সীমান্ত থেকে দুয়ারে বিএসএফ

তাইদুল ইসলাম
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য জাতিরাষ্ট্র। এই জাতি রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান উপাদান জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক জাতি রাষ্ট্র বিশ্ব রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি একক হওয়া দরকার ছিল। গোটা বিশ্ব ব্যবস্থা একটি পরিবার। এই জাতি রাষ্ট্রগুলো সেই পরিবারের এক একটা সদস্য । গোটা বিশ্ব সম্পদ এই পরিবারের । এই পরিবারের সমস্ত সদস্যদের অধিকার আছে এই সমপদে এবং প্রত্যেকটি সদস্য তার নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে । সবাই মিলে আলাপ আলোচনার মধ্যে, ভালোবাসার মধ্যে, সহানুভূতির মধ্যে এই সংসার চলবে। কবি কামিনী রায় লিখেছেন ‘ সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ এই ভাবনা হবে সংসারের চালিকা শক্তি । কিন্তু চলছে তার সম্পূর্ণ উল্টো পথে । প্রতিটি রাষ্ট্র তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে, অন্য রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে টিকে আছে । অনেক রাষ্ট্রের বেঁচে থাকার অন্যতম রসদ মনে করছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিরোধীতাকে। ফলে এই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পারিক হিংসা-বিদ্বেষ ঘৃণা, নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে । এরই ফলশ্রুতিতে আমরা দুটো বিশ্বযুদ্ধ দেখেছি এবং খুব দ্রুত গতিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছি । অনেক আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছেন হয়তো আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্বকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি হতে হবে। শুধুমাত্র এই রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পারিক বিরোধীতার জন্যই রাষ্ট্রগুলোকে কোটি কোটি টাকার অস্ত্রের কারবার করতে হচ্ছে এবং মানুষ মারার ষড়যন্ত্র করতে হচ্ছে। ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে বসে বসে বিশ্বনেতারা মানুষকে মারার পরিকল্পনা করছে । এই অস্ত্র তৈরি এবং অস্ত্র ব্যবসার জন্যই বিশ্বের ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ এখন না খেয়ে রাতে ঘুমোতে যান। অথবা অপুষ্টিতে ভুগছেন। এই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখি উপমহাদেশ প্রথমত একটা রাষ্ট্র ভেঙে দুটো রাষ্ট্র হল। দুটো রাষ্ট্র ভেঙ্গে তিনটে হল এবং এই ধারাবাহিকতায় আজকে যদি আমরা আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু, আমাদের সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া যার জন্মই হতো না সেই বাংলাদেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক একই পরিবারের দুই সদস্যের মতো হচ্ছে না । এই ধারাবাহিকতায় আমরা বুঝতে চেষ্টা করব গত ১১ অক্টোবর ইউনিয়ন সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তর একটি নির্দেশিকা জারি করেছে । সেই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে পাঞ্জাব আসাম এবং পশ্চিমবাংলায় আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত ভিতরে গিয়ে বিএসএফ কাজকর্ম চালাতে পারবে অর্থাৎ নির্দেশিকায় বলা হল বিএসএফ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে ভারতের দিকে 50 কিলোমিটার পর্যন্ত কাজকর্ম করার অধিকার পেয়ে গেল । ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমানা আছে ৪১৫৬ কিলোমিটার । বাংলাদেশের সাথে পশ্চিমবাংলার সীমানা আছে ২২১৭ কিলোমিটার। পশ্চিমবাংলার নয়টি জেলা এই সীমান্ত এলাকায় । কোচবিহার, জলপাইগুড়ি দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, উত্তর 24 পরগনা । এই নির্দেশিকা জারি হওয়ার পর থেকেই গোটা রাজ্যের সুশীল সমাজ, মানবাধিকার কর্মী, সংগঠন, সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক সংগঠন এই নির্দেশিকার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করে তাদের সামনে উঠে এসেছে এবং তাঁরা সেইগুলো পশ্চিমবাংলার মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন । রাজ্য সরকারের কাছে এগুলো বলার চেষ্টা করছেন । কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকার বিধানসভায় একটি প্রস্তাব পাস করিয়ে বলেছে যে এই নির্দেশিকা পশ্চিমবাংলায় চালু করা যাবে না । প্রত্যাহার করতে হবে। এতে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে । রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে । পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক , সামাজিক , মানবাধিকার সংগঠন ১৫ নভেম্বর কলকাতা প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে এ নির্দেশিকার ফলে পশ্চিমবাংলার সাধারণ জনগণের বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলাগুলির জনগণের কী ধরনের সমস্যা হবে তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন চিত্র পরিচালিকা এবং চিত্রাভিনেত্রী অপর্ণা সেন, মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র, সিকিম হাই কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মলয় সেনগুপ্ত সহ বিশিষ্টজনেরা । ১ ডিসেম্বর রাজ্যের অনেক জায়গায় বিএসএফ আধিকারিকদের কাছে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ডেপুটেশন দেওয়া হয় যাতে এই নির্দেশিকা বাতিল করা হয় এবং সীমান্তে বিএসএফ নাগরিকদের ওপর অত্যাচার ধর্ষণ খুন পাচার বন্ধ করে। গত ৪ ডিসেম্বর মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে এসডিপিআই এর পক্ষ থেকে ওয়ার্কশপ করা হয় যেখানে শতাধিক মানুষ উপস্থিত ছিলেন এবং মাসুম নামক মানবাধিকার সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক সহ আরো অনেকে বক্তব্য রাখেন । এখনো পর্যন্ত যে সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা গুলো চলছে সেগুলো এক জায়গায় করলে বোঝায় (১) ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক সীমানা পাহারা দেওয়ার জন্য বিএসএফ কে তৈরি করা হয়েছিল ।৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে । বাংলাদেশে এখন আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ সৃষ্টিতে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল । ফলে যে কারণে বিএফ সৃষ্টি করা হয়েছিল বাংলাদেশ সীমান্তের ক্ষেত্রে সে কারণটা আর থাকে না। তা হলে বাংলাদেশ বর্ডারে বিএসএফ কেন এই প্রশ্ন বারবার বিভিন্ন আলোচনায় উঠে আসছে। (২) আমাদের দেশের সীমানা বাংলাদেশ ভুটান নেপালের সাথে আছে । নেপাল ভুটান সীমান্তে বিএসএফ নেই । নেপাল ভুটান এর সাথে যাতায়াতের জন্য আমাদের কোন ধরনের নিয়ম-শৃঙ্খলা মানতে হয় না। পাসপোর্ট লাগে না । আমরা যেমন দেশের মধ্যে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারি নেপাল ভুটান ক্ষেত্রেও সে রকম করতে পারি। তা হলে শুধুমাত্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এত কড়াকড়ি ,এত নিয়ম, পাসপোর্ট, বিএসএফ, কাঁটাতার কেন ? (৩) কাঁটাতারের ওপারে অনেক ভারতীয় বসবাস করেন । তাদের সাথে বিএসএফ কখনোই বিএসএফের আইন মেনে ব্যবহার করে না। ফলে বিএসএফকে তার নিজের আইন মেনে চলার জন্য বাধ্য করতে হবে। (৪) বিএসএফের কাজ কী হবে , বিএসএফ কোথায় থাকবে, সেই নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে আইন আছে আমাদের দেশে। আন্তর্জাতিক বর্ডারে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী কিভাবে কাজ করবে তার একটি আন্তর্জাতিক আইন আছে । এ সবের কোনো তোয়াক্কা করে না বিএসএফ। সে সমস্ত আইন মেনে চলার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করতে হবে। (৫) বিএসএফ চোরাচালানে মদদ দিয়ে থাকে বলেই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে চোরাচালান হয় । প্রচুর মানুষের সাথে কথা বলে মানবাধিকার আন্দোলন কর্মীদের মনে হয়েছে বিএসএফের মদদ ছাড়া সীমান্তে পাচার চলতে পারে না এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের একাংশের সাথে বিএসএফের যোগসাজশ থাকে । বিশেষ করে শাসক দলের নেতাদের একাংশ এবং বিএসএফের একাংশ যোগসাজশ করে চোরাচালান চালিয়ে যায়। ফলে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে চোরাচালান বন্ধ করার দায়বদ্ধতা তৈরি না হলে চোরাচালান বন্ধ হবে না। (৬) ১১ অক্টোবর এর আগে বিএসএফের কাজের এলাকা ছিল সীমান্ত থেকে ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত । ১৫ কিলোমিটার সিদ্ধান্তটা কোথায় কিভাবে কারা নিয়েছে সেই প্রশ্নটাও বারবার উঠে আসছে। কারণ বিএসএফ সংক্রান্ত আইনে স্পষ্ট আছে বিএসএফ সংক্রান্ত কোন নতুন নির্দেশিকা তৈরি করতে হবে লোকসভায় আলাপ আলোচনা করার মধ্য দিয়ে । কিন্তু ১৫ কিলোমিটার এর সিদ্ধান্ত সে ভাবে হয়নি। আইন বলছে বিএসএফকে থাকতে হবে সীমান্তে । কিন্তু বাস্তব বলছে বিএসএফের কোন অফিস সীমান্তে নেই । কোথাও সীমান্ত থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে , কোথাও ৫ কিলোমিটার দূরে । সীমান্ত পাহারা দেওয়ার কথা । বিএসএফ সীমান্তে যদি না থাকে তার দায়িত্ব পালন করবে কী করে? সীমান্তে বিএসএফ থাকে না এবং যেখানে আছে সেটা সীমান্ত নয়। ফলে বিভিন্ন আলোচনায় দাবি আসছে বিএসএফে সীমান্তে ফিরে যেতে হবে । ৫০ কিলোমিটারের নির্দেশিকা প্রত্যাহার করতে হবে।
তাইদুল ইসলাম : রাজনৈতিক কর্মী