ফিরে দেখা আফগানিস্তান, পর্ব-১

সংগ্রাম চক্রবর্তী
“আফগানিস্থান”- নাম টি শুনলেই মানস পটে ভেসে ওঠে ফিওদর বন্দারচুকের “নাইথ কোম্পানী” সিনেমার একটি দৃশ্য।তাসখেন্দ থেকে বাগরামে আগত সোভিয়েত ইল ৭৬ বিমানের পেটের তলা খুলে যায় ও নবাগত সৈন্যদের ঘুম ভাঙে এম.আই ১৭ সুপার হিন্দের রোটারের আওয়াজে।কুকুরের ডাক, ভারী বুটের আওয়াজ, একাধিক পেট্রল হেলিকপ্টার মিলে দৃশ্যপট কে আরো ভারী করে তোলে। খোস্তে হিল ৩২৩৪ দখলের লড়াই নিয়ে এই সিনেমা নির্মিত যেখানে ৩৯ জন(কোম্পানী) সোভিয়েত সৈন্য ২০০ উপর মুজাহিদিন ও পাকিস্থান স্পেশাল ফোর্স “ব্লাক স্ট্রোক” বাহিনীর আক্রমণ মোকাবিলা করে পোস্টের দখল ধরে রাখে।
আফগানিস্তান বলতে আবার অনেকেরই স্মরণে আসবে ২৭৮ টা মারামারি তাতে মোট ১০৮ জনের মৃত্যু নিয়ে মোস্ট ভায়োলেন্স ক্যাটাগরীতে নাম তোলা র্যাম্বো ৩ সিনেমার না না দৃশ্য যেখানে প্রকাশ্যেই দেখান হয়েছে আফগানিস্তানে সি.আই.এ কিভাবে র্যাম্বো পৌঁছে দেয় সোভিয়েতের সাথে লড়তে।আর এই লড়াই ভেতর খুব কম জনই স্মরণ করবে কাবুলীওয়ালা সিনেমার সেই স্নেহপরশীল উদার ইমানদার ছবি বিশ্বাস কে।কারণ আফঘানিস্থান কে ঘিরে একটার পর একটা ভার্সান নির্মাণ হয়েছে অর্ধ শতক জুড়ে, সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় আফঘানিস্থানের মাটি ইতিহাসের স্বর্ণখনি কিন্তু আফগানরা গরীব, তারা ইতিহাসের আবিস্কারের জন্যে নয়, কয়লা পাওয়ার আশায় মাটি খোড়ে।
ডিওডোরাস বা মিলিন্দের চরণ ধুলির খোঁজ এই প্রবন্ধে সম্ভব নয়, আমরা বরং সেই মহান কবি ও যোদ্ধা বাদশা বাবরের কবর জিয়ারাত করে মিডিয়া ও মিথ্যার সেই ভার্সান গুলো কে খন্ডন করে, একদিকে মধ্য এশীয়া ও অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগরের নাট্যমঞ্চের দিকে তাকাই সেই বাবর বাদশার মতই।
আফঘানিস্তান রাস্ট্রের স্থাপন হয় ১৭৪৭ সালে আহমেদ শাহ দুরানীর হাত ধরে যার অন্তর্গত ছিল পাকতুনিস্তান, পাঞ্জাব, বেলুচিস্থান, কাশ্মীর. পরবর্তীকালে শিখ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে সে অনেক এলাকা হারায় আপনারা আজকের ম্যাপ দেখলেই বুঝতে পারবেন।বিশেষ করে দ্বিতীয় আফঘান যুদ্ধের পর ১৮৯৩ ডুরান্ড লাইন কে অবশ্যই বিবেচনায় রাখবেন।এরপর হবিবুল্লা ও আমানুল্লা পেরিয়ে আফঘানিস্তানের শেষ রাজা
জাহির শাহ যিনি তারই প্রধানমন্ত্রী দাউদ খানের দ্বারা ক্যু তে ১৯৭৩ সালে ক্ষমতাচ্যুত হন।আর এরপর থেকেই খোকী ও তার বন্ধু কাবুলীওয়ালারা হারিয়ে গিয়ে রঙ্গমঞ্চে নতুন কূশীলবরা নতুন নতুন সংলাপ নিয়ে হাজির হয়।১৯ শতকের মতই যুযুধান দুই সাম্রাজ্য আবারও আফঘান ভূমিকে ছায়াযুদ্ধ্বের কেন্দ্রে পরিণত করে।
আফগানিস্তানে আধুনিকতার জন্যে দরজা খোলে ১৯৫৩ সালে, যখন জাহির শাহ তার সবথেকে বিশ্বস্ত জেনারেল দাউদ খান কে নিজের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দিন, আধুনিক শিক্ষা, প্রযুক্তি, শিল্পকলা ও সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণের জন্যে কাবুল মুলত তিনটে দেশের দিকে তাকায়- আমেরিকা,ফ্রান্স
,সোভিয়েত ইউনিয়ান।এর বাইরেও খুব অল্প সংখ্যক সংযোগ স্থাপন হয় আব্দুল গামের নাসেরের মিশরের সাথে।নাসেরের তীব্র সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা ও পার্সোনালিটি কাল্ট পলিটিক্স দাউদ খান কে আকৃষ্ট করে। কিন্তু শাহের নিয়ম বিধিনিষেধে তার হাত বাধা। ফলে ১৯৬৮ পর থেকেই দাউদ খান ও জাহির শাহের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে নতুন যে আফঘান সমাজ গড়ে ওঠে উদার গণতান্ত্রিক চেতনার পাশাপাশি মার্ক্সীয় চিন্তা চেতনাও বাসা বাধে তাতে। কিন্তু শহর গুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নতুন সমাজের টেকনোক্রাট ও আমলারা মুলত পশ্চিমা বিশ্বের শিক্ষায় শিক্ষিত ও অনুগত, আবার আফগান সামরিক বাহিনী সোভিয়েত শিক্ষায় শিক্ষিত ও মার্ক্সীয় চেতনায় উদ্বুধ। কাবুল জোট নিরপেক্ষ বিদেশ নীতি বজায় রাখলেও স্বাভাবিক কারণেই আমেরিকার তুলনায় সোভিয়েতের সাহায্যের উপর অনেক বেশী নির্ভরশীল ছিল। ১৯৭৩ কাবুলে রাজতন্ত্রের পতন হলে বামপন্থী মহলে তার উপাধি হয় “রেড প্রিন্স” এবং এই বিপ্লবে কেজিবির উপস্থিতির কথাও শোনা যায়।বামপন্থীদের মধ্যে তুলনায় নরমপন্থী অংশ, পর্চমের অনেকেই দাউদের মন্ত্রীসভায় ঠাঁই পায়।
কিন্ত ততদিনে মস্কো ততদিনে বিশ্বে বিপ্লবের ফর্মুলা বানিয়ে ফেলেছে একদম রুশ বিপ্লবের ছকে, আর এক্ষেত্রে কাবুলের রাজনৈতিক ঘটনাক্রম একদম ছক মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে যে প্রথমে গণতান্ত্রিক বিপ্লবে রাজতন্ত্রের পতন ও তারপর এসে বলশেভিক বিপ্লব অর্থাৎ সুর রেভোলিউশান, ১৯৭৮ এপ্রিলে এসে বসন্তের বর্জ্র নির্ঘোষ শোনা গেল নুর মহম্মদ তারাকি ও শাহনাওয়াজ টানাই এর কন্ঠে।অচিরেই সেই আওয়াজে আকৃষ্ট হলেন লাহোর ও ওয়াশিংটনের শকুনেরা– শুরু হল অন্তহীন যুদ্ধ ও মিথ্যার নির্মাণ.
প্রথম মিথ্যা হল “আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধ” এবং প্রচলিত ধারণা যে আমেরিকার সাহায্যে মুজাহিদিনদের হাতে সোভিয়েত বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয়ের ফলেই সোভিয়েত ইউনিয়ান ভেঙে যায়। কিন্তু সোভিয়েত সেনা আফগানিস্তানে পৌঁছায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃত আফগান সরকারের আমন্ত্রণে, তাও ১২ বার এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার পর শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ ডিসেম্বরে পলিটব্যুরো এই ইস্যু তে সম্মতি দেয়।অথচ হাফিজুল্লা আমিন ১৯৭৮ মে মাস থেকেই ক্রমাগত অনুরোধ করে গেছে সেনা পাঠানর।আর ১৯৭৮ জুলাই মাসে জিমি কার্টার মুজাহিদিনদের বছরে ৫০ মিলিয়ন অর্থ সাহায্য (অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ আলাদা)ড্য দেওয়ার গোপন নির্দেশ দেয় সি.আই.এ কে.. এই সংস্থার প্রাক্তন ডিরেক্টর রবার্ট গেটসের ভাষায় -“আমাদের উদ্দ্যেশ ছিল আফগানিস্থানে এমন একটা ফাদ নির্মাণ করা যাতে সোভিয়েত এসে আটকে যায়, আর আমরা ভিয়েতনামের প্রতিশোধ নিতে পারি”
এই ফাঁদেরই আরেকটি সুতোয় টান দেয় নতুন নির্বাচিত কনার্জেটিভ প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন এসে।সোভিয়েতের প্রতি বছর আফগানিস্তানে খরচ হত ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার যা সোভিয়েত রাষ্ট্রের কাছে ৭৯ কিছুই না, কারণ তেলের দর ছিল সমকালীন সময়ের সর্বোচ্চ, কিন্তু ৮০ নভেম্বরের পর থেকেই তেলে দর ক্রমশ পড়তে থাকে যখন সৌদি আরব ব্যাপক তেল উৎপাদন করে বাজার ভাসিয়ে দেয়, এটা চলে ৮৬ শেষ পর্যন্ত. কিন্তু এই ক্ষতি সামলানও সম্ভব হত যদি না আরেক সি.আই.এ এজেন্ট (ব্যক্তিগত মত) গর্বাচেভ তার এলকোহল বিরোধী যুদ্ধ শুরু না করত, কারণ শুধুমাত্র সোভিয়েতের আভ্যন্তরীণ বাজারেই ভদকা বেচে এই টাকা অনায়াসে উঠে আসত।
সামরিক দৃস্টিকোণ থেকেও যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলেও দেখব এই গোটা পর্বে শহর দুরে থাক বরং একটাও সোভিয়েত পোস্টেরও দখল নিতে পারে নি মুজাহিদিনরা, বরং ১৯৮৫ পর মুজাহিদিনদের অবস্থা এমন হয়ে ওঠে যে তাদের দেওয়ালে পীঠ ঠেকে যায়।সোভিয়েত ৪০ তম আর্মির কম্যান্ডার বরিস গ্রোমভের মতে এটা ছিল একটা নীচু স্তরের সংঘর্ষ যেখানে আমরা লড়ছিলাম গেরিলাদের অনিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যেখানে কোন পক্ষ্যেই নির্ণায়ক জয় বা পরাজয় সম্ভব নয়।
এমন কি যুদ্ধে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ৪০ তম আর্মির সেনা সংখ্যা ছিল ১০৮০০, অন্যদিকে আফগানিস্তান থেকে আকারে অনেক ছোট ভিয়েতনামে আমেরিকান সেনা ছিল এর পাচগুণ। এমন কি ন্যাটো অপারেশন ২০০৯-১০সালে ২৫০০০০ অধিক সেনা ব্যবহার করতে হয়, ১৯৮৮ সালে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মাঝে শান্তিচুক্তি সাক্ষরিত হয় যার গ্যারান্টার ছিল আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ান এবং ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারী তে সোভিয়েত সেনা সরে আসার পরও দুবছর পর্যন্ত নাজিবুল্লা সরকার টিকে ছিল ,পতন হয়নি আশরাফ ঘানির মত। কিন্তু তারপরেও সোভিয়েতের উপস্থিতি তে আমেরিকার হাতে যে প্যান্ডোরার বক্স খুলে যায় তার থেকে একে একে গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ার থেকে শুরু করে ইসলাম খান, রশিদ দস্তুমরা বেরোতে থাকে। প্রাক্তন সোভিয়েত প্রধান আন্দ্রোপভের ভাষায় “আমরা এটা করতে চাই না, কিন্তু এটা আমাদের করতেই হবে”
দ্বিতীয় মিথ্যা -অপারেশন এন্ডিওরিং ফ্রীডম। মানব ইতিহাসে বিশ্বের সবচেয়ে ঘৃণীত, বর্বর ও মানবতাবিরোধী শক্তি হল অ্যাংলো স্যাক্সন সাম্রাজ্যবাদ। যে ব্রিটিশ একদা সভ্যতা শেখানোর জন্যে আফ্রিকা ও এশীয়া ও আমেরিকায় গণহত্যা চালিয়েছে, তাদেরই উত্তরসূরী এই মার্কিনীরা দেশে দেশে গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে গনহত্যা চালাচ্ছে।আর তারই আরেক টি নাম হল “সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ”।৯/১১ হামলাকারীদের কোন পাসপোর্ট পাওয়া গেছে যেখানে প্রমাণ হয়েছে তারা আফগান নাগরিক..? হামলাকারীদের সাথে তৎকালীন কাবুল সরকারের কোন যোগাযোগ পাওয়া গেছে..? উভয় প্রশ্নেরই উত্তর হল “না” ..তবু এই অজুহাতে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ শুরু হল কোথায় -আফগানিস্তানে।আর এর সহযোগী হল কে,গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ার, যুদ্ধবাজ এই পাখতুন নেতা ১৯৯২ সালে নতুন সরকারে ক্ষমতার ভাগ না পেয়ে কাবুল অবরোধ করে ও রকেট হামলা চালায় যাতে বহু অসামরিক নাগরিক প্রাণ হারায়।১৯৯৬ সালে তালিবান আসার আগ পর্যন্ত বিরতিহীন ভাবে এই হামলা চলে।উজবেক নেতা আব্দুল রশিদ দস্তুম যিনি একদা ছিলেন নাজিবুল্লা সরকারের নির্ভরযোগ্য জেনারেল ও আমেরিকার ভাষায় “যুদ্ধাপরাধী”।ন্যাটো বাহিনীর যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা শিশু হত্যা কাহিনী না হয় নারী স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার কার্পেটে ঢেকে রাখলাম।আসলে মিথ্যা দিয়ে যার শুরু তার শেষ ল্যান্ডিং গীয়ার থেকে মাটি তে আছাড় খেয়ে পড়া।
আশ্রিত কে শত্রুর হাতে তুলে দেওয়া হারাম, উপজাতীয় প্রাচীন এই নীতিবোধ আজকের কর্পোরেট পূজি নির্ভর রাজনীতিকরা বুঝতে পারবে না, তাই তারা হাতড়ে বেড়াচ্ছেন যে তালিবানের এই বিজয় কে কিভাবে দেখবো..
সংগ্রাম চক্রবর্তী ঃ পেশায় কৃষক। কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে কৃষিকাজ করেন।
1 Comments
নাইন ইলেভেন, মাস ৯ তারিখ ১১। ২০০১খ্রিঃ ৯ সেপ্টেম্বর ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়দা আমেরিকার ভিরজিনিয়া রাজ্যের নিউইয়র্ক এর আমেরিকান ট্রেড সেন্টারে দুটি যাত্রিবাহী বিমান দিয়ে আত্মঘাতি আক্রমণ চালায়। সেদিনই স্পটেই মারা যান ১৯ জন ঘাতক ছাড়াও টুইন টাওয়ারে অবস্হিত ২৯৭৭ জন এবং মারাত্মক আহত হন ২৫ হাজার। প্রায় ১০ হাজার মানুষকে গুরুতর আহত অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হামলার পৌনে দুই ঘণ্টার মাথায় ধসে পড়ে টুইন টাওয়ার। ভবনটি ধসে পড়ার সময় ভেতরে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র ছয়জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা গিয়েছিল। বিমানটির ভেতরে থাকা ৬৪ জন যাত্রীর দেহাবশেষ এক মুঠ ছাইও পাওয়া যায়নি গঙ্গায় দেয়ার মতো। আটকে পড়া লোকজনকে উদ্ধার করতে গিয়ে ৩৪৩ জন দমকলকর্মী এবং ৬০ জন পুলিশ সদস্যও নিহত হন। ৪টি হামলায় সম্মিলিতভাবে ৭৮টি দেশের মানুষ নিহত হন। যাঁরা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন, তাঁদের জীবনে নাইন-ইলেভেন হয়ে আছে দগদগে ঘায়ের মতো। একদিনেই আমেরিকার আর্থিক ক্ষতি হয় ১০ বিলিয়ন ডলার।
এই হামলার পর থেকেই সন্ত্রাসবাদ দমনে আরও কঠোর হয় যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, এর সঙ্গে মার্কিন নাগরিকদের জীবনের মূল্য ও দেশের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত ছিল। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল। যুদ্ধকেই একমাত্র পথ বলে মনে করলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসন। এ বছরেই শুরু হয় মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের আফগানিস্তান আক্রমণ। লক্ষ্য ছিল আল-কায়েদা ও এর নেতা ওসামা বিন লাদেন এবং তাঁকে সমর্থন দেওয়া তালেবান সরকারকে শায়েস্তা করা। অথচ আফগানিস্তানের এই তালেবানদের দুধ কলা দিয়ে পুষে বড় করেছিল যুক্তরাষ্ট্রই। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবেই। সেই ঢোঁড়া সাপ পরে ফণা তুলে গোখরায় পরিণত হয়!
দীর্ঘ কুড়ি বছরের এই যুদ্ধে কে কি পেলো? সমস্ত দিনের শেষে এখন সময় এসেছে এর একটা হিসেব নিকেষতো করা যায়। ২০০১খ্রিঃ থেকে অদ্যাবধি ন্যাটো জোটের নিহত ৩৮০০ সৈনের ২৪০০ জনই আমেরিকান। আর তালেবানদের হাতে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে ৬৬ হাজার স্বদেশী আফগান সৈন্য এবং বাড়ীঘর ছেড়ে ইরানে পালিয়ে গেছে ২.৭ মিলিয়ন নিরিহ মানুষ। নাইন-ইলেভেনের হামলার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। প্রথম দিনেই নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে বড় ধস নামে। এক মাসেই চাকরি হারান ১ লাখ ৪৩ হাজার মানুষ। ধারণা করা হয়, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলায় আনুমানিক ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের ক্ষতি হয়েছিল। সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের প্রতিজ্ঞায় হাজার হাজার মার্কিন সেনাকে বিদেশের মাটিতে ঘাঁটি গাড়তে হয়। আফগানিস্তানের পর ২০০৩ সালে ইরাকে আক্রমণ চালাতে হয় যুক্তরাষ্ট্রকে। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার বলেছিলেন, ইরাকে যুদ্ধ না হলে আইএসের জন্ম হতো না। আল-কায়েদা সন্ত্রাসের সমার্থক শব্দে পরিণত হয় এই আইএস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালানো সন্ত্রাসী হামলার দায় স্বীকার করে আলোচনায় চলে আসে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি। নাইন-ইলেভেন-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। বেড়েছে প্রযুক্তিগত নজরদারি। নাইন-ইলেভেনের পর যুক্তরাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করতে হোয়েছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে বিভিন্ন গোয়েন্দা ও নজরদারি সংস্থায়। ২০১৭খ্রিঃ তালেবান গোষ্টি আফগানিস্হানে ৬৯৯টি সসস্ত্র আক্রমনে ৩,৫৭১টি হত্যাকান্ড ঘটায়। একই সময়ে এদের একটি পাকিস্হানি শাখা তেহরিকি তালিবান, পাকিস্হানে ৫৬ বার আক্রমন চালিয়ে ২৩৩জনকে হত্যা করে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে এরা আফগানিস্হানের ১১ ভাগে দখল প্রতিষ্ঠা করে এবং আরো ৩৯৮টি জেলা বা জনপদ নিয়ন্ত্রন করতে থাকে। এই তালেবান গোষ্ঠি আফগানিস্হানের ৭০ ভাগ এলাকার মানুষের জন্য আতংকের কারণ হোয়ে দাড়িয়েছিলো। গত বছর থেকে এরা এদের আক্রমন কৌশল বদল করে সাধারন নাগরিকদের পরিবর্তে মিলিটারি ও পুলিশকে টার্গেট করে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিলো। ২০১৬খ্রিঃ এরা পুলিশ ও মিলিটারি হত্যা করেছে ১,৭৮২ জন যা ২০১৭খ্রিঃ ছিলো ২,৪১৯ জন। একই সময়ে সিভিলিয়ান হত্যাকান্ডের সংখ্যা ছিলো ২০১৭খ্রিঃ ৩৮৬জন এবং ২০১৬খ্রিঃ ৩৬৯ জন। খানিকটা নিষ্ক্রিয় হলেও একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়নি আল-কায়েদা এবং আইএস। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, নামে-বেনামে ফের ফণা তুলতে পারে এসব সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্ক। কারণ, সন্ত্রাসবাদের সমূল উৎপাটনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নানা দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নানা স্বার্থ সমিকরণ। লক্ষ্য করুন ১৫ আগষ্ট থেকে গত কয়েক সপ্তাহে আফগানিস্হানে মৌলবাদের উত্থান ও ব্লাসফেমী আইনের উদ্ভব ঘটছে। আমেরিকার জনগণের ট্যাক্সের টাকা ব্যয় করে আফগানিস্হানে গণতন্ত্রের কবর রচিত হোয়েছে। আফগান ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পররাষ্ট্র নীতি স্বার্থপরতার নজির। এরই মধ্যে তালেবানরা বলতে শুরু কোরেছে, We have won the war, America has lost. সত্যিকার অর্থে কে জিতেজে কি হেরেছে এটি যদি সময়ের হাতে ছেড়ে দেই তারপরেও বাস্তবতা হলো পৃথিবীর বুকে সন্ত্রাসীদের একখন্ড ভূমি এবং একটি রাষ্ট্রের উদ্ভব হোয়েছে। সেটি হোতে পারে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীর উর্বর ভূমি। রেজাউল করিম মুকুল, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১খ্রিঃ। তথ্যসূত্রঃ Afghanistan: Biden says Afghans must decide their own future