লকআপে হত্যা

শৈলেন মিশ্র
বোলপুর থানা লকআপে রাজু থান্ডার বলে একজন রিক্সা চালককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠলো।২০১৬ সালের ১৪ই আগস্ট রাতে বোলপুর থানার পুলিশ রাজু থান্ডারকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে তার লাশ পুলিশ বোলপুর মহাকুমা হাসপাতালে পাঁচিলের পাশে ফেলে দেয়।পরে পুলিশ ওই লাশ নিয়ে হাসপাতালে গেলে ডাক্তার রাজু থান্ডার কে মৃত বলে ঘোষণা করেন। রাজু থান্ডার বোলপুর শহরের দর্জিপাড়ার বাসিন্দা। স্ত্রী, কন্যা সহ স্বপরিবারে বসবাস করেন। পোস্টমর্টেমের পূর্বে ওর স্ত্রীকে পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে যায়।সেখানে গিয়ে ওর স্ত্রী তার মৃত স্বামীকে দেখেন। দুপুরের মধ্যে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে। আমি তখন যজ্ঞনগর গ্রামে ছিলাম। খবর পেয়ে বোলপুর থানায় চলে আসি। সঙ্গে ছিল উত্তম। উত্তম একজন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন প্রতিবাদী যুবক। আমরা দুজনে থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার কে বললাম আপনারা একজন যুবককে হত্যা করে দিলেন। বোলপুর থানার আইসি কোথায় আছেন আমরা ওনার সাথে কথা বলতে চাই। ওই অফিসার (কল্যাণ বাবু) বললেন আমিই দায়িত্বে আছি। আগে পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট আসুক তারপর যা করণীয় ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ করবেন। থানার বাইরে এসে বিশ্বভারতীর ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যারা এপিডিআর এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের ফোন করে গোটা বিষয়টি জানিয়ে বলি তোমরা বোলপুর থানায় চলে এসো। পুলিশের বিরুদ্ধে থানায় বিক্ষোভ দেখানো হবে। ইতিমধ্যে পীযূষ (বিশ্বভারতী প্রাক্তন ছাত্র) থানার সামনে চলে আসে। ছাত্র-ছাত্রীরা থানায় আসার পূর্বে উত্তম কে নিয়ে দর্জিপাড়ায় রাজু থান্ডারের বাড়ি যাই।ওর বাড়ির সামনে রাস্তায় একটি ভ্যানের উপর রাজুর দেহ রাখা ছিল। অনেক মানুষ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কেউ কেউ কাঁদছেন। তাদের বললাম ওর দেহ থেকে আবরণ খোলো। আমরা দেখলাম ওর শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতের চিহ্ন ছিল। আঘাতের চিহ্ন দেখে আমরাও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলাম। উপস্থিত মানুষদের বললাম এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করুন।থানায় বিক্ষোভ দেখান এবং বলুন ‘ইনসাফ চাহিয়ে’। ওই পাড়ায় অনেক মুসলিম পরিবারে বসবাস করেন।আমরা থানায় চলে এলাম। ততক্ষনের মধ্যে দেবপ্রিয়া, হিমাদ্রিজা, স্বাগুপ্তা, প্রিয়াঙ্কা এবং আরো দুই একজন ছাত্রী এসে পড়েছেন। আমরা সকলেই থানার সামনে হত্যাকারী পুলিশদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকি। আবার আমরা থানার ভারপ্রাপ্ত আইসির সঙ্গে কথা বললাম। আমাদের দাবি ছিল – (এক) অবিলম্বে খুনের মামলা চালু করতে হবে। (দুই) তদন্ত সাপেক্ষে থানার আইসি কে বরখাস্ত করতে হবে। (তিন) রাজু থান্ডারের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। থানা থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম। ছাত্রীরা চলে গেলেন। আমি আর পীযূষ আমাদের পাড়ার মোড়ে এলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে স্লোগান চিৎকার এবং গুলির শব্দ শুনলাম। ওই পাড়ার মানুষ স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে থানায় বিক্ষোভ দেখাতে এসেছিলেন। থানার গেটে পুলিশের সাথে বিক্ষোভকারীদের ধস্তাধস্তি হয়। পরে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে রাজুর শ্বশুর সহ ৬ জন রাবার বুলেটে আহত হন। পীযূষ আর আমি ছুটে থানায় আসি। হঠাৎই বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টির জন্য সকল বিক্ষোভকারী ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যান। আমরা তখন থানার গেটে দাঁড়িয়ে আছি। দশ পনের মিনিট পর বৃষ্টি থামল। আমরা আবার আমাদের পাড়ার মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। ওখান থেকেই মনীষা ব্যানার্জিকে ফোনে সমস্ত ঘটনা জানাই। পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচি স্থির করার জন্য বললাম। মনীষা ফেসবুকে গোটা ঘটনা বিবৃত করে একটি পোস্ট করলেন। তাতে অনেক সাড়া পড়ল। সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ পুলিশ গাড়ি আমার বাড়ির কাছে গেল। পরে আরও একটি পুলিশের গাড়ি এলো। আমি আমার পাড়া ছেড়ে কালীবাড়ি তলায় চলে এলাম। ওখান থেকে খবর রাখছি। মনীষাকে আবার ফোনে বললাম। উনি বললেন অনেক মানুষ ফেসবুক থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে।তবে আমার একটু চিন্তা হচ্ছে। এই পোস্টটা করার জন্য কেউ আক্রমণ করতে আসবে কিনা?ওনাকে বললাম আমার বাড়ির সামনে দুটি পুলিশ গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার বাড়ি যাওয়া যাবে না। আমি আপনার ওখানেই যাচ্ছি। রাত্রে থাকা-খাওয়া করব। রাত ৯ টায় মনিষার বাড়িতে হাজির হলাম। রাতেই লক-আপ হত্যার বিরুদ্ধে পরবর্তী কর্মসূচি মনীষা সঙ্গে আলোচনা হল। স্থির হল পরদিন ১৫ ই আগস্ট বৈকালে বোলপুর চৌরাস্তায় পুলিশের এই বর্বোরোচিত কাণ্ডের বিরুদ্ধে ধিক্কার সভা হবে। সেই মতো এপিডিআর এর বাকি সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা হল। এই সভায় শিক্ষক, নাট্যকর্মী, ও গণ-আন্দোলনের কর্মীদের আমন্ত্রণ জানানো হবে বলে সিদ্ধান্ত হলো। ওই সময় মনীষা ব্যানার্জী এপিডিআর এর স্থানীয় শাখা সভাপতি এবং আমি সম্পাদক ছিলাম। পরদিন সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাজু থান্ডারের বাড়িতে এলাম। ওখানে জানতে পারলাম গতকাল সন্ধ্যায় ৬ জন রবার বুলেটে আহত হয়েছেন। ওরা মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দু-একজনকে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হসপিটালে পাঠানো হয়েছে। ধিক্কার সভায় উপস্থিত থাকার জন্য অনেক কেই জানানো হলো। বৈকালে ধিক্কার সভায় ৬০ থেকে ৭০ জন উপস্থিত হয়েছিলেন। সভায় কৃষ্ণপদ সিংহ রায়, মনীষা ব্যানার্জি, হিমাদ্রিজা, নাট্যব্যক্তিত্ব জিন্না বাবু এবং আমি পুলিশের বর্বরোচিত আচরণের তীব্র নিন্দা করে বক্তব্য রাখলাম। বেআইনিভাবে তিন দিনের বেশি আটকে রাখা এবং হত্যার প্রতিবাদ করা হয়। দাবি করা হয় ওই পরিবারের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য। পরবর্তী কর্মসূচি হিসাবে ঘোষণা করা হয় শান্তিনিকেতনে প্রথম গেটের সামনে এবং থানার সামনে বিক্ষোভ সভা হবে। এদিন রাজুর স্ত্রীকে (অন্ন) তৃণমূল দলের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করে। শ্রাদ্ধের জন্য ভালো পরিমাণ টাকা সাহায্য দেওয়া হয়। নেতারা বলেন যা গেছে তা গেছে। তোমাকে তৃণমূল পরিচালিত পৌরসভায় ঝাড়ু দেওয়া কাজ দেওয়া হবে সঙ্গে আরও অনেক টাকা। তুমি শুধুমাত্র মুখ বন্ধ করে রাখবে। পুলিশের বিরুদ্ধে একটাও কথা বলবে না। আমরা আবার রাজুর বাড়িতে যাই। ওনার স্ত্রী কোন কথা আর বলতে চাইলেন না। তার মুখ পুলিশের স্বার্থে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ সভা করা হচ্ছে।থানায় বিক্ষোভ দেখানো চলছে। পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডটি আড়াল করার সর্বতোভাবে চেষ্টা চালায়। কখনো বলা হয় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। কখনো বলা হয় তাকে জামিনের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এপিডিআর এর কর্মীরা ভালোমতো অনুসন্ধান চালিয়ে সত্য উদঘাটন করে। সিআইডিকে এই ঘটনার তদন্ত ভার দেওয়া হয়। পুলিশ একটি খুনের মামলা রুজু করে। তৃণমূলের প্রিয় পাত্র অফিসারকে বরখাস্ত না করে বর্ধমান জেলায় স্থানান্তরিত করা হয়। চার বছর পর ২০২০ সালের ১০ই নভেম্বর পুলিশ অফিসার বোলপুর আদালতে গ্রেপ্তার হয়ে আসে। ওই অফিসার প্রবীর কুমার দত্ত এখন জেলে আছে।
(ফিচার ছবি প্রতীকী)
শৈলেন মিশ্র : রাজনৈতিক ও মানবাধিকার কর্মী।