উত্তরবঙ্গের লোকক্রীড়ায় ব্যবহৃত ছড়া

ড. মো. এরশাদুল হক :
বাংলা লোকসাহিত্যের প্রাচীন ও হৃদয়স্পর্শী শাখা হলো ছড়া। মৌখিক উপাদানের মধ্যে ছড়ার উৎপত্তি ও ব্যবহার বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রাচীনকালের মানুষ বাঁচার তাগিদে দেবতা কল্পনার মধ্য দিয়ে যে ছন্দ ও সুর ব্যবহারে অঞ্জলি নিবেদন করতো, কালের বিবর্তন ধারায় তাই ছড়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের অভিজ্ঞতা ও চেতনার বিকাশ ঘটেছে। সেই সঙ্গে ছড়ার বিষয়, ভাষা, সুর ও ছন্দের পরিবর্তন ঘটেছে। অবশ্য কল্পনা প্রবণ ব্যক্তিই সৃষ্টি ব্যাকুলতায় ছন্দ মিলের মধ্য দিয়ে ছড়া রচনা করে। কেননা ছড়ার মধ্যে সুসংহত ভাব প্রকাশের কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না। তাই ছড়া রচিয়তা পারিবারিক ও সামাজিক অসঙ্গতির চিন্তা মাথায় রেখে ছন্দোবদ্ধ পদ রচনা করে। ভৌগোলিক পরিমণ্ডলের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের ভাষার, জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে সাযুজ্য বজায় রেখে ছড়ার রূপান্তর লক্ষ করা যায়। এই রূপান্তর দেখা যায় কখনো পদের পরিবর্তনে কখনো বা পঙক্তির পরিবর্তনে আবার কখনো বা আঞ্চলিকতার প্রভাবে। এ প্রবন্ধে অঞ্চল বিশেষে লোকক্রীড়ায় ব্যবহৃত ছড়ার বহুমাত্রিকতা তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রয়াস রয়েছে।
১.ক্রীড়া জীবমাত্রেরই সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ, প্রকৃতি ও প্রাণীর সহাবস্থানে পৃথিবীতে আদিম ক্রীড়ার সূত্রপাত। ক্রীড়া নামক যে কসরৎ ও দৈহিক অনুশীলন পাওয়া যায় তার উৎসমূলে খাদ্য ও যুদ্ধই অন্যতম। প্লেটোর মতে, খেলাধুলার সূচনা হয়েছে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি ও প্রয়োজন থেকে। আধুনিক খেলাধুলা প্রাচীন দৈহিক কসরৎ ও অনুশীলনের মার্জিত রূপমাত্র। সমাজ বিকাশের বিভিন্ন স্তরে নৃত্য, গীত, ছন্দ, ছড়া প্রভৃতি কলা-সৌন্দর্যের যে ব্যঞ্জনা আছে সেসবের মূলে রয়েছে ক্রীড়া। এভাবে ক্রীড়া যুগে যুগে নানা কৌণিকে প্রদর্শনমূলক মানব সংস্কৃতির অভিজ্ঞানরূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। লোকক্রীড়া নিয়ে যৎসামান্য আলোচনা হলেও উত্তরবঙ্গের লোকক্রীড়ায় ব্যবহৃত ছড়া নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এ বিষয়ে প্রবন্ধ রচনায় ওয়াকিল আহমদ এর বাংলার লোক-সংস্কৃতি, আশুতোষ ভট্টাচার্যের বাংলার লোকসাহিত্য, মুহম্মদ হাবিবুল্লাহ পাঠান এর নরসিংদীর লৌকিক খেলাধুলা, বরুণকুমার চক্রবর্তীর বাঙলার লোকক্রীড়া, অসীম দাসের বাংলার লৌকিক ক্রীড়ার সামাজিক উৎস, আশরাফ সিদ্দিকীর লোক-সাহিত্য (প্রথম খণ্ড), এবং পল্লব সেনগুপ্তের লোকসংস্কৃতির সীমানা ও স্বরূপ প্রভৃতি গ্রন্থের সহায়তা নেয়া হয়েছে। সমীক্ষিত এলাকা থেকে প্রাপ্ত ছড়াগুলো গুরুত্বের সাথে বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপস্থাপন করাই এ প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য।
২. এ প্রবন্ধ রচনায় প্রাথমিক উৎস হিসেবে ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং সেকেন্ডারি উৎস হিসেবে বিভিন্ন গ্রন্থ, পত্র-পত্রিকা ব্যবহৃত হয়েছে। তবে ক্ষেত্রসমীক্ষার উপর বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সমীক্ষিত এলাকা থেকে সংগৃহীত তথ্য আঞ্চলিক মান বজায় রেখে প্রবন্ধে সন্নিবেশিত হয়েছে।৩.গবেষণা এলাকা হিসেবে উত্তরবঙ্গ নির্বাচন করা হয়েছে। উত্তরবঙ্গের ব্যাপ্তি ব্যাপক ও বিস্তৃত হলেও এ প্রবন্ধে উত্তরবঙ্গ বলতে কুড়িগ্রাম জেলাকে নির্বাচন করা হয়েছে।
৪.প্রত্যেক জাতির রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য। আর এই বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্যকে তারা যুগ যুগ ধরে ধারণ ও বহন করে চলছে বিভিন্নভাবে। যার প্রকাশ হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, নিত্যদিনের ভালোলাগা-মন্দলাগায় বিভিন্ন ভঙ্গিতে মিশ্রিত। এই পটভূমিতে লোকসমাজ উপযোগিতা ও উদ্দেশ্যের দিক থেকে লোকক্রীড়াকে বেছে নিয়েছে তাদের আনন্দ-বেদনা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যমহিসেবে। এ প্রবন্ধে সমীক্ষিত এলাকায় লোকক্রীড়ার নাম উল্লেখপূর্বক ব্যবহৃত ছড়াগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।
৫.ফুলোনো উত্তরবঙ্গ তথা কুড়িগ্রাম জেলার গ্রামীণ মেয়েদের অতি জনপ্রিয় একটি লোকক্রীড়া। এ খেলার বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। যেমন বড় ফুলোনো, ছোট ফুলোনো, পাঁচগুটির ফুলোনো। এ খেলার মূল উপকরণ হলো ছোট ছোট পাথর, ইটের ছোট টুকরা কিংবা কোন ফলের বীজ (কাঁঠাল, জলপাই)। খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৩ থেকে ৫ জন। মেয়েরা গোল হয়ে বসে একের এক খেলতে থাকে। অর্থাৎ খেলোয়াড়ের হাত থেকে গুটি চ্যুত হয়ে মাটিতে পড়লে সে মরা এরপর পরবর্তী খেলোয়াড় আবার খেলা শুরু করে। এভাবে শেষ খেলোয়াড় পর্যন্ত পোঁছে। খেলা চলাকলীন খেলোয়াড়রা মুখে আবৃত্তি করতে থাকেফুলোনো ফুলোনো ফুলোনোটিএকে দো ফুলোনোটিসুরে শাম সুরে শামসুরে শামটিএকে দো সুরি শামটিকদম কদম কদমটিবকুল বকুলএকে দো বকুলটিতারি ঝাম তারি ঝামতারি ঝামটিএকে দো ঝাপএভাবে ছড়া আবৃত্তি শেষে থুক্কুু বলে মুখ বন্ধ করে। পরবর্তীতে মুখ খুলে আবার আবৃত্তি করেহায় হাচ্ছা বাঘের বাচ্চাহায় হাচ্চা বাঘের বাচ্চাহায় হাচ্চাটি লায়লন ভুরিপেনটিলাল টুকাটুক সোনার বাটিলাল টুকাটুক টিলাল টুকাটুক লাল টুকাটুকলাল টুকাটুক টিএকে গুটি বদল সেরে কাঞ্চন এক্কামেঘে দিও ধাক্কা ছকে এক্কাসাতে শালুক নাচে আটে বান্ধা গুটিনয়ে নব জোড়াদুই দশে করলো জোড়াএগারো এক কোটি বারো বিয়ের কোটতেরো কেটি কাটা চৌদ্দে পানের বোটাপনের পান খায় ষোল গান গায়সতের ইঞ্চি আঠার কিঞ্চিউনিশে লাখ বিশে ঝাকছোট ফুলোনো খেলায় খেলুড়ি যখন গুটি চালে তখন মুখে বলতে থাকেফুলোনো ফুলোনো ফুলোনোটিএকতে দুলোনোটি তেলোনোটিরিটি রুটি পিটাটি লঙ বচ এলাচিঝাম কাঁঠালে নারিকেলটিএকটি পয়সার কলাদুটি পয়সার মলা ধাপ্পু দিয়ে তোলা।গোসর মোসর দারগা দোসরতিন তেলিয়া মেলোরিয়াবোল্লার চাক হাত থাক।এর মধ্যে যে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারে সে-ই হয় জয়ী।
৬.কিত কিত খেলা বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে। এর মধ্যে বিশেষ করে ছয় বা আট ঘরের কিত কিত উত্তরবঙ্গে বেশ জনপ্রিয়। এ খেলার জন্য প্রথমে মাটিতে ছক কেটে ৯ টি বর্গাকৃতির ঘর কাটা হয়। ঘরগুলোর কেন্দ্রবর্তী ঘর হলো বড় ঘর বা মক্কাঘর। গুটি বা খোলা চালার মাধ্যমে খেলোয়াড়কে নির্বাচন করা হয়। প্রত্যেক খেলোয়ারের একটি করে গুটি বা খোলা থাকে। প্রথম খেলোয়াড় প্রথম ঘরে তার গুটি রাখে। এরপর এক পা দিয়ে কিত কিত বলতে বলতে নিঃশ্বাস না ছেড়ে সকল ঘর প্রদক্ষিণ করে বড় ঘর বা মক্কা ঘরে গিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়ে। বড় ঘর থেকে তার গুটি ছুড়ে দেয়। গুটি যতদূরে গিয়ে পড়বে এক লাফ দিয়ে সেই গুটিকে ছুতে হয়। খেলোয়াড় ঘর প্রদক্ষিণ করার সময় মুখে আবৃত্তি করতে থাকেকিত কিত রায়মধু পুরে যায়কোন দেশে মধু আছেবলে দেরে ভাই।।
ছড়া আবৃত্তি করার সময় যদি নিঃশ্বাস না থাকে কিংবা দাগে পা পড়ে তবে সে মর হবে। অর্থাৎ অন্য খেলোয়াড় তখন খেলা শুরু করবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে খেলা চলতে থাকে। এ খেলায় খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৫-৬ জন হয়ে থাকে। মেয়েরাই এ খেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে।
৭. বউছি খেলার পোশাকি নাম বৌ-বাসন্তী। দু পক্ষের প্রতিযোগিতামূলক এ খেলায় সামাজিক ঘটনার প্রতিফলন ঘটে। একদল বউয়ের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত, অপরপক্ষ অপহরণের সুযোগ সন্ধানে রত। ছি দিয়ে শত্রুকে তাড়া করা হয়। ছি দেয়ার সময় খেলোয়াড় মুখে বলতে থাকে এক ছি দুই ছি মরীচের বিচি মরিচ কান্দে হায় হায় করি।। অথবা খেজুর পাতা দাড়ি পাল্লা নদীর পানি টলমলা খোড়া মোর এক ঠ্যাং ন্যাল ন্যালা।।ছড়া আবৃত্তির সময় সুযোগ বুঝে বউ বন্দীবৃত্ত থেকে নিরাপদ দুর্গে চলে আসে। এতে দলের এক পয়েন্ট যুক্ত হয়। প্রতিপক্ষ পথে বউকে ছুঁয়ে দিলে পুরো দল দান হারায়। তখন তারা নতুন করে খেলা শুরু করে।
৮. হাইস্ক্রিম খেলা মেয়েদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। একাধিক খেলোয়াড়ের অংশগ্রহণে এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ খেলায় একজন চোর বা চুন্নি নির্ধারিত হয় এবং অন্য খেলোয়াড়রা চোর বা চুন্নির পিঠের উপর লাফ দিয়ে পার হয়। পার হওয়ার সময় যদি চোর বা চুন্নির পিঠে পা লাগে তাহলে পরবর্তীকালে সে চোর নির্ধারিত হয়। চোর বা চুন্নির পিঠ দিয়ে লাফ দেওয়ার সময় খেলোয়াড় নিম্নোক্ত ছড়াগুলো আবৃত্তি করে থাকে। যেমন হাইস্ক্রিম ক্লাস থ্রী এক থালা বল্টু ডবল ডবল বল্টু হাপলা মায়ের শাপলা কথা কিত কিত থা।
উদ্ধৃত ছড়া বলা পর খেলোয়াড় পুনরায় বলেআলু ভাজা খাইতে মজা আমের পাতা ঝলমল করে পশ্চিম দিকে বেলা ডুবে বাঁশের পাতা ঝিলমিল করে পূর্ব দিকে বেলা উঠে ভাবীর টাঁই আয়না দ্যাখতো মা দেয়না কলার গাছত গামছা দ্যাখব আমি তামশা মাগুর মাছের দাঁড়ি পাল্লা এক ঠ্যাং মোর ন্যাল ন্যালা।।
৯.মাটিতে চার কোণাকৃতির ছক কেটে ডাব্বা ডাব্বা খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ খেলায় খেলোয়াড়ের সংখ্যা পাঁচজন। চারকোণায় চারজন দাঁড়িয়ে থাকে এবং অন্যজন তথা বুড়ি ঘরের মধ্যখানে থাকে। প্রতি কোণের খেলোয়াড় বুড়িকে প্রদক্ষিণ করে বলতে থাকে ছিকিয়ের মধ্যে দুধের বাটিখাও তো মামা চাটি চাটিনাচনি বড়ি নাচিয়ে যাওভাল করিয়ে নাচিয়ে যাওহাসনা একটা বাজনা দাওসুরি একটা বিড়ি দাও।
১০.বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় খেলা ঢেক্কি ঢেক্কি। ছেলেরাই এ খেলায় অংশগ্রহণ করে। এখানে খেলোয়াড়ের সংখ্যা তিনজন। একজন খেলোয়াড়কে চিত করে অপর দুই খেলোয়াড় প্রথম খেলোয়াড়ের দুই পা হাত দিয়ে ধরে এবং পিঠে থাপ্পর মেড়ে জিজ্ঞাসা করে ঢেক্কি রে ঢেক্কিক্যান রে ঢেক্কি?ভাত খাছিস কিদি?হরিণের গোস্তপ্যাট ক্যানে ভরে নাই?মাইয়া শালী ভাত দেয় নাই।একথা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায়, লোকক্রীড়ায় ব্যবহৃত ছড়া এ অঞ্চলের শিশুমনের আবেগ ও সৌন্দর্যবোধের প্রতিচ্ছবি। লোকক্রীড়ায় ব্যবহৃত ছড়া আবৃত্তি করে শিশুরা আস্বাদন করেছে এর চিরন্তন রস, যা বেছে নিয়েছে চিত্তবিনোদনের অন্যতম মাধ্যম রূপে। খেলায় ব্যবহৃত ছড়ার ভাষাগুলো একান্তই আদিবাসি উত্তর সংহত লোকের অঞ্চল বিশেষের ভাষা। এর মধ্যে নেই কোনো বক্রতা কিংবা জটিলতা। বরং খেলতে গিয়ে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবহার করেছে এসব ছড়া।
ড. মোঃ এরশাদুল হক : শিক্ষক,লোকসংস্কৃতি গবেষক ও প্রাবন্ধিক।