• June 1, 2023

দেউচা-পাচামি কয়লাখনি প্রকল্প ও সংগ্রামী জনগণের প্রতিরোধ, পর্ব-২

 দেউচা-পাচামি কয়লাখনি প্রকল্প ও সংগ্রামী জনগণের প্রতিরোধ, পর্ব-২

অচিন্ত্য রায়

গত বছরের অর্থাৎ ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময় করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব বীরভূমের মহম্মদ বাজার ব্লক এলাকায় যান এবং দেউচা-পাচামি তে কয়লা উত্তোলনের পরিকল্পনা করে আসেন। যেখানে, কয়লাখনির কাজ শুরু হলে হাজার-হাজার আদিবাসী মানুষকে বলপূর্বক উচ্ছেদ করা হবে, ক্রমশ কেড়ে নেওয়া হবে তাদের অধিকার, সেখানে মিটিংয়ে লোকাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া উপস্থিত ছিলেন মাত্র ২০ জন গ্রামবাসী। অর্থাৎ, কয়লাখনি প্রস্তাবিত গ্রামগুলিতে কোনো আর্থসামাজিক সমীক্ষা, তার ওপর ভিত্তি করে পরিবেশের ওপর কয়লাখনির প্রভাব সম্পর্কে এনভায়রেনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট বা EIA রিপোর্ট এবং সর্বোপরি সেই EIA রিপোর্টের ভিত্তিতে গ্রামগুলিতে জনশুনানি- এসব কিছুই করেনি রাজ্য সরকার। আইনি ভাবে জনশুনানিতে সম্মতি মিললে কয়লাখনি প্রকল্পের পরিকল্পনা করা যায়। অথচ, এসব আইনি পদ্ধতির কোনোকিছুই সম্পন্ন করেনি রাজ্য সরকার। সুতরাং, দশকের পর দশক ধরে দীর্ঘ সংগ্রামের দরুণ শ্রমজীবী মানুষ যেটুকু আইনি অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছেন, সেটাও আমল দিতে রাজি নয় বর্তমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র। এর আগেও বহুবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের আইনি অধিকার লঙ্ঘন করেছে কেন্দ্রে-রাজ্যে থাকা রঙবেরঙের সরকারগুলি। উল্টোদিকে মানুষের সংগঠিত প্রতিরোধও বারেবারে আছড়ে পড়েছে দেশের মাটিতে। অর্থাৎ একদিকে বিশ্বপুঁজির সঙ্কট ও তার দরুণ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির স্বার্থে দেশের বিভিন্ন সময়ের দালাল সরকারগুলি কর্তৃক নানা জনবিরোধী আইন প্রণয়ন এবং উল্টোদিকে তার বিরুদ্ধে নিরন্তর বিপ্লবী লড়াই লড়ে চলেছেন দেশের মেহনতী জনগণ। সুতরাং, শ্রেণী সমাজে শুধুমাত্র আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হলো একপ্রকার সোনার পাথরবাটি। দেউচা-পাচামি কয়লাখনি প্রকল্প এবং সেটা ঘিরে হাজার-হাজার মানুষকে তাদের শেকড় থেকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্রও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং তাদের দালাল দেশীয় পুঁজিপতিদের স্বার্থেই সম্পন্ন করতে তৎপর হয়ে উঠেছে রাজ্য সরকার। মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে জল-জঙ্গল-জমি ধ্বংস করে যে সাম্রাজ্যবাদী লুন্ঠন চলছে, দেউচা-পাচামি কয়লাখনি প্রকল্পও তার থেকে কোনোভাবে বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। এবং আজকের দেউচা-পাচামি কয়লাখনি প্রকল্প কে বুঝতে গেলে, কিভাবে কয়লা খনির জাতীয়করণ কে ঘুঁচিয়ে দিয়ে কয়লাখনিগুলিকে ক্রমাগত ব্যক্তিপুঁজির হাতে তুলে আরও বেশী যন্ত্রনির্ভর খোলামুখ কয়লা খনির দিকে এগিয়েছে ভারত রাষ্ট্র, তা জানা দরকার।

১৭৭৮ সালে প্রথম খনন শুরু হয় রানিগঞ্জ-ঝরিয়া অঞ্চলে। ইংরেজ শাসনের সেই সময়ে বেশিরভাগ ভূগর্ভস্থ খনিতেই অগভীর খননকার্য হওয়ার পর সেই খনিগুলি এখন মিথেন গ্যাসে পরিপূর্ণ, পরিত্যক্ত ও জলমগ্ন হয়ে ছোট ছোট পিলারের ওপরে দাঁড়ানো। পিলারগুলি বয়সের ভারে দূর্বল ও ভঙ্গুর, ফলত প্রতিনিয়ত ধ্বসের সম্মুখীন হয় এলাকাগুলি।মিথেন গ্যাস থেকে খনিতে আগুন লেগে, বিপদ বেড়েছে কয়েক গুণ। যাইহোক, সেইসময়ে না ছিল পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য কোন আইন না ছিল শ্রমিকদের নিরাপত্তা সম্পর্কিত কোন আইন। ৪৭-এ ইংরেজ শাসনের অবসানের পর মালিকানার বদল হয়, কয়লা খনিগুলি ব্রিটিশ কোম্পানিদের হাত থেকে বিভিন্ন দেশীয় পুঁজিপতিদের মালিকানায় বদল হয়। শুধুমাত্র মুনাফা অর্জন-ই যে লক্ষ্য সেই দৃষ্টিভঙ্গী ব্রিটিশ বা ভারতীয় সকল কোম্পানিই বজায় রাখে।

১৯৭৩ সালের ১ মে Coal Mines (Nationalization Act), 1973, এই আইন বলে বেসরকারি বাণিজ্যিক খননের একচেটিয়া রাজত্ব খতম করে কয়লা খনিগুলির জাতীয়করণ করা হয়। ১ নভেম্বর, ১৯৭৫-এ সরকারি কোম্পানি কোল ইন্ডিয়া (Coal India)স্থাপিত হয়। এর অধীনে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পূর্বতন কয়লা কোম্পানিগুলিকে নিবন্ধিত করা হয়। কোল ইন্ডিয়ার অধীনে থাকে ভারত কোকিং কোল লিমিটেড, ইস্টার্ন কোল ফিল্ড লিমিটেড, ওয়েস্টার্ন কোল ফিল্ড লিমিটেড ইত্যাদি সংস্থাগুলি। কিন্তু তারপর নয়া-উদারবাদী নীতি গ্রহণের মাধ্যমে মোটামুটি সমস্ত ক্ষেত্রকেই দেশী-বিদেশী কোম্পানিদের জন্য খোলাবাজারে পরিণত করে দেওয়া হয়। তখন থেকেই ভূগর্ভস্থ খনি তে অগভীর খনন কার্য চালিয়ে বা সুড়ঙ্গ কেটে কয়লা উত্তোলন প্রায় বন্ধ হতে থাকে আস্তে আস্তে। অল্প সময়ে, কম খরচে আরও বেশী বেশী মুনাফার লোভে ডিনামাইট ফাটিয়ে খোলামুখ খনি থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু করে বিভিন্ন মালিকগোষ্ঠী। আর তার সাথে সাথেই ধ্বস, গ্যাস, আগুন সঙ্গী হয়ে ওঠে কয়লা অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের কাছে।

১৯৯৩ সাল থেকে দেশের কয়লা সম্পদকে বেসরকারী মালিকদের হাতে তুলে দেবার যে পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল তা ২০১৯ সালে কয়লা শিল্পে ১০০ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগের ছাড়পত্র দেওয়ার মাধ্যমে সম্পূর্ণ করেছে কেন্দ্রে বসে থাকা বিজেপি সরকার। ২০১৫ সালে ‘কোল মাইন্স স্পেশাল প্রভিশন অ্যাক্ট’ এনে ও গতবছরের করোনার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বেসরকারী কোল কোম্পানিগুলিকে বাজারে কয়লা বিক্রির জন্য কোল ব্লক বরাদ্দ করে সরকারী কোল কোম্পানির ধ্বংসের পথ তৈরী করে গত বছরের জুন মাস নাগাদ দেশের ৪১টি কয়লা ব্লক নিলামে চড়িয়েছেন স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী ‘দি মিনারেল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’ এর বলে বলীয়ান হয়ে। ৪১টি কয়লা ব্লকের মধ্যে ১১টি মধ্যপ্রদেশে, ৯টি করে ব্লক ছত্তিশগড়, ওড়িশা আর ঝাড়খন্ডে আর তিনটি মহারাষ্ট্রে। ৪১টি কয়লা ব্লকের ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ৬লক্ষ হেক্টর জমি ‘নো গো’ এরিয়ায় অর্থাৎ গভীর বনাঞ্চলের অন্তর্গত। মোদীর সঙ্গেই ই-অকশনে শামিল ছিলেন টাটা সনস’র চেয়ারম্যান চন্দ্রশেখরন, বেদান্ত গ্রুপের অনিল আগরওয়াল। আর খরিদ্দার হিসাবে ছুটে এসেছে টাটা, বেদান্ত, আদানি, জিন্দাল, হিন্ডালকো, জেএসডব্লিউ থেকে বিএইচপি,রিও টিন্টো, বিলিটনপিবডির মত বিদেশি গ্রুপ।

ক্রমশ…

অচিন্ত্য রায় : ছাত্র ও গৃহশিক্ষক।

1 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Related post