জোর যার মুলুক তার

জয়শ্রী ভূষণ
এই মাত্র খবরটা পেলাম। শুনেই জানি না কেন চিৎকার করে উঠলাম। সেই সাথে টের পেলাম চোখের জল আটকানো যাচ্ছে না। না না দুঃখে নয়, রাগেও নয়, ঘেন্নায়, নিজের উপর ঘেন্নায়। দাঁতগুলো কিড়মিড়িয়ে উঠলো যেন। নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে। ছেলে বলছে মা ভাতটা মেখে খাইয়ে দাও । তার উপরেও খিঁচিয়ে উঠলাম। না খেলেও হবে। আজ থেকে অনেকেই উপোস থাকবে। একদিন না খেলেও হবে। বলছি আর পড়াশোনা না করলেও হবে । ছেলে নিজেই মুখ ফুলিয়ে ভাত খেলো। ঘুম থেকে উঠেই খবরটা ছেলের বাবার থেকেই পাওয়া, বলছিলো- “দেখো পুরো আসাম থেকে জেসিবি এসেছে হুঁহুঁ প্রায় ২০০টা ভাবতে পারো।”

হ্যাঁ বিষয় ডলু চা বাগান। শুধু চা বাগান নয়, বিষয় সেখানে বসবাসরত প্রায় দু-তিন হাজার মানুষ, চা বাগানটাকে যারা গত ১০০ বছর ধরে সিঞ্চন করে সবুজ করে রেখেছে নিজেদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে একবেলা আধপেটা খেয়ে। বিষয় পরিবেশ, বিষয় উচ্ছেদ, বিষয় হিন্দু রাষ্ট্র, বিষয় হিন্দু মুসলমান, বিষয় আমাদের তোষামোদি, বিষয় সুশীল সমাজ, বিষয় বরাকের কবি সাহিত্যিকদের নির্লিপ্ততা, বিষয় আমি নিজেও।
কেন জানি না টাইটানিকের ডোবার দৃশ্যটা মনে পড়ছে। হুড়হুড় করে জল ঢুকছে। সেই টাইটানিক যে জাহাজ নির্মাণের পর বলা হয়েছিল এ নাকি কখনো ডুববে না, এতটাই মজবুত করে বানানো হয়েছিল। যত্ন করে বানানো হয়েছিলো সমস্ত সুবিধা সহ। সেই টাইটানিকের যখন নীচু তলা ফুটো হয়ে গেছিল, তখনো আমোদ প্রমোদ চলছিলো উপরের মহলে। কারণ প্রথম আঘাতে ভাঙা ফুটো দিয়ে হুহু করে জল ঢুকে শেষ করে দেওয়া নীচের মানুষগুলোর হাহাকার কেউ শুনতে পাচ্ছিল না। টাকা, পয়সা, অহংকারের দমকে কেউই পাত্তা দেয়নি নীচে কি হচ্ছে। এই যেমন আজ ডলু চা বাগান উপড়ে ফেলা নিয়ে বৃহত্তর বরাক ও আসাম এক্কেবারে নীরব। পারছি না, যন্ত্রণাটা সহ্য করতে পারছি না। বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আমার চোখে আজ কি যে হয়েছে জানি না সব ঝাপসা লাগছে। নিজে টবে একটা গাছ লাগালে সেই গাছকে সন্তানসম যত্নে আগলে রাখি। ভাবছি সেই বাগানের আবালবৃদ্ধবনিতাদের কথা। যারা গোটা বাগানটাকে ঝাঁ চকচকে করে রাখে নিজেদের রক্ত দিয়ে। ওদের সামনে যখন বাগানের চা গাছগুলোতে জেসিবি হামলে পড়েছে, ওদের সবার অন্তরাত্মা হাহাকার করছে। ওরাও কাঁদছে জানি, অসহায় বোধ করছে৷

না না এ গরুখুটি নয়, না কোন মুসলমান বিতাড়ন চলছে না, সবাই হিন্দু কাট্টা হিন্দু। গোটা অঞ্চলে একজন মুসলমানও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবুও উচ্ছেদ চলছে। এবার বুলডোজার নয় এবার জেসিবি। আহ্, বুকে প্রচণ্ড ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে দৌঁড়ে গিয়ে সব গুড়িয়ে দিই। কিন্তু আমিও অসহায়। পারিনা কিছুই করতে পারিনা। অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। বাগান সবুজে ঝকমক করছে। সেইসব উপড়ে লাল মাটি বের করে দিচ্ছে। মনে মনে ভেবেই শিউরে উঠছি। আসলে উন্নয়নের বীজ পোতা চলছে। যে উন্নয়নের জোয়ারে একটা গোটা সবুজ অঞ্চল ধুধু প্রান্তরে পরিণত হতে চলেছে। সেখানে একটা বিমানবন্দর হবে বড় বড় বিমান অবতরণ করবে। সব সবুজের কবরের উপর। যত গাছ গাছালি সুন্দর মনোরম দৃশ্য, পাখিপাখালি সবার ঘরের উচ্ছেদ চলছে। কিন্তু কি আশ্চর্য লাগে, বহু বহু বছর বছর ধরে পড়ে আছে ওই বাগানের অদূরেই মহাসড়কের কাজ । কমপক্ষে ১০/১৫ বছর তো হবেই। যার কাজ কোনদিনই শেষ হবে না বলেই জানি। অবশ্যই কারণ পরিবেশ। পরিবেশ সুরক্ষার দোহাই দিয়ে বনবিভাগ নাকি শিলচর গৌহাটির মহাসড়কের কাজ বন্ধ করে রেখেছে। তাছাড়াও অত সহজে বাসে গাড়িতে সহজে গৌহাটি বা অন্য শহরে কম খরচে পৌঁছুলে কিভাবে চলবে। আধমরা হয়ে এম্বুল্যান্সে যেতে যেতে পথে মরণ না হলে কি করে হবে। তা সেই বনবিভাগের ডলু চা বাগানকে ধূলিসাৎ করে বিমানবন্দরে পরিবর্তনে কোন সমস্যা নেই। ইংরেজিতে একেই বোধহয় বলে হিপোক্রেসি।

এতগুলো মানুষ মিলে দিনের পর দিন, এত অনুনয় বিনয়, এত কথাবার্তা, এত অহিংস আন্দোলন, সবই অর্থহীন। হাজারটা গরীব আর পোকামাকড় একই। বিমানবন্দরে বিমানে কারা চড়বে, এতগুলো ছাড়পোকাদের পেটে লাথ মারলে কার কি এসে গেছে। নিদেন পক্ষে নাহয় আমরা কিছুদিন এনিয়ে গান কবিতা করবো। হ্যাঁ শুধুই কবিতা, না এনিয়ে কোন বিশেষ আলোচনা ফালোচনায় আমরা নেই। আমরা কেউ রাজনীতি করি না। আমরা সব নিরপেক্ষ সহজ সরল মানুষ সাহিত্য সংস্কৃতি করি। বিশেষ বিশেষ দিবসে অনুষ্ঠান। হ্যাঁ ,আমাদের একটু অসুবিধে হবে বইকি, বনভোজনের জন্য এই ডলু বাগানে আর আসা যাবে না।
আসলে সমস্যাটা কোথায়। বিমানবন্দরে কোন সমস্যা নেই। রোজ শিলচর থেকে কয়টা বিমান ওঠা নামা করে আমার জানা নেই। তবে খুব বেশি হবে না। তবুও আরেকটি চাই, হোক তাতেও আপত্তি নেই। কিন্তু এখানেই কেন। আর কোনো পতিত জায়গা কি নেই। আসলে শষ্যের মধ্যেই ভুত। সমস্যাটা আজকের ভারতে তাই। আমরা উন্নয়ন চাই কিন্তু উপরের উন্নয়ন। শেকড় বাকড় উপড়ে ফেলে উন্নয়ন চলছে। গোটা উত্তর পূর্বের মধ্যে সব থেকে কাহিল যোগাযোগ ব্যবস্থা বরাকের সাথে অন্যান্য অঞ্চলের। একটা ভালো রাস্তা নেই, ব্রীজ নেই, রেললাইন আছে ট্রেন নেই সেইখানে একটা বিমানবন্দর থাকা সত্ত্বেও আরেকটি বিমানবন্দর। খুব ভালো কথা হোক। কিন্তু এতগুলো মানুষ, বন, এত সবুজ উচ্ছেদ করে কেন?
আসলে সব আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। ভোট দেবে যারা তারা জানে না সরকারের নীতি কি? তারা অন্ধের মত তাকেই ভোট দিচ্ছে। আর বাকি তো সবাই আজকাল মাস্কবাদী। সবার মুখে এক পেটে আরেক। এতগুলো মানুষ পথে বসলে তো ভালোই আমার আপনার জন্যে। সস্তা শ্রমিক আরও সস্তা হবে। আমরা এবার থেকে শুধুই সাহিত্য সংস্কৃতি করবো। আর নাহয় তেলা মাথায় তেল দেবো। আমাদের কাজগুলো করার জন্য তো দুমুঠো ভাতের বদলে এই মানুষগুলোকে তো পাবোই। বাগানের মরদগুলো নাহয় মদ খেয়ে মরবে, আর মেয়ে মানুষেরা গতর খাটাবে। এসব নিয়ে বাবুবিবি বুদ্ধিজীবীদের কোন মাথা ব্যথা নেই। শুধু একটাই চিন্তা চুরিচামারি বাড়বে। তখন কি করে ধোলাই দিয়ে আধমরা করতে হয় সেসব ভালো করে শিখে রাখা দরকার ।

ছোটবেলা শুনতাম এই ভারতবর্ষ পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। এই দেশের সংবিধানে দেশের প্রজাদের জন্য সব সুবিধা আছে। কিন্তু সব কিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে লাঠির জোর যার, যে যত বেশি জোচ্চর তাদেরই এখন বেশি রমরমা। সাধারণ মানুষ হাজারে হাজারে মাসের পর মাস আন্দোলন করলেও এদেশের হবু গবুদের কানে কিচ্ছুই যায় না। সবই অরণ্যে রোদন। কাজেই বেশি পড়াশোনা, বেশি খাটাখাটি না করে ভালো থাকার একটাই রাস্তা সক্রিয় রাজনীতিতে চলে আসা। এখানে এলে সাহিত্য পুরষ্কার, কবি উপাধি, ডক্টরেট সব পাওয়া যায়। সেই সাথে যত ভালো মন্দ মানুষ আছে তারাও তোমার লেজুড়বৃত্তি করতে শুরু করে দেয়।
তবে টাইটানিকের শেষ দৃশ্যটা কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছে না। উন্নয়নের গোড়া কেটে শেকড় উপড়ে ফেললে আজ না হয় কাল টাইটানিকের মত উপর তলার মানুষদেরও একই দশা হবে যা আজ ডলুর চা বাগানের শ্রমিকদের হচ্ছে। পার্থক্য শুধু যে শেষ মুহূর্তে আর কিচ্ছু করার থাকে না ডুবে মরা ছাড়া।
পাশের দেশ শ্রীলঙ্কাতেও ধর্ম, বিভেদ, ঘৃণার রাজনীতি কাজ আসে নি। জার্মানিতে হিটলারকেও একদিন পরাজিত হতে হয়েছিল। সময় থাকতে থাকতে এখানের মেরুদণ্ডহীন জীবরা যদি মান ও হুশ সম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠতে পারেন তো ভালো, না হলে আর কি করা যাবে। এত বছর ধরে ধূর্ত শেয়াল মামারা যেমন কুমীর ছানা সব খেয়ে একটা ছানা দেখিয়ে সবাইকে উল্লু বানিয়েই যাচ্ছে, ঠিক একই ভাবে এই আসামে কিছু মানুষ আজ এই জার্সি কাল সেই জার্সি বদল করে সব খেয়ে খোকলা করে দেবে এই উপত্যকা। তারা আসলেই চায়না এখানে মানুষ থাকুক, চায় না কোন উন্নয়ন হোক, চায় শুধু নতুন একটা কাশ্মীর বানাতে। রোহিংগাদের মত নতুন প্রোডাক্ট বাংলাদেশি বানিয়ে সস্তা শ্রমিক বানিয়ে হিন্দু মুসলমানের আফিম খাইয়ে সব উন্নয়ন, নতুন রুজিরোজগার থেকে এই অঞ্চলকে বঞ্চিত করে রাখতে। তাই সময় থাকতে নিজেদের ভালোর জন্য রাজনীতিটা বুঝুন এবং সবাইকে বোঝান। আজকের এই পরিস্থিতির জন্য আমরা সবাই দায়ী। কবিগুরু বলেছিলেন অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা তারে তৃণসম দোহে তারে। অন্তত এখন সময় এসেছে আমরা বরাকবাসী হিসেবে একজোট হই। অন্যের কষ্টে যেন সমব্যথী হই। আমরা তো নতুন যোগী সবাই। সব কিছু পেছনে ফেলে আমাদের পায়ের নীচের মাটি শক্ত করার জন্য আমাদের নিজেদের চারপাশের কাঁচের দেওয়াল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা খুব দরকার। জানি না এই কথাগুলো কাকে বলছি আসলে নিজেকেই বলছি। নিজে শক্ত হবার চেষ্টা করছি।কাল রাত থেকেই অজানা আশংকায় ভালো লাগছিল না। সকাল থেকে ভীষণ মনখারাপ, কিচ্ছুই ভালো লাগছে না । কোথায় আছি আমরা ? সংবিধান, গণতন্ত্র, আইন সব কিছুই তো ধূলিসাৎ। ইতিহাস ক্ষমা করবে না, প্রকৃতি ক্ষমা করবে না। কিন্তু এভাবে আর কতদিন আর কতদিন। এর উত্তর কোথায় খুঁজবো। সকাল থেকে মেঘলা আকাশ কাঁদছে অঝোরে। আমি চোখ বন্ধ করে বেহালা বাজিয়ে নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্য এই লেখা লিখছি, কারণ আমি জানি ডুবছি আমরা সবাই ডুবছি। আজ আকাশের মত আমার চোখের ধারা বন্ধ হচ্ছে না কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। লাল লাল ছাপা শাড়িতে ভিজে জুবুথুবু মাথা সিঁথির লেপটানো সিঁদুর নিয়ে শয়ে শয়ে মহিলারা কাঁদছে দুহাত জোড় করে কাকুতি মিনতি করছে বাগান উপড়ে ফেলো না গো, এক দল মাটিতে উবু হয়ে পড়েছেন। তবুও এই বৃষ্টিতে সবুজ উপড়ে লাল মাটি বের করেছে যে জেসিবি চালকরা তাদের কথা ভাবছি তাদেরও কি কষ্ট হচ্ছে। জানি না কবে তবে ইতিহাস সাক্ষী সময় এবং প্রকৃতি কাউকে ছেড়ে কথা কয় না। মজুরি শ্রমিক ইউনিয়নের সভ্যরা, যারা আজ এতদিন ধরে এই বাগানকে রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে সবার কান্না আজ আকাশে বাতাসে। কিন্তু আমাদের নির্বাচিত রাজার মন তো এতে গলবে না। কারণ এই রাজ্যে মৃতের উপরে উল্লাসের ইতিহাস আছে। এত শুধু বাগান উপড়ে ফেলা নিতান্তই সামান্য কিছু।
এই যে এত এত জেসিবি, তা ব্যবহার করে তড়িঘড়ি এই বরাকের সাথে গোটা দেশের রেল যোগাযোগ এবং মহা সড়ক বাজপেয়ীজির স্বপ্না পুরা কেন হলো না তাই ভাবছি । উপড়ে ফেলার সময়, উচ্ছেদের সময় পুলিশ, অস্ত্র, মেশিন সবই সহজলভ্য হয়ে যায় এটাও কিছুদিন ধরেই আমরা সবাই বুঝতে পারছি। আসলে রাজা চাইলেই সব হবে নাইলে কচুকাটা। কিন্ত মিজোরামের সাথে গোলাগুলি ঢিল ছোড়াছুড়ির সময়ও তো এই জেসিবিগুলো নিদেনপক্ষে ব্যবহার করা উচিত ছিল।
হিন্দু রাষ্ট্র হবে গো। সব হিন্দুরা সুরক্ষিত থাকবে এই দেশে। মাটি লেপা বাঁশের ঘরের মাটির বারান্দার বাইরে বহু যতনে তুলসী গাছে জল তেল সিঁদুর দেওয়া আর হবে না এই বাগানের রক্ষাকারীদের । তাদের সবাইকে পলিথিনে মোড়ানো বৃষ্টিতে জল চুঁইয়ে পড়া যত্নের মাথার ছাদ ফেলে আকাশের নীচে চলে যেতে হবে। কোথায় যাবে তারা কোথায় তাদের দেশ তারা জানে না কেউ। আমিও না। কিন্তু ভোট এলে সব্বাই এক্কাট্টা হয়ে ভোট দিবি। আমাদের এখানে দুয়ার বনছে, শুধু দুয়ার। আমাদের মূলে নাই ঘর আর পূব দিকে দুয়ার। উন্নয়নের দুয়ার।

1 Comments
1916 sale e Gandhi ke diye prothom bije lagiye chilo British, Africa thekey neye ase, er jonno probity te Subash Chandra Bose desh sadhin korleo Gandhi jaharlal neheru Ballabh bai Patel jinna aro Kichu British dalal sotty ta mene ney ni, Karan era British er Dalal, eta hower Chilo eky group badh baki team er aladha aladha bibenno name company kule barathborser jonogon ke lutepute kawa.