কমলেশ সেন : এক অগ্নিময় স্বদেশের কবি

অশোক চট্টোপাধ্যায়
আজ থেকে দেড় দশক আগে এই দিনেই তিনি আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন। কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে তাঁর নিথর দেহখানি সেই রাত্রেই শেষপর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল শ্মশানে। একটু তাড়াহুড়োই করে তাঁর শবদাহ করা হয়েছিল। আমরা যারা পরেরদিন তাঁকে শেষবারের মতো দেখার জন্যে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম তাঁরা নিদারুণ হতাশগ্রস্ত হয়েছিলাম। এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে তাঁর আপাত বিপন্মুক্তির খবর পেয়ে আমরা কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে গিয়ে অপেক্ষমান অন্যদের সেই সংবাদ জানাবার অব্যবহিত পরেই জানতে পারি তাঁর প্রয়াণ সংবাদ। কবি আমাদের ছেড়ে গেলেন। আর কখনও তাঁর পাশে বসে আলোচনা করবো না, তাঁর মুখ থেকে তাঁর লেখার পাঠ শুনবো না। আমাদের মতো নামগোত্রহীন লেখক যশাকাঙ্ক্ষী তাঁর নিকট থেকে অকৃপণ উৎসাহ আর পাবে না। এমন অসমবয়সি বন্ধু আমরা আর পাবো না। মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বেশ কয়েকটা দিন কেটেছিল সীমাহীন বিমর্ষতার মধ্যে দিয়ে। তারপর যা হয়। নাজিম হিকমতের উত্তরকালে তো শোকের আয়ু এখন কয়েক ঘণ্টায় এসে দাঁড়িয়েছে। এই কবিই হলেন কমলেশ সেন, যিনি যেকোনো বয়সের ছেলেমেয়ে পুরুষ মহিলার সঙ্গে অনায়াসেই মিশতে পারতেন, তাঁদের সঙ্গে একদিনের কিছুসময়ের আলাপেই তাঁদের একান্ত আপনজন হয়ে উঠতে পারতেন।
কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে তিনি রাষ্টের কোপে পড়েছেন বারবার। এই রাষ্ট্রীয় কোপে পড়েই একসময় পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান) বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসেছিলেন পশ্চিমবাংলায়। এখানে তিনি নবাগত কমিউনিস্ট। তাঁর তো সঙ্গী দরকার, বন্ধু দরকার যারা তাঁকে সাহচর্য দেবেন। কিন্তু তিনি তো বন্ধুতার অপেক্ষায় থাকার মানুষ নন। দিনে দিনে তিনিই সবার প্রিয় বন্ধু হয়ে ওঠেন। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে সাবলীলভাবে মিশতে পারেন তাঁর মতো এমন মানুষ আর দেখিনি। অবন্ধু শিবিরেও তিনি স্বচ্ছন্দ। তবে রাজনৈতিক মতাদর্শের জায়গায় তাঁর কারও সঙ্গে কোনও আপস ছিলনা কোনদিন। বিরুদ্ধতা নিয়েই কীভাবে অন্যদের সঙ্গে পথ চলতে হয় তাঁর নিকট থেকে শিখেছি। মানুষকে সরল মনেই বিশ্বাস করতেন ফলে প্রতারিত হয়েছেন অনেক অনেকবার। তবু তিনি তাঁর স্বভাবজ সারল্য ত্যাগ করতে পারেন নি কোনদিন।
কবিতা পাগল এই মানুষটিকে দেখেছি রীতিমতো রাজনৈতিক অবস্থানে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে। নকশাল আন্দোলনের আগে থেকেই, আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, বিগত শতকের ষাটের দশকের প্রত্যূষলগ্ন থেকেই সাংস্কৃতিক সংগঠন মনস্কতার পরিচয় রাখতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি। তাঁর নিজের কথায় : ‘উনিশ শ বাষট্টি সালের গোড়ার দিকে’ কয়েকজন তরুণের সাহচর্যে ‘কর্ণিক’ নামে একটি ক্ষুদ্রায়তনিক কবিতা পত্রিকা তিনি প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর কথায়—
কর্ণিক প্রকাশনের প্রথম দিকে আমাদের অনুভূতি ছিল, জ্বালা ছিল, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির ছিল একান্ত অভাব। অবশ্য এই অভাবটা ছিল স্বাভাবিক। কারণ সেদিন শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি কমিউনিস্ট পার্টির যে অবস্থা ছিল, সেই অবস্থার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে কোন সৎ এবং নিষ্ঠাবান কমিউনিস্ট কর্মীর পক্ষেই এককভাবে সমস্ত বাধা-বিঘ্নকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা ছিল সম্পূর্ণ অসম্ভব।
আদ্যন্ত রাজনৈতিক চিন্তার মানুষ, কমিউনিস্ট কবি এবং কর্মী কমলেশ সেনের এই বক্তব্যই তাঁর মতাদর্শিক অবস্থানের দ্যোতক। এই কথাগুলি তিনি লিখেছিলেন ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি। তখন রক্তস্নাত সময়। স্বদেশের গোঙানি অনবরত ধ্বনি থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে। হাজার তরুণ-তরুণী সুখী জীবনের হাতছানি উপেক্ষা করেই রাস্তায় নেমে এসেছেন মুক্তির স্বপ্নের বীজ দেশময় ছড়িয়ে দিতে। রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনী বুলেটের সামনেই সরাসরি বুক পেতে অসম যুদ্ধে সামিল হতে তাঁরা নির্দ্বিধচিত্তে এগিয়ে এসেছিলেন। এইসময় কবি কমলেশ সেন সম্পাদনা করেন একটি কবিতা সংকলন যার শিরোনাম ছিল ‘স্বদেশ অগ্নিময় স্বদেশ’। সত্তরের উত্তাল রক্তাক্ত লড়াইয়ের সময় তিনি এই ‘অগ্নিময়’ স্বদেশের গাথাকাব্যের সম্ভারে যাঁদের কবিতা স্থান পেয়েছিল তাঁদের মধ্যে তিনটি উল্লেখযোগ্য নাম : অমিয় চট্টোপাধ্যায়, তুষার চন্দ্র, দ্রোণাচার্য ঘোষ। কবি কমলেশ সেন এই প্রসঙ্গে লিখেছেন :
এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত তিনজন কবি সম্পর্কে বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন।…এঁদের তিনজন কবিকে কারাগারে ফ্যাশিস্ত সরকার নিহত করেছে। অমিয় দীর্ঘদিন বেহালার শ্রমিক এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোভাবে দাঁড়িয়ে সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন। তুষার ছিলেন রানীগঞ্জ খনি শ্রমিকদের একজন প্রিয় নেতা। দ্রোণ বয়সে সর্বকনিষ্ঠ। হুগলী জেলার এক গরিব কৃষক পরিবারের সন্তান।
এইভাবে তাঁদের পরিচয়দানের মধ্যে দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে কবি নিছক কোনও স্বপ্নলোকের বাসিন্দা নন। তিনিও দেশের লড়াকু মানুষের সজীব সান্নিধ্যে থেকে সংগঠন করার মধ্যে দিয়েই সক্রিয় রাজনৈতিক দর্শনের ফলিত চর্চায় জীবনের সার্থকতার অনুসারী হয়েছিলেন।
কমিউনিস্ট রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক অনুশীলক কবি হিসেবে তিনি বিগত শতকের ষাটের দশকের প্রত্যূষলগ্নে কীভাবে দেখেছিলেন তাঁর সমসময়কে? তিনি লিখেছেন :
১৯৬২ সালের পর থেকে ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের উপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গিয়েছে। অসহনীয় শোষণ এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে অসংখ্য মানুষ নিজেদের সংগঠিত করে, ক্ষোভে জ্বালায় ফেটে পড়েছেন। কখনো স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। বিপ্লবী কর্মীরা সাধারণ মানুষের এই জ্বালা এই ক্ষোভের সঙ্গে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে যারা বিপ্লবী মুখোশ পরে আমাদের নেতৃত্বে এসেছিলান তারা মানুষের এই জ্বালা, এই ক্রোধ, এই বিদ্রোহী মনোভাবকে তাদের নিজস্ব শ্রেণী স্বার্থেই সংসদীয় পথের চোরাবালিতে ডুবিয়ে দিলেন।
কবি এবং রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তিনি এখানে তাঁর অবস্থান পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সুবিধাবাদ সমসময়ের জনসাধারণের ন্যায্য এবং সংগত জ্বালা, ক্রোধ এবং বিদ্রোহী মনোভাবকে বিপ্লবী আন্দোলনের খাতে বহিয়ে না দিয়ে তাকে ‘সংসদীয় পথের চোরাবালিতে ডুবিয়ে’ দিয়েছিল। পার্টির এই অনুশীলিত প্রক্রিয়া কবি কমলেশ সেন প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তার দীর্ঘ ছয় দশকের মাথায় এসেও কি এর কোনও গুণগত পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করছি? সেই ট্রাডিশান আজও বহমান।
নিজেকে সরাসরি ‘কমিউনিস্ট’ বলে দাবি করে কবি লিখেছিলেন যে ‘আমরা কমিউনিস্টরা’ আমাদের দেশকে ‘বিমূর্ত ভাবে’ দেখতে অভ্যস্ত নই। ‘আমাদের’ কাছে দেশ হচ্ছে সজীব, সবাক, যা দেশের কোটি কোটি ‘নিপীড়িত’ মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, ঘৃণা, ক্রোধ, সংগ্রাম এবং ‘অভ্যুত্থান’-এর সম্মিলনে এক নতুন স্বপ্নকে জারিত করে থাকে। তাঁর মতে আমাদের দেশ হচ্ছে এক ‘অগ্নিময় বিক্ষুব্ধ’ মানুষের দেশ, আর এই কারণেই ‘আমরা’ এই প্রিয় দেশকে ভালোবাসি। আর এই দেশ এবং মানব মুক্তির লক্ষ্যেই কবিরা প্রয়োজনে ‘কলমকে হাতিয়ার’ করে হাতে তুলে নেন। কবি নাজিম হিকমতের সেই বহু ব্যবহৃত অসাধারণ উক্তির ঝঙ্কার যেন এখানেও প্রতিধ্বনিত হয়।
এই হচ্ছেন কবি কমলেশ সেন যিনি নকশালবাড়ির কৃষকদের বৈপ্লবিক আন্দোলনের প্রজ্বলিত আগুনের শিখার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন স্বদেশ এবং মানব মুক্তির দিশা। এসময় তিনি লিখেছিলেন : ‘উত্তরের/উত্তরের মানুষগুলো/খেপে উঠেছে/খেপে উঠেছে/##/উত্তরের পলাশ ফোটা মাঠে/উত্তরের পলাশ ফোটা মাঠে/একলক্ষ/একলক্ষ সজ্জিত মানুষ/##/সজ্জিত মানুষ।’ এই ‘সজ্জিত’ মানুষের লড়াইয়ের মধ্যেই তিনি তাঁর প্রিয় দেশকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর স্বপ্নের এই উত্তোলিত নিশান তিনি কোনদিন নামিয়ে রাখেন নি। বিগত শতকের অন্তিম পর্যায়ে এসেও তিনি নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন : ‘একথা তো ঠিক, অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলা যায় নকশালবাড়ির আন্দোলন ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা—এক নতুন প্রত্যয় সংযোজিত করে(ছে)।’
উত্তরকালেও এক সাক্ষাৎকার তিনি স্বীকার করেছেন যে বিগত শতকের সত্তরের দশকে এক ‘উন্মাদনার’ মধ্যে থেকে তিনি লিখেছেন। পরবর্তীতেও তিনি সেই উন্মাদনাকে কখনও বিভ্রম বলে মনে করেন নি। পাবলো নেরুদা আর লোরকা ছিলেন তাঁর প্রিয় কবি। এই দুই কবিও কমিউনিস্ট হিসেবেই সংগ্রাম আর কবিতাকে মেলাতে চেয়েছিলেন। কমলেশ সেনও আমৃত্যু সেই পথেই পদচারণা করেছেন।