খেলার মাঠ ও বিদ্বেষঃ ইতিহাস অন্তহীন

সুমন কল্যাণ মৌলিক
একসময় ক্রিকেটকে বলা হত ভদ্রলোকের খেলা।’ ভদ্র ‘ শব্দটার সঠিক সংজ্ঞা কি,এনিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু একথাটা নিয়ে বোধহয় কোন সন্দেহ নেই যে খেলার মাঠে খেলোয়াড়,পরিচালকমন্ডলী এবং দর্শক — সবাই মানবিক আচরণ করবেন,দ্বেষ, হিংসা বা প্ররোচনা ছড়াবেন না- এটাই কাম্য।কিন্তু অতি সম্প্রতি টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানের কাছে ভারতের পরাজয়ের পর দলের অন্যতম সদস্য মহম্মদ শামিকে যেভাবে কিছু ধর্মান্ধ, ইতর মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ সোসাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে গালিগালাজ করল তাতে ক্রিকেট সম্পর্কিত ভদ্রলোকের বিশেষন টি যে আজ তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। সেদিন যোগ্যদল হিসাবে পাকিস্তান জিতলেও এবং ব্যাটিং,বোলিং, ফিল্ডিং — সব বিভাগে গোটা দলটাই শোচনীয় পারফরম্যান্স করলেও,একজন নির্দিষ্ট খেলোয়াড়কে চাঁদমারি করা হল কেন! উত্তরটা আমাদের সবার জানা।শামি যেহেতু ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান তাই তার প্রতি এই কুৎসিত আক্রমণ। আশার কথা হল এই আক্রমণের বিরুদ্ধে অধিনায়ক বিরাট কোহলি সহ বহু প্রাক্তন ও বর্তমান খেলোয়াড় সরব হয়েছেন। যদিও এটা আশ্চর্যের এই ক্রিকেট দলের অভিভাবক বিসিসিআই এখনো পর্যন্ত এই ব্যাপারে হিরন্ময় নীরবতা পালন করছেন। আমরা বরং বিরাট কোহলির কথার প্রতিধ্বনি করে বলতে পারি এই অমেরুদণ্ডী, কুৎসাকারীরা ভারতীয় দল তথা এদেশের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক মানুষের মানবিক চেতনাকে কলুষিত করতে পারবেন না।
এই ঘৃণার রাজনীতির শিকার কিন্তু মহম্মদ শামিই প্রথম নন।আসুন আমরা তরুণ প্রজন্মের অন্যতম মহিলা হকি খেলোয়াড় বন্দনা কাটারিয়াকে স্মরণ করি।টোকিও অলিম্পিকসে এবার ভারতীয় মহিলা হকি দল দারুণ ভালো খেলেও শেষ পর্যন্ত সেমিফাইনালে পরাজিত হয়।পরাজয়ের ‘ শোকে ‘ হরিদ্বারের কিছু বীরপুঙ্গব বন্দনার বাড়ির সামনে বাজি ফাটায় ও পরিবারের লোকজনকে গালিগালাজ করে।তাদের বক্তব্য বন্দনার মত ‘ নিচুজাতের’ খেলোয়ার দেশের হয়ে খেলার কারণে ভারত মাতার পরাজয় হয়েছে।হাজার খবরের ভিড়ে এখবরটাও আমাদের চোখ এড়ায় নি যে জাত তুলে ক্রিকেটার যজুবেন্দ্র চাহালকে গালিগালাজ করার অভিযোগে ভারতীয় ক্রিকেটের একদা সুপারস্টার যুবরাজ সিংকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল কয়েকদিন আগে।
এই রোগ ইউরোপের দেশগুলোতেও কম নয়।কদিন আগে ইউরো ফুটবলের ফাইনালে ইংল্যান্ড টাইব্রেকারে ইতালির কাছে পরাজিত হয়।তারপরেই শুরু হয়ে যায় পেনাল্টি শটে গোল করতে ব্যর্থ তিন খেলোয়াড় ( যাদের মধ্যে দুজন কৃষ্নাঙ্গ) মার্কাস রাশফোর্ড,জডান স্যাঞ্চো,ব্রাহকে গাত্রবর্ণ ও জাত তুলে সোসাল মিডিয়ায় টিটকারি। একই ঘটনা ঘটেছিল যখন ইংল্যান্ড প্রাক বিশ্বকাপ পর্বের খেলাতে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে সেদেশের সমর্থকদের দ্বারা বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়।তবে ভারতের সঙ্গে পার্থক্য হল ইংল্যান্ডের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বর্ণবিদ্বেষীদের প্রশ্নে ‘ জিরো টলারেন্স ‘ নীতি গ্রহণ করে দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে সফল হয়েছে।সেদেশের প্রধানমন্ত্রী এই কুৎসাকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বয়কটের ডাক দিতে পারেন কিন্তু আমাদের প্রধান মন্ত্রী, ক্রীড়া মন্ত্রীরা নীরবতাকে শ্রেয় মনে করেন।
ভারতের খেলাধূলায় এই বিদ্বেষ ও ঘৃণার সংস্কৃতি রয়েছে কিন্তু আমরা তা গোপন রাখতে পছন্দ করি।কিছুদিন আগে বিশিষ্ট সাংবাদিক রাজদীপ সরদেশাই তথ্য দিয়ে দেখান ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ভারতীয় ক্রিকেট দলে মাত্র চারজন দলিত খেলোয়াড় প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছেন। রাজদীপের বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক হয় প্রচুর কিন্তু কিভাবে পরিস্থিতির বদল ঘটানো সম্ভব তা নিয়ে কোন গঠনমূলক আলোচনা হয় না।খেলার মাঠকে জাতপাত ও ধর্মান্ধতার কলুষ থেকে মুক্ত করতে গেলে যেমন এই ঘৃণার মতাদর্শের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে তেমনি কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।ভারতীয় ফৌজদারি দন্ডবিধির ১৫৩(১)(গ) ধারায় পরিষ্কার বলা হয়েছে – ‘ Anyone who makes or publishes any assertion etc,concerning the obligation or duty of any class of persons based on religion, race,language or regional group or caste or community is liable to be punished for three years or fined or both’।সুযোগ ছিল যারা মহম্মদ সামিকে এইভাবে অপমান করেছে,খেলার মাঠের ধর্মকে কলুষিত করেছে তাদের এই ধারায় অভিযুক্ত করে উপযুক্ত শাস্তি দেবার।কিন্তু সরকারের সদিচ্ছার অভাব সেই সম্ভাবনাকে নষ্ট করল।
সুমন কল্যাণ মৌলিক : বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক।