ফিরে দেখা আফগানিস্তান,পর্ব-৫

(আফগানিস্থান ওয়ার অন টেরর)
সংগ্রাম চক্রবর্তী
“এই যুদ্ধ অনেক সময় নেবে এবং সমাধান হবে” –প্রেসীডেন্ট জর্জ ডবলু বুশ ঘোষণা দিলেন ১২ ই সেপ্টেম্বর ২০০১ –“এবং এখানে কোন ভুল নেই আমরা এই যুদ্ধে জয়ী হব” এর পরবর্তী দুই দশক মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি তথা আন্তর্জাতিক রাজনীতি এই দর্শনেই পরিচালিত হয়েছে। আফগানিস্থান ও ইরাকে, মার্কিনীরা সরাসরি যুদ্ধ করে পুতুল সরকার বসিয়েছে, পাকিস্থান, সুদান, লিবিয়া, সিরিয়া সহ একাধিক দেশে বিমান হামলা চালিয়েছে, শুধু আমেরিকা একাই খরচ করেছে ৮ ট্রিলিয়ন ডলার,গোটা বিশ্বেই নিরাপত্তা খাতে বিপুল অর্থ বরাদ্দ হয়েছে, বহু জিহাদী গোষ্ঠী উদ্ভব যেমন হয়েছে ধ্বংসও হয়েছে অনেক, আবার নতুন নতুন গোষ্ঠীর জন্মও হয়েছে কিন্তু মুল প্রশ্নের উত্তরটাই থেকে গেছে অনুচ্চারিত–কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও জয়ী কে…?
সোভিয়েত পতন উত্তর বিশ্বে “ওয়ার অন টেরর” আসলে গোটা বিশ্বকে মার্কিন দখলে আনার এক মেগা প্রজেক্ট যার বলি হয়েছেন ৯০ লক্ষ মানুষ। আফগানিস্থানই কিন্তু প্রথম নয়, “ওয়ার অন টেরর” প্রজেক্টের প্রথম মহড়া হয় সোমালিয়ায়, তারপর যুগোশ্লাভিয়ার সফল অভিজ্ঞতা পেরিয়ে হাল্লা রাজা ২০০১ ঘোষণা দিলেন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধের এবং তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে তারা এই যুদ্ধে জয়ী হবেন।এই যুদ্ধে আমেরিকা কত টা সফল বা জয়ী তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হল আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় আমরা এর সুত্র ধরে কি কি পরিবর্তন দেখলাম– প্রথমত মানুষের মৌলিক চাহিদার স্থান নিল এক কল্পিত সন্ত্রাসবাদের জুজু,দ্বিতীয়ত এই জুজু দেখিয়ে পুলিশি রাষ্ট্রের নির্মাণ, তৃতীয়ত পেশাগত পরিচয় হারিয়ে মানুষ আস্তে আস্তে ধর্মীয় বা ভাষাগত বা জাতিগত পরিচয়ে পরিচিত হতে লাগল, চতুর্থত বহুজাতিক বৃহৎ রাস্ট্রের (সোভিয়েত ইউনিয়ান, যুগোশ্লাভিয়া) বদলে উগ্র জাতিসত্তার ভিত্তিতে ছোট ছোট রাষ্ট্রের নির্মাণ, এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭-০৮ অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষিতে দেশে দেশে নরেন্দ্র মোদী, এরদোগানের উত্থান। আসলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার যে সংকট যা কিনা ক্রমান্বয়ে ফিরে ফিরে আসছে তার থেকে তাৎক্ষণিক মুক্তি দিতে পারে একমাত্র অস্ত্র ব্যবসা ও যুদ্ধের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত মুনাফা নিশ্চিত করা।এই জন্যেই দেখবেন “ওয়ার অন টেরর” প্রজেক্ট শুধু একা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই চালিয়েছে এমন টা নয়, বরং ফ্রান্স, রাশিয়া, ভারত থেকে শুরু করে মায় ফিলিপিন্সও তার তার নিজের মত করে নিজস্ব নামে এই যুদ্ধটাকে জণগণের উপর চাপিয়ে দিয়েছে।মোজাম্বিক, ডিপি.আর কংগো, রুয়ান্ডায় যে গৃহযুদ্ধ তা আসলে ই.ইউয়ের স্বার্থরক্ষায়, তেমনই দাগেস্তান ও চেচেনিয়া রুশ রাজনীতিতে পুতিনের ক্ষমতা সংহত করেছে, চিদাম্ববরন বেরিয়েছে সবুজ শিকারে। স্থান-কাল-পাত্র মাত্রা ও নাম ভেদে পৃথক পৃথক হলেও এগুলো আসলে এই ওয়ার অন টেরর প্রজেক্টেরই অংশ। এটাই এই প্রজেক্টের রাজনীতি। আর তাই তালিবানের হাতে কাবুলের পতন গোটা বিশ্বকে এত চমকিত ও শিহরিত করেছে। এই রাজনীতিকে বাদ দিয়ে কাবুলের পালাবদল কে আপনি বুঝতে পারবেন না। আফ্রিকার শিঙের উপর অবস্থিত সোমালিয়া যেমন বিশ্ব নৌবাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলে, আফগানিস্থানও বিশ্ব স্থলবাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত।শুধু তেল গ্যাস, খনিজ সম্পদই রাজনীতি কে নিয়ন্ত্রণ করে সবসময় এমন নয়, সেই স্থানের ভৌগলিক অবস্থান ও রাজনীতি তে গভীর ছাপ রাখে।
এখন আফগানিস্থানের তালিবান কে কেন্দ্র করে এক বিতর্কের জন্ম হয়েছে যার পোশাকি নাম “ভালো তালিবান, খারাপ তালিবান” বা “পরিবর্তিত তালিবান”।পরোক্ষে অনেকেই বলতে চাইছেন পূর্বের তালিবানের চেয়ে দ্বিতীয় তালিবান সরকার অনেক উদার ও আধুনিক। জীবিত তালিবানের শবব্যবচ্ছেদেও মেতেছে অনেকে, কিন্তু অহেতুক এই বিতর্কে না গিয়ে আমাদের রাজনৈতিক ইসলামের শিকড় অনুসন্ধান করা উচিত।কারণ এই যে “ভাল তালিবান খারাপ তালিবান” এই তত্ত্বের জন্মদাতা আসলে জো বাইডেন তথা মার্কিন প্রচারমাধ্যম।সেনা প্রত্যাহার পর্বে কাবুল বিমানবন্দরে আত্মঘাতী বিস্ফোরণের পর পরই বাইডেনের বক্তব্য ছিল “আই.এস(কে) ইজ আওয়ার সোল এনিমি” অথচ দর্শনগতভাবে ইসলামিক স্টেট ও তালিবানের ভেতর ফারাক নেই।আসলে এই বক্তব্যের ভেতর দিয়ে বাইডেন সাহেব এক ঢীলে দুই পাখি মারলেন, তিনি মার্কিন রাজনৈতিক পরাজয় কে আড়াল করলেন, দ্বিতীয়ত পুনরায় আফগানিস্তানে ফিরে আসার সুত্র দিয়ে রাখলেন। ইসলামিক স্টেট যদি প্রকৃতই “সোল এনিমি” হত তাহলে আসাদ সরকার কে উৎখাত করতে উত্তর সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের গঠন কেন করেছিল আমেরিকা..? আবার এই ইসলামিক স্টেটের পৃষ্ঠপোষক হলেন রিসেপ তাইপে এরদোগান। ইদলিবের শেষ জিহাদী ঘাটি উচ্ছেদে রুশ সিরিয়ান সামরিক আক্রমণকে প্রতিহত করতে যিনি সেনা পাঠিয়েছেন।আমাদের দেশে অনেকেই ওনাকে আজকাল মুসলিম বিশ্বের আদর্শ শাসক বা মুক্তিদাতা হিসাবে কল্পনা করেন, কিন্তু তারা এটা মাথায় রাখেন না যে মুসলিমের বেশ ধরেই আবু লুলু হযরত ওমর কে হত্যা করেছিল, হযরত আলীর হত্যাকারীও মুসলিম খরেজীরা।আর এই খরেজীদেরই উত্তরাধীকারী হল ওয়াহাবীজম ও সৌদীরা। আজ কে শরীয়া আইন প্রয়োগের যে যে অভিযোগে তালিবান বিদ্ধ সেই একই আইন সৌদি আরবেও বলবৎ আছে।কিন্তু সৌদি শাসকদের সাথে গলাগলি করতে ট্রাম্প বা হিন্দু সম্রাট মোদীরও দ্বিধা হয় না।
ইসলামের যে চার টি মাজহাব আছে তার ভেতর মালিকী মতবাদ থেকে ওয়াহাবীইজমের উদ্ভব হয়। এর মুল কথাই হল শাসকের বিরুদ্ধে জেহাদের মাধ্যমে ইসলামের আদি তে ফিরে যাওয়া। মুলত কোরান ও সহী হাদীসই হল দর্শনের কেন্দ্রে। ইসলামের আদিতে ফিরতে চাওয়ায় অনেকে ওয়াহাবীদের সালাফিও বলে থাকেন। সালাফ এর অর্থ পূর্ববর্তী কিন্তু আব্দুল ওয়াহাব অনুসারীদের কীর্তিকলাপে ক্ষুব্ধ হয়ে মালিকী সম্প্রদায় আব্দুল ওয়াহাব কে বহিস্কার করে, তখন তিনি নজফের আমীর, আমমেদ ইবন সৌদের সাথে হাত মিলিয়ে তৎকালীন আরবের শাসক অটোমান দের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে।এত বড় মুসলিম এরা যে শ্রদ্ধেয় সাহাবাদের কবর ধ্বংস করা বাদেও মক্কা ও মদিনার দখল নিয়ে ওয়াহাবীরা রাসুলের কবরও ক্ষতিগ্রস্ত করে, গণহত্যা চালায়, কারবালায় হযরত আলী ও ইমাম হাসানের কবরও এদের হাতে ধংস হয়। ১৯৭৯ ইরানে শিয়াপন্থী ইসলামিক বিপ্লবের পর, আরব ভূখন্ডকে শিয়াপন্থা মোকাবিলা করতে সৌদিরা এই ওয়াহাবীইজমের কৌশলী ব্যবহার শুরু করার সিধান্ত নেয়, ১৯৭৯ কাবুলে সোভিয়েত সেনার আগমণ রিয়াধের সামনে এক তীরে দুই পাখি মারার সেই সুযোগ তৈরী করে। আবার এই একই সময়ে গোটা মুসলিম দুনিয়া আলোড়িত ছিল আরবজাতীয়তাবাদ ও বাথ সোসালিজম নিয়ে, ফলে আমেরিকার কাছেও প্রয়োজন ছিল এক বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি তে দাঁড় করানোর।১৭৭৪ সালের আব্দুল ওয়াহাবের সেই জেহাদ অ্যাংলো স্যাক্সন প্রভুর স্বার্থে ফণা তোলে ঠিক যেমন টি তুলেছিল অষ্টাদশ ও উনিশ শতকে অটোমান দের দুর্বল করার জন্যে।
কিন্তু জাস্টিস এন্ড ডেভোলপমেন্ট পার্টির নয়া অটোমান খলিফা এরদোগান সাহেব কে নামিয়েছে আমেরিকা আফগানিস্তানে তাদের স্বার্থ কে রক্ষা করতে। কাতারে অবস্থিত এশিয়ার বৃহত্তম মার্কিন সেনাঘাটি এবং ৬ টি পরমাণু বোমা সহ তুরস্কের মার্কিন ঘাটি বন্ধ করতেন এরদোগান সাহেব যদি তার ইমান সাফ হত। এমন কি ন্যাটো ছেড়েও বেরিয়ে আসতে পারতেন। অনেক এরদোগান সমর্থক হয়ত জানে না ইজিপ্টে মিলিটারী জুন্টার হাত থেকে বাচতে মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে তুরস্ক। মহঃ মোরসীর পতন ও হত্যাও এত সহজ হত না মিলিটারী জুন্টার পক্ষে।একই কথা দোহার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।এই কথাগুলো বলার একটাই উদ্দ্যেশ যে রাজনৈতিক ইসলাম নীতিগতভাবে যতই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোক না কেন, গোটা ইতিহাস পর্বে তারা আসলে সাম্রাজ্যবাদের দ্বারাই ব্যবহৃত হয়েছে।হাসান আল বান্না সহ ব্রাদারহুডের নেতা ও কর্মীদের সততা, দৃঢ় একাগ্রতা ও আত্মত্যাগ কে শ্রদ্ধা জানিয়েই এই কথা বলছি যে তা আসলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদেরই সেবা করে অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত না বাইরের আঘাত তার পরিবর্তন না ঘটায়, যেমন হামাস।তালিবানের বদল আমরা এতটুকুই আশা করতে পারি। কিন্তু তারপরেও আমি বলব মুসলিম ব্রাদারহুড় থেকে শুরু করে তালিবান, লস্কর-ই-তৈবা, থেকে শুরু করে আল শামস বিগ্রেড, ফ্রী সিরিয়ান আর্মি, বোকো হারাম এরা সবাই মুলে গিয়ে এক টা কমন ধারণা ধারণ করে তা হল ইসলামের আদি তে ফিরে যাওয়া,আর এই ফেরার পথে তারা মদিনা সদন, বায়তুল মাল, হযরত ওমরের পারসিয়ার কৃষি সংস্কার সহ অর্থনৈতিক অংশ টা কে বাদ দিয়ে বসেন। ওয়াহাবী মতবাদের প্রভাবে ভারতে যে দারুল উলুম দেওবন্দী মাদ্রাসা,তার আফগান সংস্করণ হাক্কানী মাদ্রাসা যেটা হাক্কানী নেটওয়ার্ক এত আলোচিত, তার ইতিহাস পাঠান ভাইদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ইতিহাস, বহু ওয়াহাবী সাহাদত বরণ করেছে এই লড়াইতে, মৌলানা মেহমুদ হাসান প্রাণ পর্যন্ত দিলেন ব্রিটিশ কারাগারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন মৌলিক ছাপ রাখতে না পেরে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ গান্ধীবাদেরই আশ্রয় গ্রহণ করে কার সেবা করেছে আজ ইতিহাস বিশ্লেষণ করলেই উত্তর উঠে আসবে। আবার বাংলায় যে ফরাজীরা একদা আরব থেকে আমদানী করা সহী ইসলাম শেখাতে তৎপর হয়েছিল ব্রিটিশ ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার আঘাত তাদের বাধ্য করেছিল জমির প্রশ্ন, কৃষকের অধিকারের প্রশ্ন কে তাদের প্রধান ইস্যু হিসাবে তুলে আনতে, এখন তালিবানের ক্ষেত্রেও দেখার যে চিনা পুঁজি কি পরিবর্তন আনে সেখানে।
সংগ্রাম চক্রবর্তী : পেশায় কৃষক। কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে কৃষিকাজ করেন।