ফিরে দেখা আফগানিস্তান, পর্ব-৬

সংগ্রাম চক্রবর্তী
পুঁজির একটা নিজস্ব গতি আছে যা পারিপার্শ্বিকতাকে নিজের মুনাফার স্বার্থে বদল করে, আর বদলটাকেই এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ “উন্নয়ন” নামে চালায়, আজকের যে আধুনিকতা ও উন্নয়নের ধারণা অহর্নিশ নির্মিত হয় তা আসলে পুঁজিপতির উন্নয়ন ও তার বাজারের স্বার্থে যা যা করা দরকার সেটাই আধুকিনতা,( যেমন কর্পোরেট হসপিটালের স্বার্থে স্বাস্থ্যসাথী)।কিন্তু আফগান ভূমিতে পুঁজির এই বিকাশটাই ঘটেনি, ১৯১৯ সালে ব্রিটিশদের থেকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করার পর বিভিন্ন সময়ে যেটুকু যা বিনিয়োগ হয়েছে তা মুলত সরকারী কতৃত্ব, স্বাভাবিক ভাবেই তা এক জন বিচ্ছিন্ন আমলাতান্ত্রিকতার জন্ম দিয়েছে।তাই একটা দেশ হিসাবে আফগানিস্তান কোনদিনই গড়ে ওঠেনি।সেখানে পাঠান আছে, তাজিক আছে, উজবেক আছে, হাজারে আছে, আইম্যাক, নুরিস্থানী ও তুর্কমেনরা আছে,কিন্তু কোন আফগান নেই। পাঠক কে স্মরণ করতে বলব ভারতে ব্রিটিশের ক্ষমতা সংহত করার ঠিক আগের অবস্থাটাকে, যেখানে মোঘল ছিল, পাঠান ছিল, রাজপুত মারাঠা ও শিখেরা ছিল কিন্তু কোন ভারতীয় ছিল না। একমাত্র ব্রিটিশ পুঁজির মুনাফার স্বার্থে শিল্পায়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটার পরই এদেশে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়।এই জিনিষটাই হয়ে ওঠেনি আফগানিস্তানে। এখানকার জাতিগত সংঘর্ষ বলকান অঞ্চলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়, কিন্তু তবু বৃহত্তর তাজিকিস্তান বা উজবেকিস্তানের দাবী কোন দিনই উচ্চারিত হয় না ঠিক এই কারণেই।এই জাতিগুলোও আবার টুকরো হয়ে আছে গোত্র সম্পর্কে।
পুঁজির অবস্থা প্রথম কারণ হলে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ টি হল এর ভূ-প্রকৃতি।মুলত হিন্দুকুশ ও পামীরের পর্বতমালা আর দক্ষিণে ইরান লাগোয়া অঞ্চলে সিস্তানের মরুভূমি নিয়ে আফগানিস্তানের জনপদগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন এবং অনেকাংশেই স্বয়ংসম্পূর্ণ।উৎপাদন ব্যবস্থা টাই মুলত স্থানীয় অর্থনীতি নির্ভর। আফগান ভূমির প্রচলিত প্রবাদই হল পাঠান বুলেট আর গমের জন্যে পয়সা খরচ করে।নিজের উপত্যকা থেকে চাহিদা মিটে গেলেই আমার বাইরের দুনিয়া নিয়ে মাথা ঘামানরও প্রয়োজন নেই।
যোগাযোগ ব্যবস্থার এই অপ্রতুলতা ও পারস্পারিক বিচ্ছিন্নতা কে অনুভব করেই সোভিয়েত রাশিয়া বিগত শতাব্দীর বিশের দশক থেকেই আফগানিস্তানে বাধ, রাস্তা, সেতু, নির্মাণ শুরু করে।মাঝে ৩০ দশকে কাবুলে জার্মান প্রভাব বৃদ্ধি পেলে এই গঠন প্রক্রিয়া ব্যহত হয়।তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শুরু হলে ইরানে ব্রিটিশ ও লাল ফৌজ প্রবেশ করলে কাবুলও বাধ্য হয় নাজী জার্মানীর স্বার্থে কোন উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপের সংকল্প ত্যাগ করতে।একদিকে সোভিয়েতের এই ধারাবাহিক কার্যক্রম ও অন্যদিকে হাবিবুল্লা ও আমানুল্লার সংস্কারের অনিবার্য ফল হিসাবে কাবুল, কান্দাহার, হেরাট, জালালাবাদ ইত্যাদি শহর গুলোয় এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠে।এর একটা বড় অংশ মার্ক্সবাদী চিন্তায় প্রভাবিত, এরাই মুলত পর্চম নামে পরিচিত, আরেকটি গোষ্ঠী জাতীয়তাবাদী এবং তীব্র কম্যুনিস্ট বিরোধী। এরা নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের পক্ষ্যে। ২০০১ সালে তালিবানের পতন হলে এই অংশই দাবী তোলে রাজা জাহির শাহ কে নিয়মতান্ত্রিক প্রধান করার, আজকের তালিবানের অন্যতম বড় রাজনৈতিক সাফল্য হল এই অংশের সমর্থন লাভ করা।তালিবান কাবুলে যে সংবিধান লাগু করতে চলেছে তা ১৯৬৪ সালের জাহির শাহর সংবিধান কেই অদলবদল করে এবং দ্বীতিয় তালিবান সরকারের প্যাটার্নটি কে খেয়াল করুন। ১৯২২ সালে মিশর স্বাধীন হলে আফগানিস্তানে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে, এই দুই শ্রেণীর বাইরে একটি ছোট অংশ আল আজহার মুখী হয়, মিশর ফেরত এই ছোট অংশটিই নীরবে আফগান উপত্যকায় রাজনৈতিক ইসলামের বার্তা ছড়ায়, শক্তি সংহত করে এবং এরাই ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ কাবুলে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেস্টা করে।সৌদি মার্কিন যৌথ প্রচেষ্টায় ওয়াহাবী মতবাদ জোর পেলে এরা প্রথম দিকে বাধাও দেয়, কিন্তু প্রবল পরাক্রান্ত কম্যুনিস্ট শত্রুকে রোখার দায়ে ও মার্কিন এরা পরস্পর সমঝোতাও করে, কিন্তু ১৯৯২-৯৬ আফগান গৃহযুদ্ধ তা শুধু তাজিক উজবেক হাজারা পাঠানের সংঘর্ষই এই মতবাদেরও সংঘর্ষ গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ার ও বুরারুদ্দিন রব্বানীর দ্বন্দ কে এই প্রেক্ষিতেই দেখা যায়। আফগানিস্তানের দূর্ভাগ্য হল বিগত দুই শতাব্দী ব্যাপী আন্তর্জাতিক শক্তির স্বার্থবাহী মতবাদ ও রাজনৈতিক শক্তি কাবুলকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে ও সেই মত ভার্সান নির্মিত হয়েছে।সে আব্দুর রহমান ই হোক বা নুর মহ.তারাকী, বারবাক কারমাল থেকে মোল্লা ওমর,হামিদ কারজাই এই একই চিত্র।জাতীয় পুঁজির অভাব ও ভৌগলিক অবস্থান যুগে যুগে কাবুলে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। কাবুলের কেন্দ্রীয় শক্তি যখনই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দের ফলে টালমাটাল হয়েছে তখনই কাবুলে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে, সে ঘানি-সালেহের দ্বন্দই হোক বা পর্চম-খালেকের দ্বন্দ।আফগানিস্তানের মত বহুজাতিক দেশে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার না থাকার অর্থই হল শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর অনুপস্থিতি, স্বাভাবিক ভাবেই তাই এই অভাব পূরণ করতে বহি দেশীয় সেনাবাহিনী কে বারবার আসতেও হয়েছে আবার ফিরেও যেতে হয়েছে।
৭৫০০০ তালিবানী যোদ্ধার বিরুদ্ধে ৩০০০০০ আফগান ন্যাশানাল আর্মির এত দ্রুত পরাজয়ে আমি তাই বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হইনি, বরং এটাই স্বাভাবিক ছিল।আমেরিকা যত ডলারই ব্যয় করুক না কেন সামরিক দৃষ্টিকোন তারা যে মারাত্মক ভুলটা করে তা হল যে যুদ্ধাস্ত্র ও কৌশলে আফগান সামরিক বাহিনী কে সজ্জিত করে তা বহন করার মত আর্থিক ক্ষমতা ও যোগ্যতা দুটোরই কোন টিই তাদের ছিল না। এমন কি একটা সময়ে বাধ্য হয়ে নিজের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কে উপেক্ষা করে, আফগান সামরিক বাহিনীর জন্যে রুশ যুদ্ধাস্ত্র কিনতে বাধ্য হয় আমেরিকা।আজকাল অনেক স্বঘোষিত সামরিক বিশেষজ্ঞ, সংবাদ পরিবেশক ও মূর্খ ভক্তদের বলতে শুনি মোদীজ্বী চীন ও পাকিস্থানকে টাইট দিতে আপ্যাচে, এম৭৭৭ ও অন্যান শক্তিশালী আমেরিকান অস্ত্র কিনে দেশকে শক্তিশালী করছেন- কিন্তু এই গোমূর্খরা ভেবে দেখেন না দুই দশকেরও অধিক পুরান এই মার্কিন যুদ্ধাস্ত্রগুলোর পরিচালন ব্যয় ও সেই পরিকাঠামো ভারতীয় সেনার আদৌ আছে কিনা।
এর সাথে আফগানিস্তানের সীমিত জনঘনত্ব (প্রতি বর্গ কিমি তে ৬০জন) তালিবান কে ব্লীসৎক্লীগ জাতীয় যুদ্ধ পরিচালনায় সহায়ক হয়েছে।বিশ্বের অন্যান্য গেরিলা বাহিনীর মত তালিবান পজিশনাল ওয়ারফেয়ারে যায় না। আর এই ধরণের আক্রমণ কে ঠেকানর একমাত্র উপায়ই হল বিমানবাহিনী।কিন্তু মার্কিন সেনা বাগরাম ছাড়ার পরই আফগান ন্যাশানাল আর্মি এই বিমান সাহায্য থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়। বস্তুত ২০২০ ফেব্রুয়ারী তে দোহাচুক্তির পর থেকে আমেরিকান বিমান বাহিনী আফগান আকাশ থেকে প্রায় অন্তর্হিত হয়।আমি আফগান বাহিনীর ভুতুড়ে সেনা সংখ্যার কথা না হয় বাদই দিলাম। আসলে রাজনীতি বাদ দিলে সেনাবাহিনী যে ভাড়াটে এক খুনে বাহিনী তালিবানের জয় সেটা চোখে আঙুল দিয়ে আরেক বার প্রমাণ করল।
সংগ্রাম চক্রবর্তী ঃ পেশায় কৃষক। কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে কৃষিকাজ করেন।