রঙিন পথের পাঁচালী প্রসঙ্গে কিছু ভাবনা

শিমূল সেন
জনৈক বিচক্ষণ প্রযুক্তিপটু বাঙালির চমৎকার উদ্ভাবন– আইকনিক পথের পাঁচালী-র আইকনিক দৃশ্যগুলিকে তিনি সাদাকালো জাড্য থেকে মুক্তি দিয়েছেন ও রাঙিয়ে তুলেছেন বর্ণিল কালার ইমেজে৷ স্বভাবতই, ফেসবুকীয় বাহবার অন্ত নেই, প্রযুক্তিপ্রসূত মহাবিস্ময়কর ম্যাজিক বাঙালি মহলে হাতফেরতা হয়ে অনলাইনে ছড়াচ্ছে ক্রমশ। বেচারির জন্য কষ্ট হচ্ছে, কেন না ‘আধুনিকীকরণের’ স্বার্থে তাঁর প্রথমত টাইটেল কার্ডে সিনেমার নাম পাল্টানো উচিত ছিল, আমি খালি এটুকুই ভাবছি– পাঁচালির মত ব্যাকডেটেড, ‘মধ্যযুগীয়’, শ্লথ একটি ফর্মের নামই বা কেন অক্ষত থাকবে– প্রয়োজনে ওটিকেও পাল্টে ‘আধুনিক’ ব্যালাড, রক বা ব্লুজের আওতায় নিয়ে এলে খাটনি কম পড়ত কারিগরের।
এহ বাহ্য। সিনেমা সম্পর্কে নির্বোধ ও আকাট আমি সাদাকালো ছবির মায়াটান ও নান্দনিকতা সম্পর্কে এই লেখায় একটি কথাও বলব না। বরঞ্চ, এই ভেবেই কিঞ্চিৎ স্বস্তি পাচ্ছি যে পূর্বপুরুষদের প্রবাদপ্রতিম কীর্তিগুলি ধ্বংস করা দুর্ভাগা জনসমষ্টির নৈমিত্তিক অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে– শুধু সিনেমায় নয়, সর্বত্রই। এই অ্যাচিভমেন্ট গৌরীশৃঙ্গে পৌঁছেছে, বিশেষত, কলকাতার পুরোনো স্থাপত্যগুলির ক্ষেত্রে। কলকাতার অসামান্য-নির্বিকল্প ঘুলঘুলি, কার্নিশ, লাল মেঝে, খোলা ছাদ, কড়িবরগা, হাতলওলা জানলা-সমৃদ্ধ বাড়িগুলো একদা ছিল আমাদের দেশের নিজস্ব আধুনিকতার একান্ত ইজারাদার। তার অধিকাংশটাই উত্তরপুরুষের পাল্লায় পড়ে বিধ্বস্ত, এবং কালান্তরে প্রোমোটার তার গর্দান নিয়ে তাকে যথাসাধ্য পর্যবসিত করেছে পালিশ-করা ঝাঁ-চকচকে উত্তর-আধুনিকতায়। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মত জরুরি আর্কিটেকচারের মেঝের প্যাটার্ন ভ্যানিশ হয়ে গেছে গণতান্ত্রিক সরকারের পর্যটন দফতরের হাঙরসুলভ লোলুপতার সামনে– আধুনিকীকরণের নামে তার সর্বাঙ্গে চড়েছে কাফে-রেস্তোরাঁর বৈধতাজ্ঞাপক জোব্বা। আবার পর্যটন নিয়ে এত মাতামাতি– কলকাতার প্রধানতম আইকনিক পরিবহণ, ট্রাম, সরকারি ঔদাসীন্যের ধাক্কায় কার্যত গঙ্গাপ্রাপ্তির অপেক্ষায়। সরকারের কথা তো দূর কি বাত, যে বাঙালি মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজের রুচি নিয়ে অহোরাত্র মোরা মুচ্ছো যাচ্ছি– সে তার বৃহত্তম সাংস্কৃতিক বিজ্ঞাপন রবীন্দ্রসংগীতকে যথাসম্ভব ‘আপডেটেড’, অধুনাশ্লিষ্ট সাম্প্রতিকতায় ভরিয়ে তুলতে চায়– গ্লোবায়ন-প্রসূত অ্যানাক্রনিস্টিক মিউজিকাল স্কেপ খাড়া করে রবীন্দ্রনাথকে আরও কেতাদুরস্ত, সুলভশ্রবণ হিসেবে ছয়লাপ করে তোলে। তার বাজার আছে, রয়েছে নির্দিষ্ট শ্রোতাগোষ্ঠীও– আধুনিক সংবেদনের পরিপাক এই একুশ-শতকীয় রবীন্দ্রগানকে দিব্য গিলে নেয়!
হেরিটেজ সম্পর্কে নিদারুণ শৈথিল্য ও নির্মম অবজ্ঞার মোদ্দায় রয়েছে, প্রথমত, ‘আধুনিকীকরণে’র ব্যাপক খিদে, ও দিকে উপভোক্তার বানানো চাহিদা– যে চায় তার নিজের চোখে দুনিয়াটা দেখতে। তার জন্য যতটা পাচ্য, যতটা সরল, যতটা আবিল করে দেওয়া যায় আর কী– দেখতেও খাটুনি লাগে না, রস নিতেও শ্রম ও প্রশিক্ষণের দরকার থাকে না, প্রযুক্তির অনবদ্য খুড়োর কলটি বাগানোই যথেষ্ট। দুই, বাঙালি সম্ভবত তার শিল্পবস্তুগুলির সাংস্কৃতিক প্রতিমান তৈরি করতে নারাজ। শিল্প ও নন্দনে যা দিব্য উচ্চমার্গ, বাঙালি তার জন্য কোনও পণ্যদর খাড়া করতে নারাজ। সোজা কথা: বাজারে তার জন্য কোনও প্রতীকী মূল্য হাঁকানো হয় নি, পণ্যরতির ছটায় ও দিকে বাঙালি দিবারাত্র উদগার তুলছে কিন্তু এ দিকে তার প্রদত্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলির কোনও রসিক নেই, খদ্দেরও নেই স্বভাবতই– ভোক্তার দুনিয়ায় রেস্ত ও রুচি চিরাচরিত সম্পূরক!
এটা লিখতে গিয়েই মনে হল: হেরিটেজের বোধ আসে ইনহেরিটেন্সের ধারণা থেকে– কাজেই, ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার, নেহাত শব্দমূলের সাদৃশ্যেও, পুরোদস্তুর মিলমিশ। প্রযুক্তিবিজ্ঞ ই-কারিগরের হাতে একুশ শতকে বর্তেছে বিভূতিভূষণ ও সত্যজিতের সাংস্কৃতিক ওয়ারিশ– ফল অপ্রত্যাশিত নয়। ঐতিহ্যময় সাংস্কৃতিক কীর্তিগুলিকে ধূলিসাৎ করা তালিবান বা আইসিসের একচেটিয়া– মিডিয়া-বাহিত সেই সব বিভীষিকা স্মরণে এনেই এই কালাপাহাড়ি কারিগরবৃন্দকে, এক বার মনে হল, ডাকি ‘শিল্প-তালিবান’ বলে।
তাপ্পর চিমটি কেটে মালুম হল, বাঙালি মধ্যবিত্তই বা নিজের ক্ষমতায় কম কী! সমস্যাটা আসলে শ্রেণিগত বা জাতিগত পরিচয়ের নয়– সমস্যাটা, এক দিক থেকে ভাবলে, মনে হয়, আধুনিক মানুষের। আধুনিক মানুষ প্রগতির স্কেলে বিশ্বাস করতে শেখে, সে ধরে নেয়, চল্লিশ বছর আগের প্রযুক্তি ও শিল্প-উৎপাদনের মাপকাঠিগুলি আজকের তুলনায় ‘অনুন্নত’, অতএব, তারও উন্নততর বিকল্প সম্ভব। সে কদাপি ভাবে না, ভালতর প্রযুক্তির খরিদ যথাযথ পয়সা ফেললেই সম্ভব– ধনতন্ত্রের ফাঁকিটি তার ঠুলিতে সেঁধোয় না। সে ভাবে না, সাদাকালো ছবি বানানোটা শিল্পীর চয়েসও হতে পারে– কৃতঘ্ন ও স্পর্ধিত সে মনে করে নেয়, উহা সে’ কালের দীনহীন পরিচালকের অক্ষমতা। আধুনিকের তরফ অতএব শ্রেয় বিকল্প: পরিকাঠামোকে যথাসম্ভব সাম্প্রতিক রেখে দিতে হবে– মালমশলা যা-ই হোক না কেন, প্রগতির এই সরল সূত্রই এক মাত্র বাঞ্ছিত শিল্পকাজ পয়দা করতে পারে৷ আর, সিনেমার মত প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পে তো সমস্যাটা আরও বেশি– কাজেই ‘অনুন্নত’র দেহে চড়াতে হবে ‘উন্নত’ প্রগতির পরত, যাতে সে আরও দর্শনীয়, আরও ঈপ্সীত, এবং, পণ্যরতির বুভুক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সংবেদন সরবরাহ করতে পারে।
তালিবানদের সঙ্গে আধুনিকের এই অ্যাটিটিউডের ফারাকটাই বা কী? তালিবান মনে করে: যা কিছু ভাল, সব ওই ঐতিহাসিক ‘সঠিক’ পরম মিথ-মুহূর্তটির অবদান মাত্র– তার পরের যা-যা সৃষ্টি, সবই কাঙ্ক্ষিত ইতিহাসের বিচ্যুতি, তার মিথ্যে প্রতিরূপ, কাজেই এই পরের ইতিহাসকে মুছে ফেলতে হবে, পুনরুদ্ধার করতে হবে সেই সত্যি-ইতিহাসকে। আর আধুনিক? পথের পাঁচালী দেখতে নেমে তার কৌতূহল হয়, এখনকার বীক্ষণে চেহারাটা ঠিক কেমন দাঁড়াত তার, মনে হয়, এ’ কালের ভাষায়, প্রগতি ও যথাযথ কারিগরি উন্নতির ভাষায় অনুবাদ করে ফেলতে হবে তাকে– তা হলেই দর্শকের সংবেদন মথিত করে পথের পাঁচালী হয়ে উঠবে আরও উপভোগ্য, শানদার, উৎকৃষ্টতর– সেই স্বার্থে ছেঁটে দিতে হবে যাবতীয় ইতিহাস ও কালসঙ্গতি। তার মনে হয়, অধুনার মুহূর্তটিই স্বর্ণদীপ্ত সেই পরম মুহূর্ত– এর আওতায় শিল্পকে আনা গেলেই তা প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়তে বাধ্য। মধ্যিখানে, সে’ কালের সাদাকালো মায়া ও আর্তির কোলাজ এ’ কালের মাঝমাঠে মারা যায়, জন্ম নেয় অক্ষম ও পঙ্গু শিল্পকাজ৷ তালিবান খারাপ, কেন-না সে বিশ্বাস করে দার-উল-ইসলামের লুপ্ত সময়টিতে, তার বাইরে সকলই হারাম। সভ্য-সাংস্কৃতিক আধুনিক, যে কি-না বিশ্বাস করে প্রগতি-প্রসূত অধুনার, সাম্প্রতিকতার নির্বিকল্প শ্রেষ্ঠত্বে– তার হতকুচ্ছিত ও বর্বর কালাপাহাড়পনাটিই বা ছাড় পাবে কোন যুক্তিতে?
অতএব চিরকালীন পথের পাঁচালী অধুনার খপ্পরে পড়ে– কালারঅপু আর কালারদুর্গার মিতালিতে। সাদাটে মেঘ ও কাশফুল, ফ্যাটফেটে নীল শরৎকালের আকাশ– দ্যাখ দিদি, ঘরঘরে সাদাকালো রেলগাড়ির মাথায় ভসভসে ছাইরঙ উঠেছে!
শিমূল সেন : যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এমফিল ছাত্র
