্বালিয়ে আমাদের সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। পার্থক্য হলো ঝড়ের ইঙ্গিত থাকলেও ঝড় উঠছে না, লাল আলো বিরতিবিহীন জ্বলছে আর নিভছে আর জ্বলছে। আমরা এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থার মধ্যে পড়ে হাঁফিয়ে উঠছি। সন্ত্রাস আমাদের চারপাশে চক্রব্যূহ রচনা করে বহাল রয়েছে।
গত শতকের সত্তরের দশকের সন্ত্রাস কবলিত রক্তে-ভাসা স্বদেশি সময়ে বিজন ভট্টাচার্য লিখেছিলেন :
পলাশি যুদ্ধের পর স্বদেশি বিশ্বাসঘাতক ও ইংরাজের চাটুকার দল তাবৎ প্রজার মাথা কেটে ছিন্নমুন্ডের মালা পরিয়ে দিলেন ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে। বাংলাদেশের ৯০-৯৫ ভাগ মানুষের রক্ত নিংড়ে সাম্রাজ্যবাদের পুণ্যাহ শুরু হল সেদিন। নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে গেল বাংলাদেশের চাষা কুলিকামিন জেলে খে্টে-খাওয়া অভাবী মানুষের দল। মধ্যবিত্তের শ্রীহীন সংসারে ঘুলিয়ে উঠল দুঃস্বপ্ন, হা-অন্নের ঘরে জননী সেদিন প্রেতিনী হলেন।
আর ঐতিহাসিকভাবে এর পরের ঘটনা যা তিনি বিবৃত করেছেন ১৯৬৭-র মাঝামাঝির পর তা হলো :
অগস্ট বিপ্লবে যে-মা সনকাকে দেখেছি মেদিনীপুরে, সেই মা-কেই দেখেছি পঞ্চাশ সালের মন্বন্তরে কলকাতার রাস্তায় বাতি-হাতে কাঁদতে। দাঙ্গার সময়ে সেই মায়েরই দেখেছি চিন্নমস্তা রূপ। নিজের রুধির নিজেই পান করে বলাধান করে নিচ্ছেন মা। কাঁখে-কোলে মা ষষ্ঠীর দান সেই মা-কেই দেখেছি বাস্তু হারিয়ে এসেছেন দেশঘর ফেলে শিয়ালদহ স্টেশনে। পরনে ছিন্নবাস, আলুথালু বেশ—স্বামীপুত্র খেয়ে ক্ষুধার্ত মায়ের তখনও আকণ্ঠ ভরে আছে। আবার সেই মা-ই হয়েছেন কাকদ্বীপে অহল্যা পাষাণী। মৃত্যুর সময়ে বলে গেছেন, আমি কোন রামচন্দ্রের জন্য এখানেই প্রতীক্ষা করে থাকব। কোথায় কাকদ্বীপ আর কোথায় তেলেঙ্গানা! মান্দাস ভেলা ফিরে আসছে বলে দুঃখিনী মা দেশের এক প্রান্ত থেকে আর–এক প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে বেড়িয়েছেন উল্কার মতো।
বিজন ভট্টাচার্য এক স্বপ্নাহত দার্শনিকের মতো এই উক্তি করেছেন। তাঁর যন্ত্রণা, বেদনার স্বরলিপি এখানে মূর্ত। কথাগুলো যেন কোনও ট্র্যাজিক নায়কের সংলাপ। কিন্তু এই সংলাপ স্পর্শের শক্তি রাখে, চেতনাকে আক্রমণ সক্ষম। কিন্তু আমাদের চিন্তা-মনন কি সত্যিই আক্রান্ত হয়? নবারুণ স্পষ্টতই স্বীকার করেছেন যে তাঁর পিতা বিজন ভট্টাচার্য ‘বামপন্থায়’ বিশ্বাসী ছিলেন তবে তাঁর মধ্যে ‘বেয়াড়া কট্টরপন্থার ছিটেফোঁটাও’ ছিলোনা। ‘বেয়ারা কট্টরপনার ছিটেফোঁটা’ যে ছিলোনা, তা উপরোক্ত বক্তব্যের নির্যাসে স্পষ্ট হয়। কিন্তু নবারুণের চিন্তা-মননে এই ‘বেয়াড়া বামপন্থার’ উগ্রতা অনেক সময়ই লক্ষ্য করা গিয়েছে যদিও তাঁর মধ্যে কোনও গোঁড়ামি ছিল না। নিজে যা সত্যি বলে মনে করতেন তা অবলীলায় বলে ফেলতেন, কোনওরকম দ্বিধাদীর্ণ হতেন না। স্পষ্ট মন্ত্রোচ্চারণের মতো তিনি মেকি বামপন্থীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন:
…মনে রেখ তোমার ও লাল
বড় কপট এক খুনখারাবি রং আদপে
মরচের ওরকম রং হয়, জং ধরার রং
হাতুড়ি ও কাস্তেকে তুমি অচল করে দেওয়ার চেস্টায় মেতেছো
অথচ হাতুড়ি ও কাস্তের এরকম সপক্ষতা করেও বর্তমান সমাজব্যবস্থার প্রতি বিতৃষ্ণ নবারুণ যখন আবার বলে ওঠেন :
…আমৃত্যু লিখে যাব প্রতিবাদ
উন্মত্ত হিংস্র ও ক্রুদ্ধ নিরবধি
এ যদি সমাজ হয়
তবে আমি সমাজবিরোধী।
তখন প্রতিবাদের স্বরলিপি রচনার শপথ আমাদের উদ্দীপ্ত করলেও শেষ দুই পংক্তির বক্তব্যের নির্যাস আমাদের বিস্ময়কে খানিকটা বিপন্ন না-হয়ে পারে না।
নবারুণ কখনও উগ্রতার মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন, কখনও আবার উগ্রতা সরিয়ে রেখে আশ্চর্য সংবেদনশীলতার পরিচয় রেখেছেন। তাঁর পিতা বিজন ভট্টাচার্য লিখেছেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় কোনওদিন সঙ্গীত বা নাটকে অংশগ্রহণ না করলেও ‘বেসুরো গলায় তাঁর আন্তরিক অনধিকারচর্চা’ বিজন ভট্টাচার্যদের কর্ম প্রচেস্টায় সবসময়ই ‘রসদ যুগিয়েছে’। নবারুণ একথা তাঁর পিতা নিকট শুনে থাকতে পারেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক অধঃপতন নিয়ে বামপন্থীরা, বিশেষ করে, নকশালপন্থীরা সমালোচনামুখর হলেও নকশাল আন্দোলনের ধারায় উজ্জীবিত কবি নবারুণ কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে অন্য এক শিল্পীসত্তার সন্ধানে যত্নশীল হয়েছেন ২০১২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত তাঁর ‘আনাড়ির নাড়িজ্ঞান’ শীর্ষক গদ্যসংগ্রহে তাঁর ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়; বিনম্র ব্যক্তিগত কথায়’। নবারুণ তাঁর এই নিবন্ধে লিখেছেন:
যেখানে আত্মজিজ্ঞাসা আর্তেজীয় কূপের জলের মতো উঠে আসা দরকার সেখানে শত পিপাসার মধ্যে নিথর থর মরুভূমি যখন জেঁকে বসে থাকে তখন সুভাষ মুখোপাধ্যায়-এর মতো লেখকরা তাঁদের কবিতা ও আখ্যানে সেই পিপাসা মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। … রুশ লেখক ভাসিলি গ্রসম্যান-ও একই চেষ্টা করেছিলেন। করেছিলেন জামিয়াতিন, বুলগাকভ, বাবেল ও মান্দেলস্তাম। …এঁদের অনেককে চরম দাম দিতে হয়েছে। লেখক হলে দাম দিতে হয়। দরকারে দলছুট হতে হয়।
লেখক হওয়ার সঙ্গে দাম দিতে হওয়া এবং দরকারে দলছুট হওয়ার বিষয়টিকেও নবারুণ দ্বিধাহীনতার সঙ্গেই বলেছেন। দলছুট হওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে নবারুণ অবলীলায় অনুমোদন দিয়েছেন!এটাই নবারুণের বৈশিষ্ট্য। আর এই বৈশিষ্ট্যরক্ষার ক্ষেত্রে নবারুণ সবসময় সতর্ক ও সচেতন থেকেছিলেন। তিনি ‘বনে যাওয়া ছেলেদের একজনকে’ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘হাংরাস’ পড়িয়েছিলেন। সময়টা ছিলো ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। সময়টাও লক্ষণীয়। এর মাত্র একবছর আগে তিনি লিখেছেন :
ত্রাস কী
আটজন স্পর্শ করছে
গ্রহণের অন্ধকারে ফিসফিস করে বলছে কোথায় কখন প্রহরা
তাঁদের কণ্ঠে অযুত তারকাপুঞ্জ ছায়াপথ সমুদ্র
গ্রহ থেকে গ্রহে ভেসে বেড়াবার উত্তরাধিকার—
কবিতার জ্বলন্ত মশাল
কবিতার মলোটভ ককটেল
কবিতার টলউইন অগ্নিশিখা
এই আগুনের আকাঙ্ক্ষাতে আছড়ে পড়ুক।
২
কার্ল মার্কস বলেছিলেন যে কোনও চিন্তার দার্শনিকীকরন করতে গেলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন হলো একটি স্বাধীন ও নির্ভীক মনের। বাস্তবিক এই স্বাধীন ও নির্ভীক মনের অনধিকারিত্বের দরুন আমাদের চিন্তা বারবার একটি বদ্ধ জলায় পড়ে অনবরত ছটফট করতে থাকে। প্রলোভন, ভয়, সন্ত্রাস ইত্যাকার উপসর্গগুলি সবসময়ই আমাদের স্বাধীনতাবোধকে বিপন্ন করে। প্রতিবাদযোগ্য ঘটনার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও আমরা হিসেব করি, সামনে দুবার আর পেছনে দশবার তাকাই, আবার হিসেব করি। শঙ্কিত হই। পাদুটো কে যেন চেপে ধরে। তারপর একসময় নতমস্তকে বাড়ি ফিরে আসি। এক একটা সময় বিবেকদংশনে বিদ্ধ হই, কষ্ট পাই, তবু সাহসী হওয়ার পরিবর্তে নীরবতা সুবর্ণময় বিবেচনায় আত্মকেন্দ্রিকতার আলস্যে আরাম কেদারায় বসে সুখনিদ্রায় স্বপ্নসন্ধানী হই। আমাদের এই ভূমিকায় রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীন সরকার খুশি হয়, আমরা সরকারি পুরস্কারে সম্মানিত হয়ে জীবন সার্থক বিবেচনায় হ্লাদিত হই। আমাদের এই ভূমিকার সমালোচনায় কে কী বললো আমাদের তাতে কিচ্ছু যায় আসেনা।
একজন সামাজিক মানুষের এ ধরনের ভূমিকা কাঙ্খিত নয়। বিশেষত বুদ্ধিজীবীদের এ ধরনের ভূমিকাকে মার্কস-এঙ্গেলস তারিফ করতে পারেননি। মার্কস তো সমাজের মানবিকীকরন ও মানবের সামাজিকীকরনের কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ সমাজ এবং মানুষের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়ে গিয়েছে। আর সম্পর্কের এই বিষয়টি অনড়, জড়বস্তু নয়। এই সম্পর্ক নিয়ত বিকাশশীল। সুতরাং বিভিন্ন সামাজিক ঘটনার প্রেক্ষিতে সামাজিক মানুষের প্রতিক্রিয়া খুব স্বাভাবিকভাবেই অবয়বিত হয়। সংঘটমান ঘটনার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে, সামাজিক দায়িত্ব অস্বীকার করে, আত্মসুখচর্চা শেষ অর্থে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের সহায়ক হয়ে ওঠে।
নবারুণ উপরোক্ত ভূমিকার বিপ্রতীপ অবস্থানে দৃঢ়বদ্ধ ছিলেন। তিনি তাঁর পিতা বিজন ভট্টাচার্য, মামা মনীশ ঘটক, ঋত্বিক ঘটকদের বামপন্থী রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে পিতার নিকটই তিনি মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, মাও-এর লেখাপত্তরের পাঠ নিয়েছিলেন। তাঁর পিতা তাঁকে কোনও বই পড়ার ব্যাপারে কখনও কোনওরকম নিষেধাজ্ঞা জারি করতেন না। ঋত্বিক ঘটক ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের মে-জুন সংখ্যার ‘অভিনয় দর্পণ’ পত্রিকায় লিখেছিলেন :
বাংলাদেশ চাষির দেশ। ইহার যে প্রাণ আহরণের ক্ষমতা তাহা তো ছাড়িয়া যাইবার কোন অবকাশ নাই। অনুবাদ নাটকে এই জীবন গাথা গ্রহণ করিবার কোন ক্ষমতা কাহারও নাই।..এইসব মেকি জিনিস ছাড়িয়া মানুষের (সঙ্গে?) সামিল হউন…মানুষকে ভালবাসা হইতেছে সর্বশিল্পে গভীরতম প্রশ্ন। … প্রধান প্রেরণার উৎস হইতে সরিয়া গেলে চলিবে না।
এই মানুষের সংসর্গে থেকে তাঁদের সংগ্রামে সহযোদ্ধা হওয়ার শিক্ষা বোধহয় নবারুণ এখান থেকেই পেয়ে থাকবেন। ঋত্বিককে নবারুণ ‘আমার অঙ্গীকার’ বলে উল্লেখ করেছেন। নবারুণ জেনেছিলেন যে এই ঋত্বিককে কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ অক্টোবর তারিখাঙ্কিত এক চিঠি দিয়ে তিনি আর পার্টির সদস্য নন বলে জানিয়ে দিয়েছিল। নবারুণ নিশ্চয়ই জানতেন যে সমসময়ের ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ঋত্বিকের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত চক্রান্ত করে তাঁকে পার্টি থেকে বহিস্কারের অপপ্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। এবং তাঁদের সেই অপপ্রচেষ্টা শেষপর্যন্ত সফলও হয়। ঋত্বিক লিখেছিলেন :
জনগণের কাছে পৌঁছতে হলে, কমিউনিস্ট ও অ-কমিউনিস্ট শিল্পীদের দিয়ে পার্টির আদর্শ প্রচার করতে হলে, জনগণের সংস্কৃতিকে বুঝতে হলে এবং অনেক বেশিসংখ্যক শিল্পীকে নিয়ে তার বিকল্প গড়ে তুলতে হলে—এবং এই সমস্ত কাজ অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে সম্পাদন করতে হলে কমিউনিস্ট শিল্পীদের অবশ্যই এই কর্মে রত অন্যদের সঙ্গে সাধারণ প্ল্যাটফর্মে মিলিত ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
ঋত্বিকের এই বক্তব্যের মধ্যে নবারুণ, একজন দীক্ষিত সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে, দিশা খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই মনে হয়। নিজের চিন্তাচর্চায় তিনি উপরোক্ত বক্তব্যকে বারবার মান্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। নবারুণের পিতা বিজন ভট্টাচার্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা পূরণচাঁদ যোশিকে একবার বলেছিলেন যে সাংস্কৃতিক কর্মীদের কাজ হলো জমি তৈরি করা আর কমিউনিস্ট পার্টির কাজ সেই জমিতে চাষ করা। পিতার এই অমোঘ উক্তিতে নবারুণের আস্থা ছিল। তিনি নিজেও একজন দায়বদ্ধ সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে এই জমি তৈরির কাজটিতে গুরুত্ব আরোপ করতে চেয়েছিলেন। নিজেকে ‘কলমের সিপাহি’ হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছিলেন নবারুণ। আর একারণেই তিনি কোনরকম দ্বিধা ব্যতিরেকেই বলেছেন :
যেখানেই হোক, যে মাপেরই হোক নিরপরাধ সাধারণ মানুষের ওপর অন্যায় আক্রমণ ও তজ্জনিত রক্তোৎসব ঘটলে কলমের সিপাহিরা চুপ করে বসে থাকতে পারে না। নন্দীগ্রামের কৃষক হত্যার ব্যাপারেও প্রতিবাদ জানাতে লেখকেরা এগিয়ে এসেছেন।
মানবিকতার দলন, মানুষের ন্যায্য অধিকারহরণের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে দ্বিধান্বিত হননি নবারুণ। তিনি জানতেন সমাজের নিচুস্তরের যে কোন একটা আন্দোলনও শেষ অর্থে রাষ্ট্রবিরোধী। তাই রাষ্ট্র, সরকার এবং বর্তমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একজন সচেতন ‘কলমের সিপাহি’ হিসেবেই তিনি যুদ্ধঘোষণায় সামিল হয়েছিলেন। চীন এবং ভিয়েতনামে ‘জোর’ করে কৃষকের জমি ছিনিয়ে নেবার বিরোধিতায় কলমী প্রতিবাদের জন্যে বেশ কিছুসংখ্যক লেখক রাষ্ট্রের কোপানলে পড়েছিলেন, এমত তথ্য জানা সত্ত্বেও নবারুণ নন্দীগ্রামে সরকারি দমন পীড়নের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদের পথে সংলগ্ন হয়েছিলেন।
সামাজিক আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের যে একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে এবং বিভিন্ন দেশের লেখক-বুদ্ধিজীবীরা যে এইসব আন্দোলনে ‘কলমের সিপাহি’ হিসেবেই সামিল হয়েছিলেন, এমন নজির তো সুলভ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধের সময়, অসংখ্য লেখক-বুদ্ধিজীবীরা মসী ছেড়ে অসি হাতে যুদ্ধে নেমেছিলেন, অনেকে শহিদ হয়েছিলেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় পাবলো নেরুদা, অরাগঁ, অডেন প্রমুখ লেখকেরা দুটো প্রশ্ন রেখেছিলেন : আপনি/তুমি স্পেনের জনসাধারণ ও সরকারের পক্ষে কিনা এবং ফ্রাঙ্কো ও ফ্যাসিবাদের পক্ষে কিনা। উত্তর যা এসেছিল তার বেশিরভাগই স্পেনের মানুষ আর সরকারের পক্ষে আর ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দেও অনুরূপ অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছিল আমেরিকার ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়। নবারুণ তো কবি সরোজ দত্ত, অমিয় চট্টোপাধ্যায়, দ্রোণাচার্য ঘোষ, তিমিরবরণ সিংহ, আশুতোষ মজুমদার সহ সুব্বারাও পানিগ্রাহী প্রমুখকে ‘কলমের সিপাহি’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলি হতে দেখেছেন। নবারুণ লিখেছেন :
আশু মজুমদারকে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসার সময় যাদবপুর থানার পুলিশ খুন করেছিল। দাহ করার সময় অত্যন্ত কড়া প্রহরায় তাঁর মৃতদেহ যখন কেওড়াতলায় নিয়ে যাওয়া হয়, সেদিন ঘটনাচক্রে আমিও সেখানে হাজির হয়েছিলাম।
সত্তরের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নবারুণ স্বচক্ষে দেখেছেন, অসংখ্য স্বপ্নপাগল তরুণ-তরুণী ক্যারিয়ারের মোহ ছুঁড়ে ফেলে শোষণমুক্ত ভারতবর্ষের গান গাইতে গাইতে হাসতে হাসতে সশস্ত্র রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড গড়ে অসম লড়াইয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। বারাসাত, বরানগর সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে পুলিশ ও দলীয় খুনে বাহিনীর যৌথ আক্রমণে নিহত হয়েছিলেন অসংখ্য তরুণ। এসব ঘটনাবলী নবারুণকে ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ করেছিল, প্রতিবাদে বেহিসেবি সাহসী করেছিল। নিজে কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না-থাকলেও পরিবেশ, পরিস্থিতি, স্বদেশ ও স্বকাল নবারুণকে রাজনৈতিক প্রতিবাদের অগ্নিময় রাজপথে টেনে এনেছিল। সে সময়ের শহিদদের তিনি কখনও ভুলতে পারেননি। স্বপ্নের জন্যে তাঁদের শহিদত্ব তাঁকে তাঁদের স্বপ্নপূরণের প্রতি দায়বদ্ধ করেছিল। শুধুমাত্র কংগ্রেস সরকারের তরফে সংগঠিত রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সন্ত্রাস ও গণহত্যাই নয়, সেই সত্তরের দশকেই, গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল খোদ সেই দলের ক্যাডারদের হাতেই যারা সাতাত্তরের পরে ‘বৃহত্তর বামপন্থী’ দল হিসেবে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। গণহত্যা সংগঠিত করার সময় মুমূর্ষুদের একফোঁটা জল পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। সেই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে নবারুণ লিখেছেন :
এই হত্যাকাণ্ড পুলিশ করেনি।করেছিল ক্ষমতাসীন বৃহত্তম বামপন্থী দল। যার নেতা একসময়…প্রশ্ন করেছিলেন, পুলিশের বুলেটে নিরোধ পরানো আছে কিনা, কারণ প্রত্যাশিত সংখ্যায় নকশাল মরছে না। ইনিই প্রস্তাব করেছিলেন যে, পুলিশরা সরে দাঁড়াক, তাঁর দল নকশাল সমস্যা চুকিয়ে দেবে।
স্বভাবতই সেইসব সন্ত্রাসের কথা, শহিদদের কথা, তাঁদের স্বপ্নের কথা নবারুণ বিস্মৃত হক্তে পারেননি কোনদিন। সত্তরের মৃত্যু উপত্যকায় এবং উত্তরকালে তথাকথিত বামজমানায় কিম্বা তারও পরে ‘পরিবর্তনের’ আবরণ-খসে-পড়া মমতাময়ীর চলতি নয়াজমানার মধ্যে নবারুণের চোখ কোনও মৌলিক পার্থক্যের সন্ধান পায়নি। নবারুণের উগ্রতা, অশান্তচিত্ততা, মুক্তির পথসন্ধিৎসা আবার একই সঙ্গে অদ্ভুত সংবেদনশীলতা একরৈখিকতায় সচল থেকেছিল।
৩
গ্যেটে লিখেছিলেন : মানুষ যখন আর কষ্ট সহ্য করতে অপারগ হয় তখন তার জন্য থাকে প্রকৃতি-প্রদত্ত চোখের জল, আর যন্ত্রণা সহ্য করতে না-পারার জন্যে আর্ত কান্না; আর এই যন্ত্রণা প্রকাশের ভাষা হিসেবে কবির কাছে থাকে সুরে-না-বাঁধা সঙ্গীত—সাধারণ মানুষ যখন যন্ত্রণায় বোবা হয়ে যায়, তখন কবি হিসেবে আমি আমার যন্ত্রণাকে কাব্যিক ভাষায় প্রকাশ করি। আর শেকশপিঅর বলেছেন সমুদ্রপ্রমাণ সমস্যাদীর্ণ যন্ত্রণার বিপ্রতীপে বিরুদ্ধতার চাবুক ওঠাতে। একজন কবি চাইছেন মূর্ত বেদনার কাব্যিক প্রকাশ ঘটাতে, আর অন্যজন চাইছেন যুদ্ধ ঘোষণা করতে। অসহায়তায় যন্ত্রণাহত মানুষ একটা পর্যায় পর্যন্ত ক্রন্দন করে, কিন্তু সহ্যেরও একটা সীমা আছে। সেই সীমা লঙ্ঘিত হলে সেই বেদনাদীর্ণ মানুষই মরিয়া হয়ে রুখে দাঁড়ায়। হয়তো পরাজিত হয়, তবু সে একটা বার্তা রেখে যায় তার পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে। এভাবেই বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত হয়ে চারিয়ে যায়। আমাদের দেশের অসংখ্য বিদ্রোহের মধ্যে এই তথ্যটি খুঁজে পাওয়া যাবে।
লেনিন বলেছেন যে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো এবং ঝেঁটিয়ে বিদায় করার মতো পদ্ধতিগুলো সবচাইতে খারাপ –আমাদের তরুণ লেখক শিল্পী এবং কমিউনিস্টদের এই বিষয়গুলি মাথায় রাখা দরকার। অথচ আমরা লেনিনের এই পরামর্শকে কতটা মান্যতা দিয়ে থাকি? নবারুণ লিখেছেন :
যদি আমরা ব্যাপক মানুষকে, শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্তকে এই জায়গায় দাঁড় করাতে পারি তাহলেই আমরা গ্রীণ হান্ট রুখতে পারব। শহরের কতিপয় বুদ্ধিজীবী পাবলিসিটির জন্য লাল চশমা পরে …লাল জামা গায়ে কিছু ভাবলে বা বললে গ্রীণ হান্টের কিছু এসে যায়না। সঙ্কটটা অনেক গভীরে।… কেউ যদি আজকে ভেবে থাকেন যে ফায়ার পাওয়ার দিয়ে এই যুদ্ধটা জিতব… ভাবতেই পারেন কেউ। কিন্তু বিশ্বের ইতিহাস তা বলেনা ।…আজকে আমরা যারা লিখি, ছবি আঁকি, গান গাই, পড়াই বা কোনো কাজ করি, আমাদের দায়িত্বটা পালন করা দরকার। এবং দায়িত্বটা আমরা সকলের জন্যই পালন করব। মাওবাদীদের জন্যও করব। সকলের জন্যও করব। এইটেই আজকের কাজ আর এই কাজটা করতে না পারলে খুব বড় ভুল বা বড় অন্যায় হয়ে যাবে।
লেনিন-কথিত ঝেঁটিয়ে বিদায় করার মতো সব চাইতে খারাপ কাজ-এর বিষয়টিকে নবারুণ যে কতখানি গভীরতা থেকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছিলেন, তার প্রমাণ এখানেই। কোনওরকম সঙ্কীর্ণতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে খোলামনে প্রতিবাদের বিষয়টিকে নির্দিষ্ট করে নবারুণ প্রকৃত বামপন্থী সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে একটা গুরুদায়িত্বের কথা এখানে ব্যক্ত করেছেন। আর এব্যাপারে তিনি যথেষ্ট সাহসী। এই বক্তব্যের জন্যে কে তাঁকে উগ্রপন্থী তকমা ভূষিত করলো কিম্বা তাঁর বক্তব্যকে পার্টিলাইনের বিরোধী বলে বন্ধুবর্গের মধ্যে প্রচার রেখে আত্মতৃপ্তি পেতে চেষ্টা করলো, তা নিয়ে তিনি ভাবিত হননি। বরং তিনি সরাসরি বলেছেন :
আজকের অবস্থানে পার্টিবাজি করে বেশি দূর এগোনো যাবেনা সেটা বোধহয় আর নতুন করে বলার দরকার নেই। ট্রটস্কি বা বুখারিন কত অপরাধ করেছিলেন জানিনা, তবে শাস্তি বেশ মোক্ষমই হয়েছিল। আজ মনে হয় যাঁরা অভ্রান্ত বলে পূজিত হচ্ছেন তাঁদের অবস্থানটাও প্রভূত গোলমেলে। বিপ্লব কারো ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তি নয়। এ বিষয়ে জন্মগত অধিকার বা দক্ষতা নিয়ে কেউ জন্মায় না। এবং বিপ্লব ও মুক্তির দুনিয়ায় মৌলবাদ অচল।
মনে রাখা দরকার যে নবারুণ ভট্টাচার্য কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। বিগত শতকের সত্তরের দশকে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সন্ত্রাসের দিনগুলিতে মুক্তির স্বপ্নদেখা দুর্জয় সাহসী তরুণ-তরুণীরা যেভাবে বিশ্ববিপ্লবের সুপবনে পতাকা উড়িয়ে উন্মুক্ত বেঅনেটের সামনে বুক পেতে দিয়ে হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করে যে এক নতুন দর্শনের জগৎকে অনাবৃত করে গিয়েছিলেন, তা সমসময়ের তরুণ নবারুণকে উদ্দীপ্ত, সাহসী করে তুলেছিল। তারুণ্যের বিদ্রোহের বিস্ফোরণে চমকিত নবারুণ পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও ক্রোধের অনিয়ন্ত্রিত আবেগে বলেছিলেন : ‘যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায়/ আমি তাকে ঘৃণা করি’।
নবারুণ স্বীকার করেছেন যে তিনি ‘ব্যক্তিগতভাবে মার্কসবেত্তা’ নন। তিনি একজন নিতান্তই ‘নগণ্য লেখক’মাত্র। শুধু তাই নয়, স্বস্বীকৃতিতে সত্তরের বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল ‘স্পর্শকের’। আরও স্পষ্ট করে তিনি বলেছেন :
রাজনীতি যে খুব ভালো বুঝি তা নয়। মার্কসবোধও কাঁচা। কিন্তু সাম্প্রতিক স্বদেশে যে কাণ্ডকারখানা চলছে তা দেখে মনে হয় ভারত, আমার মহান ভারত যেন একটি ল্যাবরেটরি যেখানে প্রতিনিয়ত নানা পরীক্ষায় মার্কসবাদের যৌক্তিকতা ও যুগোপযোগিতা যেন প্রমাণিত হচ্ছে।
আর এসবের পর তিনি, অসংখ্য বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করার পরও, দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে তিনি বিপ্লবে বিশ্বাস হারাননি এবং চে গ্যেভারার সেই বিখ্যাত পংক্তি স্মরণ করিয়ে দেন : প্রত্যেক বিপ্লবীর কর্তব্যই হচ্ছে বিপ্লব সংঘটিত করা।
নবারুণ মনে করতেন সমাজতন্ত্র কায়েমের নামে ‘বড় বেশি নিষ্ঠুরতা’ হয়েছে। পল পট-কে তিনি গণহত্যাকারী বলে আখ্যা দিতে দ্বিধান্বিত হননি! মায়াকোভস্কি এবং এসেনিন আত্মহত্যা করেছিলেন, এই প্রচারিত তথ্যকে মান্যতা দিতে অপারগ হয়েছেন তিনি। আসলে মার্কসীয় দর্শনের বিশুদ্ধতাবাদের সঙ্গে নবারুণ মানবিকতার একটা সংমিশ্রণ ঘটাতে চেয়েছিলেন, তাই কী? মার্কসবাদের চাইতে মানবিক দর্শন আর কী হয়? মার্কসবাদের নামে অমানবিক আচার-আচরণের বাহুল্যদর্শনে বিরক্ত নবারুণ সম্ভবত এভাবে ভাবতে চেয়েছিলেন, নিজের মতো করে মার্কসবাদকে বুঝতে এবং একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে তার প্রায়োগিক অনুশীলনে অভ্যস্ত থাকতে চেয়েছিলেন। তবে নবারুনের মধ্যে একটা নৈরাজ্যবাদী অবস্থান বজায় ছিল। তিনি মনে করতেন যে কোনও লেখকের উচিত ‘নৈরাজ্যবাদী অবস্থান ছুঁয়ে থাকা’। তিনি লিখেছেন :
নৈরাজ্যকে যেমন স্পর্শকের স্পর্ধায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে আছি তেমনই দুই চুম্বনমুখী প্যারাবোলা নিকট কিন্তু চিরবিচ্ছিন্ন। …মৃত্যু নিকট জেনেও আমি এখন কিয়দংশে স্বপ্ন নির্মাণ করতে পারি। বাহাত্তর এগারো এগারো ভাগে কাঠকয়লা সোরা ও গন্ধক দিয়ে বোমা বানিয়ে এরকমই গনগনে আনন্দ পেয়েছিলাম এক সময়। সেই বিক্ষোভের স্বপ্ন দেখাতেও ঝুঁকি ছিল। স্বপ্ন দেখলে ঝুঁকি থাকবেই।… শত আঘাত, সহস্র পরাজয়, লক্ষ মরণ—কোনো কিছুই আমাকে বিপ্লব ও মুক্তির পথ থেকে সরাতে পারবে না। তার কারণ, আমি রাজপথে ফেলে রাখা বোমা নই। আমি মানুষ। আমি লিখি। এবং সংক্রামক।
নবারুণ মনে করতেন কমিউনিস্ট পার্টি মানেই ‘পবিত্র, নিত্য’ এজাতীয় কিছু নয়, সময় ফুরোলে কমিউনিস্ট পার্টি ‘থাকবে না’! কিন্তু নানাবিধ অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতনের প্রবহমানতার বিরুদ্ধে ‘অনেক প্রাচীন ও পবিত্র একটা কাজ’ হিসেবে লড়াইটা থেকে যাবে এবং এই লড়াই চলতেই থাকবে। নবারুণ এই চলমান লড়াইয়ের প্রক্রিয়ায় সাংস্কৃতিক আয়ুধ হাতে নিয়ে অনলস রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কৃষকদের ওপর গুলিচালনার বিরুদ্ধে সরব ‘ধিক্কার’ জানিয়েও নিজের মনেই প্রশ্ন করেছেন : ফাঁকা ধিক্কারে কিছু হয় কী? ‘গুলি চালানোটা নিষিদ্ধ করা যায় না?’ কিন্তু কে এবং কেন গুলিনচালনা নিষিদ্ধ করবে, একথা কি নবারুণ জানতেন না? তিনি জানতেন তথাকথিত বামজমানায় সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে যা হয়েছে তা ‘অন্যায়’, বর্তমান ‘পরিবর্তনের’ জমানায় মানুষের মৌলিক অধিকারহরণের যে সরকারি অনুশীলন জারি আছে তা অন্যায়, অবিহিত। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার, প্রতিরোধ গড়ে তোলার ‘অধিকার’ মানুষের আছে এবং প্রতিবাদী মানুষের সেই লড়াইয়ে ‘কাঁধ লাগানোটা’ লেখক হিসেবে তাঁর কর্তব্য। তবে তিনি আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে তিনি কোনও ‘প্রত্যক্ষ রাজনীতি’ করেননা, তবে তাঁর লেখালেখির মধ্যে অবশ্যই ‘রাজনীতি’ থাকে।
পার্টি রাজনীতির অনুবর্তী না-হয়েও ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের সময়কাল থেকে নবারুণ ‘পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ’-এর সঙ্গে শারীরিকভাবে যুক্ত হন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই সংগঠনের সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করে গিয়েছেন। এই সংগঠনের অভ্যন্তরে তিনি মানসিক স্বস্তির সন্ধান পেয়েছিলেন। সংগঠনের বিভিন্ন সভায়, মিটিং কিম্বা সমাবেশে তিনি বারবার ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থানের বিষয়ে সতর্ক করতেন এবং ফ্যাসিবাদের মোকাবিলায় শিল্পী সাহিত্যকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন। সার্ত্রে বলেচিলেন : আমরা আমাদের কথা বলার অধিকার থেকে শুরু করে সব অধিকারগুলোই হারিয়েছি; প্রতিটি দিন-ই আমরা অপমানিত হই এবং একান্তে নীরবে যন্ত্রণাহত হই।–এই রুদ্ধশ্বাস অবস্থা ফ্যাসিবাদী জমানার কথা মনে পড়িয়ে দেয়। আমাদের দেশের শাসকবর্গের, তা সে যে বর্ণ বা ধর্মেরই হোক না কেন, আগ্রাসী আচরণ এবং আক্রমণাত্মক সংস্কৃতি একটা অস্বস্তিকর, যন্ত্রণাদায়ক পরিবেশ-পরিস্থিতি সবসময় জারি রাখে। ফলে জনস্বার্থ বিঘ্নকারী এই পরিবেশ অনবরত খারাপ সময়ের জন্ম দেয়। ভালোসময় অধরাই থেকে যায়। নবারুণ লেখেন :
খারাপ সময় কখনও একলা আসে না
তার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ আসে
তাদের বুটের রঙ কালো
খারাপ সময় এলে রুমাল দিয়ে হাসি
মুচে ফেলতে হয়
ফুসফুস গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়
জুয়ার বাজার মরা জন্তুর মতো ফুলতে থাকে
ভালোবাসার গলা কামড়ে ধরে ঝুলতে থাকে ভয়…
এই ভালোবাসার গলা-কামড়ে ঝুলে-থাকা ভয়ের আবহেই প্রতিবাদের সংস্কৃতির বেড়ে ওঠার স্পন্দন ইতিহাসের নির্মিতি দেয়। ইতিহাস সততই নির্মম, সে কোনও লোফারের পৃষ্ঠপোষক হয়না। আমাদের দেশের ‘বুদ্ধিজীবনে ক্লীবতার লজ্জাহীন প্রদর্শনী’র সামনে দাঁড়িয়ে নবারুণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন, উত্তেজিত হয়েছেন, বলেছেন ‘পুঁজির পিশাচবুদ্ধির ভাইরাস’ যেভাবে দ্রুতবেগে সমাজের সর্বস্তরে বিস্তৃতিলাভ করছে তাতে করে ‘ঘুম ছুটে যাওয়ারই কথা’; তথাপি বুদ্ধিজীবীদের নাক ডাকার শব্দ কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।ঘনীভূত অন্ধকারে নবারুণের মনে হয়েছে :
রাত একটা পুলিশভ্যান
রাত একটা কালো পুলিশভ্যান
এতদসত্ত্বেও নবারুণ হতাশ নন, বরং তিনি নাটকের সংলাপের মতই ধীরে ধীরে উচ্চারণ করেন :
গাছের ডালের ছায়া ক্রুশের মতো দেখতে
ক্রুশ যখন রয়েছে তখন আছে তাতে
ওঠার মানুষ, ওঠাবার মানুষ,
মানুষের হাতে পায়ে পেরেক মারার মানুষ
তাই সবটাই যখন অবশ্যম্ভাবী, পূর্বনির্ধারিত, অমোঘ
তখন কেন একবার চিৎকার করে উঠব না
একবার চেষ্টা করব না স্বাধীন, মুক্ত, অবাধ হবার
আর কী করার আছে তোমার, আমার, আমাদের,
দেশবাসীর?
নবারুণ এমন একটা সমাজব্যবস্থার প্রত্যাশী ছিলেন যেখানে কোনও মানুষের একমুঠো ভাতের অভাব হবে না, প্রত্যেকটি শিশুর শিক্ষার সুব্যবস্থা থাকবে, থাকবে তাদের জন্যে অবারিত খেলার মাঠ। এমন সমাজব্যবস্থাই তো মার্কসবাদীরা, প্রকৃত বামপন্থী ও কমিউনিস্টরা, চান এবং তার জন্যেই তো তাঁরা অনলস লড়াই করে চলেছেন। আর এখানেই নবারুণ নৈরাজ্যবাদকে অতিক্রম করে মার্কসবাদীদের নির্ভরযোগ্য সহযোদ্ধা হয়ে উঠেছেন।
অশোক চট্টোপাধ্যায় : বিশিষ্ট কবি ও প্রাবন্ধিক।