উন্নয়নের কয়লা খনি ও প্রাণ প্রকৃতি ধ্বংস-এক ছাত্রের চোখে।

কৌস্তভ বসু
উন্নয়ন মানে আসলে কী?
উন্নয়ন এর মানে যদি হয় শিল্পের নামে খনি বা বড় বাঁধ তৈরি করে আদিবাসী, সংখ্যালঘু এবং স্থানীয় সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা থেকে উচ্ছেদ করা আর পরিবেশ দূষণ বাড়ানো বা জলবায়ু পরিবর্তনকে আরো দুর্বিষহ করা, তবে সেই উন্নয়ন আমরা চাই না। আর বস্তিবাসী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করে, জলাভূমি বুজিয়ে শহরে বড় বড় বহুতল , শপিংমল নির্মাণ বা গাছ কেটে, নয়নজুলি বুঝিয়ে রাস্তা চওড়া, ফ্লাইওভার তৈরি যদি উন্নয়নের সংজ্ঞা হয়, তবে প্রকৃতি ও মানব বিরোধী সেই উন্নয়নেরও আমরা বিরোধী। তথাকথিত এই উন্নয়নের থেকে আসলে লাভবান হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলির ছত্রছায়ায় থাকা নেতা-বাবু-ঠিকাদার-মাফিয়া ও পুঁজিপতি তথা কর্পোরেট কোম্পানিগুলি।
দেউচা-পাচামির বিপর্যয় কোন পথে:
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে– দেউচা পাচামি প্রকল্প হলে একুশ হাজারের বেশি মানুষ উচ্ছেদ হবেন, যার মধ্যে অধিকাংশই আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ। প্রায় ৪৩২০ টির ওপর বাড়ি ভাঙ্গা পড়বে। ওই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ধর্মাচরণ শহুরে মধ্যবিত্ত মানুষের মতন নয়। ফলত ধ্বংস হবে তাদের লোকায়ত জীবনের অন্যতম অংশ মাঝি থান ও জোহার থান। ধ্বংস হবে ওই অঞ্চলে অবস্থিত মাবেলিয়া রিজাভ ফরেস্ট।
ইতিমধ্যেই বীরভূমের এই অঞ্চল পাথর খাদানের দূষণে দূষিত। পাথর খাদান স্থানীয় জনজাতি মানুষের জীবনে কোন আর্থিক উন্নতি ঘটায়নি। উপরন্তু ক্ষতি করেছে তাদের চাষাবাস, তাদের সংস্কৃতি-কৃষ্টি। পাথর খাদানের শ্রমিকরা সিলিকোসিসের মত মারণ রোগে আক্রান্ত।
পরিবেশ আইন কেন মানা হলো না:
চালু থাকা পরিবেশ আইন, কয়লাখনি আইন, নতুন খনির জন্য এলাকার পরিবেশ জরিপ বা এই খনির কারণে উদ্ভূত পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাবের মূল্যায়ন এখনো পর্যন্ত দেউচা-পাচামিতে মানা বা সর্বসমক্ষে আনা হয়নি। খনন-উত্তর জমি, জলের মান উন্নয়ন, বায়ুর মান উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মৃত্তিকার উপরিভাগ বিষয়ক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সংক্রান্ত নির্দেশিকা পালন করা হয়নি। বর্জ্য ও ধুলোর ফলে রাস্তার ওপর ২-৪ ইঞ্চি ধুলোর আস্তরণ। ক্ষতি করে চলেছে মানুষের শরীর আর প্রকৃতিকে। এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা ব্লক থেকে কয়লা উত্তোলনে রাজ্য সরকার ঠান্ডা-গরমে যেনতেন প্রকারে তা করতে সচেষ্ট। কারণ, আজকের সমাজের মূলমন্ত্র হলো উন্নয়ন! কিন্তু সেই উন্নয়ন কীসের জন্য-কাদের স্বার্থে এবং কীসের বিনিময়ে সেইসব ভাবার ফুরসৎ নেই প্রকল্পের হর্তা-কর্তাদের।
কেন্দ্রীয় সরকারের এই প্রকল্পে প্রথমে ইস্টার্ন কোলফিল্ডকে কয়লা উত্তোলনের দায়িত্ব দেওয়া হলেও প্রকল্প লাভজনক নয় বলে তারা কোনো উদ্যোগ নেয় না। এরপর বিহার, ঝাড়খন্ড সহ ছয়টি রাজ্য প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে, ২০১৮ সালে পশ্চিমবাংলার সরকার এই দায়িত্ব WBPDCL কে দিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, ২০১১-সালের ৯ মার্চ সংসদে সাংসদ প্রশান্ত কুমার মজুমদার ও নীপেন্দ্রনাথ রায়ের প্রশ্নের উত্তরে তৎকালীন কয়লা দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন– এই প্রকল্প লাভজনক নয় বলে কোল ইন্ডিয়া এতে থাকবে না।
যেভাবে কয়লা উত্তোলন হবে:
এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ডেউচা-পাচামিতে কয়লা স্তর রয়েছে ব্যাসল্ট পাথর স্তরের অনেক নিচে। ২২৫ থেকে ২৪৫ মিটার পুরু পাথর কেটে এবং তা তুলে ফেলে তার নিচ থেকে কয়লা উত্তোলনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যা বিপুল ব্যায় সাপেক্ষ। ব্যাসল্ট শিলার ঠিক ওপরে রয়েছে টপ সয়েল, যাকে আমরা মাটি বলি। ব্যাসল্ট পাথরের নিচে চারটি স্তরে কয়লা আছে, আর কয়লা স্তরগুলির মধ্যে মধ্যে আছে পাথরের স্তর।
একটা অংশ থেকে প্রচার করা হচ্ছে– দেউচা-পাচামিতে কয়লা খনি তৈরি হলে এই রাজ্যে নাকি শিল্পের বান আসবে, কর্মসংস্থানের বন্যা বইবে। তাদের কাছে আমাদের বিনীত প্রশ্ন– এই শিল্প কি সত্যি সত্যি স্থানীয় মানুষের স্বার্থে, নাকি পুঁজিপতি ও কর্পোরেট কোম্পানিগুলির স্বার্থে? আসল উদ্দেশ্য জমির ‘টপ সয়েল’ নষ্ট করে ব্যাসল্ট পাথরের ব্যবসা করা। যার ফলে আদিবাসী জনজাতির মানুষ উচ্ছেদ হবেন, স্থানীয় মানুষ জীবিকা হারাবেন, পরিবেশ ধ্বংস হবে, অন্যদিকে চলবে লুটের ভাগ বাটোয়ারা।
দেউচা-পাচামিতে কয়লা উত্তোলন হবে মূলত খোলামুখ কয়লাখনির মাধ্যমে। এ ধরনের উত্তোলন মূলত যন্ত্রনির্ভর এবং যাতে দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন। সুতরাং প্রকল্পের রূপকাররা স্থানীয় বাসিন্দাদের এই কাজে নিয়োগ করবে না বলেই প্রাথমিক ধারণা। সুতরাং স্থানীয় বাসিন্দাদের এই শিল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই বললেই চলে।
ফলে খোলামুখ কয়লা খনির যে গল্প বলা হচ্ছে তা এককথায় অবাস্তব। সস্তায় বিদ্যুৎ দেওয়াটা আসলে ভাঁওতাবাজি। বিদ্যুৎ নিগমের খনিগুলির হাতে আগামী ৩০ বছরের জন্য পর্যাপ্ত কয়লা আছে। ব্যাসল্ট এর জন্য ‘বোরহোল ড্রিল’ খুবই ব্যয়বহুল। তাছাড়া এই ধরনের ব্লাস্টিং এর ফলে এলাকায় বারুদের মাত্রা, শব্দ, বাতাসে কয়লার গুঁড়ো ও বিষাক্ত গ্যাস সবটাই মাত্রাহীনভাবে বাড়বে। ফলে আশেপাশের প্রকৃতি পরিবেশ এবং ওখানকার মানুষদের শারীরিক অবস্থা কি হবে তা সহজেই অনুমেয়। বলাই বাহুল্য, খনি থেকে উড়ে আসা গুঁড়ো কয়লা ও নানান বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে মিশে যাওয়ায় শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি সহ ফুসফুসের নানান রোগে প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হবেন। সাথে সাথে ভূগর্ভস্থ জলস্তর আরো নীচে নামবে, বাড়বে জলের দূষণ ও সংকট, তা আর বলার অপেক্ষা করে না।
কয়লাখনি ও দূষণ-এক অবিচ্ছেদ্য গ্রন্থি:
খোলামুখ কয়লাখনির অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। পশ্চিম বর্ধমান জেলার পাণ্ডবেশ্বর ব্লকের ও সোনপুর বাজারি খোলামুখ কয়লাখনির ওপর ২০১৫ সালের এক সমীক্ষায় জানা গেছে যে, ঐ অঞ্চলে বাতাসে ২.৫ মাইক্রন ব্যাসার্ধের এসপিএম (suspended particulate matter)’ এর মাত্রা ২৬৭.৪ এবং ১০ মাইক্রন ব্যাসার্ধের মাত্রা ২৭৪.৯, যা নির্ধারিত মাত্রার তুলনায় অনেকটাই বেশি।
দেউচা-পাচামি অঞ্চলের খোলামুখ কয়লাখনি তৈরি হলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে বীরভূমের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সৃষ্টি হওয়া টপ সয়েল চিরতরে নষ্ট হয়ে বর্জ্য পাহাড়ে পরিণত হবে। মরুভূমি সাদৃশ্য এলাকায় পরিণত হবে। জমির উর্বরতা ধ্বংস হবে। খোলামুখ কয়লাখনি হওয়ার ফলে কয়েকশো মিটার নিচের মাটির উপরে চলে আসবে, আর উপরের মাটি নিচে চলে যাবে। ফলে এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ চাষ জমি উর্বরতা হারিয়ে বন্ধা হয়ে যাবে। এলাকা জুড়ে ভূমিধ্বসের ঘটনা বাড়বে। শুধু তাই নয়, এই বিশাল মাপের কয়লাখনির ফলে স্থলজ ও জলজ জীব বৈচিত্র এবং এলাকার তামাম বাস্তুতন্ত্রের ভয়ানক ক্ষতি হবে। আর বর্ষার সময় মাটির স্তূপ ধুয়ে গিয়ে ওই অঞ্চলের নদ-নদীর তলদেশে জমা হবে, ডেকে আনবে অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যা। জমে থাকা বিপুলাকার মাটির স্তূপ ভূগর্ভস্থ জল প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটিয়ে শুধু ওই এলাকার নয়, এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষিজ-বনজ উৎপাদন ও নদী পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করবে। এলাকার প্রাকৃতিক ভূ-গর্ভস্থ জলের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। খোলামুখ কয়লা খনি থেকে দূরবর্তী অঞ্চলের কুয়ো, টিউবলের জল শুকিয়ে যাবে। প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক জলস্তরের পরিবর্তন ঘটবে। যা বর্তমানে জামুরিয়া, আসানসোল, রানীগঞ্জ প্রভৃতি কয়লাখনি অঞ্চলে প্রকট রূপ ধারণ করেছে।
বাস্তব চিত্রটা ঠিক কেমন:
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ জীবাশ্ম জ্বালানি, যা বিশ্ব উষ্ণায়নের অন্যতম কারণ। শিল্প বিপ্লবের আগে থেকেই কার্বন নিঃসরণের ৮০% উৎস হল কয়লা, পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস। এর ফলে নির্গত গ্যাস পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরে ছিদ্র তৈরি করে, যার ফলে ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি বায়ুমন্ডলের প্রবেশ করে একদিকে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে এর ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে অতি দ্রুত হারে। IPPC
(Intergovernmental Panel on Climate Change)-এর ষষ্ঠ রিপোর্ট অনুসারে আশঙ্কা করা হচ্ছে– সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধির কারণে
২০৩০ সালের মধ্যে সুন্দরবন, কলকাতা, খিদিরপুরের মতন অঞ্চল জলের তলায় তলিয়ে যাবে। এই তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ভারতের উপকূলীয় ১২টি শহর।
২০২১ সালের শেষের দিকে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত ‘COP-26’ বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে দাবি উঠেছে– জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে যত দ্রুত সম্ভব তা শূন্যের ঘরে নামিয়ে আনতে হবে। সারা বিশ্বে আওয়াজ উঠছে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাবহারের বিরুদ্ধে। এই রাজ্যে বর্তমানে বিদ্যুতের ঘাটতি নেই, অনেক ক্ষেত্রে রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে এমনকি প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশেও বিদ্যুৎ রপ্তানি করা হয়। আগামী ৩০ বছরের জন্য পর্যাপ্ত কয়লা মজুদ থাকা সত্ত্বেও নতুন করে কয়লাখনি কাদের স্বার্থে এবং কিসের বিনিময়ে –এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা খুব জরুরী। বুঝে নেওয়া জরুরী – এতো এতো শক্তির উৎপাদন ও ব্যবহার কাদের স্বার্থে, সকল মানুষের নূন্যতম প্রয়োজন মেটাতে এবং সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এতো এতো বিদ্যুতের কী আদৌ কোন দরকার আছে কিনা।
আমরা ছোটরা যতটুকু ভাবতে পারছি:
কয়লা উত্তোলন সম্পর্কিত যাবতীয় কাজকর্ম যথা খনন, উত্তোলন, ধৌতকরণ থেকে পরিবহন শিল্পে ও কারখানায় এর ব্যাপক ব্যবহার সবই বায়ুমন্ডলে কার্বন-দূষণ বৃদ্ধি করে। আসলে দেউচা-পাচামি কয়লা খনি একটি ধোঁকাবাজি শিল্প। কিছু অংশের মানুষ সরকারের সাথে কথা বলে সমঝোতায় আসতে চাইলেও অধিকাংশ স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ই জনজীবন বিঘ্নকারী ও প্রকৃতি পরিবেশ ধ্বংসকারী এই কয়লাখনির বিরুদ্ধে। তাঁরা সোচ্চারে জানিয়েছেন– যতদিন না কয়লাখনি সম্পূর্ণ বন্ধ হচ্ছে, ততদিন তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। দেউচা-পাচামি সহ এই ধরণের সমস্ত কয়লাখনি বন্ধের দাবিতে স্থানীয় জনজাতি মানুষের আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে আসুন –ছাত্রযুব, বিজ্ঞানকর্মী, পরিবেশ কর্মী, অধিকার আন্দোলনের কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী সহ সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ। আমাদের জন্য একটা সুস্থ সুন্দর নির্মল বিষহীন পৃথিবী রেখে যেতে এটাই আপনাদের মতো বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ দের প্রধান ও প্রথম দায়িত্ব কর্তব্য বলেই আমরা মনে করি।
লেখক : প্রথম বর্ষের ছাত্র, বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলননের কর্মী।
