• June 1, 2023

বিএসএফের কাজের এলাকা বাড়ালে নাগরিক যন্ত্রণা বাড়বে

 বিএসএফের কাজের এলাকা বাড়ালে নাগরিক যন্ত্রণা বাড়বে

মিলন মালাকার

সালটা ২০০৪। অক্টোবর মাসে মনিপুরের ৩২ বছরের মনোরমা থাংজুনের বিবস্ত্র মৃতদেহ মিলল আসাম রাইফেলসের শিবিরের কাছে রাস্তার ধারে এক জঙ্গলে। তাঁকে আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানেরা তার তিন দিন আগে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। মা, ভাইয়ের চোখের সামনে দিয়ে। মৃতদেহের স্তনে ক্ষত ও যোনি বন্দুকের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত। তিনি সমাজকর্মী হিসাবে পরিচিত ছিলেন, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াতেন, বিদ্যালয়ে পাঠাতেন, খেলা করাতেন, শেখাতেন। তবে তাঁর বদগুণ ছিল, কোন অন্যায় হছে দেখলে, শুনলে বা জানলে প্রতিবাদে সোচ্চার হতেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “দেশকে নিরন্তর পীড়ন হইতে বাঁচাইবার জন্য এক দল লোকের তো বুকের পাটা থাকা চাই, অন্যায়কে তারা প্রাণপণে প্রমাণ করিবে, পুনঃপুনঃ ঘোষণা করিবে।”(‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’)। অপরাধীদের শাস্তি হয়েছিল কি? জানা যায়নি। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সামরিক, আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানেরা বাড়তি সুযোগ পেয়ে থাকেন। কর্তব্যরত অবস্থায় তাঁরা ফৌজদারি অপরাধ করলেও সাধারণ আদালতে তাঁদের বিচার হবে না যদি কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মতি না মেলে। সেনাদের বিভাগীয় বিচারের ব্যবস্থা আছে বটে, কিন্তু তাতে অভিযোগকারীর আমজনতার অংশ গ্রহণ সামান্য। ডাক পেলে তিনি নিজে হাজির হতে পারবেন, আইনজীবী কিংবা অন্য কোন বন্ধুর সহায়তা নিতে পারবেন না। চলতি ২০২১ সালের ডিসেম্বরে নাগাল্যান্ডের মন জেলার কয়লা শ্রমিকরা ফিরছিলেন একটা ছোট গাড়িতে হপ্তান্তে বাড়িতে। এমনটাই তাঁরা ফেরেন প্রত্যেক হপ্তায়। আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানেরা সামনে থেকে গাড়িতে গুলি চালিয়ে দশ জনকে মেরে ফেললেন।

খবর পেয়ে ছুটে আসা ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীদের ছয় জনকেও প্রাণ দিতে হলো। নাগাল্যান্ডের পুলিশের তদন্ত রিপোর্টের সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বিবৃতিতে অমিল দেখা গেল। বারে বারে কেন্দ্রীয় সরকার অপরাধী সেনাদের পাশে থেকেছে। না হ’লে নাকি তাদের মনোবল নষ্ট হয়ে যাবে। সেনা বাহিনীর জওয়ানেরা দেশ রক্ষার জন্য অনেক কষ্ট স্বীকার করেন, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তাঁদের সীমান্তে পাহারা দিতে হয়। কিন্তু সাধারণ নাগরিক কেন তাঁদের বেখেয়ালের শিকার হবেন? সরকার বিরোধীরা ২০০৪ সালেও সোচ্চার হয়েছিলেন, ২০২১ সালেও হয়েছেন। সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন(আফস্পা নামে যা আখ্যাত) বাতিলের আবার দাবি তুলছেন। শুধু কেন্দ্রীয় সরকারে ও বিরোধী দলে রঙের পরিবর্তন হয়েছে। মনমোহন সিং তাঁর মেয়ের এক বই প্রকাশনী অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছিলেন যে কোন রাজনৈতিক দলের স্বরূপ বোঝা যায় না যখন তারা বিরোধী পক্ষে থাকে। মনমোহন সিং তখন ছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী।
আবার একটা হইচই শুরু হয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের এক ঘোষণায়। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কাজের এলাকা বর্তমানের ১৫ কিলোমিটার থেকে বাড়িয়ে ৫০ কিলোমিটার করা হয়েছে। সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বা বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স তৈরি হয়েছিল ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে। ১৯৬৫ সালেই ভারতে হামলা চালিয়েছিল পাকিস্তানী সেনারা। তাই ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে নজরদারি বরাবর বজায় রাখার জন্য এই নয়া বাহিনী গঠন করা হয়েছিল যদিও আইন তৈরি হয় ১৯৬৮ সালে। দেশের বৃহৎ সামরিক বাহিনী থাকা সত্ত্বেও এই ধরণের আধা সামরিক বাহিনী সীমানা পাহারা দেওয়ার জন্য কেন তৈরি করা হ’ল? প্রশ্ন সেদিন কেউ তোলেননি। বিএসএ্ফ আইনে বলা আছে কর্তব্যরত অবস্থায় তাঁদের মদ্যপ থাকা চলবে না, কারও বাড়ি ঘর লুটপাট করা চলবে না, নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটানো চলবে না।সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা কিন্তু পুরো উল্টো।জওয়ানদের ছাউনিই তো মূল সীমান্ত থেকে ৮/১০ কিলোমিটার ভিতরে। এপারের বাসিন্দাদের নিজের জমিতে কাজের জন্যও যেতে হলে জওয়ানদের হাতে নানাভাবেই হয়রানি ভোগ করতে হয়। সীমান্ত রক্ষীদের আবার প্রয়োজনে বিপর্যয় মোকাবিলা, দেশের ভিতরে শান্তি রক্ষার জন্য, নির্বাচনী হিংসা প্রতিরোধ বা প্রশমনের কাজেও নিয়োগ করা হয়। কাশ্মীরে আজাদীদের বিরুদ্ধে, ১৯৮৪ সালে পাঞ্জাবে খালিস্তানীদের দমন করার জন্য অপারেশন ব্লু স্টারে, ১৯৮৬ সালে অপারেশন থান্ডারে এঁদের ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে পূব পাকিস্তানের মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি সাহায্য করেছিলেন সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর জওয়ানেরা।পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নয়া রাষ্ট্র বাংলাদেশ গঠিত হলে প্রতিবেশি দেশ তো আর শত্রু নয়, বন্ধু। তবু ভারত-বাংলাদেশের প্রায় ৪১৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমানা পাহারা দেওয়ার জন্য এই বাহিনীকে রাখার প্রয়োজন কেন? পশ্চিম বঙ্গের সঙ্গে নেপালের ও ভুটানের সীমান্ত যথাক্রমে ১০০ ও ১১৪ কিলোমিটার। এই সীমানা পাহারা দেওয়ার জন্য বিএসএফের জওয়ানদের নিয়োগ করা হয়নি। এমন কি এই সীমানা এলাকা দিয়ে এপার-ওপার করার জন্য তেমন কোন বিধিনিষেধের মধ্যে পড়তে হয় না। পাশপোর্টের দরকার হয় না।কিন্তু বাংলাদেশ সীমানা পেরোনোর জন্য পাশপোর্ট লাগবে কেন? পাশপোর্ট ছাডা সীমানা টপকালেই অপরাধী সাব্যস্ত হবেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিম বঙ্গের সীমানা প্রায় ২২১৬ কিলোমিটার(মুর্শিদাবাদে ১৪২ কিলোমিটার প্রায়)। কাঁটাতার লাগানোর কাজ চলছে অনুপ্রবেশ রোখার জন্য। কাঁটাতার বসছে চাষের জমিতেই। চাষী ভূ-সম্পত্তি হাস্রাচ্ছেন। চাষ এলাকা হ্রাস পাচ্ছে। জওয়ানদের চব্বিশ ঘন্টার সদা জাগ্রত পাহারা সীমান্তে পাচার রুখতে পারছে না, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারছে না। কিন্তু সীমান্তবাসীরা নিজ প্রয়োজনে নিজের জমিতে যেতে পারছেন না। কারণ কাঁটাতারের ওপারে পড়ে গিয়েছে তাঁদের চাষের জমি। তাঁরা পাট জাতীয় এমন কোন ফসলের চাষ করতে পারেন না যা উচ্চতায় আড়াই ফুট ছাপিয়ে যেতে পারে। সন্ধ্যার পর মৎস্যজীবীরা নদীতে জাল ফেলতে পারেন না, যদিও সন্ধ্যার পরেই জালে বেশি মাছ ওঠে। চিনি, লবণের ব্যবসা বন্ধ। সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে পাঁচ জনের বেশি এক সঙ্গে থাকা যাবে না। মসজিদে যাওয়ার ক্ষেত্রেও একই রকম নিষেধ। জরু্রি চিকিৎসার প্রয়োজনে বা প্রসববেদনা উঠলে সূর্য ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় অসুস্থকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। নিষিদ্ধ বস্তু সাথে আছে কিনা জানার জন্য পুরুষ জওয়ানরা নারী দেহে হাত দেন এবং সংবেদনশীল অংশেও। সুপ্রতিম কর্মকার গত দুই ডিসেম্বরের আনন্দবাজার পত্রিকার উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধে(‘নদীই যেখানে সীমান্ত গড়ে দেয়’) লিখেছেন, “বাহান্ন বছরের পার্বতী মণ্ডলের এমন অভিজ্ঞতা অনেক বার হয়েছে।” সীমান্তে কার্ফু জারি আছে। দেশের অভ্যন্তরে লাগাতার কার্ফু, অনির্দিষ্ট কালের জন্য কার্ফু জারি থাকা কি স্বাভাবিক? বিএসএফের সন্দেহভাজন কাউকে শাস্তি দেওয়ার কথা নয়, অপরাধী মনে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নিকটবর্তী থানার পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে। কিন্তু প্রায়ই শোনা যায় সীমান্তবাসীরা নানা ভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন, এমন কি শারীরিক নিগ্রহে প্রাণও হারিয়েছেন এই জওয়ানদের অতি তৎপরতার কারণে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে মুর্শিদাবাদের চর কাকমা্রির কৃষক মফিজুল কাঁটাতার পেরিয়ে ছিলেন ঘাস কাটতে সেনাবাহিনীর অলিখিত প্রথা অনুযায়ী নিজের পরিচয় পত্র জওয়ানদের কাছে জমা রেখেই। তবু জওয়ানরা নিছক সন্দেহবশে তাঁকে এমন পেটান যে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় এবং বহরমপুরে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দিন সাতেকের মধ্যেই মারা যান।
সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর জওয়ানদের সীমান্ত ঘেঁসা এলাকাতেই থাকার কথা। আছেন এখনই সীমানা থেকে ৮/১০ কিলোমিটার ভিতরে। তাঁদের কাজের এলাকা বেড়ে ৫০ কিলোমিটার হয়ে গেলে তাঁরা তখন কোথায় থাকবেন? গোটা রাজ্যের জনপদে সর্বদা বিচরণ করবে সশস্ত্র বাহিনী? তাঁদের ভাষা বাঙালীদের থেকে ভিন্ন, খাদ্যাভ্যাস ভিন্ন, সংস্কৃতি ভিন্ন। গোটা রাজ্যের মানুষকেই তো তখন সব সময় সন্ত্রস্ত জীবন যাপন করতে হবে।অবাধ চলাচল বিঘ্নিত হবে। বেশ কিছু ব্যবসায়, পেশায় বাধা সৃষ্টি হবে। কিন্তু রাষ্ট্র যে ভয় ও অভাবমুক্ত জীবন ও অবাধ চলাচলের, পছন্দ মতো পেশা বেছে নেওয়ার অধিকার তার নাগরিকদের দিতে দায়বদ্ধ।তথ্যানুসন্ধানে জানা গিয়েছে মাদক পাচারের সব অভিযোগ সত্যি নয়, অনেক গুলোই সাজানো। অর্থাৎ মাদকপাচারকারী বলে যে কোন রাজ্যবাসীকেই পুলিশের হাতে হয়তো তুলে দেবে।তাতে দেশের সংবিধান প্রদত্ত অযথা গ্রেপ্তার না হওয়ার, বিনা বিচারে আটক না থাকার মৌলিক অধিকার যে ক্ষুণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। জার্মানীর এ্যাডলফ হিটলার অবশ্য তাঁর ‘মাইন কামফ’ বইতে লিখেছেন – ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা জনগণের পৌরাণিক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।’
এলাকা না বাড়িয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তর বরং হয় ভারত-বাংলাদেশ সীমাবিভেদ তুলে দিক, কিংবা বিএসএফের জওয়ানদের কড়া নির্দেশ দিক যাতে তাঁরা মূল সীমানা থেকে তিন কিলোমিটারের মধ্যেই থাকতে বাধ্য হ’ন। সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা তো সাধারণতঃ গরীব, হীনবল। দূরবর্তী তথা শহরের মানুষদের যে ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত বেশি, অধিকার জ্ঞানও বেশি। তখন যে মনিপুরের বারো মায়েদের মতোই পশ্চিম বঙ্গের শহর বা আধা শহর এলাকার মায়েরাও নগ্ন মিছিলে সামিল হতে পারেন, বলতে পারেন, ‘ইন্ডিয়ান আর্মি, রেপ আস।’

মিলন মালাকার : মানবাধিকার কর্মী, বহরমপুর।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Related post