• March 25, 2023

মহাত্মা গান্ধী, মওলানা ভাসানী এবং আসামের ‘বাঙাল খেদা’ আন্দোলন

 মহাত্মা গান্ধী, মওলানা ভাসানী এবং আসামের ‘বাঙাল খেদা’ আন্দোলন

আজাদ খান ভাসানী :- উপমহাদেশের রাজনৈতিক অন্তরীক্ষে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির সঙ্গে মওলানা ভাসানীর বিপ্লবী নীতির ফারাক সত্ত্বেও দুজনের মিলনাত্মক দিকও রয়েছে। এসব নিয়ে গবেষকরা একদিন গবেষণা করবেন নিশ্চয়ই। আমি আজকের আলোচনায় এর একটি সাদৃশ্যের উল্লেখ করতে চাই।

মহাত্মা গান্ধী ১৮৯৩ সালে আইনজীবী হিসেবে সর্বপ্রথম দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে পা রাখেন এবং ১৯১৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ২২ বছর সেদেশে বর্ণবাদবিরোধী সত্যাগ্রহ আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন। শুরু করেন অহিংস আন্দোলন। মোহনদাস করমচাঁদ থেকে মহাত্মা গান্ধী হয়ে ওঠেন।

অপরদিকে মওলানা ভাসানী ১৯০৪ সালে সর্বপ্রথম আসাম গেলেও ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আসামের নিপীড়িত বাঙালিদের অধিকার রক্ষায় বিশেষভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম করেন। আবদুল হামিদ খান থেকে মওলানা ভাসানী হয়ে ওঠেন। দুজনেই নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে বিভুঁইয়ের বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে রাজনৈতিক জীবনের গোড়াপত্তন করেন।

আসামের ‘বাঙাল খেদা’ ও ‘লাইন প্রথা’
সমস্যা নিরসনে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, আবদুল গাফফার খান, মওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ব্যর্থ হয়ে মওলানা ভাসানী তাদের ঔদাসীন্যের তীব্র সমালোচনা করেন। বিশেষ করে গান্ধীর নিরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “‘বাপু’ কেমন ‘মহা আত্মা’ যে আসামের বহিরাগত মুসলমানদের জন্য তাঁর কোনো দুশ্চিন্তা নেই।”

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯২৯ সালে আসামের ঘাগমারীতে (বর্তমান হামিদাবাদ) জঙ্গল কেটে প্রথম বসতি স্থাপন করেন। অবশ্য এর আগেই তিনি ১৯২৪ সালে ভাসানচরে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক কৃষক সম্মেলন থেকে নামের শেষের ‘ভাসানী’ উপাধি লাভ করেন। সেখানকার নিপীড়িত বাঙালি আর দারিদ্র্যপীড়িত মানুষগুলো তাকে সাদরে গ্রহণ করেন। ক্রমে মওলানা ভাসানী হয়ে ওঠেন ওই অঞ্চলের নিপীড়িত মানুষের নয়নের মণি। এরপর থেকেই আসামে তার পরিচয় একজন দুর্বিনীত কৃষক নেতা ও আধ্যাত্মিক পীর হিসেবে।

মওলানা ভাসানী ১৯১৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের জাতীয়তাবাদী দলের সমর্থক হিসেবে রাজনীতি শুরু করেন এবং ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান ও অসহযোগ অন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলে ভাসানী কংগ্রেসের ভেতরে থেকেই সেই দল সংগঠিত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু এর পর থেকে তিনি অতিমাত্রায় আসাম আসক্ত না হলে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে অধিকতর ভূমিকা রাখতে পারতেন বলে অনেকেই মনে করেন।

আসামের অধিকারবঞ্চিত বাঙালিদের অধিকার আদায়ের জন্য মওলানা ভাসানীর আত্মত্যাগ, সাধনা ও সংগ্রাম বিবেচনায় ভারতীয় গবেষক বিমল জে. দেব ও দিলীপ কে. লাহিড়ী অভিমত ব্যক্ত করেন, ‘Bhasani, one of the greatest leaders Assam has ever produced.’

সে সময়ে আসামের প্রজাসাধারণ জমা-জমি আবাদ করতে পারলেও জমির মালিকানা তাদের ছিল না। জমিদার-ভূস্বামীরা তাদের খেয়ালখুশি মতো প্রজাদের উচ্ছেদ করতে পারতেন। এহেন পরিস্থিতিতে মওলানা ভাসানী ভাসানচরে ‘আসাম-বাংলা প্রজা সম্মেলন’ আয়োজন করে সীমিত আকারে হলেও তাদের ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। এছাড়া আসামে গরু জবাই প্রথা চালুকরণ, ওজন পদ্ধতি সংস্কারসহ বিভিন্ন জনহিতকর কাজে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

আসামের বঞ্চিত মানুষ, বিশেষ করে বাঙালিদের ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে তিনি শুরু করেন আন্দোলন-সংগ্রামের নতুন এক অধ্যায়; যা ‘লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলন’ নামে খ্যাত। উল্লেখ্য, আসাম সরকার ১৯২০ সালে এই কুখ্যাত ‘লাইন প্রথা’ প্রবর্তন করে। এই আন্দোলনকে বেগবান করতে তিনি বাঙালি কৃষকদের সংগঠিত করে ‘আসাম চাষী মজুর সমিতি’ গঠন করেন। সমিতি ‘লাইন প্রথার’ বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশের মধ্য দিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন।

১৯৩৭ সালে প্রথমবারের মতো আসাম প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হয়েই তিনি পার্লামেন্টে ‘লাইন প্রথা বিরোধী’ বিল উত্থাপন করেন। ১৯৩৯ সালের ১৯ নভেম্বর আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে লাইন প্রথার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় তিনি কংগ্রেস সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। ১৯৪০ সালে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি হওয়ার পর থেকে তিনি ‘লাইন প্রথা’ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুক্ত হন। একই বছর তিনি লাহোর অধিবেশনেও যোগদান করেন। অধিবেশনের প্রস্তাবসমূহ তার মনে এক নতুন আশার সঞ্চার করে এবং অবিলম্বে তিনি লাহোর থেকে প্রত্যাবর্তন করে ভারতের পূর্বাঞ্চলে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা নেন। কিন্তু ১৯৪৬ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘লেজিসলেটর্স কনভেনশন’-এ লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করে মুসলমানদের ‘রাষ্ট্র সমূহ’-এর জায়গায় ‘রাষ্ট্র’ শব্দটি ব্যবহার করা হলে মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম প্রমুখ এই বিকৃতির তীব্র বিরোধিতা করেন।

১৯৪১ সালের ৩০-৩১ ফেব্রুয়ারি আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের দ্বিতীয় সম্মেলনে মওলানা ভাসানী আসামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির আবেদন জানান। ১৯৪২ সালের ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি ‘বাংলা-আসাম প্রজা সম্মেলনে’ তিনি সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন ৩১ মার্চের মধ্যে ‘লাইন প্রথা’ বিলুপ্ত করা না হলে এপ্রিল থেকে তিনি আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করবেন। এতে ভীত হয়ে সরকার পরবর্তী এক বছর মওলানা ভাসানীর সভা-সমিতির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তারপরও তিনি আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকেন। তার চাপে পড়ে ১৯৪৩ সালের ২৪ আগস্ট এক সরকারি নির্দেশে ‘লাইন প্রথা’কে অনেকটা শিথিল করা হয়। ১৯৪৪ সালের মার্চে ব্যবস্থাপক সভার বাজেট অধিবেশনের বক্তব্যে তিনি প্রদেশের অতিরিক্ত জমি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নৃগোষ্ঠী, হিন্দু ভূমিহীন কৃষক ও অভিবাসী বাঙালিদের মধ্যে বণ্টনের দাবি জানান। ১৯৪৪ সালের ৭-৮ এপ্রিল আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের বড়পেটা অধিবেশনে আসামের মুক্তি আন্দোলনে সা’দ উল্লাহকে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান। সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
১৯৪৪-৪৫ সালের দিকে ‘অহোম জাতীয় মহাসভা’র উসকানিতে আসামে ‘বাঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন চরম আকার ধারণ করতে থাকে। এর প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী মঙ্গলদই, বরপেটা, গৌহাটিসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বাঙালি উচ্ছেদ ও সরকারি নিপীড়নের প্রতিবাদ করেন এবং ‘বাঙ্গাল খেদা বিরোধী’ আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে আসামের সাধারণ নির্বাচনে তার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ শুধু তিনটি আসন ছাড়া বাকি সবকটি মুসলিম আসনে জয়লাভ করে। মে ’৪৬-এর প্রথম থেকে তিনি বসতি উচ্ছেদ ও সরকারি নিপীড়নের প্রতিবাদে বরপেটায় আমরণ অনশন শুরু করেন। একই বছর ২৬ জুন বাঙালিদের মধ্যে সংহতি জাগানোর লক্ষ্যে তিনি ‘মঙ্গলদই মহাসম্মেলন’ আয়োজন করেন। সম্মেলন থেকে ১৬ আগস্ট ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ এবং ৭ নভেম্বর থেকে ‘আইন অমান্য আন্দোলন’-এর ডাক দেন।

অবশ্য মহাত্মা গান্ধীকে বাঙাল খেদা বিরোধী আন্দোলনে নিশ্চুপ থাকতে দেখে ভাসানী তাঁর অহিংস নীতি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

১৯৪৭ সালের ৩-৪ মার্চ বাংলা-আসাম সম্মেলনে তিনি বাংলা এবং আসামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করে দ্রুত পাকিস্তানের স্বাধীনতা দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘আসামের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। আসুন আমরা সবাই এই মহান সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করি। আমরা ইপ্সিত স্বাধীনতা লাভের পূর্বে সংগ্রাম বন্ধ করব না।’ ৫ মার্চ তিনি মুসলিম লীগের বিধানসভার সকল সদস্য ও নেতাদের নিজ নিজ এলাকায় তথা সমগ্র আসামে ‘অহিংসা ও অসাম্প্রদায়িক’ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার নির্দেশ দেন।

এরপর তিনি প্রথমে আসামকেই স্বাধীন করার আহ্বান জানিয়ে ১০ মার্চ ‘আসাম দিবস’ পালনের ঘোষণা করেন। সম্মেলনে নেতারা জানান যে, ওইদিন গোয়ালপাড়া স্বাধীন হবে এবং সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আসামের বাকি অঞ্চল মুক্ত হবে। ১০ মার্চ ঘোষিত ‘আসাম দিবসে’ তিনি ১৪৪ ধারার মধ্যেই পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে জ্বালাময়ী বক্তব্যের মাধ্যমে বাঙালি কৃষকদের মরণপণ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন। সভাস্থল থেকেই তাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। ২১ জুন জনগণের আন্দোলনের মুখে গৌহাটি জেল থেকে মুক্তি পেয়েই তিনি ৬-৭ জুলাই সিলেটের গণভোটের প্রচারণায় নেমে পড়েন এবং পাকিস্তানের পক্ষে ‘কুঠার মার্কা বাক্সে’ ভোট চান। এই গণভোটে তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই সমর্থন চান।

সিলেটের গণভোটে সফলতার পর মওলানা ভাসানী ধুবড়ী, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, মিলচর, গোয়ালপাড়া, নওগাঁ কাছার প্রভৃতি জেলায় গণভোট চান। আসামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তকরণের জোরালো দাবি জানান। আগস্টে ফের নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীনতাপ্রাপ্তির দিনও তিনি ভারতের কারাগারে বন্দি ছিলেন।

অবশেষে সেপ্টেম্বরে তাকে মুক্তি দেওয়া হয় এই শর্তে যে, তিনি পাকিস্তানে চলে যাবেন। তাছাড়া মুক্তি পাওয়ার পরে তিনি গোলযোগ সৃষ্টি করতে পারেন এই আশঙ্কায় ভারত সরকার তাকে একটি জিপে করে আসাম সীমান্তে এনে পূর্ব পাকিস্তানে ঠেলে দিয়ে যায়। তিনি যেদিন আসাম ত্যাগ করেন সেদিন ধুবড়ীতে এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়। সেখানে তিনি তার ভক্ত, অনুসারী, সহকর্মীদের অন্যায়, অবিচার, শোষণ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে টিকে থাকার আকুলতা জানিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে বিদায় গ্রহণ করেন। এরপর সীমান্ত থেকে সোজা তিনি টাঙ্গাইল চলে আসেন। সেই থেকে আসামের বাঙালিরা ভাসানীহারা।

তথ্য সূত্র: ১. The Line System in Assam : A Study of The Role of Maulana Bhasani,- Bimal J Dev & Dilip K Lahiri, ২. মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী- সৈয়দ আবুল মকসুদ, ৩. মজলুম জননেতা- মওলানা ভাসানী স্মারক সংকলন, ৪. আবদুল হামিদ খান ভাসানী- ম. ইনামুল হক

লেখক : আজাদ খান ভাসানী, সভাপতি, মওলানা ভাসানী কৃষক সমিতি ও সদস্য সচিব ভাসানী পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.