পরিবেশ বিপর্যয় ও জলসঙ্কট

অনুপ গাঙ্গুলি
দেখে অনেকেই বিরক্ত হতে পারেন। একথা মনে আসতেই পারে যে আবার পরিবেশ! ঠিকই, গত দুই দশক ধরে বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানকর্মী এবং অন্যান্যরা পরিবেশের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তর লেখালেখি ও আলোচনা করে চলেছেন। তার আগেও লেখা হতো তবে পরিমাণে কম। তাছাড়া সাম্প্রতিককালে টিভি, ইন্টারনেট ইত্যাদি ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় পরিবেশ সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা এবং খবর বেড়েছে। তারপরও পরিবেশ নিয়ে লেখা? হ্যাঁ ঠিক তাই। আসলে, যে সত্য আমরা সবসময় মনে রাখি না তা হল পৃথিবীর প্রতিটি সমাজেই চেনা প্রসঙ্গ,জানা বিষয়ই সময় ও অবস্থার পরিবর্তনে নতুন করে এবং নতুন জোরে এসে হাজির হয়। এক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেই রকমই। পরিবেশের সমস্যাগুলি আজ শুধুমাত্র সিলেবাসের পাঠ্য, বিজ্ঞান কর্মীদের প্রচার আন্দোলন এবং কিছু সংখ্যক বিজ্ঞানীর দেওয়া সর্তকতা ও ক্ষোভ প্রকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। পরিবেশের বিষয়টা আজ সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। একদিকে আবহাওয়ার খামখেয়ালীপনা ও দুর্যোগের সংখ্যা বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে। মানুষ জীবন দিয়ে বুঝতে পারছেন পরিবেশের বিপদ ও ভয়াবহতা। অন্যদিকে বিষয়টি এতটাই ভাবনার যে এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিধিও সাড়া দিতে বাধ্য হচ্ছে।
গতবছর (২১ শে মার্চ ২০২১) ইউ এন ও এর ইন্টার গভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) তার ষষ্ঠ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে রয়েছে ভয়ঙ্কর বিপদের বার্তা। আগ্রহী পাঠক আন্তর্জালে খোঁজ করলেই রিপোর্টটি দেখে নিতে পারবেন। আবার গত বছর লন্ডনে যে আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন (cop26) অনুষ্ঠিত হয় সেখানেও পরিবেশ বিপর্যয় রোধের ব্যবস্থা বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়। এইসব আশঙ্কার মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী গবেষণার মাধ্যমে দাবি করেছেন যে পৃথিবীতে ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির পর্ব শুরু হয়ে গেছে। এই গণবিলুপ্তির কারণ একান্তভাবেই নৃতাত্ত্বিক (মনুষ্য সৃষ্ট),আগের পাঁচটির মতো প্রাকৃতিক নয়। তাই আজ পরিবেশ বিপর্যয় সংক্রান্ত সমস্যা মেনে নিলেই হবে না মনে নিতে হবে। বর্তমান পরিবেশ আন্দোলনের আইকন সুইডেনের মেয়ে গ্রেটা থুনবার্গের কথায় প্যানিকি হতে হবে যোগ দিতে হবে প্রতিকার আন্দোলনে। তাই পরিবেশ বিপর্যয় সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা, লেখালিখি চালিয়ে যেতে হবে নতুন নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে। সেই লক্ষ্যেই ক্ষুদ্র হলেও এই আন্তরিক প্রচেষ্টা।

পরিবেশ বিপর্যয়: পরিবেশ, পরিবেশ দূষণ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদি বিষয়গুলি স্কুলে পাঠ্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাছাড়াও এই সংক্রান্ত বিষয়ে সাম্প্রতিককালে লেখালেখি এবং আলোচনা বেড়ে গেছে। ফলে বিষয়টি সম্পর্কে সকলেই কমবেশি অবহিত। আসলে পৃথিবী পৃষ্ঠে জীবজগতের টিকে থাকার অপরিহার্য শর্ত হলো নির্মল ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ।
বহুবিধ উপাদানের মধ্যে পরিবেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক উপাদান হল জল, মাটি ও বাতাস। কিন্তু একের পর এক প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, অরণ্যবিনাশ, ওজোন স্তরের ক্ষতি, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়া, গ্রীন হাউস ক্রিয়ার প্রয়োগ,বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রভৃতি বিধ্বংসী ঘটনার ধাক্কায় উপরোক্ত তিনটি সহ পরিবেশে প্রতিটি উপাদানই আজ সংকটগ্রস্ত। সমস্ত বিষয়ের আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। এখানে যতটা সম্ভব সংক্ষেপে জল সংকটের বিষয়টি আলোচিত হবে।
জল সংকট: কোনো অঞ্চলে জল ব্যবহারের চাহিদার তুলনায় যোগান কম হলে জল বিষয়ক সমস্যার সৃষ্টি হয়। সমস্যাটি যখন বিস্তৃত এবং গভীর হয় তখনই তাকে বলে জল সংকট। জল সংকটের ফলে জলের উপর নির্ভরশীল জীব ও উদ্ভিদ জগৎ চরম দুর্দশা এবং দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে। সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশও সেই অবস্থার মধ্যে পড়া শুরু করেছে। এই বিষয়ে ২০১৮ সালে নীতি আয়োগ একটি প্রতিবেদন পেশ করে। প্রতিবেদনটিতে চোখ রাখলেই বোঝা যায় বিপদের গভীরতা ঠিক কতখানি। নীতি আয়োগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২০ মধ্যে দিল্লি,চেন্নাই,হায়দ্রাবাদ, বেঙ্গালুরু সহ ২১ টি বড় শহরে ভূগর্ভস্থ জল শূন্যে পৌঁছে গেছে। বর্তমানে এর কোনো প্রামাণ্য তথ্য জানা নেই। এছাড়াও নীতি আয়োগের প্রতিবেদন জানাচ্ছে ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ১২% মানুষ ইতিমধ্যে (২০১৮) “ডে জিরো”অবস্থায় বেঁচে আছে। অর্থাৎ বাইরে থেকে ট্যাংকারে করে আসা জলই সেখানকার মানুষদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। এই প্রতিবেদনে বলছে ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতবর্ষে জলের চাহিদা সরবরাহ থেকে দ্বিগুন হবে। বাড়বে জলের জন্য হাহাকারের তীব্রতা। ২০১৮ সালে দেখা যাচ্ছে দেশের ৬০ কোটি নাগরিক মাঝারি থেকে তীব্র জল কষ্টের শিকার হয়েছেন। প্রতিবেদনে আরও প্রকাশিত হয়েছে ৭৫% বাড়িতে শুদ্ধ পানীয় জলের কোনো উৎস নেই, গ্রামীণ এলাকার ৮৪% বাড়িতে নলবাহিত জলের সংযোগ নেই, ২০৩০ সালে ৪০% ভারতীয় নাগরিক শুদ্ধ পানীয় জল পাবেন না। তারপরেও যা উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ তা হলো দেশের প্রায় ৭০% জলের ভান্ডার কোনো না কোনোভাবে জল দূষণে আক্রান্ত। দেখা গেছে এ দেশের ২১% অসুখ বিসুখের মূল কারণ জল বাহিত সমস্যা। যে সব জায়গায় সেই ভাবে কোন জল সংকট নেই সেখানকার মানুষ দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতায় এ সমস্যাটি অনুধাবন করতে পারবেন না। কিন্তু ভারত সরকারের দেওয়া তথ্যের অংশবিশেষ থেকেই ধরা পড়ছে বিপদ খুব দূরে নেই।
সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে দ্রুতগতিতে কমে চলেছে ভারতবর্ষের ভূগর্ভস্থ জল স্তর। নাসার (NASA) গ্রাভিটি রিকভারি এন্ড ক্লাইমেট এক্সপেরিমেন্ট (GRACE) ভিশন বিশ্বের ৩৪টি অঞ্চলে ১৪ বছর ধরে চালায় পর্যবেক্ষণ। সেই পর্যবেক্ষণেও ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের জল স্তর নেমে যাওয়ার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। জল নিবিড় (Water intensive) কৃষি ব্যবস্থা, শিল্প, বিদ্যুৎ প্রকল্প ইত্যাদিতে অপরিকল্পিতভাবে ক্রমবর্ধমান জলের চাহিদা এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে এবং পরিস্থিতিকে ক্রমেই অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার করা হয় ভারতবর্ষে। ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলনের পরিমাণ বেড়েই চলেছে কোনো নিয়ম না মেনে। তার উপর পেপসি, কোকাকোলার মত ওয়াটার প্যাকেজিং এন্ড সফট ড্রিংকস ইন্ডাস্ট্রি বিনা শুল্কে ভূগর্ভস্থ জল তোলার অনুমতি পেয়েছে। ২০১৬ সালে “কোবরা পোস্টে” এ সংক্রান্ত বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা যাচ্ছে পেপসিকো বছরে ৬ লক্ষ ৪৮ হাজার কিউবিক মিটার জল তুলে নেয়, বদলে ফেরত দেয় না কিছুই। অথচ শর্ত ছিল ওই পরিমাণ বা তার কাছাকাছি পরিমাণ জল ফিরিয়ে দেবার। সফট ড্রিংকস তৈরিতে লাগে বিপুল পরিমান জল যার সবটাই ওঠে ভূ-গর্ভস্থ জলের ভান্ডার থেকে।স্বাভাবিকভাবেই দ্রুতগতিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ বিশুদ্ধ জলের ভাণ্ডার। উপরন্তু জলে মিশে যাচ্ছে বিপদজনক ধাতু ও রাসায়নিক পদার্থ। এইসব কর্পোরেট হাঙরদের ব্যবসা ও মুনাফা যত বাড়ছে ততোই ধ্বংস হচ্ছে বিশুদ্ধ জলের ভাণ্ডার। এইসব কর্পোরেট কোম্পানি ভূগর্ভস্থ জলের পুনর্নবীকরণ (Water recharge) ও বর্জ্য জলের পুনর্ব্যবহার (Treatment & recycling) সংক্রান্ত বিধি নিষেধের তোয়াক্কা করে না। এরা বোঝে শুধু মুনাফা আর মুনাফা। এছাড়াও বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং অন্যান্য পরিবেশ দূষণ জনিত কারণে আবহাওয়ার খামখেয়ালীপনা তো আছেই। বৃষ্টিপাতের পরিমাণের কোনো নির্দিষ্টতা নেই। কোনো সময় বর্ষাকালে বৃষ্টিহীন দিনের সংখ্যা বেড়ে যায়, বৃষ্টি হয় অন্য সময়। আবার কখনো বর্ষাকালে এত বেশি বৃষ্টি হয় যে সবকিছু ভেসে যায়। তবে বৃষ্টিপাতের হ্রাস বা বৃদ্ধির থেকে যা বেশি বিপদের তা হল মাটির জল ধারণ ক্ষমতার ক্রম অবনমন। কারণ এখনো এদেশে সারা বছরে যা বৃষ্টিপাত হয় তার পরিমাণ আমাদের প্রয়োজনীয় জলের থেকে বেশি। অন্যদিকে মাটির জল ধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে বর্ষায় পতিত বৃষ্টির জল দ্রুত বয়ে যায়, গিয়ে পড়ে নদীতে। দেখা দেয় বন্যা। আবার বর্ষা শেষ হবার কিছুদিনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে খরার ভ্রুকুটি। এসবের কারণ হলো সবুজের ঘনত্ব কমে যাওয়া এবং ভূপৃষ্ঠের অন্যান্য কৃত্রিম এবং প্রাকৃতিক জলাভূমি পুকুর, দিঘি, খাল,বিল ইত্যাদির ধ্বংস সাধন।
নদী বিজ্ঞানীরা সুস্পষ্টভাবে বারবার বলে থাকেন যে জল যেন খুব দ্রুত নদীতে না পড়ে। তাহলে একদিকে হবে ভূমিক্ষয় অন্যদিকে কমবে নদীর নাব্যতা। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় হল বৃক্ষের ঘনত্ব বাড়ানো এবং ভূ-পৃষ্ঠস্থ জলাভূমির সংস্কার ও সংখ্যা বৃদ্ধি। এই কাজগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর থেকেও যেটা বেশি গুরুত্বের তা হল জলবিভাজিকা (Water shed) গুলির ব্যাপক পুনরুজ্জীবন। এই পুনরুজ্জীবন বা উন্নয়নের ফলে নদী অববাহিকা অঞ্চলে ভূমিক্ষয়,ধস,বন্যা ও খরা প্রতিরোধ করা যাবে।এ ছাড়াও মাটি, জল ও বনভূমির সুষ্ঠু ব্যবহার ওই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশের উন্নতি ঘটাবে। এইসব গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি আন্তরিকভাবে করলে হারিয়ে যাওয়া জল ফিরিয়ে আনা যাবে। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে যতটা সম্ভব বৃষ্টির জল জমিয়ে রাখবার ব্যবস্থা। তার ফলে মাটি গভীরে সিক্ত হবে, ভূমি জলের ভাণ্ডার নতুন করে ভরে উঠবে, জলীয় বাষ্প বায়ুমন্ডলে ফিরে গিয়ে তাপমান কে নিয়ন্ত্রণ করে জল চক্রকে পুনরায় সক্রিয় করে তুলবে। অথচ বাস্তবে ঘটছে এর বিপরীত কার্যকলাপ। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও অবৈজ্ঞানিক উন্নয়নের ঢক্কানিনাদে বেপরোয়াভাবে ধ্বংস হয়ে চলেছে ধরণী রক্ষাকারী বৃক্ষদল এবং জলাভূমি। এসবের উপর শেষ কয়েক দশকে শুরু হয়েছে প্রকৃতির সবচেয়ে বড় রক্ষক আদিবাসী এবং প্রান্তিক জনজাতির উচ্ছেদ। মূলনিবাসী মানুষের উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হচ্ছে অরণ্য নিধন। সমস্যা সংকট স্তর থেকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বিপর্যয়ের স্তরে। নীতি আয়োগ তাই অধিকতর খারাপ হতে থাকা জল সংকটের বিষয়ে দ্বর্থহীন ভাষায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

উপসংহার : প্রথমেই দুটি বিষয়ে পরিষ্কার থাকা দরকার। পরিবেশ বিপর্যয় ও জল সংকট সংক্রান্ত যেটুকু বলা হয়েছে সমস্যা তার থেকেও বেশি। কারণ অনেক তথ্য ও ওই বিষয়ক কথাবার্তা বাদ গেছে। আর প্রকৃতির অনেকগুলি উপাদানের ফিরিয়ে না আনতে পারার মতো পরিবর্তন ঘটেছে ( irreversible change)।তাহলে সবই কি শেষ হয়ে গিয়েছে? কোন উপায়ই কি আর নেই? উত্তর হচ্ছে সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। এখনো উপায় আছে। কারণ প্রকৃতি আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পেলে এবং কিছুটা সহায়তা ও সময় পেলে নিজেই নিজের শুশ্রূষা করে নেয়।এখন দেখা যাক আক্রমণ কমিয়ে সহায়তা কি কি ভাবে করা যায়।
প্রথমত, ব্যক্তিগত স্তরের ব্যবহারিক জীবনে জলের অপচয় রোধ, গাছ লাগানো ও পরিচর্যা করা, সুযোগ থাকলে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ ও তার ব্যবহারে মনোযোগ দেওয়া। তবে মনে রাখা দরকার এগুলি প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এবং নিতেই হবে। কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট নয় প্রধানত যা একান্ত ভাবে দরকার তা হলো সরকারি উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত রূপায়নের কার্যকরী সদিচ্ছা।
দ্বিতীয়ত, সর্বক্ষেত্রে জলের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে বিবেচনা ও নিয়ন্ত্রনহীন জল ব্যবহারের লাগাম টানতে হবে, শুরু করতে হবে বিজ্ঞাননির্ভর জল ব্যবহারের প্রযুক্তি।
কৃষিক্ষেত্রে জল সাশ্রয়ী বীজের ব্যবহার বাড়াতে হবে, আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ও ভৌম জলের অবস্থার ভিত্তিতে ফসল নির্ণয় করতে হবে, আধুনিকতম প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্ষুদ্র সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে জলের ব্যবহার কমাতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বিন্দু সেচ ব্যবস্থা (drip irrigation)। ২০১৮ সালের ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট (UNO র একটি সংস্থা) আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির পাশাপাশি প্রাকৃতিক ও দেশীয় পদ্ধতির ওপর জোর দিয়েছে।
শিল্প, বিদ্যুৎ প্রকল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে জলের পরিকল্পিত ব্যবহার এবং ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে জলের শুদ্ধিকরণ এবং পুনর্ব্যবহার প্রযুক্তি উপর জোর দিতে হবে
তৃতীয়ত, ভূগর্ভের জল ভান্ডার স্থানিক জলের উৎস নয় এটি সামগ্রিক। তাই সামাজিক বা গোষ্ঠীগত অংশগ্রহণ আবশ্যিক। যার নাম পার্টিসিপেটরি গ্রাউন্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট।
চতুর্থত, উন্নয়নের নামে ধারাবাহিক অরণ্য নিধন বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে অঞ্চলের উপযোগী এবং মাটির গুণগত অবস্থার ভিত্তিতে নতুন নতুন বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যায় অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
পঞ্চমত, জলবিভাজিকা গুলিকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলা এবং জলের উৎস গুলিকে রক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে অববাহিকা এবং জল সঞ্চয়কারী সংস্থানগুলির সংস্কার এবং পুনর্গঠন বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।
ষষ্ঠত, জল সহ সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদকে কর্পোরেট হাঙরদের হাত থেকে রক্ষা করার পদ নির্ণয় এবং প্রয়োগে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে।
সুতরাং মুক্তির পথ এখনও সাধ্যের মধ্যেই আছে। দরকার সরকারি জড়তা ও অনীহা দূর করা। তার জন্য সর্বস্তরের মানুষকে সমবেতভাবে উদ্যোগী হতে হবে। যে প্রক্রিয়া কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে তাকে করতে হবে সার্বিক। তবে শুরু করতে যেন দেরি না হয়, তাহলে সত্যি সত্যিই সমাধান হাতের বাইরে চলে যাবে।
সহায়তা: Monthly Review(MR), Economic & Political Weekly(EPW) সহ একাধিক পত্র-পত্রিকা এবং আন্তর্জাল।
অনুপ গাঙ্গুলি : পরিবেশ কর্মী