উত্তর পূর্বাঞ্চলের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে বাঙালি পরিচয় সবচেয়ে শক্তিশালী অনুঘটক

তানিয়া লস্কর
উত্তর পূর্বাঞ্চলের ৮ টি রাজ্যে প্রায় আড়াইশো জনজাতির বাস। তাদের মধ্যে প্রায় ৩০ টি জাতি নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সাব্যস্ত করার জন্য সংগ্রাম করছেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আবার সশস্ত্র আন্দোলন করে। তাদের দাবী-দাওয়াগুলো প্রায় একইরকম।ভূমি অধিকার, রাজনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, ভাষিক এবং সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা রক্ষার অধিকার ইত্যাদি। কিন্তু এই dominant narrative বা প্রধান ভাষ্য এর পিছনে আরেকটি meta narrative প্রায় সবকটি আন্দোলনে বিদ্যমান সেটি হল বাঙালি-ভীতি। এর রূপ এবং ভাষ্য নানা স্থানে নানা রকম হতে পারে। যেমন অসমের ক্ষেত্রে ক্রনোলজি মতে ৬০ -৭০ এর দশকে যেটা ছিল ‘বহিরাগত’ দের বিরুদ্ধে অশস্তি এবং সাংস্কৃতিক আত্মীকরনের চাপ ৮০ এর দশকে সেটা ‘বাঙাল খেদা’ র নামে রক্তাক্ত হত্যাযজ্ঞে পরিণত হয়, ৯০ এ তথাকথিত ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-আইনি লড়াই, এবং বর্তমানে ‘অবৈধ দখলকারী’ দের বিরুদ্ধে খিলঞ্জিয়া বা আদিবাসিন্দাদের অধিকার রক্ষার সংগ্রাম এর রূপ নিয়েছে। দেশ এবং রাজ্যের ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে নানা সময় নানা রং লেগেছে। কিন্তু সব সময়ই টার্গেট গ্রুপ একই থেকে গেছে। বৃহত্তর বাঙালি জাতি এবং সেই সাথে বিহারি, মাড়ওয়ারি সহ অন্যান্য জাতির লোকদেরও এর খেসারত দিতে হয়েছে বটে। ৮০ এর দশকে একটি প্রভাবশালী স্লোগান এর উল্লেখ করা যায় এখানে। তখন বলা হত
‘আলী কুলি বাঙালি, নাক সেপেটা নেপালি,
কুকুরর পোয়ালি কোর পরা আহিলি’
অর্থাৎ কোথা থেকে এসেছিস কুকুরের বাচ্চা মুসলমান আদীবাসী এবং বাঙালিরা।
বর্তমানে সারাবিশ্বে যখন ইসালামোফোবিয়া একটি প্রভাবশালী ভাষ্য তখন উত্তর পূর্ব ভারতও এর থেকে বাদ পড়ে নেই। তাই জাতিয়তাবাদী রাজনীতিতে যে কাল্পনিক শত্রু চরিত্রটি নির্মাণ করা হয় সেটি এই ম্যাটান্যারেটিবের উপর ভিত্তি করেই ভাবা হয়। ‘জিহাদ’ ‘জামাতি’ ইত্যাদি শব্দগুলো জাতিয়তাবাদীদের অভিধানে জায়গা করে নিতে শুরু করে। ২০২১ এর নির্বাচনে অমিতশাহ শিলচরসহ নানা জায়গায় র্যালি সিম্বোধিত করতে গিয়ে দাবী করেছেন যে তার দল অসমকে ‘লাভ জিহাদ’ এবং ‘ভূমি জিহাদ’ দুটি থেকেই সুরক্ষা দেবে।
পাশের রাজ্য মেঘালয়েও ৭০ এর দশক থেকেই বাঙালি জনগণকে খাসি ছাত্রসংগঠনগুলোর নৃশংসতা সহ্য করতে হচ্ছে। ১৯৭৯ সালে খাসি ছাত্র সংস্থার নেতৃত্বে বাঙালিদের তাড়িয়ে দিতে তাদের উপর আক্রমণ করা হয়। ৮০ এবং ৯০ তেও বাঙালিদের উপর আক্রমণ ক্রমাগত বেড়েছে। ২০১৮ সালে অসম এনারসির তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর এই সংঘঠনের নেতৃত্বেই অসম থেকে আগত বাসগুলো দাড় করিয়ে বাঙালি প্যাসিঞ্জারদের কাগজ-পত্র চেক করতে দেখা যায়। এর কয়েক মাস পর ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে ‘ সব বাঙালিরাই বাংলাদেশী’ লেখা হোর্ডিং সমগ্র মেঘালয় জুড়ে লাগিয়ে রাখা হয়।
অরুণাচল প্রদেশে, মণিপুর এবং মিজোরামও বাদ পড়ে নেই। এইসব রাজ্যে ILP অর্থাৎ ইনার লাইন পারমিট এর ব্যাবস্থা আছে। ২০১৮ সনের আগস্ট মাসে ‘অল অরুণাচল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন ‘ এবং ‘ডিস্ট্রিক স্টুডেন্ট ইউনিয়ন ‘ মিলিতভাবে ‘অপারেশন ক্লিন ড্রাইব’ নামে একটি অভিযানের ডাক দেয়। এর অন্তর্গত রাজ্যের জেলায় জেলায় ILP না থাকা শ্রমিকদের ধড়পাকড় শুরু হয়।বলাই বাহুল্য যে এতে মূল টার্গেট করা হয় বাঙালি শ্রমিক শ্রেণির মানুষকে। বিশেষকরে জাতি এবং ধর্মের ভিত্তিতে সংখ্যালঘু জণগণকে। মণিপুর রাজ্যের জিরিবাম ঐতিহাসিকভাবে একটি বাঙালি প্রধান বিধানসভা চক্র। ২০১৭ সালে বাঙালি মুসলমান নেতা আসাব উদ্দিন নির্দলীয় প্রত্যাশি হিসেবে সেখান থেকে বিধানসভা নির্বাচনে জিতে আসেন, তখন ‘ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্ট এলাইন্স’ নামে একটি সংস্থা তাকে বয়কট করার ডাক দেয়। তারা রাজ্যের অন্যান্য দলগুলোকে হুমকি দেয় যে তারা যাতে আসাব উদ্দিনের সমর্থন না নেন কারণ তিনি একজন ‘বহিরাগত’। এর পর জিরি নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। বর্তমানে সেখানে বেছে বেছে লোকদের নাম ভোটার তালিকা থেকে কেটে দেওয়া হচ্ছে। আসাম-মিজোরাম সীমান্ত বিবাদ যেখানে অসমের ৫ জন পুলিশ জোয়ান এবং একজন সাধারণ নাগরিককে প্রাণ দিতে হয় সেখানেও বাঙালিফোবিয়া একটি বিষয়। মিজোরামের ক্ষমতাসীন দল ‘মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ এর একজন প্রতিনিধি লালরিংথালা সাইলো এবিষয়ে বলতে গিয়ে বলেন যে মিজোরাম আসাম বা এখানকার মানুষের প্রতি বিরূপ নয়। মিজোরাম শুধু নিজের চারিসীমাকে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ দের থেকে রক্ষা করতে চায়। তারমতে মিজোরামের সীমান্ত জেলাগুলোর ৮০ শতাংশ লোকই নাকি ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’। বলাই বাহুল্য যে সীমান্ত অঞ্চলে ৮০ শতাংশ লোকই মুসলমান এবং দলিত বাঙালি । এভাবেই সারা উত্তর পূর্ব জুড়ে চলছে বাঙালি হত্যাযজ্ঞ।
প্রথমে ‘বাঙালি’ পরিচয়কে ‘নির্বাচন’ এবং ‘ভোটার লিস্ট’ ইত্যাদির সাথে জুড়ে এই পরিচয়কে ‘problematized’ বা কাটগড়ায় দাঁড় করানো হয়। এবং একে অসমীয়া তথা বাকি তথাকথিত আদিবাসিন্দাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি প্রত্যাহবান বলে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল আজ সেই একই পরিচয়কে ভূমি তথা সম্পদের অধিকারের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এনারসি এবং উচ্ছেদের দ্বৈত মারে বর্তমানে শুধুমাত্র অসম রাজ্যে ১৯ লক্ষ মানুষ রাষ্ট্রহীনতা এবং ৪ দফা উচ্ছেদের পর প্রায় দশহাজার মানুষ গৃহহীনতা বা homelessness এর মুখোমুখি। এবং অবশ্যই এর ৯০ শতাংশই বাঙালি।
অথচ এসবের ফলে আসলে লাভ হচ্ছে কাদের?
২০২০ সনে অসমের প্রায় ১১৩৮ একর জমী লালা রামদেবকে দিয়ে দেওয়া হলো কেনো? খবরে প্রকাশ অমিত শাহের পুত্র জয় শাহ কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে অতি শীঘ্রই অসমে আসছেন। এভাবেই ঠিক এভাবেই অলীক শত্রুর হাত থেকে ভূমি এবং ভাষা সংস্কৃতি বাঁচাতে বাঁচাতে কবে যে অসমের তেল-উদ্যোগ এবং ভূমি হাতবদল হয়ে রামদেব জয় শাহের হাতে পৌঁছে যাবে বুঝতেই পারবেন না।এরই নামইতো ‘লুক ইস্ট’ পলিসি।
তানিয়া লস্কর ঃ আসামের শিলচরের বাসিন্দা। উকিল ও সমাজকর্মী।
1 Comments
তানিয়া র লেখাটি খুব তথ্য সমৃদ্ধ । ধন্যবাদ তানিয়া । আমার কাজে লাগবে ।