• March 25, 2023

লুসাই নৃ-গোষ্ঠী

 লুসাই নৃ-গোষ্ঠী

সাজিদ হাসান কামাল

মেঘের রাজ্য সাজেকের সবচেয়ে বৈচিত্রময় সৌন্দর্য হচ্ছে লুসাইগ্রাম। এই গ্রামের সৌন্দর্যে মুগ্ধতা আসবেই।পাহাড়ি সৌন্দর্যের সাজেক রাঙ্গামাটি জেলার একেবারে উত্তরে মিজোরাম সিমান্তে অবস্থিত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন হচ্ছে সাজেক। আয়তন প্রায় ৭০২ বর্গমাইল। সাজেকের উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিণে রাঙ্গামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম ও পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা অবস্থিত। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উচ্চতার সাজেক ভ্যালি প্রাকৃতিক ভূ-স্বর্গ হিসেবে সকলের কাছে সমাদৃত। প্রকৃতি এখানে সকাল বিকাল রঙ বদলায়। মন যা চায় প্রকৃতি যেন সেইভাবেই উপস্থাপন হয়। সারি সারি পাহাড় আর পাহাড়ের গায়ে মেঘের চাদর দেখে যেকোনো বিষন্ন মন সৃষ্টির সৌন্দর্যে মেতে উঠে।নৈস্বর্গিক সাজেক ভ্যালিকে রাঙামাটির ছাদ বলা হয়। কর্ণফুলী নদীর উদ্ভূত সাজেক নদী থেকেই সাজেক ভ্যালির নাম এসেছে। সাজেকের কংলাক পাহাড় থেকে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখা যায় এবং হিলভিউ রুম থেকে সুউচ্চ সবুজের সমারোহ উপভোগ করা যায়। সাজেকে বাঁশের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী মানুষেরা তাঁদের বাড়িঘর বাঁশের মাচানের উপর তৈরি করে বসবাস করে। পর্যটকদের থাকার ঘরগুলো বাঁশের মাচান দিয়ে তৈরি। পাহাড়ের গায়ে তৈরি করা এই ঘরগুলো যেন পাহাড়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে দিয়েছে বহুগুণ।

মেঘে আচ্ছন্ন পর্বতশ্রেণী সাজেকে বসবাস করে লুসাই নৃ-গোষ্ঠী। পর্যটকেরা বিলুপ্তপ্রায় লুসাই নৃ-গোষ্ঠীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে তাদের ভিন্নধারার জীবনযাপন আত্মস্থ করার প্রয়াসে ব্যাকুল থাকে সবসময়। লুসাই এক অদ্ভুত গ্রাম! চিত্রশিল্পীর আঁকা কাল্পনিক ছবিকে হারমানায় লুসাইগ্রামের সৌন্দর্য। প্রকৃতির ক্যানভাস আবরণের সৌন্দর্য উন্মাদনায় উন্মুখ হয়ে পড়বে যে-কেউ। লুসাইদের চাকমারা ‘কুগী’, মারমারা ‘লাঙ্গী’ ও ত্রিপুরারা ‘শিকাম’ নামে অভিহিত করে। লুসাই জনগোষ্ঠী লোকবিশ্বাস তাদের কারো মৃত্যুর পর মৃতের আত্না ‘মিথিখুয়া’ নামক মৃতপূরীতে বাস করে। মিথিখুয়াতে অবস্থানকালে প্রত্যেকের নিজ নিজ কর্মফলের বিচার হবে। কর্মফল অনুসারেই তারা স্বর্ণে (পিয়াল রাল) যেতে পারবে। পৃথিবী ছেড়ে মিথিখুয়াতে যাবার মান হিসেবে (থি টিন থ্‌লা) আগস্ট মাসকেই ধরা হয়। তাই লুসাই সমাজে আগস্ট মাসে কোন বিয়ের অনুষ্ঠান বা বিনোদনমূলক উৎসব করা হয় না। বর্তমানেও এ রীতি মানা হয়। লুসাইরা আদিতে সৃষ্টিকর্তা বা পাথিয়েল বিশ্বাস করে থাকেন। ধর্মীয় উৎসব পালন ছাড়াও বছরে তারা প্রধান তিনটি উৎসব পালন করে থাকে: ১. চাপচারকূত (বসন্ত উৎসব) ২. মীমতূত (মৃত আত্মাদের স্মরণে) এবং ৩. পলকূত (শস্য কাটার উৎসব)। এছাড়া আরও রয়েছে চাপচার কুট, মিনকুট, পাল কুট। তাদের মাতৃভাষায় রচিত বিভিন্ন গান ও আদি নৃত্য। মনকুট উৎসব- জুমের ঘাস কাটার যখন শেষ হয় তখন এই উৎসব করা হয়। চাপচার কুট- এটি নবান্ন উৎসব। জুমের ধান কাটা শেষ হলে এই উৎসব করা হয়।

লুসাই নৃ-গোষ্ঠী বার্মা থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয় এবং তারা নিজেদের মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর বংশধর বলে পরিচয় দেয়। কিংবদন্তী অনুসারে চীন দেশের রাজা চিনলুং তাঁর বাবার সাথে মতের অমিল থাকার কারণে তাঁর অনুসারিদের নিয়ে বার্মায় (মিয়ানমার) চলে আসেন এবং সেখানে গ্রাম তৈরি করে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে উক্ত রাজার বংশধররা চিনহিলস, মনিপুর, কাছাড়, মিজোরাম, সাতিকাং (চিটাগাং) অঞ্চলে প্রায় দুশত বছর রাজত্ব করেন। এই রাজার উত্তরসূরী যাম্হুয়াকার রাজত্বকালে তাঁরা বঙ্গ দেশের রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও ভারতের মিজোরামে অনেক লুসাইয়ের বসবাস রয়েছে।

তাদের প্রধান খাদ্য ভাত ও শাকসবজি। তারা জুমচাষের মাধ্যমে ধান, শাকসবজি উৎপাদন করে। তাদের প্রিয় খাবারের মধ্যে ‘সা-উম-বাই’ (শূকরের তৈল, শাকসবজি ও কাঁচামরিচ দিয়ে তৈরি তরকারি) অন্যতম। মাছ, মাংস দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে রাখার উদ্দেশ্যে লুসাইরা মাচার উপর আগুনের তাপে সেগুলো ঝুলিয়ে রাখে এবং পরে রান্না করে খায়।

কিন্তু, কষ্টের কথা হচ্ছে, আজ তাদের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। সর্বশেষ আদমশুমারী মতে, লুসাই সম্প্রদায়ের ১ হাজার ৯৬ জন মানুষ প্রত্যন্তপর্বত ও আশেপাশে অবশিষ্ট রয়েছেন। এরমধ্যেই বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, লুসাইদের শতকরা ৯৬% শিক্ষিত। তারা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্তব্যরত রয়েছেন। উনবিংশ শতকের শেষার্ধে দুজন আর্থিংটন ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি রেভা এফ.ডব্লিউ সেভিডজ ও রেভা জে.এইচ লরেইন এর প্রচেষ্টায় রোমান অক্ষরের অনুকরণে লুসাই বর্ণমালা তৈরি করেন। যুবকদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষাকেন্দ্র নির্মাণ করেন। আস্তে আস্তে লুসাইরা পড়াশুনায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। শিক্ষাকে তারা পূজার মতো করে দেখে। তারা মনে করে দেবতার সবচেয়ে বড় দান হচ্ছে শিক্ষা আর এই দান থেকে তারা যেন বঞ্চিত না হয় তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে এবং সফল হয় যেকোনো জাতিগোষ্ঠী থেকে বহুগুণ।

লুসাইরা খুবই সংস্কৃতিমনা এবং নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষার ব্যাপারে সচেতন। নিজেদের ঐতিহ্য, পোশাক, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, অলংকার ইত্যাদির ব্যবহার এখনও প্রচলিত আছে। তাদের উৎসব পাহাড়কে আলোকিত করে তুলে। লুসাইদের মধ্যে জেঠাতো বা কাকাতো ভাইবোনের বিয়ে হতে পারে না। তবে মামাতো ও খালাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হয়। বর্তমানে খিস্টধর্ম গ্রহণের পরে বিয়ের ব্যাপারে কোনো বাধা না থাকায় অতীতের রীতিনীতি অদ্যাবধি পালিত হয়। পূর্বের ন্যায় লুসাইদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ও বিধবাবিবাহ বিদ্যমান।

পূর্বের ধর্ম ত্যাগ করে তারা অনেকেই এখন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। লুসাই জনগোষ্ঠী এককালে জড়োপাসক ও সর্বপ্রাণবাদের বিশ্বাসী ছিল। তারা ভূতপ্রেত, অপদেবতা ইত্যাদি বিশ্বাস করতেন। তারা ভূতপ্রেত ও অপদেবতা উদ্দেশ্যে পশুদিয়ে শির পূজা ও নদী পূজা করতেন। অতীতে লুসাইরা যার যার গ্রামে যে যার মতো বিভিন্ন নিয়মে দেবদেবীর আরাধনা করতেন। ইতিহাসে লুসাই নৃগোষ্ঠীকে নিয়ে খুব তথ্যনির্ভর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। ধারণামতে, লুসাই সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে চীন থেকে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত ও মায়ানমারেও লুসাই সম্প্রদায়ের জনগণ বসবাস করেন।
শতবছরের লুসাই ইতিহাসে জানা গেলো- তারা পাহাড়ে পশু শিকারে বেশ পারদর্শী ছিলেন। লুসাইগ্রামে এখনো তাদের শিকার করা বিভিন্ন পশুর মাথার খুলি রয়েছে। দর্শনার্থীরা তা কোনপ্রকার বিধিনিষেধ ছাড়া ভিতরে প্রবেশের মাধ্যমে অনায়াসে উপভোগ করতে পারেন।

লুসাই জনগোষ্ঠী অতীতে পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি পোশাক পরিধান করতেন। পরবর্তীকালে তুলা থেকে উৎপন্ন সুতা দিয়ে তৈরি ‘হ্নখাল’ নামে একধরণের চাদর প্রথমে লুসাই পুরুষরা এবং পরে নারীরা ব্যবহার শুরু করে। সময়ের পরিবর্তনে মহিলারা কোমর-তাঁত দিয়ে ‘পুয়ানফেল’ (থামি), ‘করচুং’ (টপস/ব্লাউজ) প্রভৃতি এবং পুরুষরা ‘করচুর’ (শার্ট) ও পুয়ানবি (লুঙ্গি) তৈরি করে ব্যবহার করতে শুরু করে। এছাড়া লুসাই নারীরা বিভিন্ন ধরনের থামি যেমন পুয়ান রৌপুই, পুয়ান চেই, পুয়ানদুম, ঙৌতেখের পরিধান করেন। লুসাই নারীরা বিভিন্ন ডিজাইনের অলংকার দিয়ে নিজেদের সাজাতে পছন্দ করতেন। তারা দামী পাথরের মালা পরতেন। এখনো যেসকল লুসাই নরনারী রয়েছে তারা তাদের পোশাক ও মালার ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন।

লুসাইগ্রামে কাউকে হত্যা করা হলে হত্যাকারীকে ফাঁসি দেওয়া হতো বা শিরচ্ছেদ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো। আর হত্যাকারী যদি ভয়ে গ্রাম প্রধানের কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করতেন তাহলে তাকে গ্রাম প্রধান ক্ষমা করে দাস বানিয়ে রাখতেন। সেই খুনি আসামীর পরবর্তী বংশধরেরাও গ্রাম প্রধানের দাস হয়ে থাকতো। তাই, সারাজীবন দাস হয়ে কাটানোর ভয়ে কেউ কাউকে খুন করার চিন্তা কখনো করতেন না। তারা খুব শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী ছিলেন। তাদের দোকানগুলো দোকানদার ছাড়া চালাতেন। আজও সেখানে সেই দোকান রয়েছে। পর্যটকেরা অবাক হয়ে তা উপলব্ধি করে থাকে। প্রত্যেকটা দ্রব্যের গায়ে দাম লেখা থাকে এবং একটা টাকা ফেলার বাক্স থাকে। যে যা ক্রয় করার করে সেই বাক্সে টাকা ফেলেন। কী অবাক বিস্ময়। তাদের বিশ্বাস এবং সম্প্রীতি ছিল খুবই মজবুত।

লুসাইরা খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার পরে তাদের জীবন ব্যবস্থা ধর্মীয় নিয়মকানুন মান্যতায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। আধুনিকতার ছোয়া লেগেছে সবখানে যে কয়েকজন লুসাই জনগণ আছেন তারাও সংস্কারে সাজিয়ে নিয়েছেন নিজেদেরকে।

1 Comments

  • সাজিদ হাসান কামাল ভাই আমার অত্যন্ত একজন কাছের ও প্রিয় মানুষ, তার লেখা আমার খুবই ভালো লাগে তিনি সমসময় সদা সত্যের পথের লিখে হারিয়ে যাওয়া বিলুপ্ত জিনিস গুলো তিনি সর্বদা তুলে ধরেন এটা আমাদের গর্ব,,❣️🥀

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Related post