রামানুজন : এক ক্ষণজন্মা ও গণিতের কাহিনী

রাজেশ পাত্র
১৯৭৬ সাল। কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের লাইব্রেরীতে একটি পুরনো বাক্সের মধ্যে পাওয়া গেল একশোরও বেশি লেখা পাতা, যার মধ্যে লেখা রয়েছে অসংখ্য গণিতের সূত্র। সেই সব গণিতের বিষয়গুলি পরবর্তীকালে বই আকারে প্রথম প্রকাশিত হল ১৯৮৮ সালে। যার শিরোনাম ‘The Lost Notebook and Other Unpublished Papers’। বইয়ের লেখক শ্রীনিবাস রামানুজন। মৃত্যুর ৫৬ বছর পরে রামানুজনের ডায়েরি বা গবেষণার নথিগুলি কিভাবে ট্রিনিটি কলেজের রেন লাইব্রেরীতে এল, সেই ঘটনা এক অজানা বা ধারণা করা ইতিহাস। তবে এইটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, রামানুজনের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ভারত থেকে ইংল্যান্ডে এই ডায়েরি বা কাগজের পাতাগুলি প্রফেসর জি. এইচ. হার্ডির কাছেই পাঠিয়ে ছিলেন এবং হার্ডির মৃত্যুর পর সেগুলি ক্রমান্বয়ে অবহেলিত হতে হতে ঠাঁই পেয়েছিল পরিতক্ত বা বর্জিত কাগজপত্রের একটি ঘরে এবং সেখান থেকে উদ্ধার করলেন জর্জ অ্যান্ড্র্যুস। কাগজগুলি ছিল রামানুজনের গবেষণাগার এবং কলম ছিল তার গবেষণাগারে ব্যবহৃত যন্ত্র। আবার কখনো তিনি কাগজ কেনার খরচ বাঁচাতে ব্যবহার করেছেন স্লেট-পেন্সিল। মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টে চাকরি করার সময় একদিন তাকে বন্দরে কাগজ কুড়াতে দেখেন তার এক বন্ধু- সেই ঘটনায় তার সহজ বিবৃতি, ফেলে দেওয়া অব্যবহৃত কাগজগুলি তার গণিত চর্চার কাজে লাগবে। অতএব, নোটবুক, হিসেবের খাতা বা কুড়িয়ে পাওয়া পাতা- কোনও কিছুই বাদ যেত না তার গবেষণার উপাদান হতে পারার সুযোগ থেকে।
১৮৮৭ সালের ২২ শে ডিসেম্বর তামিলনাড়ুর তাঞ্জোর জেলার কুম্ভকোনমে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে দেবী নামগিরির আশীর্বাদে জন্ম হয় শ্রীনিবাস রামানুজন আইয়াঙ্গারের। অসীম গণিত প্রতিভাধর এই মানুষটি খুব অল্প বয়স থেকেই গণিতের শিকড় বের করে চরম সত্য অনুসন্ধান করতে চেয়েছিলেন। কুম্ভকোনম টাউন হাই স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় তার সহজ প্রশ্ন ‘শূন্যকে শূন্য দিয়ে ভাগ করলে কি হয়?’- শুনে নিরুত্তর থেকে গিয়েছিলেন তার শিক্ষক এবং সেই প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ উভয়ই এড়িয়ে যান। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় বি.এ. ক্লাসের এক বন্ধুর কাছ থেকে এস. এল. লোনির ত্রিকোণমিতির একটি বই পান। সাগ্রহে পুরো বইটি পড়ে ফেলে তার সমস্যাগুলি সমাধান করতে শুরু করেছিলেন- সেই প্রথম শুরু। তাঁর বন্ধুটি এ কথা জানতে পেরে জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য ছুটে আসতেন রামানুজনের কাছে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় আরেক বন্ধু সরকারি কলেজের লাইব্রেরী থেকে জি. এস. কার রচিত ‘A Synopsis of Elementary Results in Pure and Applied Mathematics’ এনে দেয়। এই বইটিই যেন তার গবেষণার বীজ। এই বইটি থেকে শুরু হয় তার Magic Square তৈরির ভাবনা। ১৯০৩ সালে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ১৬ বছর বয়সী ছেলেটি ভাবতে শুরু করল একটি বৃত্তের ক্ষেত্রফলের সমান ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট বর্গক্ষেত্র কিভাবে তৈরি করা যায়! কিন্তু জ্যামিতির প্রতি তার আগ্রহ বেশিদিন রইল না, তাই চরম সত্যের খোঁজে তিনি মনোনিবেশ করলেন বীজগণিতে। কিন্তু এফ. এ. ক্লাসে বাধ সাধল অন্যান্য বিষয়। ইংরেজিতে ফেল করায় সিনিয়রে উত্তীর্ণ হতে পারলেন না বলে তার বৃত্তি কাটা গেল। ১৯০৭ সালে আবার প্রাইভেটে এফ. এ. পরীক্ষা দিলেন। তাতে অংকে ১০০তে ১০০ পেলেও অন্যান্য বিষয়ে ফেল করলেন এবং তার ছাত্রজীবনের এখানেই সমাপ্তি ঘটল।
এদিকে ১৯০৭ সালে রামস্বামী আইয়ার Indian Mathematical Society প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৯১০ সালে রামানুজন তার সাথে দেখা করে অংকের দুটি নোটবুক তাকে দেখালেন এবং একটি সামান্য কেরানীর চাকরী চাইলেন। উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট; সামান্য কিছু উপার্জনের পাশাপাশি নিশ্চিন্তে গণিত চর্চা চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু আইয়ার কেরানির চাকরি দিয়ে তার গণিত প্রতিভাকে শেষ করতে চাইলেন না। তাই নোটবুকগুলো নিয়ে দেখা করতে বলেছিলেন প্রফেসর শেশু আইয়ারের সঙ্গে। শেশু আইয়ার মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের অফিসে একটি সাময়িক চাকরি দিলেন তাই কয়েক মাস পর্যন্ত ঠিক চলে গেল। কিছু ছাত্র পড়িয়ে কোনভাবে দিন চালাচ্ছেন শুনে ১৯১০ সালের ডিসেম্বর মাসে শেশু আইয়ার বিচলিত হয়ে আবার তাকে ডেকে পাঠালেন এবং নেলোরের কালেক্টর রামচন্দ্র রাও-এর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। রামানুজন রামচন্দ্র রাও-এর সঙ্গে দেখা করে নোট বই গুলি দেখালেন এবং তাকে বললেন, আমি যৎসামান্য উপার্জন করে আর্থিক চিন্তা থেকে মুক্ত হতে চাই এবং আমার গণিতের চর্চা চালিয়ে যেতে চাই। রামচন্দ্র রাও তার জন্য কোন চাকরির ব্যবস্থা করতে পারলেন না ঠিকই, কিন্তু ২৫ টাকার একটি মাসিক অর্থ পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। কয়েক মাস এইভাবে চলার পর, তাঁর চরম আত্মসম্মানবোধ বিনা পরিশ্রমে সেই টাকা নিতে অস্বীকার করল। পরবর্তীকালে রামচন্দ্র রাও-এর একটি সাক্ষাৎকারে এইসব কথা উঠে আসে। ১৯১১ সালে Indian Mathematical Society-এর বার্ষিক পত্রিকার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় ‘Some Properties of Bernoulli’s Numbers’ নামে রামানুজনের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হল। ১৯১২ সালে যখন মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টে একটি কেরানির চাকরি জুটলো তখন আরও দুটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হওয়ায় তার গণিত চর্চা আরও স্ফুরিত হতে লাগলো। পোর্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ফ্রান্সিস স্প্রিং একদিন রামানুজনের তৈরি করা এক ফাইলের মধ্যে Elliptical Numbers সম্পর্কিত সূত্র ও উপপাদ্য দেখতে পেলেন। এই ঘটনা কিছুটা পেটেন্ট অফিসে আইনস্টাইনের ক্লার্কের চাকরি করার মত। আইনস্টাইন যেমন অফিসের কাগজে নিজের গবেষণার অংকগুলি কষে ফেলতেন এবং তাই দেখে বিব্রত হতেন তার কিছু সহকর্মী, এক্ষেত্রেও সেই ঘটনার পুনর্নির্মাণ ঘটলো।অনন্য প্রতিভাধর ব্যক্তিদের প্রতিভা আবিষ্কার করার পেছনে একজন ব্যক্তি থাকেন। আইনস্টাইনের ক্ষেত্রে যেমন ছিল বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাক্স প্লাঙ্ক, রামানুজন এর কাছে সেইরকমই বিধাতা হয়ে উঠেছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জি. এইচ. হার্ডি। ১৯১৩ সালের ১৬ই জানুয়ারি প্রফেসর হার্ডিকে চিঠি লিখলেন রামানুজন, পাঠালেন ১২০টি সমাধান করা উপপাদ্য। সঙ্গে চাইলেন কিছু উপদেশ এবং প্রযুক্ত উপপাদ্য গুলি প্রকাশের আবেদন। প্রফেসর হার্ডি কিছু উপপাদ্য সারবত্তাহীন মনে করলেও বেশ কয়েকটির গুরুত্ব অস্বীকার করতে পারলেন না। জহুরীর চোখ ঠিক সেদিন খুঁজে নিয়েছিল লুকিয়ে থাকা রত্নকে। তাই চিঠি লিখে প্রশংসা করলেন রামানুজনের। ২৭ ফেব্রুয়ারি হার্ডিকে আবার চিঠি লিখে রামানুজন বলেছিলেন মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়কে তাঁর গণিত চর্চা সম্পর্কে জানাতে যাতে সেখান থেকে কিছু বৃত্তি পাওয়া যায়। হার্ডি উপায় বের করতে লাগলেন, কিভাবে রামানুজনকে ইংল্যান্ডে আনা যায়। তৎকালীন লন্ডনে ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস ফেডারেশনে চিঠি লিখে সে কথা জানালেন এবং রামানুজনকেও একটি চিঠি লিখে ইংল্যান্ডে আসতে বললেন। এই সময় ডক্টর গিলবার্ট ওয়াকার মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টে এসে ফ্রান্সিস স্প্রিং-এর কাছে রামানুজনের সম্পর্কে জানতে পেরে তার গবেষণাপত্র দেখতে চাইলেন। একজন করণিকের এমন গণিত চর্চা সেই সময় তাকে প্রভাবিত করায়, তিনি মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে একটি চিঠি লেখেন। গণিত বিভাগের বোর্ড অফ স্টাডিজ রামানুজনের জন্য একটি মাসিক ৭৫ টাকার বৃত্তির ব্যবস্থা করে এবং সেইসঙ্গে রামানুজনকে একটি শর্ত দেওয়া হয় যে, প্রতি তিন মাস অন্তর তাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে তার কাজের রিপোর্ট বা নতুন গবেষণার কিছু নথি পেশ করতে হবে। ১লা মে কেরানির পদ থেকে চাকরির ইস্তফা দিয়ে রামানুজন সম্পূর্ণ নিবৃত হলেন অনন্য গণিত চর্চা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শর্ত অনুযায়ী আগস্ট, নভেম্বর এবং ১৯১৪ এর মার্চ মাসে তিনটি ত্রৈমাসিক কাজের বিবরণ পেশ করেন। প্রথমবার, নিজের সংস্কৃতিকে বর্জন করে ও মায়ের নিষেধ অগ্রাহ্য করে ইংল্যান্ডে যেতে অস্বীকার করলেও ধীরে ধীরে রামানুজন উপলব্ধি করেছিলেন যে, বিদেশ যাত্রায় কেউ ম্লেচ্ছ হয় না। ১৯১৪’র ফেব্রুয়ারি মাসে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের ফেলো ই. এইচ. নেভিলি যখন মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে একটি সেমিনারে বক্তব্য রাখতে আসেন, তখন প্রফেসর হার্ডি চেষ্টা করলেন নেভিলিকে দিয়ে রামানুজনকে বিদেশযাত্রায় প্রণোদিত করতে। রামানুজন রাজি হলেও বিদেশ যাওয়ার অর্থ সংগ্রহ করতে অপারগ। ফ্রান্সিস স্প্রিং এবার রাজ্যপালের কাছে রামানুজনের প্রসঙ্গ নিয়ে একটি চিঠিতে আবেদন করলেন- ‘এদেশে রামানুজনের গণিত প্রতিভার অপচয় ও অপমৃত্যু ঘটবে, তাই বিশ্ববিদ্যালয়কে বলে তাকে বিদেশে গণিত চর্চার উপায় বের করতে’। রাজ্যপালের একটি অনুমোদন পত্র পৌঁছে গেল মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে, যার ফলস্বরুপ বিশ্ববিদ্যালয় রামানুজনের বিদেশ যাওয়ার খরচ এবং মাসিক ২৫০ পাউন্ড বৃত্তির ব্যবস্থা করল। অবশেষে মার্চ মাসে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো গণিতের দুই নক্ষত্র রামানুজন ও হার্ডির মহা মিলনে।
সংখ্যাতত্ত্ব বা সংখ্যা নিয়ে খেলার অকপট অভ্যেস রামানুজনের মস্তিষ্ককে আরও প্রখর করে তুলেছিল। Mock Theta Function, Partition theory বা highly composite number -এর চরমতম উদাহরণ। কিভাবে সমস্ত ধনাত্মক সংখ্যার যোগফল -১/১২ অর্থাৎ ঋণাত্মক হতে পারে তার প্রমাণ আলোড়িত করেছিল বিশ্ব গণিতকে। প্রফেসর হার্ডি সংখ্যাতত্ত্বের তিনটি উপপাদ্য দেখে রামানুজনকে বিশ্বের প্রথমস্থানীয় গণিতজ্ঞদের মধ্যে তুলে ধরেছিলেন। ১৯১৭ সালে রামানুজন একবার অসুস্থ হয়ে ইংল্যান্ডের এক নার্সিংহোমে ভর্তি হন। প্রফেসর হার্ডি তাঁকে দেখতে এলে, রামানুজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি যে গাড়িতে এসেছেন তার নম্বর কত?’ হার্ডি অকপট হেসে উত্তর দিলেন, ‘১৭২৯। এই নম্বরে কোন ম্যাজিক নেই, ওর মধ্যে তুমি কিছু পাবে না।’ কিন্তু যার মস্তিষ্কে শুধুমাত্র সংখ্যা প্রক্ষালিত হয় তার মস্তিষ্ক থেকে এই নম্বরটিও বাদ গেল না। রামানুজন বললেন, ‘এটি এমন একটি ক্ষুদ্রতম সংখ্যা যাকে, দুই রকম ভাবে দুটি আলাদা সংখ্যার ঘনফলের যোগফল হিসেবে প্রকাশ করা যায়।’ ১৭২৯= ১০৩+৯৩ = ১২৩+১৩ । পরবর্তীকালে এই সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় রামানুজন- হার্ডি সংখ্যা নামে।প্রফেসর হার্ডির সান্নিধ্য এবং বিদেশে গণিতের আস্ফালন মাত্র পাঁচ বছর স্থায়ী হয়েছিল। তবে এই পাঁচটা বছরই রামানুজনের জীবনের গৌরবজ্জ্বল অধ্যায়। এসময় একুশটি গবেষণাপত্র প্রকাশের পাশাপাশি ১৯১৮ সালে নির্বাচিত হন রয়েল সোসাইটির ফেলো হিসেবে। বৈজ্ঞানিক অবদানের ভিত্তিতে তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি রয়েল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে ইংল্যান্ডে জীবনযাত্রায় কিছু অনিয়মিত জীবনযাপন তার আয়ু ক্রমাগত ক্ষয় করে চলেছিল। নিরামিষ ভোজনকারী যে মানুষটি দেশে থাকাকালীন কোন দিন রান্নাঘরে যাননি, সেই মানুষটি যখন একদিন শুনলেন তিনি যেখানে খাবার খান, সেখানে চর্বি দিয়ে রান্না করা হয়, তখন স্থির করলেন নিজেই বাড়িতে রান্না করে খাবেন। যদিও খাবারে চর্বি দেওয়ার কথাটা তাকে উত্ত্যক্ত করার জন্য বলা হয়েছিল। অনিয়মিত খাবার-দাবার এবং নিজের প্রতি অবহেলা রোগ হয়ে বাসা বাঁধতে শুরু করে তার শরীরে। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ একদিন রামানুজনের বাড়িতে এসে দেখলেন প্রবল শীতে কম্বল থাকা সত্ত্বেও রামানুজন কাঁপছেন। অনেকগুলি কম্বল একসঙ্গে বেঁধে খাটের উপর পাতা রয়েছে। তার মধ্যে থেকে কিছু পেতে রেখে এক-দুটি গায়ে দেওয়া যেত। রামানুজন বললেন তিনি ভেবেছিলেন, পুরোটাই বোধ হয় একখানা বিছানা। তার এই সারল্য ও উদাসীনতা কিছুটা তাকে মৃত্যুর দিকে টেনে এনেছিল। যদিও ছোটবেলা থেকে বহুবার তিনি অসুখে ভুগছেন। স্কুলে পড়াকালীন ফেল করার পর তিনি বাড়িতে না জানিয়ে এক বন্ধুর কাছে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে বন্ধু তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। সেই সময়ে রামানুজন তার বন্ধুর কাছে দুটি ডায়েরি রেখে এসেছিল। রোগ নিরাময়ের পরে অবশ্য তিনি ডায়েরি দুটি ফেরত নিয়ে যান। বিবাহের পরে একটি ভাড়া বাড়িতে স্ত্রী নিয়ে বসবাস করার সময়ও তিনি প্রবল রোগাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তখনও তার বন্ধুরা তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। সুতরাং এক্ষেত্রেও লন্ডনে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হলে তার শুভানুধ্যায়ীরা তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। শেষ এই একটা বছর তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটালেন। তার স্ত্রী স্মৃতিচারণে বলেছেন; “তাঁর জীবনের শেষ বছর টুকুই আমি তার সেবা করার সুযোগ পেয়েছি।”
১৯১৯ সালের মার্চ মাসে দেশে ফিরে এলে রামানুজনের শরীরে ক্রমাগত ভাটা পড়তে থাকে। এই বছরের মাঝামাঝি Indian Mathematical Society তাকে বিশেষ সম্মানিত সদস্য পদ প্রদান করার পাশাপাশি সারাদেশের কাছে তাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন। ১৯২০ সালের প্রথম দিকে রামানুজনকে মাদ্রাজে নিয়ে এসে উন্নততর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলেও আর সুস্থ করা যায়নি। ২৬ এপ্রিল বাবা-মা, স্ত্রী, এবং দুই ভাইকে নিঃসঙ্গ করে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গণিতের জগত সংখ্যাহারা হয়ে পড়েছিল, তার প্রমান- আজ ১০০ বছর পরেও আমরা তাঁকে নিয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি, যিনি শুধুমাত্র গণিত নিয়ে বাঁচবেন ব’লে অনায়াসে বলতে পারেন, আমাকে শুধু দু-মুঠো অন্নের ব্যবস্থা করে দিন যেন আমি গণিতের চর্চাটুকু চালিয়ে যেতে পারি। সুকান্ত বা রামানুজনের মতো ক্ষণজন্মা মানুষদের জীবনচরিত অধ্যায়ন করলে একথা সহজেই বলা যায়, জীবন দীর্ঘ সময়ের জন্য নয়, বড় কাজের জন্য। আর এই বড় কাজের শিকড় থেকে তার মৃত্যুর ৫৫ বছর পরেও একটি বটবৃক্ষ জন্মাতে পারে যার স্থায়িত্ব কয়েকশো বছর পর্যন্ত গণিতের ক্ষেত্রে ছত্রছায়ার মতো অবস্থান করতে পারবে।
রাজেশ পাত্রঃ বিজ্ঞান শিক্ষক ও নাট্যকর্মী।