ফিরে দেখা আফগানিস্তান, পর্ব-৪

সংগ্রাম চক্রবর্তী
ক্যাসপিয়ান প্রাকৃতিক গ্যাস বেসিন আফগান রাজনীতি কে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ না করলেও, এর পরোক্ষ প্রভাব এই যুদ্ধে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ক্যাসপিয়ান সাগরের তলায় বিপুল পরিমাণ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সঞ্চিত আছে, যার পরিমাণ ৯০বিলিয়ন কিউবিক মিটার ও তেলের সঞ্চয় আমেরিকা সৌদির মোট তেলের থেকেও বেশী।শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্য নয় মধ্য এশীয়া ও ককেশাস অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের সঞ্চয় রয়েছে।কিন্তু এই তেল ও গ্যাস উত্তোলন ও পরিবহণের মুল দায়িত্বে রয়েছে রুশ রাস্ট্রায়ত্ত সংস্থা গ্যাসপ্রোনের হাতে।সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এই অঞ্চলে মার্কিন কূটনীতির লক্ষ্যই হয়ে দাড়ায় মধ্য এশীয়ার এই দেশগুলো কে (তুর্কমেনিস্থান, উজবেকিস্থান, কীরঘীজস্থান,কাজাখস্থান,তাজিকিস্থান) নিয়ে প্রভাব বলয়ে এনে রাশিয়া কে গ্যাস ও তেলের নিয়ন্ত্রণ থেকে বঞ্চিত করা।পুরাতন সোভিয়েত পরিবহণ নেটওয়ার্ক কে এড়িয়ে এই গ্যাসপরিবহণের বিকল্প লাইন তৈরী করা, কিন্তু সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর ক্যাসপিয়ান সাগরে প্রতিটি দেশের সীমা ও অধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত কোন আইন ছিল না, ফলে মার্কিন হস্তক্ষেপ রাশিয়া ও ইরানের সাথে তার সংঘাত বাধিয়ে তুলতে পারে অচিরেই।
১৯৮৮ সালে মার্কিন তেল কোম্পানী ইউনিকল আফগান-উজেবেক সীমান্তে তেলের সন্ধান পায়, কিন্তু তৎকালীন সময়ে উজবেকিস্থান, তুর্কমেনিস্থান, আজারবাইজান থেকে তেল ও গ্যাস পরিবহণের সমস্ত লাইনই গ্যাসপ্রোন বা রুশ নিয়ন্ত্রণে, ফলে বিকল্প পরিবহণ লাইন তৈরীর প্রয়োজন দেখা দেয়।১৯৯২ সালে চীনা পেট্রলিয়াম, মিৎসুবিসি মিলে পরিকল্পনা করে প্রায় ১৪০০ কিমি পাইপলাইন বানিয়ে চীনের জিংজিয়ানে এই গ্যাস নিয়ে যাওয়ার কিন্তু ভুপ্রকৃতির কারণে তা বাতিল করে। অন্যদিকে ইউনিকল পরিকল্পনা করে তুর্কমেনিস্তান থেকে আফগানিস্থানে প্রবেশ করে হেরাট-কান্দাহার হয়ে পাকিস্থানের কোয়েটা-মুলাত পেরিয়ে পাইপলাইন আরব সাগরে গিয়ে পৌঁছাবে সেখান থেকে ট্যাংকারে ভারত জাপান কোরিয়া সহ দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে তা পৌছে দেওয়া হবে। তবে এই পাইনলাইনের জন্যে আবশ্যিক শর্ত হল আফগানিস্থানের শান্তি ও স্থিতিশীলতা এবং শক্তিশালী কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা, কিন্তু সোভিয়েত সেনা সরে যাওয়ার পর আফগানিস্থানে যা একেবারেই ছিল না, বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠী নিজের নিজের অঞ্চলের শাসনকর্তা হয়ে পরস্পরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত, আর এই শূণ্যতা পূরণ করতেই “তালিবান” জন্ম হয়।মার্কিন প্রভুর স্বার্থসিদ্ধির পাশাপাশি পাকিস্থান যে অতিরিক্ত যে সুবিধা টা পায় তা হল “ডীপ স্টেট” কনসেপ্ট কে রুপায়ন করা, ভবিষৎ ভারতের সাথে যুদ্ধে সে প্রয়োজনে পিছিয়ে এসে আফগান মাটি থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারবে এবং কাবুলে পাক নিয়ন্ত্রিত কোন সরকার তার পশ্চিম সীমান্ত কে সম্পূর্ণ নিরাপদ করবে। বাস্তবে পাখতুন উপজাতি শুধু নিজের ভূমি কে ট্রেনিং ক্যাম্প হিসাবেই ব্যবহার করতে দিয়েছে তাই নয়, সে প্রয়োজনীয় লোকবলেরও যোগান দিয়েছে ভারতের সাথে ছায়াযুদ্ধে।
১৯৯৬ সালে কাবুলের মসনদ দখন করে তালিবান, এবং বিল ক্লীটনের আমন্ত্রণে তলিবান প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটন সফর করে, এর পরেই ১৯৯৭ সালে তুর্কমেনিস্থান, উজবেকিস্থান, পাকিস্থান ও আফগানিস্তান মিলে ২বিলিয়ন ডলারের “সেন্টগ্যাস” পাইপলাইন নির্মাণে সম্মত হয়,যার ৪৭% মালিকানা আমেরিকান ইউনিকল, ১৭% ডেল্টা অয়েল কোম্পানী(সৌদি আরব), হুন্ডাই ও হীতাচীর ১৯% শেয়ার, ৭% তুর্কমেন সরকার ও ৫%পাকিস্থান সরকারের মালিকানায় থাকবে।বাকি তালিবানের হাতে থাকবে,এরই পাশাপাশি ইউনিকলের প্রতিদ্বন্দী কনসোর্টিয়াম আর্জেন্টিনার ব্রাইডাস পশ্চিম আফগানিস্তান হয়ে বিকল্প পাইন লাইন নির্মাণের অফার দেয় তালিবান কে যার ১৫% শেয়ার থাকবে আফগান সরকারের হাতে, পাশাপাশি গ্যাস পরিবহণ বাবদ বছরে ১ বিলিয়ন ডলার ট্রানসিট ফী, পাইন লাইন কে কেন্দ্র করে রাস্তা, প্রতি ২০ কিমি অন্তর পুলিশ পোস্ট, রেললাইন ও অন্যান পরিকাঠামো ও নির্মাণ করা হবে যথেস্ট পরিমানে।পুলিশ বাহিনী সহ এর পুরো খরচও বহন করবে ব্রাইডাস।
ইউনিকলের সাথে মার্কিন ডেমোক্রাটদের সম্পর্ক অন্তত ভাল, কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকান জার্জ বুশ নিয়ে নির্বাচিত হয়ে এলে এই পাইনলাইনের ভনিষৎ ও নিরাপত্তা নিয়ে না না প্রশ্ন তুলতে থাকে রিপাবলিকানরা, এমতাবস্থায় ১৯৯৮ সালে ইয়েমেনে আল কায়দা মার্কিন সেনা শিবিরে হামলা চালায়,পাল্টা মার্কিন সেনা সৌদি তে ওসামা বিন লাদেনের শিবিরে হামলা চালালে ইউনিকল সেন্টগ্যাস প্রকল্প থেকে নিজেকে প্রত্যহার করে ১৯৯৯ সালে।
সংগ্রাম চক্রবর্তী : পেশায় কৃষক। কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে কৃষিকাজ করেন।