হুল দিবসের অঙ্গীকার

মলয় তেওয়ারি
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, চুয়াড় বিদ্রোহ, ফরিদপুরের দিদুমীর, চিটাগাঙের চাকমা বিদ্রোহ, কোল ও ভূমিজ সহ অসংখ্য বিদ্রোহের পথ বেয়ে এসেছিল ১৮৫৫’র হুল বা সাঁওতাল বিদ্রোহ যা এক তীব্র সশস্ত্র গণসংগ্রামের রূপ নিয়েছিল। হুল বিদ্রোহ সাঁওতাল সমাজকে বিপ্লবী জাতীয়তাবাদে ঐক্যবদ্ধ করে এবং অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠিকে উজ্জীবিত করে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই চালানোর যে দৃষ্টান্ত ও সম্ভাবনা হুলের মধ্যে দিয়ে সাঁওতাল জাতি সামনে এনেছিল তা সমগ্র ভারতে স্বাধীনতার আকাঙ্খাকে জাগিয়ে তুলেছিল। হুল স্তিমিত হতে না হতেই ১৮৫৭’র মহাবিদ্রোহের দাবানল জ্বলে উঠেছিল। মহাবিদ্রোহের পরেও প্রথম গণবিদ্রোহ ছিল বিরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে উলগুলান। পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলন বা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রতিটি আহ্বানে আদিবাসী সমাজের মানুষ সোৎসাহে অংশ নিয়েছে। স্বাধীন ভারতেও নিপীড়িত গ্রামীণ শ্রমজীবী কৃষকের সকল অভ্যুত্থানে আদিবাসী মানুষেরা লড়েছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন।
এখন আমরা স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপন করছি। ঔপনিবেশিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন অংশের দীর্ঘ বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের এক সম্মিলিত ফসল হিসেবে আমরা আমাদের স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু আমাদের শাসক দলগুলি স্বাধীনতা সংগ্রামে কৃষক, শ্রমিক, দলিত ও আদিবাসীদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে বরাবর ব্যাঙ্গবিদ্রুপ করে এসেছে। স্বাধীনতা অর্জনের এই ৭৫ তম বছরে প্রথম কোনও আদিবাসীর নাম রাষ্ট্রপতি পদের জন্য সামনে এল, কিন্তু তা এল এমন এক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় যারা এরকম প্রতিটি প্রতীকী পদক্ষেপকে ব্যবহার করে সেই জনগোষ্ঠির ওপর তাদের নীতিগত হামলাগুলিকে আড়াল করতে। বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর আদিবাসীদের প্রতিটি অধিকারের ওপর একের পর এক অভূতপূর্ব আক্রমণ নেমেছে। সংবিধানে প্রতিশ্রুত স্বায়ত্ত্ব শাসন, জমি মালিকানার রক্ষাকবচ, ধর্ম পরিচিতির স্বাতন্ত্র্য, ভাষা সংস্কৃতির সুরক্ষা, শিক্ষা ও চাকরির সংরক্ষণ, জাতবিদ্বেষী নিপীড়ন নিবারণের আইন, অরণ্যভূমি ও অরণ্যের সম্পদের ওপর অধিকার —স্বাধীনতার আগে ও পরে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যা যা অর্জিত হয়েছিল তার সবকিছুই বিজেপি-আরএসএসের শাসনে চরম বিপন্ন।
১৭৭৪-৭৯ সালে বস্তারের হালবা বিদ্রোহ, ১৮৫৫’র হুল, ১৯০০’র উলগুলান— এই সমস্ত বিদ্রোহগুলি ভারতে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম ভিত্তি তৈরি করেছিল। একই সাথে এই সংগ্রামগুলির মৌলিক লক্ষ্য ও কর্মসূচী ছিল নিজ নিজ এলাকার স্বাধীনতা ও স্বায়ত্ততা। হালবা বিদ্রোহ মারাঠা ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শেকল ভেঙ্গে স্বাধীন বস্তার রাজ্য গঠন করতে চেয়েছিল। হুল ছিল ব্রিটিশ ও তার দালাল দিকুদের কোম্পানিরাজ উৎখাত করে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠার লড়াই। উলগুলানে বিরসা মুণ্ডা সূত্রবদ্ধ শ্লোগানে তুলে ধরেছিলেন সেই একই দিশা, “আবোয়া দিশম, আবোয়া রাজ”, আমাদের দেশে আমাদের শাসন। ব্রিটিশ শাসকেরা সাঁওতাল পরগণা ও ছোটনাগপুরে আদিবাসীদের জমি ও প্রথাগত সমাজ-শাসন কাঠামোকে সুরক্ষা দেওয়ার আইন আনতে বাধ্য হয়েছিল। স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার সময় সংবিধানসভার অন্যতম সদস্য জয়পাল সিং মুণ্ডা দেশের মধ্যে সম্পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসিত আদিবাসী অঞ্চলের স্বীকৃতির লক্ষ্যে তীব্র বিতর্ক চালিয়েছিলেন। তার ফলশ্রুতিতে আদিবাসীদের জন্য বিভিন্ন স্তরের স্বায়ত্তশাসনের অঙ্গীকার ও অধিকার সংবিধানে গৃহীত হয়। কিন্তু বাস্তবে সেই অঙ্গীকারের খুব সামান্যই পালিত হয়েছে। বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠিকে কার্যত অস্বীকার করা হয়েছে এবং যতটা সম্ভব অদৃশ্য করে রাখা হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয় রাজ্য পুনর্গঠন প্রক্রিয়া। ভারতে রাজ্যগুলি প্রথমে গঠিত হয়েছিল ঔপনিবেশিক রাজনীতির প্রয়োজন অনুযায়ি। স্বাধীনতার পর তীব্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগুলির পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ভাষিক সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে ভারতীয় ইউনিয়নের আওতায় বিভিন্ন জাতিগুলি মাথা তোলে। কিন্তু আদিবাসী জনগোষ্ঠিগুলিকে অত্যন্ত সন্তর্পণে এই জাতি গঠনের প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। ভীল, গোন্দ, সাঁওতাল, মুণ্ডা সহ বড় বড় আদিবাসী ভাষাগোষ্ঠির বসবাসের অঞ্চলগুলিকে হয় একাধিক রাজ্যের মধ্যে ভাগ করে রাখা হয়েছে, নয়তো আধিপত্যকারী প্রাদেশিক ভাষাগোষ্ঠিগুলির দ্বারা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ভারতের সবচেয়ে বড় আদিবাসী ভীল জাতির বাসভূমিকে চারটি সংলগ্ন রাজ্যে বাঁটোয়ারা করে রাখা আছে, অথচ গত একশ বছরের বেশি সময় ধরে তাঁরা ভীল প্রদেশের দাবি করছেন। উত্তর পূর্ব ভারতে কার্বি আদিবাসীরা সংবিধানের ২৪৪(ক) ধারা অনুযায়ি স্বায়ত্তশাসনের জন্য দীর্ঘকাল লড়ছেন।
দেশের আদিবাসী জনবহুল এলাকাগুলির খুবই সামান্য অংশ এখন পর্যন্ত পঞ্চম তপশিলভুক্ত হয়ে সংবিধান প্রতিশ্রুত স্বায়ত্ত পঞ্চায়েত পেয়েছে। যেখানে তা পেয়েছে সেখানেও গ্রামসভার সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে আদিবাসীদের উৎখাত করা হচ্ছে কর্পোরেটদের স্বার্থে। বহু পথ পেরিয়ে ২০০৬ সালে আদিবাসীদের জন্য যে অরণ্যের অধিকার আইন স্বীকৃত হয়েছিল তা বাস্তবে খুব অল্প ক্ষেত্রেই কার্যকর হয়েছে এবং বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর আদালতের মামলা আর সরকারি নির্দেশিকায় এই আইনটি বহুলাংশে অকেজো হয়ে গেছে। বিজেপি-আরএসএস আদিবাসীদের আদিবাসী পরিচয়কেই কোনওদিন স্বীকৃতি দেয়নি। ওরা বলে ‘বনবাসী’। ওরা সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে তুলে দিতে চায় এবং আদিবাসীদের স্বতন্ত্র ধর্ম-পরিচয়কে নাকচ করে ‘হিন্দু’ হিসেবে ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থায় এনে সামাজিকভাবেও পদানত রাখতে চায়।
১৬৭ বছর আগের হুলের মূল লড়াইটা এখনও জারি আছে। কোম্পানিরাজ হঠিয়ে স্বায়ত্তশাসন কায়েম করাই ছিল হুলের মূল কথা। ভারতীয় ইউনিয়নে ভারতের আদিবাসীদের পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন ও সাংবিধানিক অধিকারগুলি কায়েম করা, কর্পোরেট গ্রাস থেকে আমাদের জমি, অরণ্য, নদী, পাহাড়কে রক্ষা করা এবং হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের হাত থেকে ভারতের গণতন্ত্র, সংবিধান ও সমাজকে বাঁচানো—আজকের সময়ে এটাই হুল মাহার অঙ্গীকার।
মলয় তেওয়ারি : প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক কর্মী।
