এক বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা

রাজেশ পাত্র
‘চেতনাই সর্বস্ব’- এ কথা যেমন সাহিত্য বা দর্শণে বারবার উঠে আসে, বিজ্ঞানে সেভাবে লক্ষ্য করা যায় না। তবে অনেক সময় একথা উঠে এসেছে ম্যাক্স প্লাঙ্ক, আর্থার এডিংটন বা অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের বিজ্ঞান চর্চায়। এই আত্ম চেতনাই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কখনও জাগিয়ে তোলে আধ্যাত্মিকতা।
১৯৪১ সাল, বছর-দশেকের এক শিশু তার বাবার সঙ্গে রাত্রিবেলায় ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছে। হঠাৎ একটা কাক উড়ে চলে যাওয়ায় উপর দিকে তাকিয়ে সে দেখল মুক্ত আকাশ, যেখানে জ্বলজ্বল করছে অসংখ্য তারা। এভাবে এর আগে আকাশ কখনও দেখেনি সেই ছেলে। খালি পায়ে কর্দমাক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে বাবাকে প্রশ্ন সেই ছেলের – ‘এটাই কি ভগবান?’ বাবার উত্তর -‘এখন ওসব নিয়ে ভাবার সময় নেই, তাছাড়া তোমাকেও এখন ঈশ্বর, মহাকাশ এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। বড় হও লেখাপড়া করো তারপর নিজেই ওসব জানতে পারবে।’ শিক্ষক বাবা তখন গান্ধীজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশ হিতৈষীতার সংকল্পে মগ্ন তাই তিনি পুত্রকে এখানেই শান্ত করলেন যাতে তার প্রশ্নবানে জর্জরিত না হতে হয়। কিন্তু সেই ১০ বছরের শিশুটির চেতনার উদ্ভব এখান থেকেই। সেই শিশুটি আজ ৯০ বছর বয়সি এক প্রভাবশালী আমেরিকাবাসী বাঙালি বিজ্ঞানী ডক্টর মণিলাল ভৌমিক।
মেদিনীপুরের তমলুকের কাছাকাছি বৈদ্যুতিক সংযোগবিহীন একটি গ্রামের খড়ের ছাউনি দিয়ে তৈরি মাটির ঘর এবং লস অ্যাঞ্জেলসের সেই বিলাসবহুল ঝাঁ-চকচকে বাড়ির মধ্যে দুটি বিষয় সাধারণ ছিল, তা হল ডক্টর মণি ভৌমিক ও তাঁর আধ্যাত্মিক চেতনা। ঠাকুমার সঙ্গে তিন মাইল খালি পায়ে হেঁটে গঙ্গা দেখে যেভাবে প্রকৃতি চিনেছেন, তেমনি আবার দেখেছেন লস অ্যাঞ্জেলসের নিয়নবাতি দিয়ে সাজানো রাস্তা ও রেস্তোরাঁ। তিনি অনুভব করেছিলেন বিলাসবহুল বাড়ির মার্বেলের ঝাঁ-চকচকে মেঝের চেয়ে অনেক বেশি যত্নশীল তার ঠাকুমার হাতে নিকোনো মাটির মেঝে। এবং তিনি গর্ববোধ করতেন যে, তিনি সেই মেঝেতে জন্মেছিলেন। এই ঐশ্বরিক চেতনাই চরম দারিদ্র্য থেকে আর্থিক সচ্ছলতার পথ প্রশস্ত করেছিল। যে পরিবেশে তিনি বড় হচ্ছিলেন, সেখানে আশেপাশের সবাই তো সেরকমই, আর্থিক দিক এবং জাতের দিক থেকে সবচেয়ে নিচু তলার চেয়ে সামান্য উপরে। ছোট থেকেই সেই পরিবেশে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে, তাদের ওপর ঈশ্বরের প্রকোপ রয়েছে।
বাবা গুণধর ভৌমিক স্কুলে শিক্ষকতা করতেন ঠিকই কিন্তু অধিকাংশ সময়ে বাড়িতে থাকতেন না। ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল তাদের বাড়িতে একটি বৈপ্লবিক আস্তানা গড়ে উঠেছে। গভীর রাতে তারা শিশুটির মাথায় বন্দুকের বেয়োনেট ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করত – ‘বাবা কোথায়?’ তাঁর মনে হতো, পুলিশের শব্দ পেয়ে বা গন্ধ পেয়ে বাবা যেন এক অদৃশ্য শক্তিবলে কোথাও মিলিয়ে গেছেন। বাবা হয়তো সামনেই আড়ালে কোথাও লুকিয়ে আছেন এবং তাকে দেখছেন। পুলিশ তাঁর বাবাকে খুঁজে না পেয়ে বিস্মিত হয়ে ফিরে যেত। আবার হঠাৎ করে কোনও দিন তিনি চোখের সামনে পেয়েছেন তাঁর বাবাকে। ছোটবেলায় এই ধরাছোঁয়ার খেলাতেও তিনি দেখেছেন এক অসম্পূর্ণ আধ্যাত্মিকতা।
আমরা ভারতীয়রা যে ধরনের মহাজাগতিকতায় বিশ্বাসী, তা বহু বছর ধরে জন্ম দিয়েছে অন্ধ বিশ্বাসের। কিন্তু একজন বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি যে মহাজাগতিকতা দেখতে পেয়েছিলেন তা জন্ম দিয়েছিল এক ঐশ্বরিক উপলব্ধির। যেভাবে কোয়ান্টাম থিওরির জনক ম্যাক্স প্লাঙ্ক বলেছিলেন, ‘আমি চেতনাকেই আদি এবং মৌলিক মনে করি’, মণি ভৌমিকও পরবর্তীকালে চেতনাকে ‘আদি উৎস’ বলেছেন। ছোটবেলার সেই আকাশ দেখার রাত, এবং লস অ্যাঞ্জেলসের বর্ষবরণের রাতের মধ্যে যে প্রাণময়তার পার্থক্য, তা সেই বিজ্ঞানীর মধ্যে জন্ম দিয়েছিল এক ভয়াবহ শূন্যতার। এই বিশেষ দুঃখের মধ্যে তিনি খোঁজ করেছেন ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার, উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন কেন তিনি অসুখী। তিনি অনুভব করলেন, যে তিনি বন্দী হয়ে গেছেন এক পার্থিব সাফল্যে। যদিও সেই সাফল্য একদিনে আসেনি। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং তারপর খড়গপুর আই,আই,টি, থেকে ১৯৫৮ সালে পি,এইচ,ডি, ডিগ্রি লাভ করার পর ১৯৫৯ সালে স্লোন ফাউন্ডেশনের বৃত্তি পেয়ে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরেট পড়তে আমেরিকা যাত্রা ও তারও ১৪ বছর পর এক্সাইমার লেজার আবিষ্কারের পর তাঁর এই সাফল্য।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রনিক এনার্জি ট্রান্সফার নিয়ে গবেষণা করার জন্য যখন ১৯৬১ সালে তাকে জেরক্স ইলেক্ট্রো অপটিক্যাল সিস্টেমস্ – এর রিসার্চ ফেলো করা হলো তখন ৩০ বছর বয়সী এই বিজ্ঞানী প্রথম আর্থিক স্বচ্ছলতার স্বাদ পেলেন। সেখানে ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন কিলেট লিকুইড লেজারের অ্যাডভাইজার। ১৯৬৮ তে তাকে নিয়ে আসা হয় নরথ্রপ কর্পোরেট ল্যাবরেটরিতে। তিনি উন্নীত হলেন লেজার টেকনোলজির ম্যানেজার পদে। প্রায় বছর পাঁচেক গবেষণার পর ১৯৭৩ সালে তিনি এবং তাঁর সহকর্মী বিশ্বের সামনে হাজির করলেন এক্সাইমার লেজার। দারিদ্র্যে জর্জরিত সেই মানুষটি নিম্নবিত্ত থেকে উন্নীত হলেন মধ্যবিত্ত এবং তারপর ধীরে ধীরে এক উচ্চবিত্ত বিজ্ঞানীতে। দীর্ঘ ১৪ বছর গবেষণায় প্রতিবারই পেছনে ফিরে ফিরে দেখেছেন তাঁর অতীতকে। যতটা পথ সামনের দিকে এগোতে লাগলেন ততই অনুভব করলেন তাকে পাহাড়ের চূড়ার উপরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কিছু মানুষ আর এক অজানা শক্তি। ধাপে ধাপে লেজারের আবিষ্কার এবং প্রতিটি স্তরে আধ্যাত্মিকতার সংবরণ তাঁকে এক নতুন আলোর সন্ধান দিয়েছিল।
১৪ বছর সময়টা কম নয় তবু এক্সাইমার লেজার আবিষ্কারের পরেই খ্যাতি লাভ করেননি এই বাঙালি বিজ্ঞানী। এক্সাইমার লেজার গুরুত্ব পেতে শুরু করে যখন Corneal Sculpting নামক একপ্রকার চোখের সার্জারিতে এর প্রয়োগ শুরু হয়। পরবর্তীকালে এটি Laser Assisted in Situ Keratomileusis বা LASIK নামে জনপ্রিয় হয়। ধীরে ধীরে বছরের পর বছর ধরে আমেরিকার বিত্তবান ও খ্যাতিমান ব্যক্তিদের মধ্যে স্থান পান ডক্টর মণি ভৌমিক। এই সাফল্য তার আধ্যাত্মিকতা বা ঐশ্বরিক চেতনার চূড়ান্ত লক্ষণ। আমেরিকায় বসে তখনও তিনি দেখতে পেয়েছিলেন তার মেদিনীপুরের গ্রামের ধানক্ষেত, মাটির গন্ধ আর তারায় ভরা আকাশ। সৌরকেন্দ্রিক মহাজগতে তিনি নির্দিষ্ট করেছিলেন নিজের অস্তিত্ব যা বেদের ভাষায় ‘অহম ব্রহ্মাস্মি’ বা আমিই ব্রম্ভ।
আইনস্টাইন বলেছিলেন ‘বিজ্ঞান ধর্ম ছাড়া খঞ্জ, আর ধর্ম বিজ্ঞান ছাড়া অন্ধ’। ডক্টর মণিলাল ভৌমিক এই পথেরই পথিক। আইনস্টাইনের সেই ছোট্ট সমীকরণ E=mc2 বিজ্ঞানে নিয়ে এসেছিল এক আধ্যাত্মিকতার সন্ধান। স্কুলে বা কলেজে পড়ার সময় যেই আধ্যাত্মিকতা নিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব লেগে থাকত এবং তা ক্রমশ নিজের মধ্যেও আত্মদ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছিল। ১৯৫০ সালের পর মানুষ যখন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিল, তখন ধীরে ধীরে সেই আত্মদ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস আরো দৃঢ় হতে শুরু করল। ডক্টর মণি ভৌমিকের লেখা ‘কোড নেম গড’ বইটি বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার এক অসাধারণ মেলবন্ধন। বেদ, বাইবেল, কোরআন, জেন্দ আবেস্তা বা একেশ্বরবাদ এই মহাজগতে একটিই পরম সত্যে বিশ্বাসী যা হল শক্তি বা এনার্জি। অন্যদিকে কোয়ান্টাম ফিজিক্সও আমাদের দিয়েছে মাস-এনার্জি কনভার্শনের ব্যাখ্যা। আবার এই মাস বা কোনও কণা আলোর বেগে ছুটলেই তা হয়ে যায় অদৃশ্য। এই অদৃশ্যতা ও শক্তি উভয়ের পরিপন্থী এবং অদৃশ্য শক্তিই হল ব্রম্ভ। বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা উভয়ের কাছেই এই ব্রম্ভ বর্তমান।
1 Comments
Very good …informative