প্রথমা কাদম্বিনী

প্রদোষ পাল (বিশিষ্ট শিল্পী ও প্রাবন্ধিক) :- সত্যি কথা বলতে কাদম্বিনী দেবীর নাম শুনেছিলাম, তেমনভাবে জানা ছিল না অন্যতম মহীয়সী কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৬২-১৯২৩) আসলে কে ছিলেন! তিনিই প্রথম কলকাতা ম্যাডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা মহিলা ডাক্তার। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর দোর্দন্ড সমাজের সঙ্গে তাঁর লড়াইয়ের কিছুই প্রায় জানতাম না। সম্প্রতি তাঁর সম্পর্কে একটু একটু জেনেছি, এবং তাতে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! সে যুগে মহিলাদের পড়াশোনা করা ছিল যেখানে মারাত্মক অপরাধের সেখানে ডাক্তার হওয়া ছিল কল্পনারও অতীত। প্রতি পদে পদে হেনস্থা, অপমানিত হতে হয়েছে তাঁকে। অনমনীয় কাদম্বিনী দেবী বিন্দুমাত্র হাল ছাড়েননি। তাঁর লড়াই শুধু সমাজের সাধারণের সঙ্গে ছিলনা মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন উচ্চ শিক্ষিত ডাক্তারদের সঙ্গেও সমানে লড়াই চালাতে হয়েছে।
মেডিক্যাল কলেজে তাঁর ঢোকা নিয়ে তখনকার সমাজে সমালোচনার ঝড় উঠবে, এ তো প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু প্রবল বাধা এসেছিল ডাক্তারদের থেকেও। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেট ১৮৭৫ সালে লিখেছিল, ‘that females of any kind are fit to be doctors is a very doubtful point.’ তাঁকে পদে পদে হেনস্থা করার জন্য অতি সচেষ্ট ছিলেন মেডিক্যাল কলেজের বিলেত-ফেরত ডাক্তার-শিক্ষক রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র। যতদিন কাদম্বিনী দেবী মেডিকেল কলেজে পড়েছেন আগাগোড়াই বিরোধিতা করেছিলেন উনি। তিন বছরের শেষে প্রথম পরীক্ষায় তাঁর কাছে ফেল হন কাদম্বিনী দেবী। এম বি পড়া হল না। সেনেট ‘লাইসেন্সিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি’ পড়ার অনুমতি দিল। দু’বছর পর ফাইনাল পরীক্ষায় আবারও একই পরীক্ষক রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র ফেল করালেন। মজার ব্যাপার মেডিক্যাল কলেজে পড়াকালীন কাদম্বিনী দেবীর রেজাল্ট বরাবরই ঈর্ষনীয় ছিল। ষাট শতাংশের নিচে ছিলনা। তবু ওই নির্লজ্জ শিক্ষক শুধুমাত্র নারী বিদ্বেষ থেকে ও ডাক্তার হওয়া বানচাল করতে কাদম্বিনী দেবীকে আবার ফেল করালেন। সেনেটের অনুরোধে পুনর্মূল্যায়ন হল, তাতেও পাশ করালেন না। তখন তৎকালীন ইংরেজ অধ্যক্ষ ডা. কোটস তাঁর উপর ন্যস্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে কাদম্বিনী দেবীকে ‘গ্র্যাজুয়েট অব দ্য মেডিক্যাল কলেজ অব বেঙ্গল’ উপাধি দিলেন। কাদম্বিনী দেবী ডাক্তারি প্র্যাকটিস করার লাইসেন্স পেলেন।মেডিক্যাল কলেজের ইডেন হাসপাতালে তাঁর চাকরিও হল এই উপাধির ভিত্তিতেই।
তবে অসম বয়সী স্বামী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের (১৮৪৪ – ১৮৯৮) একশো শতাংশ সমর্থন ও সহযোগিতা না পেলে ওই দোর্দন্ড ইতর সমাজের সঙ্গে তিনি লড়তে পারতেন কিনা সন্দেহ!
গোটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম দুই মহিলা গ্র্যাজুয়েটের যিনি একজন। কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশকরা প্রথম মহিলা ডাক্তার। আবার তিনিই প্রথম মহিলা যিনি ভারতীয় কংগ্রেসে ভাষণ দিয়েছেন। বিলেত থেকে ডাক্তারি ডিগ্রি এনেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় গাঁন্ধীর আন্দোলনের জন্য টাকা তুলেছেন। কলকাতায় মহিলাদের জাতীয় সভা করেছেন। নীলরতন সরকার-প্রাণকৃষ্ণ আচার্যের মতো দুঁদে ডাক্তারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্র্যাকটিস জমিয়েছেন কলকাতায়, নেপালে। বাংলার মেয়েদের শিল্পকৃতি নিজের উদ্যোগে সংগ্রহ করে পাঠিয়েছেন মার্কিন মুলুকের প্রদর্শনীতে। প্রেম করে বিয়ে করেছেন অসম বয়সী নিজের শিক্ষককে, যিনি ছিলেন অন্য জাতের। ন’টি ছেলেমেয়ে মানুষ করেছেন, তাদের বিয়ে দিয়েছেন, নাতি-নাতনি নিয়ে সংসার করেছেন পুরোমাত্রায়।
তিনিই প্রথম মহিলা সহবাস আইন বদলাতে ইংরেজদের কাছে দরবার করেছিলেন। অর্থাৎ বিয়ে করা ১২ বছরের নিচের মেয়েদের সঙ্গে সহবাস করার বিরোধিতা করেছিলেন। বলাই বাহুল্য তারজন্য সেযুগের গোঁড়া হিন্দু ব্রাহ্মণরা প্রচন্ড রুষ্ট হয়েছিল। নানান ভাবে তাঁকে হেনস্থা, অপমান করেছে। ১৬ বছরের আগে বিবাহিত কোনো মেয়ের সঙ্গে সহবাস করা আইনত দন্ডনীয়, এই নতুন আইন বলবত হয়েছিল তাঁরই প্রচেষ্টায়।
সে যুগের ‘বঙ্গবাসী’ বাংলা সংবাদপত্র এক প্রতিবেদনে কার্যত তাঁকে ‘বেশ্যা’ বলে উল্লেখ করেছিল। কাদম্বিনী দেবী তখন ডাক্তার, পাঁচ ছেলেমেয়ের মা। ছাড়েননি ওই সংবাদপত্রের সম্পাদককে। মামলা করে জেল খাটিয়েছিলেন পত্রিকার সম্পাদক মহেশচন্দ্র পালকে। শুধু জেল নয়, সে যুগে ১০০ টাকা জরিমানাও হয়েছিল ওই সম্পাদকের।
তাঁর সময়ে কাদম্বিনী দেবীকে নিয়ে অজস্র লেখালেখি হয়েছে। পড়াশোনা, চাকরি খোঁজা, বিলেতযাত্রা, সব কিছুর খুঁটিনাটি বেরিয়েছে। তবু তিনি ঠিক ‘পপুলার’ ছিলেন না। তাঁকে ঘিরে বারবার বিতর্ক হয়েছে মেয়েরা কী করতে পারে, কী পারে না, কী করা উচিত, কী নয় এ সব ধারণাই তাঁর জন্য নতুন করে ঢেলে সাজতে হয়েছে। তবু তিনি ঠিক কারও রোল মডেল হয়ে ওঠেননি। তাঁর মতো একটা চরিত্রকে মাঝখানে রেখে কেউ নাটক-নভেল লেখেনি, এমনকী নারী আন্দোলনের ইতিহাসেও তাঁর কথা তেমন ভাবে আসে না। বোধ হয় তার কারণ কাদম্বিনী দেবীর কাছে ঘরের কাজ আর বাইরের কাজে কোনও বিরোধ ছিলনা। পেশার জগতে যিনি প্রতিযোগিতা করে নিজের জায়গা তৈরি করেন, গাঁধীর আন্দোলনের জন্য টাকা তোলেন, ডাফরিন হাসপাতালের জন্য ২৪ হাজার টাকা সংগ্রহ করেছিলেন সে যুগে। সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দেন, আবার আগাগোড়া প্রায় বাঙাল ভাষায় কথা বলা কাদম্বিনী দেবী পুত্রবধূকে চিঠি লেখেন, ‘কাল বিকালেও রাঁধুনি আইসে নাই। আজও ক্যাঁও ক্যাঁও করিয়াছে শরীর ভাল না। কাল আসিবে কিনা জানি না।’
মালবিকা কার্লেকর লিখছেন, ঘর-বার সমান ভাবে সামলানোর যে চেষ্টা কাদম্বিনী করেছিলেন তখনকার বাঙালি সমাজে সেটা সমাদর পায়নি। ‘যা প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছিল তা হল, তিনি এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছেন যেখানে এই দুয়ের স্বার্থে সংঘাত হতে পারে। আর ঠিক এই সংঘাতের ধারণাটাই বাঙালি সমাজের অধিকাংশ মানুষ এড়িয়ে চলতে চাইতেন।’
লীলা মজুমদারের আত্মকথায় পাওয়া যায়, তাঁর মেয়ে-বন্ধুদের শান্তিনিকেতনে পড়ানোর অনুমতি যদিবা মিলত, মাইনে নেওয়া ছিল নিষিদ্ধ। মেয়েরা রোজগার করবে? ছিঃ! তাঁর সময়ের যে সব কাজ মানুষকে ‘পপুলার’ করত স্বদেশি আন্দোলন, সমাজ-ধর্ম সংস্কারের চেষ্টা, আগুনে লেখালেখি, সে সব কিছুই কাদম্বিনী করেননি। তিনি স্নেহময়ী মাতৃমূর্তি নন, আত্মত্যাগী সন্ন্যাসিনীও নন। সশস্ত্র বিপ্লব করেননি, অনশন-অরন্ধন করেননি, আবার বনেদি জমিদার গিন্নির ইমেজও তাঁর নয়। তাঁর ছবিটা যেন টাট্টুঘোড়ায় টানা ফিটন চেপে এক মহিলা যাচ্ছেন শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, রোগী দেখতে। হাতে কুরুশ-কাঠি, লেস বুনছেন রাস্তায়। বিধবা বড় ননদের জন্য হিন্দু মতে রান্না করছেন, আবার বিহার, ওড়িশায় খনিমজুর মেয়েরা কেমন আছেন, তা সরেজমিনে দেখে রিপোর্ট দিয়েছেন সরকারকে। এমন মেয়েকে ঠাহর করা সহজ নয়।
কাদম্বিনী দেবীর জীবনের কিছু কথা জেনে যে কথাটা বার বার মনে উঁকি দেয় প্রায় দেড়শ বছর পর আমাদের সমাজটা খুব কি এগিয়েছে? এখনো হামেশাই কানে আসে ‘মেয়েছেলের এতকিছু করা সাজেনা’।
দেড়শ বছর আগে কাদম্বিনী দেবী যা করেছিলেন কম? দেড়শো বছর পর আমরা তবে কতটা এগোতে পেরেছি? নারী সম্পর্কে পুরুষ শাসিত সমাজের মানসিকতা কতটা বদলেছে? আদৌ বদলেছে কী? নারী সম্পর্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক বা ধর্মবাজ পুরুষদের যেসব অপমানজনক মন্তব্য শুনি, এবং সমাজের বৃহৎ সংখ্যক মানুষের কাছে যখন তা মান্যতা পায় তখন মনে হয়না কি এগোনের থেকে আমরা ক্রমশ পিছিয়েই চলেছি?