ফিরে দেখা আফগানিস্তান, পর্ব-২

সংগ্রাম চক্রবর্তী
এখন প্রশ্ন হল তালিবানের বিজয় কে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করব..?এখন এই দেখা টাও মুলত নির্ভর করে আমরা কোন রাজনৈতিক আর্থসামাজিক স্রোতের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি তার উপর, আমাদের দেখার মাধ্যমগুলোর উপর।তবে এটা নি:সন্দেহে বলা যায় যে ১৯৮৯ তে সোভিয়েত ফৌজ হঠে যাওয়ার পরে কাশ্মীরে যে অস্থিরতা তৈরী হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি হবে না।এর কারণ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চুড়ান্ত সফল ও শক্তিশালী মোদীজীর ভারত সরকার নয়, এর মুল কারণ এবার মধ্যপ্রাচ্যে ও উত্তর আফ্রিকায় অনেক গুলো ক্ষেত্র ইতিমধ্যেই প্রস্তুত হয়ে আছে কর্মহীন মুজাহিদিনদের জন্যে।বিশেষ করে ইরাক ও সিরিয়া। কাশ্মীরের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কে ধ্বংস করতে, বিভ্রান্ত করতে যেমন লস্কর-ই- তৈবা ও জয়েশ-ই-মহম্মদ নির্মিত হয়েছিল সেই রকমই এবার ইরান কে চাপে রাখতে ইসলামিক স্টেট (খোরাসান), জাবাত-আল-নুসরা কে তৈরী করা আছে।পরমানু চুক্তির নতুন শর্ত যদি ইরান না মানে, গোলান হাইটসের থেকে যোদ্ধা না সরায় তাহলে আফগানিস্তানে সিরিয়ার পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পাব।আফগানিস্তানে জয় পরাজয় টা কোন ইস্যুই নয় মার্কিনীদের কাছে, আসল উদ্দ্যেশ হল দেশে দেশে অস্থিরতা তৈরী করে অস্ত্র বিক্রি করা, সেনা ঘাটি বানানো এবং এই সামরিক উপস্থিতির বলে নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থ কে সুরক্ষিত করা, আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে ইরান সহ গোটা পারস্য উপসাগর অঞ্চল, বিশেষত হরমুজ প্রণালী ও মধ্য এশিয়ার মার্কিন নিরন্ত্রণ স্থাপন করা।ইসলামিক স্টেট, আল কায়েদা, আল নুসরা, হায়াত-তাহরিক -ই-আল-শাম থেকে বোকো হারাম এগুলো আসলে সি.আই.এ এবং মোসাদেরই আরেক টি সংস্করণ। মার্কিন আধিপত্যবাদেরই আরেক টি বর্ধিত অংশ।মধ্যপ্রাচ্যে এই খেলা টা শুরু করে ইসলামিক স্টেটের নামে ২০১০ সালে মোক্তাদা আল সদর সমর্থিত ইরাকী সরকার ইরাক ছাড়ার জন্যে মার্কিন সরকার কে চাপ দেয় এবং ২০১৫ সালে আফঘানিস্তানের কুনার, জাবুল ও কুন্দুজে ইসলামিক স্টেটের সুচনা হয়।আমেরিকার এই কৌশলের গুরুত্ব বুঝেই ২০১৬ সালে রাশিয়ান চীন ইরান পাকিস্তান ও তালিবান মিলে এক জয়েন্ট কম্যান্ড গঠন করে আই.এস কে মোকাবিলার জন্যে.।তাই আজকে তালিবানের শপথ গ্রহণ অনুসঠানে রাশিয়া, চীন ইরানের আমন্ত্রণ পাওয়া কোন অসংলগ্ন ঘটনা নয় অন্তত ভারতীয় মিডিয়া যেভাবে দেখাতে চাইছে উজবেকিস্তান ইসলামিক ফ্রন্ট, তাজিক ইসলামিক জোট বা পূর্ব তুর্কিস্থান ইসলামিক পার্টির নামে গোটা মধ্য এশিয়ায় আমেরিকার এই খেলা টা খেলে আসছে সোভিয়েতের পতনের পর থেকে।দাগেস্তান ও চেচেনিয়ার কথা না হয় আমি বাদই রাখলাম।শেষমেশ ২০০৮ সালে উজবেকিস্তান থেকে আমেরিকা ঘাটি সরাতে বাধ্য হয় রাশিয়ান চাপে।এরই সমান্তরলে একটু বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আফঘান শান্তি আলোচনার পর্যায় ও ঘটনাক্রম কে বিশ্লেষণ করেন তাহলে দেখতে পাবেন বৃহত্তর এশীয়ো নাট্যমঞ্চের একটি অংশ মাত্র আফগানিস্তান।কাবুলে তালিবানের রাজনৈতিক বিজয় সুনিশ্চিত হয় ২০১০ সালে লন্ডন কনফারেন্সে এবং ২০১১ সালে ওবামার ভাষণে তালিবান কে একটি অপরিহার্য রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে স্বীকার করে নেওয়া হয় ২০১৬ সালের মধ্যেই সেনা সরানোর কথা বলা হয় শুধুমাত্র চারটে গ্যারিসন থাকবে কাবুল, কান্দাহার বাগরাম ও জালালাবাদে ট্রেনিং ও অন্যান টেকনিক্যাল সহায়তার জন্যে। কিন্তু তালিবান অনড় থাকে একজনও বিদেশী সৈন্য থাকা চলবে না এই শর্তে।২০১১ থেকে ২০১৬ এই পর্যায়ে শান্তি আলোচনার নামে তালিবান কে আমেরিকা নির্ধারিত মুল স্রোতে ফেরানর চেস্টা শুরু হয়।কিন্ত এর মুল উদ্দ্যেশ ছিল তালিবানের ভেতর ভাঙন ধরান, মোল্লা ওমর কে হাক্কানীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা, এই উদ্দ্যেশে তারা তেহরিক-ই-তালিবানও তৈরী করে পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চল (নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রদেশ, ওয়াজিরস্তান)বালুচিস্তানে অস্থিরতা তৈরী করে.।যাতে পাকিস্থানও আমেরিকার এই উদ্যোগে সামিল হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মার্কিন সরকারের বিবৃতিগুলোও এই আঙ্গিকেই পরিবেশিত হত।ঠিক এখানে যেমন দেখেন কৃষক আন্দোলন নিয়ে মোদী সরকার ও গদী মিডিয়ার খবর পরিবেশনে।তালিবান কে মুল স্রোতে (?) ফেরানর দ্বিতীয় আরেক টি কারণও ছিল যে আমেরিকা ততদিনে বুঝে গেছে যে আর যাইহোক “কুইসিলিং” সরকার কে দিয়ে আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, মার্কিন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ কে সেবা করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা কোন টিই তাদের নেই।হামিদ কারজাই ও আশরাফ ঘানি দুজনের কেউই কিন্তু আফগান নাগরিক নন, আমেরিকা থেকে আমদানী করা মার্কিন নাগরিক।”কুইসিলিং” সরকারের প্রতি অনাস্থা থেকেই আরেক টি রাজনৈতিক শক্তি তালিবানের সাথে আলোচনা শুরু করে প্রায় একই সময়ে , তিনি হলেন তাজিক নেতা ও আফগানিস্তানের প্রাক্তন রাস্ট্রপতি(১৯৯২-৯৬) বুরারুদ্দিন রব্বানী। আফগানিস্তানে ইসলামিক রাজনীতির অন্যতম স্থপতী তিনি এবং তারই জামাত ইসলাম দাউদ খানের সংস্কারের বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালে প্রথম বিদ্রোহ করে। কিন্ত এই উদ্যোগের প্রারম্ভেই এক আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে তাকে হত্যা করা হয় ২০১১ সালে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও কাবুলের তৎকালীন রাজনৈতিক টানাপোড়েন কে বিচার করলে সন্দেহের তীর অবশ্যই যায় মার্কিনীদের দিকেই।কারণ রব্বানী শান্তি আলোচনা শুরু করতে চাইছিলেন সরাসরি মোল্লা ওমরের সাথে।আর আমেরিকার(হামিদ কারজাই) শান্তি প্রক্রিয়া ছিল তালিবানের আলাদা আলাদা গোসঠীর সাথে পৃথক পৃথক ভাবে।এমন কি আফগানিস্তানে শান্তি স্থাপন ও পুনগঠন আমেরিকার উদ্দ্যেশ কখনই ছিল না বোঝা যায় ২০১৬ সালে তৎকালীন তালিবান প্রধান মনসুর আখতার বা মোল্লা মনসুর কে ড্রোন হামলায় হত্যার মধ্যে দিয়ে। আজ কে কাতারের রাজধানী দোহায় তালিবানের যে রাজনৈতিক অফিস তার সুচনা হয় মোল্লা মনসুরের হাত ধরে এবং তিনিই হিবাতুল্লা আখুনজাদা কে নিজের উত্তরসুরী মনোনীত করেন, তালিবানের বিভিন্ন স্তরের নেতা ও কম্যান্ডারদের শান্তি আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধাবসানের পক্ষ্যে নিয়ে আসেন।ইসলামিক আমীরাত অফ আফগানিস্তানের পক্ষ্য থেকে ২০১৫ সালে তিনি ইসলামিক স্টেটের কর্মকান্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি আবু বকর আল বাগদাদী কে চিঠি লিখে জানান যে আই.এসের কর্মকান্ডের ফলে আফগানিস্থান তথা গোটা বিশ্বে জেহাদী কার্যকলাপ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।শিয়াপন্থী যে ইরান প্রথম তালিবান সরকারের চূড়ান্ত বিরোধী ছিল, মোল্লা মনসুরের দীর্ঘ ইরান অবস্থান ও দৌত্য ইরান ও পাকিস্থান কে আফগান প্রশ্নে এক জায়গায় নিয়ে আসে। আর তাই ড্রোন হামলায় তার হত্যার পরে বারাক ওবামার বিবৃতি যে এবার তালিবান আমাদের সাথে শান্তি আলোচনায় আসতে বাধ্য হবে -ফোর্জ টু ডু। এখান থেকেই স্পট হয়ে যায় আমেরিকার প্রকৃত উদ্দ্যেশ।কিন্তু সিরিয়ায় রাশিয়ান সামরিক হস্তক্ষেপ ও ট্রাম্পের আগমণ গোটা পালার পট পরিবর্তন করে দেয়।
সংগ্রাম চক্রবর্তী : পেশায় কৃষক। কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে কৃষিকাজ করেন।
3 Comments
যথেষ্ট তথ্যবহুল ও সাজানো লেখা।স্পষ্ট কথা।✊🏾✊🏾✊🏾
Osadharon….❤️
dhonnobad