‘আসানসোল মাইন্স বোর্ড অফ্ হেল্থ’ শতবর্ষেরও অধিক পুরোনো একটি স্বাস্থ্য সংস্থা

দূর্বাদল চট্টোপাধ্যায়
নানাবিধ কারণে ১৮৯০ সাল থেকে রানিগঞ্জ কয়লা অঞ্চলে স্থানীয় বাউরি সম্প্রদায় শ্রমিকদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেতে থাকে। যার দরুন কয়লাখনির মালিকরা ‘আড়কাঠি’-দের মাধ্যমে ভিন রাজ্য বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও ওড়িষ্যা থেকে শ্রমিক এনে রানিগঞ্জ কয়লা অঞ্চলের বিভিন্ন খনিতে নিযুক্ত করে। গোড়ার দিকে ভিন রাজ্যের শ্রমিকদের বসবাসের কোন উপযুক্ত বাসগৃহ না থাকার কারণে শ্রমিকরা নিজেরাই নির্মাণ করেছিল অস্থায়ী ঘর। ফলস্বরূপ রানিগঞ্জ-আসানসোল অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠে বালিয়া বস্তি, মুঙ্গের বস্তি, ছাপরা বস্তি, ওড়িয়া ধাওড়া, গয়া মহল্লা সহ আরও অন্যান্য নামে পরিচিত জনবসতি । কিন্ত ওই সমস্ত বস্তির অস্থায়ী বাসগৃহে পর্যাপ্ত পরিমাণের সূর্যালোক ও বায়ু প্রবেশের সুবন্দোবস্ত ছিল না। ছিল না শৌচালয় ও পানীয় জলের ব্যবস্থা। যার দরুন সেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টির হয়। বস্তিগুলিতে মাঝে মধ্যে কলেরা, আন্ত্রিক, ম্যালেরিয়া, গুটিবসন্ত, প্লেগ ইত্যাদি নানান মহামারীর প্রাদুর্ভাবের ফলে অনেক খনিশ্রমিকের মৃত্যুর কথা শোনা যায়। অনেকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাদের রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করে। ব্যঘাত ঘটে কয়লা উত্তোলনের কাজে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯০৮ সালে কলেরা মহামারীর কারণে ছোটনাগপুর মালভূমির রানিগঞ্জ ও ঝরিয়া কয়লা অঞ্চলে বেশ কয়েকটি কয়লাখনি বন্ধ থাকে। অবশেষে ‘বেঙ্গল মাইনিং সেটেলমেন্ট অ্যাক্ট’ ১৯১২ সালে ভারত সরকার কর্তৃক গঠিত হয়। সেই আইন অনুযায়ী ১৯১৪ সালে আসানসোল-রানিগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চলের জন্য ‘আসানসোল মাইন্স বোর্ড অফ হেল্থ’ (এএমবিএইচ) এবং ঝরিয়া কয়লাখনি অঞ্চলের জন্য ‘ঝরিয়া মাইন্স বোর্ড অফ হেল্থ গঠন করা হয়েছিল।
এএমবিএইচ-এর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯১৫ সালে। তৎকালীন সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান বর্তমান সময়ের মতন উন্নত ছিল না। যে কারণে মানুষকে সুস্থ রাখতে রোগ ও মহামারীর প্রাদুর্ভাব যাতে না ঘটে তার জন্য প্রতিরোধমূলক বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা পালন করা হয়। ড. জেডব্লু টোমব আসানসোল মাইন্স বোর্ডের প্রথম চিফ স্যানিটারি অফিসার (সিএসও) পদে নিযুক্ত হন। তাঁর বাংলোটি ছিল আসানসোল দূরদর্শন টাওয়ারের ঠিক বিপরীতে যা পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত জেলা শাসকের দপ্তরে পরিণত হয়েছিল।
পরিবেশ পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি ১৯৩০ সালে আসানসোল মাইন্স বোর্ড অফ হেল্থ কর্তৃক নারী শ্রমিকদের জন্য মাতৃত্বকালীন সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৩৪ সালে মাইন্স বোর্ড অফ হেল্থ আসানসোল মহকুমায় পাঁচটি মাতৃত্বকালীন ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র চালু করে। এক সময় আসানসোল মহকুমায় এএমবিএইচ দ্বারা পরিচালিত ১৩টি কুষ্ঠ চিকিৎসা কেন্দ্র ছিল। কাল্লা মোড়ের নিকট শম্ভুনাথ রায় কুষ্ঠ হাসপাতাল এএমবিএইচ-এর উদ্যোগে স্থাপিত হয় ১৯৪০ সালে। যদিও বর্তমানে এএমবিএইচ-এর কোনও কুষ্ঠ চিকিৎসা কেন্দ্র চালু নেই।
স্বাধীনোত্তর সময়ে আসানসোল মহকুমায় রাজ্য সরকারের উদ্যোগে বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্র ও হাসাপাতাল গঠন হওয়ার ফলে মাইন্স বোর্ড অফ হেল্থের ভূমিকা কিছুটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। ১৯৭২ সালে কয়লাখনির জাতীয়করণের পর এর গুরুত্ব আরও হ্রাস পায়। তথাপি ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৯ সাল অবধি আসানসোল মাইন্স বোর্ড অফ হেল্থ ১০ টি স্যানেটারী কেন্দ্র থেকে ৩৩টি বাজার এলাকায় নিয়মিত জঞ্জাল সাফাই করত। সেই সঙ্গে ১৪টি মাতৃত্ব ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রে মহিলাদের গর্ভকালীন পরীক্ষা ও শিশুদের টিকাকরণের ব্যবস্থা ছিল।
আর্থিক সঙ্কটজনিত কারণে শতবর্ষেরও অধিক পুরোনো আসানসোল মাইন্স বোর্ড অফ হেলথ নামক স্বাস্থ্য সংস্থাটি ইদানিংকালে রুগ্ন দশায় পরিণত হয়েছে। তা সত্ত্বেও এই সংস্থায় কর্মরত ছয়জন চিকিৎসক সহ সর্বমোট ১০২ জন স্বাস্থকর্মী করোনা মহামারী মোবাকিলায় বিভিন্ন জরুরি পরিষেবা সহ টীকাকরণের কাজ কর্তব্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে চলেছেন। মাইন্স বোর্ড অফ্ হেলথে একটি উন্নত রসয়নাগারে স্বল্প মূল্যে জল দূষণের পরীক্ষার ব্যবস্থা আজও রয়েছে।
বর্তমানে আসানসোল মাইন্স বোর্ড অফ হেল্থ-এর মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের পদে নিযুক্ত আছেন ড. সব্যসাচী গুপ্ত। তিনি জানালেন, এই স্বাস্থ্য সংস্থাটি এখন টন প্রতি কয়লার বিক্রয়ের অর্থ থেকে ১ টাকা প্রাপ্তিলাভ করে যা কয়েক দশক আগে ধার্য করা হয়েছিল। জানা যায়, এটিই হল আসানসোল মাইন্স বোর্ড অফ হেলথের আর্থিক সাহায্য লাভের প্রধান ভরসা। কিন্তু এই অর্থ বর্তমান বাজারের তুলনায় অতি সামান্য। কারণ এর থেকেই এই সংস্থার কর্মী ও চিকিৎসদের বেতন সহ স্বাস্থ্য পরিষেবামূলক বিভিন্ন খাতে ব্যয় করা হয়। ড. গুপ্ত অভিযোগ করে বলেন, কয়লার মূল্য আগের তুলনায় এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তথাপি কয়লা বিক্রয়ের অর্থ থেকে এখনও সেই ১ টাকায় প্রাপ্তিলাভ করে আসানসোল মাইন্স বোর্ড অফ হেল্থ। টন প্রতি কয়লার বিক্রয় অর্থ ১ টাকা থেকে ৪.৫০ টাকা করা হলে আসানসোল মাইন্স বোর্ড অফ হেল্থ-এর আর্থিক সঙ্কটের অনেকটাই সুরহা হবে। এ কথা ড. সব্যসাচী গুপ্তর বক্তব্য থেকে জানা গেল।