শিল্পনগরী চিত্তরঞ্জনে সাঁওতালদের সংগ্রাম আজ বিস্মৃতপ্রায় কাহিনী

দূর্বাদল চট্টোপাধ্যায়
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় সরকার রেলইঞ্জিন কারখানা নির্মাণের উপযুক্ত স্থান হিসেবে আসানসোল মহকুমার সালানপুর ব্লকের একটি আদিবাসী বসতিপূর্ণ অঞ্চলকে মনোনীত করে। অধুনা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের জামাতাড়া জেলার সঙ্গে সংযুক্ত অঞ্চলটি তৎকালে বিহার রাজ্যের সাঁওতাল পরগণা নামে পরিচিত। ওই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সুন্দরপাহাড়ী, আমলাদহি, উপরকেশিয়া, বড়মুড়ি, ফতেপুর ও দুর্গাডি সহ আরও কয়েকটি গ্রামের অবস্থিত থাকার কথা শোনা যায়। বিভিন্ন গ্রাম মিলিয়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলটিতে বসবাস করত সর্বমোট ৫২০ টি পরিবার । তার মধ্যে আদিবাসী সাঁওতাল পরিবারের সংখ্যা ছিল তিনশো তিরিশ। সাঁওতাল ব্যতীত কোঁড়া, তেলি, কুমোর, সুঁড়ি, বাউরি সহ আরও কয়েকটি সম্প্রদায়ের কথা জানা যায় যাদের বেশিরভাগই বসবাস করত আমলাদিহি গ্রামে।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে সালানপুরের ওই অঞ্চলে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক আনুকুল্যে রেলইঞ্জিন কারখানার প্রকল্প নির্মাণের কাজ শুরু হয়। একই সঙ্গে সরকারের বরাদ্দকৃত ৭.৬৬ কোটি টাকা অর্থে শুরু হয় আবাসন নগরী নির্মাণ প্রকল্পের কাজ। তাবু খাটানো হয় চীফ ইঞ্জিনিয়ারের। এসে পৌঁছায় সারি সারি বুলজোডার। আগমন ঘটে বিভিন্ন ঠিকাদারের। ডিনামাইটের সাহায্যে ভাঙা হয় বেশ কয়েকটি স্বল্প উচ্চতার পাহাড়। প্রকল্প নির্মাণে পূর্বেই এলাকার জমিদার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বিস্তীর্ণ খাস জমি লোকচক্ষুর অন্তরালে সরকারি সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছিল। সেখানে বসবাসকারী মানুষদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারের তরফ থেকে জমি প্রদান করা হয় নিকটবর্তী নামোকেশিয়া, গিয়াডোবা এবং জোড়বাড়ি নামক গ্রামে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় জমি বন্টনের পরিমাণ কম হওয়ার দরুন বেশিরভাগ পরিবারই এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহী ছিলেন না। যার ফলস্বরূপ ৫২০ টি পরিবারের মধ্যে মাত্র ১১৩ টি পরিবার সরকারের বরাদ্দ জমিতে তাদের বসতি স্থাপন করে।
আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ৩৩০ টি পরিবারের মধ্যে মাত্র ৮১ টি পরিবার সরকারের বরাদ্দ জমিতে স্থানান্তরিত হলেও বেশিরভাগই তাদের পুরোনো ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরে থাকে। ফলস্বরূপ তাদের বসবাসের জমিতে প্রকল্প নির্মাণের কাজে বিঘ্ন ঘটে। সংঘাত বাধে সাঁওতালদের সঙ্গে ঠিকাদারের লোকজনের । বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী সাঁওতালরা অস্ত্র হাতে রুখে দাঁড়ায় । থেমে যায় বুলডোজারের গর্জন। প্রাণ বাঁচাতে ঠিকাদারেরা আশ্রয় নেয় প্রায় বারো মাইল দূরবর্তী স্থান আসানসোল শহরে। স্থানীয় জমিদারও আদিবাসী সাঁওতালদের দৃষ্টিতে চরম শত্রু হয়ে উঠল। ক্রোধান্বিত হয়ে সাঁওতালরা তাকে হত্যার চেষ্টা করে। দল বেঁধে সাঁওতালরা জমিদার বাড়িতে হানা দিয়ে সেখানে অগ্নিসংযোগ ঘটায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের নির্দেশে মোতায়েন করা হয় বিশাল সশস্ত্র বাহিনী। রাইফেলের বুলেটের কাছে তীর ধনুক অতি সহজেই হার মানে। মুক্ত হয় বুলডোজার চলার বাধা সৃষ্ঠির পথ। অবশেষে তিন বছরের কম সময়ের মধ্যে ১৯৫০ সালে সম্পূর্ণ হয় কারখানা ও আবাসন নগরী নির্মাণ প্রকল্পের কাজ। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক ভাবে কারখানায় উৎপাদন শুরু হয়।
সাত দশকের অধিক সময় অতিক্রান্ত হওয়া চিত্তরঞ্জন রেলইঞ্জিন কারখানার ইতিহাস সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য খনি ও শিল্পাঞ্চলে অনেকেরই জানা। কিন্তু এই শিল্পনগরী গড়ে ওঠার সময় বলপূর্ব জমি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সেখানকার আদিবাসী সাঁওতালদের সংগ্রাম আজ বিস্মৃতপ্রায় কাহিনী। দরিদ্র ও নিরক্ষর আদিবাসী সাঁওতালরা তাদের বাসযোগ্য ভূমিতে কারখানা স্থাপনের বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র আপত্তি করেনি। শুধু পুনর্বাসনের স্থানে তারা একই পরিমাণের কৃষিজমি সরকারের কাছে দাবি করেছিল। চরম দারিদ্রতা সত্ত্বেও স্বাধীনতার পূর্বে সালানপুর অঞ্চলে বসবাসারী কষ্ট সহিষ্ণু আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায় মানুষদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিন্দুমাত্র বিঘ্নিত হয়নি। কিন্তু স্বাধীনোত্তর সময়ে সরকারি ভাবে জমি অধিগ্রহণের একটি ভ্রান্ত নীতি তাদের জীবনে যেন সব কিছুই তছনছ করে দেয়।
জমি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চিত্তরঞ্জনের আদিবাসী গ্রামগুলিতে কতজন সাঁওতাল শহীদ হয়েছিলেন তা আজও অজ্ঞাত হয়ে আছে। ফিল্ম ডিভিশন অফ ইন্ডিয়ার নির্মিত চিত্তরঞ্জন রেলইঞ্জিন কারখানার সাদাকালো তথ্যচিত্রেও আদিবাসী উচ্ছেদ সম্পর্কে কোন কিছুই উপস্থাপিত হয়নি। বরং প্রকল্প নির্মাণের পূর্ববর্তী সময়ের বিস্তীর্ণ স্থান জনশূন্য স্থান রূপে তথ্যচিত্রের দৃশ্যে ফুটে উঠেছে। ওই তথ্যচিত্রে এমনও দৃশ্য দেখানো হয় যে প্রকল্প নির্মাণের সময় সাঁওতাল দম্পতিরা সেখানে আনন্দের সঙ্গে কোদাল দিয়ে মাটি খনন করছে।
লেখক অমল দাশগুপ্ত ষোলো মাস চিত্তরঞ্জন রেলইঞ্জিন কারখানায় কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। সেই সময়ে চিত্তরঞ্জন রেলইঞ্জিন কারখানা ও আবাসন কলোনি সম্পর্কে ‘কারানগরী’ গ্রন্থটি তিনি রচনা করেন। সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত ওই গ্রন্থে চিত্তরঞ্জন গড়ে ওঠার সময় সাঁওতাল উচ্ছেদের স্বল্প বিস্তর উল্লেখ পাওয়া যায়। বাড়ির মধ্যে পরিবারের কেউ নেই ভেবে বুলডোজারের সাহায্যে কুঁড়ে ঘর গুড়িয়ে দেওয়ার সময় সেখানে ঘুমন্ত আট মাসের শিশুর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। জমি উচ্ছেদ অভিযানের এমন নির্মম ঘটনার কথা অমল দাশগুপ্ত তাঁর কারানগরী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
চিত্তরঞ্জন রেলইঞ্জিন কারখানার গড়ে ওঠার পূর্বে ওই স্থানে দুর্গাডি সহ আরও কয়েকটি গ্রাম ছিল। চিত্তরঞ্জন আবাসন নগরীতে বর্তমানে আদিবাসী গ্রামগুলির কোন অস্তিত্ব না থাকলেও সুন্দরপাহাড়ী, আমলাদহি, ফতেপুর এই নামগুলি সেখানে প্রচলিত । এই আবাসন নগরী অতীতে যে পাহাড় ঘেরা অঞ্চল ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আবাসন নগরীতে এক সময় আদিবাসীদের খনন করা জলাশয়গুলির দৃশ্য অতি মনোরম। শীতের সময় ওই জলাশয়গুলিতে আগমন ঘটে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখির।
তথ্য ঋণ : আদিবাসীদের জীবনে শিল্পায়নের প্রভাব, প্রণব কুমার দাশগুপ্তবিশেষ ।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: প্রভাকর চট্টোপাধ্যায়
দূর্বাদল চট্টোপাধ্যায় :আসানসোল নিবাসী,সাহিত্যকর্মী।