ইঁদুর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং নিষিদ্ধতা

রাজদীপ বিশ্বাস রুদ্র
সাধারণ ভাবে ” নিষিদ্ধতা ” এবং ” আমেরিকা ” শব্দদুটি পরস্পর বিপ্রতীপ – এমন একটি ধারণা অন্তত এশীয় মানসে বহুল খ্যাত। ” ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতার পীঠস্থান ” আমেরিকায় সেন্সরশিপ বা ব্যান নামক স্বৈরিতা যে থাকতে পারে এমনটা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারবেন না সহজে। কিন্তু প্রসঙ্গটি যখন আসে বইয়ের বিষয়ে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ধারণা যে বেশ সংকুচিত হয়ে আসে সেটা দেখা গিয়েছিল গত বছরের আমেরিকান লাইব্রেরীর রিপোর্টে। রক্ষণশীল সংগঠনগুলির সংগঠিত চাপে বই নিষিদ্ধকরণ এবং বইয়ের ওপর সেন্সর যে আমেরিকায় ক্রমবর্ধমান, রিপোর্টে সেইটি স্বীকার করা হয়েছিল। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিষিদ্ধতার কারণ – ” আপত্তিকর নগ্নতা “! সম্প্রতি এরই নবতম সংযোজন – মাউস।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলবোর্ড নগ্নতার অভিযোগে আর্ট স্পাইগ্যালমানের ” মাউস ” কে ব্যান করেছে – দিন তিনেক আগে এইরকম একটি পোস্ট যখন নিউজফিডে দেখেছিলাম, ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হয়নি। ” মাউস ” য়ে ” আপত্তিকর ” নগ্নতা! কোথাথেকে পাওয়া গেলো! ভেবে অবাক হয়েছিলাম। এও মনে হয়েছিল ভুলভাল জিনিস হয়ত। কিন্তু না। ভুল ভাল না। আসলেই ” স্বাধীনতার ” মহান পীঠস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ হয়েছে আর্ট স্পাইগ্যালমানের পুলিৎজার জয়ী গ্রাফিক উপন্যাস ” মাউস “। এবং হ্যাঁ, নগ্নতারই অভিযোগে! কি সেই ” আপত্তিকর নগ্নতা “? নাৎসী ডেথ ক্যাম্পের নকল স্নান ঘরে বন্দীদের বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে হত্যা করার দৃশ্য! স্বাধীনতার মহান পীঠস্থান, পর্ন ইন্ড্রাস্টির পীঠস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এইটি নাকি আপত্তিকর নগ্নতা!
আর্ট স্পাইগ্যালমান তার বই নিষিদ্ধকরণকে বর্ণনা করছেন গণতন্ত্রের পক্ষে ” বিপদ সঙ্কেত ” হিসেবে। নৃশংস নাৎসী শাসনের ভয়াবহ অমানবিকতার মর্মস্পর্শী দলিল ” মাউস ” আসলে স্পাইগ্যালমান পরিবারের নিজস্ব অভিজ্ঞতার বিবরণ। উপন্যাসের মুখ্যচরিত্র আর্টের বাবা নিজে। নাৎসী শাসনে সপরিবারে যার ঠাঁই হয়েছিল ডেথ ক্যাম্পে। ইহুদি ছিলেন বলে। ডেথ ক্যাম্পেই শেষ হয়ে গিয়েছিল তাদের গোটা পরিবার। আর্টের ভাই। দাদু দিদিমা সকলেই। বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন কেবল আর্টের বাবা আর মা।নাৎসী শাসনের ভয়াবহ দিনগুলোর অভিজ্ঞতাকে আর্ট একেঁছেন অসহায় ইঁদুর এবং ইঁদুরের রক্তপিপাসু বেড়ালের উপাখ্যানে। ইহুদিরা ইঁদুর। নাৎসীরা বেড়াল।
সাহিত্যিক নেইল গেইম্যান অত্যন্ত সঠিক ভাবেই বলেছেন “মাউস” কে যারা ব্যান করতে চায়, নিজেদের তারা যে নামেই ডাকুক, আসলে তারা নাৎসী। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাৎসী প্রেম নতুন কিছু না। ” অপারেশন পেপারক্লিপ ” প্রজেক্টে হাজার হাজার খুনে নাৎসীকে লালফৌজের মেশিনগান এবং ফাঁসির দড়ি থেকে রক্ষা করে আমেরিকায় পুনর্বাসন দিয়েছিল মার্কিন সরকার। কারণ এই নাৎসীরা কমিউনিস্ট দমনে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন!
মাউস নিষিদ্ধ হওয়ার খবর কোনও বাংলা কাগজ বা কোনও ভারতীয় মিডিয়ার পোর্টালে স্থান পেয়েছে – চোখে পড়েনি এখনও অব্ধি। অবশ্য অবাকও হইনি। ভারতে জার্নালিজম মোটামুটি একদশক হল মৃত। খবরের নামে এদেশে প্রচারিত হয় কোন জাতক কোন পাথরের আংটি পড়লে কোটিপতি হয়ে যাবেন। ভারতীয় মিডিয়ার আন্তর্জাতিক খবরের বিভাগ তো আরও এককাঠি সরেস। অমুক দেশের তমুক গ্রামে প্রচুর অবিবাহিতা সুন্দরী পাওয়া যায়, কিম জং উন নিজের কমোড সাথে নিয়ে ঘোরেন, ইত্যাদি।
রাজদীপ বিশ্বাস রুদ্র : ইতিহাসের ছাত্র।
