নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে

অনসূয়া গোস্বামী :- নরক গুলজার নাটকের বিখ্যাত গান মুখে মুখে এককালে খুব চর্চিত হয়েছিল; কেউ শব্দ করো না, ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন। এই বিধিসম্মত সতর্কিকরণ সেখানে দেওয়া হলেও আমরা কালে কালে দেখেছি হাজার শব্দের মধ্যেও ভগবান বেশ বোবা-কালার পার্ট করে চলেন। আমার দশ বছরের ছাত্রী যেমন তার অনলাইন ক্লাসে মাঝে মাঝে ফ্রিজ মোডে চলে যায়। ওপরে পাখা ঘোরে, ওর চুল ওড়ে, শুধু ইন্টারনেট ল্যাগের জন্য ও ফ্রিজ হয়ে যায়। তারপর যখন বলি চুল উড়ছে কিন্তু, ও হেসে লুটিয়ে পড়ে। বুঝি, এটা ওর খেলা। ম্যামকে একটু বোকা বানানো। খানিক এই খেলা খেলতে দিয়ে, আমায় ধরে ফেলতে হয়। কিন্তু আমাদের মাননীয় ভগবানেরা যে খেলা শুরু করেছেন তার ইতি ঘটছে না! ঘুম আর ভাঙছেইনা!হাজার চিৎকার, ট্রেনে কাটা পড়া লাশ, প্ল্যাটফর্মে মায়ের মৃতদেহ আগলে বসে থাকা শিশুমুখ, পবিত্র গঙ্গার গা-লেগে বালি চাপা সার সার দেহ- নাহ্! ঘুম ভাঙে না।
টিভি স্ক্রিন জুড়ে ধোপ দুরস্ত পাঞ্জাবির উদয়। মুখে মাস্ক। ফাঁকা ঘরে মুখে মাস্ক। অথচ উড়ে উড়ে নির্বাচনী প্রচার। মাস্ক উধাও। ম্যাজিক! গনতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এসব এখন সেন্ট্রাল ভিস্তার লাগোয়া কোল্ডস্টোরে কিঞ্চিত ন্যাজাল টোনে আট বছর আগের একদিন শোনাচ্ছে একে অপরকে। আমরা যারা এখনো বেঁচে আছি তারা স্বীকার করে নিতে চাইছি; যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা। কিন্তু তারপরেও ঘাড়ে ওপর কীসের নিশ্বাস এসে পড়ছে। গন্ধ চেনা লাগল?! আমারই চেনা, কখনবা অল্প চেনা, অচেনা- তবুও বুঝতে পারি এ আমাদেরই বর্তমান ভবিষ্যত অতীত। আমরা চেয়ে আছি সবাই একে অন্যের দিকে। বিড়বিড় করে আউড়েনি। যারা ঘুমোচ্ছে এবং ক্রমাগত ঘুমের ভান করে চলেছে এদের চিনে নেওয়ার সময় এসেছে। সব মনে রাখা হবে।


অতিমারী। লকডাউন। পুঁজিবাদ। মৃত্যুমিছিল। কাজ হারা মানুষ। বিত্তহীন থেকে সম্পূর্ণ মুছে যাওয়া শ্রেণী। চরম অর্থবৈষম্য। কৃষক আন্দোলন। ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থা। কৃষিবিল। বন্ধ স্কুল। ধর্মীয় সন্ত্রাস। আত্মনির্ভর ভারত।
হাওড়ার বাজে শিবপুর অঞ্চলের গতবছর অতিমারী, লকডাউন এবং আম্ফান এই তিন বিপর্যয়ের মাঝেই শুরু করা হয পি এম বস্তি কমিউনিটি কিচেন। মানুষের স্বার্থে মানুষেরাই চালু করেছিলেন। হাওড়ার প্রিয়নাথ মান্না বস্তি, চড়া বস্তির মানুষেরা যেমন ছিলেন তার সাথে যুক্ত তেমনি যুক্ত হন বিভিন্ন প্রান্তে থাকা চেনা-অচেনা বন্ধু।
কিচেনে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ বিনামূল্যে খাবার পাচ্ছিলেন। লঙ্গরখানায় যেমনটা হয়। কিন্তু মানুষের প্রয়োজনে এই ব্যবস্থাকে দীর্ঘমেয়াদী রূপ দিতে ‘কিচেন’কে “ক্যান্টিন” করা হয়। আমরা ক্রমেই ৩৫০ দিন অতিক্রম করে এসেছি। বারবার এই ক্যান্টিন চালাতে জয়রাজ, অর্ক, শ্রাবন্তী, মধুরিমা, সান্দ্রা, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, বর্ণ অনন্য, তিতুমীর কালেক্টিভ ও আরো শিল্পী বন্ধুরা অনলাইন-অফলাইন কনসার্ট করেছে। অর্থ তুলে এনেছে। এই ক্যান্টিনের সাথে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সংযোগ নেই। কোনো রাজনৈতিক দলের অর্থে এই কাজ চলেনা।


“বাঁচার জন্য নাচা” এইরকমই একটি ফান্ড রেজার কনসার্ট হিসেবেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। হচ্ছে। “বাঁচার জন্য নাচা” প্রথম কনসার্ট হয় অফলাইনে। ৪ এপ্রিল, ২০২১ সন্ধ্যা ৬.৩০টায়, গোলপার্কের ফার্স্ট ফ্লাশ কাফেতে। কোভিড পরিস্থিতি মাথায় রেখে অল্প দর্শক আসনের ব্যবস্থা রাখা স্থির হয়। এরপরের “বাঁচার জন্য নাচা” আরো দু’বার অনুষ্ঠিত হয়েছে অনলাইনে, কোভিড পরিস্থিতির কারণে। আয়োজকরা জানিয়েছেন দর্শকদের মধ্যে এই কনসার্ট নিয়ে সাড়া বাড়ছে। উত্তরোত্তর দর্শক সংখ্যা বাড়ছে। শেষবারের কনসার্টে দর্শক হিসেবে তারা পেয়েছিলেন বর্ধমানের বেশ কিছু পড়ুয়াদের, যা উদ্যোক্তাদের উৎসাহ আরো বাড়িয়ে তোলে। এই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান শ্রাবন্তী ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, “আজ অব্দি কনসার্ট করে আমরা যাবতীয় যা অর্থ সংগ্রহ করছি তা ২০২০ সালে লকডাউনে কিচেন, আম্ফান রিলিফ, শ্রমজীবী ক্যান্টিন, ইয়াশ রিলিফের তহবিলে সরাসরি দিয়ে দিচ্ছি। বিনিময়ে ক্যান্টিনের অশোক দা, দাদু আর শিলাদির হাতের তৈরি যত্নে রাধা টেস্টি খাবার পাচ্ছি। আপনাদের বিশ্বাস, ভালোবাসা, এই কঠিন সময়ে বেঁচে থাকার রসদ ও নতুন কাজ করার উদ্যোম পাচ্ছি ” এই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, সহনাগরিক হিসেবে একে অন্যের পাশে দাঁড়ানোকেই এই মুহূর্তে প্রাথমিক কাজ হিসেবে দেখছেন তারা।