• May 30, 2023

মুর্শিদাবাদের আম চর্চা দ্বিতীয় পর্ব

 মুর্শিদাবাদের আম চর্চা দ্বিতীয় পর্ব

নবাবী আমলে নিজামতের বিশেষজ্ঞরা বলতেন,-সেরা আমের পাঁচটি গুন থাকা দরকার। সেই আমের ছিলকা পাতলা ও গুলটি ছোট হবে, অর্থাৎ খোসা পাতলা হবে আর আঁটি হবে ছোট।

সুশান্ত বিশ্বাস :- নবাবী আমলে নিজামতের বিশেষজ্ঞরা বলতেন,-সেরা আমের পাঁচটি গুন থাকা দরকার। সেই আমের ছিলকা পাতলা ও গুলটি ছোট হবে, অর্থাৎ খোসা পাতলা হবে আর আঁটি হবে ছোট। তাছাড়া সেরা আম হবে শিরদার, মগজ মোলায়েম ও বেরেসা। তার মানে সেই আমের রস থাকবে প্রচুর ,আস থাকবে না এবং আঁটির উপরের খাবার অংশ হবে মোলায়েম।

বিরা লুপ্তপ্রায় আমের মধ্যে পরে বিরা আম। নবাবি আমলের এই আমের গাছ এখন খুব কম সংখ্যক আছে মুর্শিদাবাদে এবং গাছে ফল ধরেও কম। জেনে রাখা দরকার, লুপ্তপ্রায় আমগুলোকে এখন, অন্য অনামী আমকে সেই আমের নাম দিয়ে চালিয়ে দেবার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, কিছু আম বিক্রেতার মধ্যে।
বিরা আম একটু লম্বা ও গোল আকারের হয়। কাঁচাতে এই আম গাঢ় সবুজ রংয়ের হয়, পাকলে হালকা হলদেটে সঙ্গে সবুজের আভা থাকে। জৈষ্ঠ্য মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মাসের শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় এই আম। মাঝারি মিষ্টি স্বাদের এই আম বেশ রসালো, আস নেই, শাঁস খুব মোলায়েম, আটি বেশ সরু এবং হালকা সুগন্ধযুক্ত। বিরা আম বেশি না পাকিয়ে খাওয়াই ভালো, কারণ মোলায়েম শাঁস এর এই আম বেশি পেকে গেলে গলা ভাব চলে আসে, তাতে আমের আসল স্বাদ কিছুটা নষ্ট হয়ে যায়।

(৮)মোলামজাম একসময়ের মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক অশোক মিত্র নবাবী বাগানের আম খাওয়া নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিলেন। 19 49 সালে আমের মরশুমে নবাবজাদা কাজেম আলী মির্জার কাছে থেকে আম খাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে হাজারদুয়ারিতে গেলে, তাঁর বাগানের মোলামজাম আম খাওয়ানোর জন্য 36 ঘণ্টা তার সঙ্গে কাল যাপন করতে বলেছিলেন। কিন্তু কেন 36 ঘন্টা কাল যাপন করতে হবে, এই প্রশ্নের উত্তরে নবাবজাদা বলেছিলেন, মোলামজাম যে মুহূর্তে পাকবে, সেই মুহূর্তেই পেরে ফেলতে হবে, এবং সঙ্গে সঙ্গে তা খেতে পারলে তবেই মোলামজামের প্রকৃত স্বাদ ও ঘ্রাণ পাওয়া যাবে, তার দিনেই হোক বা মধ্যরাতেই হোক। নবাব বাগানে মোলামজাম আম দেখভালের জন্য নির্দিষ্ট মালি মজুত থাকতো। তারা অপেক্ষা করত কখন আম পাকবে সেই সময়ের জন্য। কিন্তু আম পাকতে কতক্ষণ সময় লাগবে তা তাদের জানা ছিল না বলেই 36 ঘন্টা অপেক্ষার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল।
বহরমপুর চুনাখালি নিমতলার নিকটবর্তী নিশাদবাগের দরগাপাড়ায় রয়েছে পীর মোসলেম শাহের মাজার। কথিত আছে তিনিই প্রথম মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত মোলামজাম আমের চারা বাইরে থেকে এনে রোপণ করেন। পরবর্তী সময়ে মোলামজাম আমের স্বাদে ও গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে নবাবরা ঠাঁই দেন তাদের বাগানে।
মুর্শিদাবাদের খুব পরিচিত নবাবি আমলের জনপ্রিয় আম মোলামজাম জৈষ্ঠ্য মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মাসের শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়। বাজারে বিভিন্ন ধরনের আমকে মোলামজাম বলে বিক্রি করা হয়। মাঝারি সাইজের এই আমের বোটার কাছে একটু নিচের দিকে বসা হয় এবং ভোটার নিচে উচু মত অংশ থাকে। পাকলে এই আম খুব সুন্দর গন্ধ ছড়ায় এবং ঘর গন্ধে ভরে যায়। হালকা মিষ্টি স্বাদের এই আম পাকলে খুব সুস্বাদু। যে সকল ব্যক্তি হালকা মিষ্টি খেতে ভালোবাসেন মোলামজাম আম তাদের পক্ষে উপযুক্ত।

(৯)আনারস আম বিলাসী নবাবরা যাতে সারাবছর আমের স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন সেই জন্য আম বিশেষজ্ঞরা আম সংরক্ষণ করে রাখতেন। সেই সময় তো কোনো আধুনিক প্রকরণ ছিলনা, কিন্তু নবাবদের ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন দেশীয় পদ্ধতিতে। আমের মরশুমে গাছ পাকা আম সাবধানে গাছ থেকে পেড়ে বোটায় গরম মোম (মৌচাকের মোম) লাগিয়ে সেই আম মধু অথবা গাওয়া ঘি এর মধ্যে রাখা হতো। জানা যায় সেই আম এক বছর পর্যন্ত সতেজ থাকতো। পরিবর্তন হতো না স্বাদ, গন্ধ ও রং এর। বছরের যেকোনো সময় সেই সংরক্ষিত আম পরিবেশন করা হতো নবাব ও আমন্ত্রিত অতিথিদের পাতে।
খুব জনপ্রিয় একটি আম আনারস, বাজারে অল্প দিনের জন্য পাওয়া যায় এই আম। মুর্শিদাবাদে এখন আনারস আম গাছের সংখ্যা কমে গেছে এবং আনারস আম গাছে ধরেও কম। যার জন্য আমপ্রেমী মানুষের কাছে আনারস আমের চাহিদা থেকেই যায়। আনারস আম দেখতে খুব সুন্দর, মাঝারি ও গোলাকৃতি আকারের এই আম পাকলে হালকা হলদেটে রংয়ের হয় এবং ভেতরের শাঁস এর রং হয় হালকা ঘিয়া কালারের এবং একেবারে মাঝের অংশ আবার আরেকটু গাঢ় ঘিয়া। আনারসের মতো হালকা গন্ধ আছে বলেই হয়তো এই আমের নাম হয়েছে আনারস। গাঢ় মিষ্টি রসাল ও সুস্বাদু আনারস আম একসময় নবাবদের যেমন মন মজিয়েছিলো এখনো আমরাও তার থেকে বঞ্চিত নই।

(১০) গোপাপ খাস : মীর জাফরের পুত্র মীরনের , আম বাগান তৈরীর উদ্যোগ ও ছিল প্রশংসনীয়। শুধু তাই নয় তিনি বাগান পরিচর্যা ও করাতেন নিয়মিত। মীরন তার সহচর গিরিজা শংকর সিংহ কে নিয়ে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন বাগানে আমের কলম চারা তৈরি করে কিংবা দেশ-বিদেশ থেকে নামি আমের চারা আমদানি করে সযত্নে লাগাতেন বাগানে। তার প্রচেষ্টায় চন্দন খোসা, হুজুর পছন্দ, মোলামজাম এইরকম শতাধিক প্রজাতির আমের জন্ম হয় মুর্শিদাবাদে।
মুর্শিদাবাদের খুব পরিচিত একটি আম গোলাপখাস। দর্শনে গোলাপখাস আম খুব সহজেই আম রসিকদের মন জয় করে নেয়। মাঝারি সাইজের এই আম যত পুষ্টু হতে থাকে বোটা থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত তত লাল গোলাপের মতো রং নিতে থাকে। মুর্শিদাবাদে প্রচুর আছে গোলাপখাস আমের গাছ, ফলন‌ও প্রচুর হয়। পুষ্টু গোলাপখাস আম গাছে ধরে থাকলে অপূর্ব সুন্দর লাগে দেখতে। মনে হয় প্রকৃতির ইজেলে শিল্পী যেন এঁকে রেখেছে লাল-সবুজের এমন চিত্র। দেখতে খুব সুন্দর এই আমে রস একটু কম থাকে কিন্তু খেতে মিষ্টি ও সুস্বাদু, নিজস্ব সুঘ্রান আছে। যারা একটু শক্ত শাঁস এর আম খেতে ভালোবাসে তাদের ভালো লাগবে ।

(১১) কালাপাহাড় (কু পাহাড়) : নবাব ওয়াসিফ আলী মির্জা ছিলেন খুব ভোজনবিলাসী, আম খেতে খুব ভালোবাসতেন। তিনি আম খেতেন বিশেষ বিশেষ গাছের এবং আমের মরশুমে নবাবী বাগানে সেই সমস্ত গাছের আম বিশেষ যত্ন নিয়ে তৈরি করা হতো। জানা যায় নবাব ওয়াসেফ আলী মির্জার সবচেয়ে প্রিয় আম ছিল “তোতা”, সেই আম আজ বিলুপ্ত। তোতা আম নিয়ে নবাবদের সঙ্গে ইংরেজদের বিবাদ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। নবাব হুমায়ুন জা-এর বেগম রইসুননেসা -এর নামে আড়াই বিঘা একটা আম বাগান ছিল, সেই বাগানের নাম ছিল র‌ইসবাগ। রইসবাগে ছিল নবাব ওয়াসেফ আলী মির্জার প্রিয় “তোতা”আম। সেই আমবাগানটি মুর্শিদাবাদ এস্টেট ম্যানেজার লালবাগের গুলু বাবু নামের একজনকে লিজ দিয়েছিলেন। একথা শুনে নবাব ভীষণ রেগে যান, এবং ব্রিটিশ রাজের বোর্ড অফ রেভিনিউ এর সঙ্গে নবাবের দ্বন্দ মেটাতে কমিশন গঠন করা হয়। নবাবকে হতাশ করে কমিশনের রায় গেল গুলু বাবুর পক্ষেই। রাগে, ক্ষোভে, হতাশায়, অপমানে আর কোনদিন “তোতা”আম ছুঁয়ে দেখেননি নবাব সৈয়দ ওয়াসেফ আলী মির্জা।
প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির আম কালাপাহাড়। কালচে সবুজ রং এর হয় এই আম। পাকলেও এই আমের রং বদলায় না। যার জন্য হাতে না নিলে দূর থেকে বোঝা যায় না কোনটা পাকা আম, কোনটা কাঁচা আম। মাঝারি সাইজের এই আমের অল্প কিছু গাছ থাকলেও সেই আম এসে বাজারে পৌঁছয় না। লালবাগে বাগানে গেলে তবে যদি সংগ্রহ করা যায়। নওদা থানাতেও কালাপাহাড় আমের বেশ কিছু গাছ ছিল, বয়সের কারণে সেইসব গাছে এখন হয়তো আম ফলে না। ছোটবেলায় দেখেছি পাকা আম গাছ তলায় পড়ে থাকলে আঁটি ছিটকে দূরে পড়ে আছে মনে হত যেন কেউ চেটেপুটে খেয়ে আঁটি টা ফেলে রেখেছে। খুব মোলায়েম শাঁসযুক্ত ও আসহীন এই আম খেতে খুব সুস্বাদু ও রসালো। পাকলে এই আমের শাঁস লাল রংয়ের হয়।

(১২)কোহিতুর : নবাব বংশের খাস পছন্দ কোহিতুর আম। লখনৌ’এর ম্যাংগো রির্সাচ সেন্টার এর মতে ভারতের সেরা আম “কোহিতুর”। কোহিতুর আমের জন্য জি আই (জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন) তকমা’র দাবি জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। হীরের দুনিয়ায় কোহিনুর যেমন তেমনি আমের বাজারেও কৌলিন্যের বিচারে সেরা কোহিতুর।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে নাকি কোহিতুর আম এর আবির্ভাব হয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলার আমলে নবাব বংশের খাস আম পালক হেকিম আগা মোহাম্মদী বাগ নাকি সৃষ্টি করেছিলেন এই আম। কালাপাহাড় আমের সঙ্গে অন্য এক ধরনের আমের সংকরায়ন করে সৃষ্টি করেছিলেন কোহিতুর আম। আবার অনেক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মোঘল বাদশা আকবরের আমবাগান থেকে নবাব সুজাউদ্দিন এর সময় কোহিতুর আম মুর্শিদাবাদে আসে।
কোহিতুর আম এতো সুস্বাদু ও উচ্চমানের ছিল যে , নবাবরা তাদের পরিবার ও আমন্ত্রিত অতিথি ছাড়া সাধারণের পাতে না পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি নবাবদের বাগান ছাড়া সাধারণের বাগানে লাগানো যেত না এই আম গাছ।
কোহিতুর আম এতই সৌখিন যে ঠুনকো আঘাতেই তার স্বাদ পাল্টে যায়, যার জন্য তাকে ঠুসিতে তুলোর প্যাড বসিয়ে সাবধানে পেড়ে, তুলোতে মুড়ে রেখে পাকাতে হয় এবং যাতে চাপ না পড়ে সেই জন্য দুই, তিন ঘন্টা অন্তর উল্টে দিতে হয়। আম কাটার আগে বোটা কেটে 2 থেকে 3 ঘন্টা জলে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর সেই আমকে বাঁশের চোচালি দিয়ে কেটে নবাবদের খেতে দেওয়া হতো।
লালবাগে বর্তমানে একটা কোহিতুর আম 50 থেকে 200 টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। কলকাতায় আম উৎসবে একটা কোহিতুর আম 600 থেকে 700 টাকায় বিক্রি হয়। কলকাতার আম উৎসবে কোন সময় নিলামে একটা আমের দাম হাজার টাকা উঠেছিল।
কোহিতুর আম এর গড়ন গোলাকার, 250-300 গ্রামের মত হয়, পাকলে হলুদ রং ধারণ করে। আম চাষিরা বলেছেন অসাধারণ স্বাদের জন্য তো বটেই তাছাড়াও এই আমের চাহিদা ও দাম বেশি হবার আর একটা কারণ হচ্ছে, এই আমের গাছের সংখ্যা খুবই কম, সমস্ত মুর্শিদাবাদে 100 টি কোহিতুর গাছও নেই এখন তাছাড়াও কোহিতুর গাছে আম বেশি ধরে না। 50 থেকে একশোটা মত আম ধরে। যদিও নবাবী আমলের কোহিতুর সহ 8 থেকে 10 টি প্রজাতির আমকে পুনরায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে, তবে তার গুণমান একই থাকবে কিনা সে বিষয় নিয়ে সন্দেহ থাকলেও কৌলিন্যের যুদ্ধে কোহিতুর কে পিছনে ফেলতে পারবে না কোন আম ই।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Related post