‘মৃত্যু লিখিবে…. জীবনের ইতিহাস’

তরুণকুমার দে
মৃত্যুদণ্ড
ফাঁসির দড়ি গলায় পরবার একান্ন দিন আগে সবমাত্র উনিশ পেরিয়ে আসা এক বিপ্লবী তাঁর মাকে লিখেছিলেন-‘মানুষকে আমরা খুন করি না। মানুষকে আমরা বাঁচাই।'[১]
সেই বিপ্লবীর মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল এক জেলাশাসককে প্রকাশ্যে গুলি করে মারবার অপরাধে।
গুলি চালাবার সময় ওই বিপ্লবীর পকেটে যে কাগজের টুকরোটি ছিল, তাতে লেখা ছিল – ‘ইহাদের মরণেতে ব্রিটেন জানুক।’
তারপরেই লেখা ছিল – ‘আমাদের আহুতিতে ভারত জাগুক।’
কাগজের টুকরোটির প্রথমেই বলা হয়েছিল – ‘হিজলীর অত্যাচারের ক্ষীণ প্রতিবাদ।’ [২]
হিজলীতে
কী হয়েছিল হিজলীতে ?
হিজলীর জেলে বন্দী ছিলেন অনেক বিপ্লবী। বিনা প্ররোচনায় বন্দী নিরস্ত্র বিপ্লবীদের উপর গুলি চালানো হয়েছিল। শহিদ হয়েছিলেন সন্তোষকুমার মিত্র এবং তারকেশ্বর সেনগুপ্ত। আরও কুড়িজন বিপ্লবী সাংঘাতিকভাবে আহত হয়েছিলেন। আহত এক বিপ্লবী গোবিন্দ দত্তের একটি হাতই বাদ দিতে হয়েছিল। সুসভ্য [!] ব্রিটিশের কী চমৎকার ক্ষমতা-প্রয়োগ ! পরবর্তীকালে যথার্থ মূল্যায়নই হয়েছিল – [ দ্বিতীয় ] ‘বিশ্বযুদ্ধের পর ইংরেজ সাংবাদিকরা আমাদের নাৎসি-জার্মানির কারাগারের ভয়াবহ নির্যাতনের বিবরণ দিয়েছিলেন, কিন্তু অন্য আর-এক দেশে তাঁরাও যে অনুরূপ বর্বরতার অনুষ্ঠান করেছিলেন, সে-কথা জগতের কাছ থেকে লুকোনো থাকেনি।’ [৩] ওই অমানবিকতাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলেন ইংরাজের চেম্বার অফ কমার্সের প্রধান। ওই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের পরে তিনি আবেগ-ভরা গলায় নির্লজ্জ সমর্থন জানিয়েছিলেন ওই হত্যালীলাকে – ‘If another European [ be ] murdered detenues should be shot.’ সেই সঙ্গে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের উদ্দেশ্য এবং স্বরূপ প্রকট করেছিলেন তিনি।
হ্যাঁ ! ওই জেলাশাসকের আগের জেলাধিপতিও নির্মম অত্যাচার চালিয়েছিলেন মুক্তিকামী ভারতবাসীর উপর। একই অপরাধে দুই বিপ্লবীর গুলিতে তিনিও ফৌত হয়েছিলেন। চেম্বার অফ কমার্সের ওই প্রধানের মাজাও সেই বিপ্লবীদের একজন ভেঙে দিয়েছিলেন। সেই শ্বেতাঙ্গ-পুঙ্গব সুস্থ হয়েই স্বদেশে ফিরে গিয়েছিলেন। [৪]
বিপ্লবীর দর্শন
তাহলে দেখা যাচ্ছে, শাসনযন্ত্রের মদতে অনেক মানুষকে যিনি বা যাঁরা বিনা বিচারে অথবা অবিচারে খুন করছিলেন, তাঁদের দু-চার জনকে সরিয়ে দিয়ে বহু মানুষকে বাঁচিয়েছিলেন ওই ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ মানসিকতার অধিকারী বিপ্লবীরাই। তার জন্য অবশ্য কয়েকজন বিপ্লবীকে নিজেদের প্রাণ আহুতি দিতে হয়েছিল। বিপ্লব সম্পর্কে আর এক বিপ্লবী ভগৎ সিং পরিষ্কার জানিয়েছিলেন – ‘বিপ্লব মানে রক্তারক্তি নয়।’ তিনি বলেছিলেন – ‘মানুষের জীবনকে আমরা পবিত্র বলে মনে করি।’ তিনি এই ঘোষণাও করেছিলেন যে, ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বা প্রতিহিংসা যথার্থ বিপ্লবীর মধ্যে থাকে না। তাঁর বক্তব্য এই ছিল যে, যথাযথ বিপ্লবীর হৃদয়ে মানুষের সেবা করবার ঐকান্তিক ইচ্ছাই বলবতী থাকে; কোনো বিপ্লবীই অকারণে কাউকে আঘাত করেন না। জেলাশাসককে হত্যা করে যিনি ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছিলেন, উল্লিখিত সেই বিপ্লবীর মানসিকতাও ছিল একই রকম। সেই জন্যই বিপ্লবীরা হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে উঠেছিলেন। ফাঁসির আদেশ শোনবার পরে তাঁদের অনেকেরই শরীরের ভর [ mass ] বেড়ে গিয়েছিল।
কিন্তু শাসনযন্ত্রের বরাভয়ে বাস করে এবং শাসন যন্ত্রের অন্যতম অংশীদার হয়েও যিনি দানবের মতো হিংস্র আচরণ করেন, তাঁকে নিশ্চিহ্ন করাই বহু সৎ মানুষকে রক্ষা করবার একমাত্র উপায়। মেদিনীপুরে পরপর তিনজন জেলাশাসককে হত্যা করে অসংখ্য ভারতবাসীকে বাঁচিয়েছিলেন বিপ্লবীরাই। একই সঙ্গে তাঁরা মদগর্বী ব্রিটিশ রাজশক্তির ঘুম টু্টিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরা যেন শাসকপক্ষকে বলেছিলেন ‘দেখেছ বাঙালী দাস, দেখনিক যৌবন।’ [৫]
যে বিপ্লবীর প্রসঙ্গ টেনে শুরু করেছিলাম, তিনি প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসের শেষ দিনটিতে তিনি আর তাঁর এক সঙ্গী চরম দণ্ড দিতে গিয়েছিলেন মেদিনীপুরের জেলাশাসক রবার্ট ডগলাসকে। প্রদ্যোতের বয়স তখন ছিল উনিশেরও কম। [৬] হাতের আগ্নেয়াস্ত্রটি কাজ না করবার জন্য তিনি ধরা পড়েছিলেন। হাজতে নির্মম অত্যাচারেও সঙ্গী বিপ্লবী [ প্রভাংশু পাল, যাঁর গুলিতেই ডগলাস নিহত হয়েছিলেন এবং যিনি আত্মগোপন করতে পেরেছিলেন। ] বা তাঁকে রিভলবার কে দিয়েছিলেন কিংবা দলের [ প্রদ্যোত ছিলেন বি ভি তথা বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের একজন। ] কারো নাম বলেননি। বিচারে প্রদ্যোতের ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন দুই বিচারক – স্পেশাল ট্রাইব্যুন্যালের চেয়ারম্যান নাগ এবং এক সদস্য মুস্তফি।
তৃতীয় সদস্য জে দে-র সম্ভবত সামান্য কিছুটা চক্ষুলজ্জা অবশিষ্ট ছিল। তাঁর মত ছিল – প্রদ্যোৎ হত্যাকারীর সঙ্গী ছিল সত্য, কিন্তু তাঁর রিভলবার তো কাজই করে নি; তাহলে সে হত্যাকারী হয় কেমন করে ? তিনি ওই যুক্তি অনুযায়ী প্রদ্যোৎকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেবার পক্ষেই ছিলেন।
কিন্তু রাজশক্তির তো ডগলাসের বদলে অন্তত একটি প্রাণ চাইই চাই। কাজেই শাস্তি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য কলকাতা হাইকোর্টে পাঠানো হয়েছিল মামলাটি। ব্রিটিশের হাইকোর্ট সংখ্যাগুরুর মতকেই গ্রহণ করেছিলেন। তখনকার ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ আদালত ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিলও ফাঁসির পক্ষেই মত দিয়েছিলেন।
প্রদ্যোৎ সেই সময়ে তাঁর মাকে লিখেছিলেন – ‘প্রাণ বাঁচানই জীবনের উদ্দেশ্য নয়, জীবন যদি জীবনের কাজে না লাগলো, তবে সেরকম জীবনের প্রয়োজন কি ?’ [৭] কী বলতে চেয়েছিলেন তিনি ? নিশ্চয় বলতে চেয়েছিলেন – দেশের কাজ করতে না পারলে বেঁচে থেকে লাভ কি ? বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত মামলার রায়ে দীর্ঘ কারাবাসের আদেশ জেনেই বিরক্ত হয়েছিলেন। তারপরই এক বিশ্বাসঘাতককে খতম করে কারাবাসের পরিবর্তে ফাঁসির দড়ি বেছে নিয়েছিলেন। প্রদ্যোৎও কারাগারে পচবার বদলে মৃত্যুকেই বরণ করে নিয়েছিলেন।
মুক্তিপথে
কিন্তু একটি তরতাজা সদ্য-যুবকের প্রাণ তো গেল ! তাহলে ?
ভগত সিং এর উত্তরও দিয়ে গিয়েছিলেন – ‘যে মহান বিপ্লব দেশকে মুক্ত করবে, যার আবির্ভাবে মানুষ আর মানুষকে কোনোমতেই শোষণ করতে সক্ষম হবে না, তার বেদীমূলে বহু লোককে উৎসর্গ করতেই হবে।’ প্রদ্যোৎ ব্রিটিশের সীমাহীন শোষণের চক্রব্যূহে বন্দী অগণিত ভারতবাসীকে মুক্তিদানের সংগ্রামে নিজেকে আহুতি দিয়েছিলেন। ডগলাস বা তাঁর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী মেদিনীপুরের দুই জেলাশাসক যথাক্রমে জেমস পেডী ও বি ই জে বার্জও ছিলেন ব্রিটিশ শোষণযন্ত্রের সক্রিয় অংশীদার। প্রকৃতপক্ষে তাঁরাও ছিলেন ভারতবাসীর রক্ত-শোষক। তাঁদের উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছিলেন যে বিপ্লবীরা, সেই [ পেডীর শাস্তিদাতা ] বিমল দাশগুপ্ত ও যতিজীবন ঘোষ; প্রদ্যোৎ ও প্রভাংশু এবং [ বার্জকে দণ্ডপ্রদানকারী ] অনাথ পাঁজা ও মৃগেন দত্তই বিপ্লবী। তাঁরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযোগ্য।
অমরত্ব
আত্মোৎসর্গের যখন দু মাসও বাকি নেই, তখন প্রদ্যোৎ তাঁর মাতৃসমা বৌদিকে লিখেছিলেন – ‘….আমি সকলের মধ্যে নিজের আসন সুদৃঢ়ভাবে পেতে রেখেই যাচ্ছি।’ [৮] প্রদ্যোতের বক্তব্য পরবর্তী কালে সত্য হয়েছিল। বছর পূর্ণ হবার আগেই বার্জকে লক্ষ্য করে অমোঘ বুলেট নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। কচি[প্রদ্যোৎ] তাঁর মাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন – ‘….একথা মনেও স্থান দিও না মা, যে, আমার সঙ্গে সঙ্গে আমার সমস্ত চিন্তা, সমস্ত আশারও লোপ পেয়ে গেল। সব রয়ে গেল আমার….’ [৯] প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল বছর পেরিয়ে যাবার আগেই। অনাথ এবং মৃগেন বার্জকে বধ করেছিলেন ০২,০৯,১৯৩৩-য়ে সশস্ত্র প্রহরী এবং পুলিশ ও পরিদর্শক পরিবৃত খেলার মাঠে, যার একদিকে ছিল আর্মারি এবং অন্যদিকে কারাগার।
প্রদ্যোতের মা কি ছেলেকে আশীর্বাদ করেছিলেন এই বলে ?
'এ কি শুনি ! গেছিস নাকি
শিকল দেবী'র পূজায় চলে !
অশ্রু ত নয় আশীষ ধারা
অবিরত পড়বে রে তোর শিরে।'
আত্মোৎসর্গে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ বিপ্লবীর মাতৃসমা বউদি কি তাঁর দেওরকে উৎসাহ দিয়েছিলেন কাব্যের ঝংকারে ?
'শঙ্কা কিসের ! যাও তবে যাও
অলক্ষণের বিজয় টীকা পরে,
হেথা বাজুক তোমার অগ্নিবীণা
আগুন টুটুক সুরে....' [১০]
প্রদ্যোতের আশা ফলবতী হয়েছিল। অগ্নিবীণা সত্যই বেজেছিল। শুধু প্রদ্যোতের মা নন, হাজার হাজার মা তাঁদের সন্তানদের পরাধীনতার শেকল ছেঁড়ার সংগ্রামে যোগ দেবার জন্য পাঠিয়েছিলেন। অবশ্য প্রদ্যোতের আত্মত্যাগের আগেও মায়েরাও সামনের সারিতে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে বিপ্লব সংঘটিত হবার পরে বিপ্লবীরা যখন আত্মগোপন করে ক্রমাগত বাসস্থান পরিবর্তন করছিলেন, তখন এক রাতে তাঁদের এক মুসলমান চাষীর বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। বাড়ির বৃদ্ধা গৃহিণী তাঁদের মহা- সমাদরে নিজে পরিবেষণ করে খাইয়েছিলেন। সেই বৃদ্ধা কি জানতেন না যে, পুলিশ টের পেলে তাঁকে এবং তাঁর পরিজনদের চরম নির্যাতন ভোগ করতে হবে ? তিনি বা তাঁর পরিবার সেই সম্ভাবনাকে গ্রাহ্যই করেন নি।[১১]
দশ বছরের গোড়ায়
প্রদ্যোতের আত্মোৎসর্গের পরে একটি দশক পূর্তির আগেই পরাক্রান্ত ব্রিটিশের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে মেদিনীপুরেই স্বাধীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রায় কুড়ি মাস ধরে স্বদেশী সেই সরকার সাইক্লোন-বিধ্বস্ত অঞ্চলে ত্রাতার ভূমিকা পালন করেছিলেন; শিক্ষায়তনগুলোতে অনুদান দিয়েছিলেন; সেই সঙ্গে বিদেশী অত্যাচারী শাসকের আক্রমণ প্রতিহত করবার জন্য বিদ্যুৎ-বাহিনী এবং ভগিনী-সেনা গঠন করেছিলেন। [১২]
বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা ব্রিটিশের তাঁবেদার ভারতীয় সৈনিকদের গুলিতে আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। পুলিশের নির্বিচার লাঠি ও বেওনেট চার্জ এবং গুলি বর্ষণের ফলে প্রতিবাদী বাহিনীর শোভাযাত্রা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছিল। গান্ধীবুড়ি [ মাতঙ্গিনী হাজরা ] জাতীয় পতাকা নাড়িয়ে তাঁদের ধিক্কার দিয়ে ঘুরে দাঁড়াবার জন্য ডাক দিয়েছিলেন। ৭৩ বছরের ওই অকুতোভয় বীরাঙ্গনার ডাকে প্রায় ছত্রভঙ্গ অভিযানকারীরা আবার সামরিক প্রণালীতেই একত্রিত হয়েছিল। বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা সকলের আগে জাতীয় পতাকা নিয়ে থানার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। প্রথমে তাঁর দুই হাতে গুলি লেগেছিল। তারপরেও তিনি এগিয়েই যাচ্ছিলেন। তখনই একটি গুলি তাঁর কপালে লেগেছিল এবং তিনি শহিদ হয়েছিলেন। এমন অসংখ্য মা স্বাধীনতা সংগ্রামে, বিশেষত ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সে দিক থেকেও প্রদ্যোতের আত্মদান ব্যর্থ হয়নি।
সীমাবদ্ধতা ও বিদূষণ
এ তো চরম সত্য যে, ডগলাসকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে চলে আসবার সময় প্রভাংশু গুলি চালিয়ে নিজের পথ পরিষ্কার করে নিলেও, প্রদ্যোৎ ধরা পড়েছিলেন তাঁর রিভলবার কাজ না করায়। সে জন্য প্রদ্যোতের কোনো ক্ষোভ ছিল – এমন জানা যায় নি। হয়তো একে ব্যর্থতাই বলা যায়। কিন্তু বিপ্লবীর জীবনে সাফল্য আর ব্যর্থতার সম্ভাবনা তো সবদিক চিন্তা করে পরিকল্পনা করবার পরেও সমানই থেকে যায়। মূল লক্ষ্য পূরণ হওয়ায় তো বিঘ্ন আসেনি। যাঁরা ওই দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা তো জীবন উৎসর্গ করবার মানসিকতা নিয়েই এগিয়েছিলেন।
ভিন্ন পথের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কেউ কেউ সশস্ত্র সংগ্রামীদের 'খুনী' বলতেন শুনেছি। তাঁরা কিন্তু যাঁরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অসংখ্য ভারতবাসীকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন, অত্যাচার চালিয়ে পঙ্গুত্ব দিয়েছিলেন এবং হত্যা করেছিলেন; সেই ব্রিটিশ-রাজের সঙ্গে আপস রফায় আসবার জন্য অহিংস নেতাদের বারবার বৈঠকে বসা অম্লান বদনে মেনে নেন। এঁরাই কোনো কোনো ঘটনাকে 'স্বদেশী ডাকাতি' বলে চিহ্নিত করেন। তাঁরা এটা বুঝেও বোঝেন না যে, ব্রিটিশ ভারতবর্ষের সম্পদ লুট করছিল। যে উন্নতি লক্ষ্য করা যায়, সেটুকু তারা নিজেদের স্বার্থেই করেছিল। ভারতবাসীদের সামান্য অংশ নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্রিটিশের পদলেহন করেছিলেন। সেটাই ছিল ওই সময়ের ধনী পরিবারের অনেকেগুলোরই অতীত। তা ছাড়া বিপ্লবীদের পক্ষে চূলচেরা বিশ্লেষণ করাও সম্ভব ছিল না।
অবশ্য বিপ্লবীদের ত্রুটি ছিল - তাঁরা নিজেদের মত ও পথ সম্পর্কে আপামর ভারতবাসীকে সচেতন করতে পারেন নি। ফলে বহু ক্ষেত্রেই ভারতবাসীরাই তাঁদের তাড়া করেছিলেন কিংবা পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। কাপ্তিপদা গ্রামে বাঘা যতীন এবং তাঁর সঙ্গী বিপ্লবীদের উপর চড়াও হয়েছিলেন গ্রামবাসীরাই। [১৩] পূর্ববঙ্গের বাঢ়ড়া গ্রামের এক ধনীর [ সুপ্রকাশ রায়ের মতে 'কুখ্যাত' ] বাড়িতে অর্থ সংগ্রহের জন্য সশস্ত্র হানা দিয়ে ফিরে আসবার সময় অনুশীলন সম্প্রদায়ের বিপ্লবীরা বারবার বিভিন্ন গ্রামের অধিবাসীদের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। গ্রামবাসীরা পুলিশ বাহিনীর সঙ্গেও যোগ দিয়েছিলেন। সংঘর্ষে বিপ্লবী ও গ্রামবাসী এবং পুলিশ পক্ষে একধিক ব্যক্তি হতাহত হয়েছিলেন। [১৪] পূর্ববঙ্গেরই মাদারিপুর সমিতির সদস্যরা বাইগুনতেয়ারী এবং আয়নাপুরে একই ভাবে অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে গ্রামবাসীদের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। বাধা দূর করবার জন্য বিপ্লবীদের বোমা ফাটাতে হয়েছিল। [১৫] এমন তো বারবারই হয়েছিল। গ্রেপ্তার এড়াবার জন্য সমস্ত কাজই বিপ্লবীদের অত্যন্ত গোপনে করতে হোত, প্রকাশ্যে ঈশ্বর-চিন্তা বা জাতীয় কংগ্রেসের অহিংস-কর্মসূচী পালন করা অথবা ওই জাতীয় কোনো ছদ্মরূপ বজায় রেখেই তাঁদের চলতে হোত। [ যেমন বারীণ ঘোষ ও তাঁর সঙ্গী মানিকতলার সংগ্রামীরা সাধুর ভেক নিয়েছিলেন। মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা অহিংস কংগ্রেসের কর্মী সেজেছিলেন। ] এই কারণেই সাধারণ ভারতবাসীর অধিকাংশই বিপ্লবীদের 'খুনী' কিংবা 'ডাকাত' মনে করতেন এবং তাঁদের গ্রেপ্তার করায় শাসক পক্ষের সহায়ক হতেন। ব্যতিক্রম অনেকেই ছিলেন। কিন্তু তাঁরা সংখ্যালঘু। অন্যদিকে সংগৃহীত অর্থ রক্ষা ও বৈপ্লবিক প্রচেষ্টায় বিনিয়োগ করা এবং গ্রেপ্তার এড়াবার জন্য বোমা-ফাটানো বা গুলিবর্ষণ করাও বিপ্লবীদের সঙ্গে দেশবাসীর দূরত্ব বৃদ্ধি করেছিল।
২৬/০৬/১৯১৬ তারিখে ওই ধরণের অর্থ সংগ্রহের একটি ঘটনার পরেই সংশ্লিষ্ট গৃহকর্তা বিপ্লবীদের কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলেন। সেই চিঠিতে সংগৃহীত ৯৮৯১ টাকা ঋণ গ্রহণের স্বীকৃতি ছিল এবং প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল - 'শতকরা পাঁচ টাকা হিসাবে বাৎসরিক সুদ দেওয়া হবে।' বিপ্লবীরা সফল হলে তথা দেশ স্বাধীন হলে সুদসমেত ওই ঋণ যে শোধ করা হবে - এও বলা হয়েছিল। [১৬] ওই জাতীয় চিঠিকে অবশ্য সংশ্লিষ্ট কোনো গৃহকর্তাই গুরুত্ব দিতেন বলে মনে হয় না। কারণ স্বাধীনতা আসবার অনাগত-কাল, স্বাধীন দেশের পরিচালক-গোষ্ঠী এবং সর্বোপরি স্বাধীন দেশের পরিচালকদের ওই চিঠির মর্যাদা-প্রদান - সবই ছিল অনিশ্চিত।
তা হলেও বিপ্লবীদের 'হটকারী', 'বিভ্রান্ত' কিংবা 'হিংস্র' বলবার কি কোন যুক্তি আছে অহিংস সংগ্রামীদের ?
স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিচালকেরা
প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামী যাঁরা, তাঁরা অহিংস বা সশস্ত্র সংগ্রামী – যাই হোন না কেন, তাঁদের মনই ছিল তাঁদের চালিকা শক্তি। অহিংস পথের পথিক বিরুদ্ধ শক্তিকে নৈতিক শক্তি দিয়ে জয় করেন। বিপ্লবীরা নৈতিক শক্তির সঙ্গে অস্ত্রও ব্যবহার করেন। দুই ধারাই একই গন্তব্যে পৌঁছবার উদ্দেশ্যে দুটি পথ মাত্র। সুতরাং একের অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবান হওয়াই সৌজন্য। দুঃখের বিষয় পরাধীন ভারতের অহিংস সংগ্রামের নেতৃত্ব সশস্ত্র সংগ্রামীদের প্রতি অনেক সময়েই সুবিচার করেন নি। গোপীনাথ[ মোহন ] সাহা চার্লস টেগার্ট ভেবে আর্নেস্ট দে-কে গুলি করে হত্যা করেছিলেন। [ শিকারকে খুব ভালোভাবে চিনে নেননি বিপ্লবী। ফলে নিরীহের প্রাণ গিয়েছিল। বিপ্লবীর আত্মবলিদান পূর্ণ সফলতাও পায়নি। এটিও বিপ্লবীদের একটি সীমাদ্ধতা। ] সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত [প্রাদেশিক] কংগ্রেসের অধিবেশনে শহিদ বিপ্লবী গোপীনাথের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়েছিল। একই প্রস্তাব নিয়েছিলেন কলকাতা কর্পোরেশনের সদস্যরা। কিন্তু সে প্রস্তাবটি confirmed হয়নি। [১৭] কয়েক বছর পরে ০৭/০৭/১৯৩১-য়ে রাইটার্স বিল্ডিং-য়ে ঐতিহাসিক অভিযানের নেতা দীনেশ গুপ্তের ফাঁসির পরে অন্য চিত্র প্রকট হয়েছিল। কলকাতা কর্পোরেশন বিপ্লবীর আদর্শের জন্য জীবন দান করায় শোক প্রকাশ করেছিল। হাওড়া পৌরসভাও দীনেশের আত্মত্যাগের জন্য গভীর দুঃখ-প্রকাশ ও শোক-প্রস্তাব-গ্রহণ করেছিল। এরও সাড়ে তিন মাস আগে বিপ্লবী ভগৎ সিং, রাজগুরু এবং শুকদেবের ফাঁসি হয়েছিল লাহোরে। তাঁদের আত্মবলিদানকে প্রশংসা করা হয়েছিল করাচী কংগ্রেসের ওই সময়ের অধিবেশনে। ওই মনোভাব গোপীনাথ [ মোহন ] সাহার আত্মত্যাগের পরেও গ্রহণ করাও কি উচিত ছিল না ? তাঁর পথের সমালোচনা যোগ করেও কী শোক-প্রস্তাব গ্রহণ করা অসম্ভব ছিল।
১৯৩১-য়ে Round Table Conference-য়ের ফলশ্রুতি সম্পর্কে ভারতবাসীরা অপরিসীম আশা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু গান্ধিজী কী নিয়ে ফিরেছিলেন ? ‘In the R.T.C. no demand was secured…..On 28th December, 1931, empty-handed Gandhiji came back to India.’ [18] বিপ্লবীদের মতোই সাফল্য এবং ব্যর্থতার সম্ভাবনা অহিংস স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ক্ষেত্রেও সমানই ছিল। সুতরাং সেই সময় [ এখনও সেই সুর স্তিমিত হয়নি। ] বিপ্লবীদের ভ্রান্ত বলা কি অনুচিত হয় নি ?
মাতঙ্গিনী হাজরার জীবনের মূল্যে ‘ভারত ছাড়ো’ তথা ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ ধ্বনিকে পূর্ণতা দেবার প্রচেষ্টাকে কি কেউ অব মূল্যায়ণ করেছেন ? ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন সম্পর্কে উদ্গাতা গান্ধীজিই ১৯৪৫-য়ের একেবারে শেষ দিকে বলেছিলেন – ‘জাতীয় সরকার ও বিদ্যুৎ বাহিনী গঠন করে যা করা হয়েছে তার অনেকটাই উচিত হয়নি।’ [১৯] সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরেও আন্দোলনকারীদের বীরত্ব এবং সংগ্রামী মনোভাবের প্রশংসাই করেছেন মুষ্টিমেয় মানুষ ছাড়া প্রায় সকলেই। [২০] এঁদের মধ্যে গান্ধীজির রাজনৈতিক বিরোধীরাও ছিলেন বা আছেন।
অবশ্য দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও হতে দেখা গেছে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ বাহিনী নিয়ে ইংরাজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করলে ভারতবর্ষের অহিংস-সংগ্রামী জাতীয় কংগ্রেস, C.P.I. এবং অন্যান্য অনেক রাজনৈতিক দল প্রায় একই সুরে তাঁর এবং আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভারত অভিযানের [ কেবলমাত্র প্রচারে ] প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ রাজশক্তি নেতাজির অনুগামী ওই সৈনিকদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করলে, তাঁদের মুক্তির দাবি নিয়ে প্রায় সব গোষ্ঠী তথা রাজনৈতিক দলই সোচ্চার হয়েছিলেন। যুদ্ধের সময়ের নেতাজি-বিরোধী জহরলাল নেহেরু অভিযুক্ত-পক্ষের উকিলের ভূমিকাও নিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন রসিদ আলির দণ্ডাদেশের প্রতিবাদে দল ও মত নির্বিশেষে প্রায় সবাই মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। ‘সামনে পতাকা হাতে হেঁটেছেন ছাত্র ফেডারেশনের নেত্রী গীতা মুখোপাধ্যায়, পাশে শ্লোগান দিয়েছেন আর এস পির বদরুল হায়দার চৌধুরী। মাত্র ২৪ ঘন্টা আগে এঁরা পরস্পরকে শত্রু বলে চিহ্নিত করেছেন,… বিপ্লব পরিস্থিতিতে বোধকরি এমনই যাদু থাকে।…. চারিদিকে উড়ছে কংগ্রেসের তেরঙ্গা ঝাণ্ডা – ….তারি মাঝে উড়ছে স্বাধীনতা-শান্তি-প্রগতির ছাত্র ফেডারেশনের পতাকাও।’ [২১] রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় যেদিন শহিদ হয়েছিলেন, ওইটি ছিল তার পরের দিনের হুবহু চিত্র। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে C.P.I. দলের ভূমিকার মূল্যায়ণ করা হয়েছিল এইভাবে – ‘….they are allied much more than any other time with the Muslim League and other reactionary forces,….’ [22] মুসলিম লীগ সম্পর্কেও ধিক্কার দেওয়া হয়েছিল – ‘….the League did their best to create anti-Hindu and anti-Congress feelings among the Muslim masses.’ [23] কিন্ত সেদিন ‘….দেখা গেল ইসলামিয়া কলেজের কয়েক শত ছাত্র মুসলিম লীগের অর্ধ-চন্দ্র এবং তারকা-খচিত সবুজ পতাকা হাতে আসছে।’ সঙ্গে সঙ্গে বহু কন্ঠে শোনা গিয়েছিল – ”হিন্দু মুসলমান এক হও। সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক।’ [২৪] শেকল ছেঁড়ার উদ্দীপনা অতীতকে চাপা দিয়েছিল, একাকার করে দিয়েছিল সমস্ত রাজনৈতিক দলের কর্মীদের।
নেতাজি ০৬/০৭/১৯৪৪-য়ের রেডিও বক্তৃতায় গান্ধীজিকে ‘মহাত্মাজি’ বলেই শুরু করেছিলেন। ‘ভারতবর্ষে আজ যে জাগরণের সাড়া পড়েছে এর মূলে রয়েছেন আপনি’ – এই স্বীকৃতিও দিয়েছিলেন। ভিন্ন মত ও পথের পথিক গান্ধীজিকে ‘আপনি আমাদের জাতির পিতা’ বলে সম্মান জানিয়ে তাঁর আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা কামনা করেছিলেন নেতাজি। [২৫] আজাদ হিন্দ ফৌজের দ্বিতীয় এবং চতুর্থ গেরিলা বাহিনীর নাম দেওয়া হয়েছিল যথাক্রমে গান্ধী এবং নেহেরু ব্রিগেড। সামান্য কয়েক বছর আগেই গান্ধীজির অনিচ্ছা এবং বিরোধিতার জন্যই আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ককে কংগ্রেস-সভাপতির পদ ছেড়ে দিতে হয়েছিল। জহরলাল নেহেরু তো তখনও আজাদ হিন্দ ফৌজ তথা নেতাজির বিরোধিতা করে যাচ্ছিলেন। সবই নেতাজির জানা ছিল। তা সত্ত্বেও গান্ধীজি এবং নেহেরুকে উপযুক্ত সম্মান দিতে দ্বিধা করেন নি নেতাজি বা তাঁর সহযোগীরা।
বা তাঁর সহযোগীরা।
আদ্যোপান্ত গান্ধী-অনুরাগী সুশীল ধাড়া ছিলেন তমলুকের উল্লিখিত জাতীয় সরকারের অন্যতম রূপকার এবং বিদ্যুৎ বাহিনীর অন্যতম প্রাণপুরুষ। তিনি লিখেছিলেন – ”….নেতাজি’র এই সম্বোধন, অদৃশ্য পথে আগস্ট আন্দোলনের শক্তি ও নতুন প্রেরণার উৎস হয়ে গেল।’ [২৬] জাতীয় সরকারের বিদ্যুৎ বাহিনী এবং ভগিনী সেনা যথাক্রমে আজাদ হিন্দ ফৌজ এবং রানি ঝাঁসি বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেবে – এও ছিল তাঁর কামনা। [২৭]
কমলা দাশগুপ্ত ছিলেন যুগান্তর দলের সদস্যা। বোমা এবং বোমার মালমসলা সংরক্ষণ এবং নির্দিষ্ট বিপ্লবীর কাছে বা স্থানে পৌঁছে দেবার কাজই তিনি করতেন। পরিণত বয়সে তিনি ‘স্বাধীনতা-সংগ্রামে বাংলার নারী’ গ্রন্থে নানা ধারার সংগ্রামীদের জীবন-কাহিনি বিধৃত করেছেন। যাঁদের কথা শুনিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে প্রীতিলতা ওয়াদ্দদার, কুমিল্লার জেলাশাসক স্টিভেন্স-বধকারী শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী, বীণা দাসের মতো সশস্ত্র সংগ্রামীরা যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন অহিংস মতে বিশ্বাসী মাতঙ্গিনী হাজরা,আশালতা সেন, জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলীরাও। একই গ্রন্থে তিনি পতিতা সাবিত্রীকেও উদ্ভাসিত করে ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সৈনিকের মর্যাদায়। [২৮]
উপসংহার
শেষে ‘ভরত বাক্য’-য়ের পরিবর্তে অতীতের একটি ঘটনা বিধৃত করছি। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৯২১-য়ে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অনুরোধে তাঁকে হাওড়া জেলে কংগ্রেসের সভাপতির পদও গ্রহণ করতে হয়েছিল। পরে অবশ্য তিনি স্বরাজ্য দলে যোগ দিয়েছিলেন। কংগ্রেসে থাকাকালীন একদিন শরৎচন্দ্র গান্ধীজির কাছে অহিংসাই স্বাধীনতা যুদ্ধের একমাত্র পথ -এমনই তাঁর ধারনা কিনা জানতে চেয়েছিলেন। ইতিবাচক উত্তর দিয়ে গান্ধীজি তাঁর মতে সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসীরা ভ্রান্ত এবং সন্ত্রাস- সৃষ্টিকারীরা দেশের শত্রু – এই অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। শরৎচন্দ্র তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করেছিলেন। বিপ্লবীদের দেশপ্রেমের গভীরতা সম্পর্কে নিজের মত প্রকাশ করে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন যে, মতবিরোধ শত্রুতা হতে পারে না; কারণ তাহলে বিপ্লবীদের দৃষ্টিকোণ থেকে একই ভাবে গান্ধীজীরও [বিপ্লবীদের মনে] দেশের শত্রুরূপে পরিগণিত হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। সেদিন গান্ধীজি তাঁর মন্তব্য প্রত্যাহার করেছিলেন।[২৯]
তথ্যসূত্র
[ ১ ] শৈলেশ দে – ‘যেন ভুলে না যাই’, পৃষ্ঠা ১২৯ ; বিশ্বাস পাবলিশিং হাউস, দ্বিতীয় প্রকাশ, ১৯৭৬
[ ২ ] ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায় – ‘প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য’, পৃষ্ঠা ৪১; গ্রন্থঃ ‘মৃত্যুহীন’ [ দ্বিতীয় ভাগ ], সংকলক – বিপ্লবী নিকেতন; দ্বিতীয় সংস্করণ, পুনর্মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারী ১৯৮০
[ ৩ ] নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় – ‘মাতঙ্গিনী হাজরা’, পৃষ্ঠা ১৪; দেব সাহিত্য কুটীর প্রা. লি., ২০০৩ প্রকাশন
[ ৪ ] চেম্বার অব কমার্সের সেই প্রধান ছিলেন ভিলিয়ার্স। তিনি এরপরেই স্বদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েছিলেন বিমল দাশগুপ্ত।
[ ৫ ] কাজি নজরুল ইসলাম – ‘আগ্নেয়গিরি বাঙলার যৌবন’, নজরুল রচনা-সম্ভার, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩; হরফ প্রকাশনী, দ্বিতীয় প্রকাশ, ১৯৭৮
[ ৬ ] প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য – জন্ম: ০২/১১/১৯১৩ এবং আত্মবলিদান ১২/০১/১৯৩৩
[ ৭ ] শৈলেশ দে-র উল্লিখিত গ্রন্থ, পৃষ্ঠা – ১২৫
[ ৮ ] ঐ, পৃষ্ঠা ১২৬
[ ৯ ] ঐ, পৃষ্ঠা – ১৩২
[ ১০] বিরজাসুন্দরী দেবী – ‘শ্রীমান কাজি নজরুল ইসলাম’, ধূমকেতু – কাজি নজরুল সংখ্যা, ২৭/০১/১৯২৩
[ ১১ ] শঙ্কর ঘোষ – ‘মাস্টারদা সূর্য সেন’, পৃষ্ঠা ১৩৯; প্রমিথিউস পাবলিশিং হাউস, প্রথম সংস্করণ, ২২/০৩/২০১২
[ ১২ ] গঠনের সময় বিদ্যুৎ-বাহিনীর ছিল সমর [ War ] ,গোয়েন্দা [ Information ] এবং অ্যাম্বুল্যান্স [ Assistance & Relief ] – এই তিনটি বিভাগ। পরে গেরিলা-বাহিনী, আইন-বিভাগ [ Peace & Order ] এবং ভগিনী-সেনা [ Army of Sisters ] যোগ করা হয়েছিল।
[ ১৩ ] শুভঙ্কর মল্লিক চৌধুরী – ‘বাঘা যতীন’, পৃষ্ঠা ৩১০-৩১২; ‘প্রমিথিউসের পথে’ – অমর শহিদ বাঘা যতীন প্রয়াণ শতবর্ষ স্মরণ সংখ্যা, মে-জুলাই, ২০১৬
[ ১৪ ] সুপ্রকাশ রায় – ‘ভারতের বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাস’, প্রথম খণ্ড / ১৯০১-১৯১৮, পৃষ্ঠা ২২৫ – ২২৬ , DNBA BROTHERS, ১৯৭০ মুদ্রণ
[ ১৫ ] ঐ; পৃষ্ঠা – ২৩৮ – ২৩৯
[ ১৬ ] কমলা দাশগুপ্ত – ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী’, পৃষ্ঠা ১৮; বসুধারা প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ, ১৯৬৩
[ ১৭ ] ‘মহাত্মাজীর চাপে সে-প্রস্তাব বাতিল করতে হয়।’ – নয়নারঞ্জন দাশগুপ্ত – ‘গোপীমোহন [ নাথ ] সাহা’, পৃষ্ঠা ৬০; ‘মৃত্যুহীন’ [ প্রথম ভাগ ], সংকলক – বিপ্লবী নিকেতন; তৃতীয় সংস্করণ, পুনর্মুদ্রণ, ১৯৮১
[ 18 ] ‘India’s Struggle for Freedom’ – Department of Information & Cultural Affairs, Government of West Bengal, Page 146; First English Edition, 1987
[ ১৯ ] ড প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ – ‘মহাত্মা গান্ধী’, পৃষ্ঠা ২৫৭; গান্ধী স্মারক নিধি প্রকাশনা, ১৯৬৩
[ ২০ ] ‘তেজদীপ্ত বিয়াল্লিশের ঐ স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহকে হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে বলে দিলেন, ‘আমি মনে করি না যে, গত তিন মাসের মধ্যে যে সব অর্থহীন উচ্ছৃঙ্খলতা এবং নাশকতা মূলক কাজ করা হয়েছে, তার দ্বারা আমাদের দেশের স্বাধীনতা লাভের সহায়তা হবে।” -অপূর্ব বিশ্বাস – ‘সুভাষচন্দ্র, সি পি আই ওআজাদ হিন্দ ফৌজ, পৃষ্ঠা ৪৪-৪৫; প্রমিথিউসের পথে, আজাদ হিন্দ ফৌজ সংখ্যা, অক্টোবর- ডিসেম্বর, ২০১৪
[ ২১ ] গৌতম চট্টোপাধ্যায় – ‘এস তবে আজ বিদ্রোহ করি’, পৃষ্ঠা ২৬৫; পরিচয়, শারদীয় ১৩৮৪ [ ১৯৭৭ ]
[ 22 ] Govind Sahai – ’42 REBELLION’, Page 447; Rajkamal Publications, First published 1947
[ 23 ] -do-, Page 444
[ ২৪] গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের উল্লিখিত প্রবন্ধ , পৃষ্ঠা ২৬৫
[ ২৫ ] ‘নেতাজি সপ্তাহ’, আজাদ হিন্দ ফৌজ সংখ্যা, প্রমিথিউসের পথে, পৃষ্ঠা ৩৫৩; অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০১৪
[ ২৬ ] সুশীল কুমার ধাড়া – ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও গান্ধীজি’, পৃষ্ঠা ৭২; ‘পশ্চিমবঙ্গ’, গান্ধী সংখ্যা, জানুয়ারি ০৬ – ফেব্রুয়ারি ০৩, ১৯৯৫
[ ২৭ ] ঐ, পৃষ্ঠা ৭৬
[ ২৮ ] পৃষ্ঠা ১২৫, ১১৩, ১১৯, ২৩৭, ৯৫, ৫৯ ও ৬৮
[ ২৯ ] সৌমেন বসু এবং মানব বেরা সম্পাদিত – ‘অনন্য দেশনায়ক’, পৃষ্ঠা ১০৭-১০৮; বিপ্লবী জনমত, প্রথম প্রকাশ, ১৯৯৮
** ভগত সিং-য়ের রচনার অনুবাদ শৈলেশ দে এবং বিপ্লব চক্রবর্তীর।