বর্তমান কৃষি ব্যবস্থা ও কৃষি বাস্তুতন্ত্রের সামগ্রিক বিপর্যয়

সন্তোষ সেন
বর্তমান কৃষি ব্যবস্থা, অর্থাৎ উচ্চফলনশীল হাইব্রিড চাষে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার ও মাটির তলা থেকে প্রচুর জল তুলে নেওয়ার একদিকে যেমন জমির উর্বরতা কমছে, চাষের খরচ বাড়ছে, কৃষি বাস্তুতন্ত্রের সংকট সমাধানের বাইরে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে রাসায়নিক চাষের ফলে জমি ও ফসলে ব্যবহৃত বিষ খাদ্যশৃঙ্খলের মধ্যে ঢুকে পড়ায় মানুষের রোগ অসুখ চড়চড়িয়ে বাড়ছে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে। নয়া কৃষি আইন যদি লাগু হতো বা ভবিষ্যতে এই ধরণের আইন প্রণয়নের চেষ্টা হয়, তাহলে নতুন করে কৃষি বাস্তুতন্ত্র সহ সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য সম্পূর্ণ ধ্বংস হবে, বাড়বে প্রাণ প্রকৃতির বিপর্যয়। বর্তমান কৃষি ব্যবস্থার সংকটের বিভিন্ন দিকগুলো এই নিবন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করবো, পাশাপাশি পাঠকদের কাছে সমাধানের কিছু দিশাও হাজির করব।
উচ্চফলনশীল চাষে অতিরিক্ত পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি কমছে, ধ্বংস হচ্ছে ফসলের জন্য উপযোগী সব অণুজীব। ফলে পরের বারের চাষে আগের মত ফলন পেতে আরো বেশী বেশী করে সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হচ্ছে। তাই আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক জায়গায় একবছর ছাড়া ছাড়া চাষ করতে হচ্ছে।
অত্যধিক পরিমাণে সার ও ওষুধ প্রয়োগের ফলে উপকারি অনুজীব,ব্যাকটেরিয়া ও কীটপতঙ্গ, যেমন ভ্রমর,মৌমাছি, প্রজাপতি ব্যাপক হারে মারা পড়ছে। সাপ ও ইন্দুর মরে যাওয়ায়, তারা জমিতে থাকা যে সব ক্ষতিকর পোকা মাকড় খেয়ে ফেলত সেটাও অনেক কমে গেছে। লন্ডনের মতো যেসব অঞ্চলে প্রচুর সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয় সেখানে নব্বই শতাংশ এর মত কীটপতঙ্গ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পরাগমিলনের মধ্য দিয়ে এখনও সত্তর শতাংশ ফসল ফলে, তাই মৌমাছি, প্রজাপতিরা প্রকৃতি থেকে হারিয়ে গেলে মানুষের পেটেও টান পড়বে।
ব্যবহৃত রাসায়নিকের খুব কম অংশই মাটি ও গাছ শুষে নেয়, কিন্তু বেশির ভাগটাই নদী, নালা, খাল, বিল বেয়ে সমুদ্রে গিয়ে মেশে, ফলে সমুদ্রের তলা বিষাক্ত হচ্ছে– তৈরী হয়েছে চারশোর বেশী ডেড জোন বা মৃত্যুর এলাকা, যেখানে মাছ, তিমি, শীল সহ নানান সামুদ্রিক প্রাণী ঝাঁকে ঝাঁকে মারা পড়ছে এবং শ্যাওলাদের অস্বাভবিক বৃদ্ধি হচ্ছে, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘অ্যালগাল ব্লুম’। চোরা পথে এইসব দূষিত ও মৃত মাছ আমাদের ডাইনিং টেবিলে স্থান পেলে আমাদের রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও নিসন্দেহে বাড়বে।
২০০০ সালে আমেরিকার এগ্রোকেমিক্যালস ও এগ্রিকালচারাল বায়োটেকনোলজি কোম্পানি মনসান্তো প্রেরিত বিটি তুলো (যা কিনা জেনেটিক্যালি মডিফায়েড শস্য) মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশের চাষীদের সমূহ সর্বনাশ ডেকে আনে ও কৃষকদের আত্মহত্যার মিছিলকে আরো লম্বা করে। ঐসব অঞ্চলের জীব-বৈচিত্রের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে।
বিষাক্ত রাসায়নিক ফসলে মিশে যাওয়ার ফলে বিষাক্ত শাকসব্জি, ফসল, ফলমূল খেয়ে মানুষের ক্যান্সার সহ নানান রোগ অসুখ বাড়ছে। পাঞ্জাব, হরিয়ানা সহ দেশের এক বড় অংশের মানুষ আজ ক্যান্সারে আক্রান্ত। চাষীরা সবুজ বিপ্লবের কুফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন এবং ভুলটাও বুঝতে পারছেন। দিল্লী সীমান্তে আন্দোলনরত কৃষকদের সাথে কথা বললে তাঁদের এই অনুভূতির কথা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
মাটির তলার সঞ্চিত জল উচ্চফলনশীল চাষের জন্য প্রচুর পরিমাণে তুলে নেওয়ায় ভূগর্ভস্থ জল আরো আরো নীচে নামছে, বাড়ছে আর্সেনিক ও ফ্লুয়াইড দূষণ। প্রচলিত চাষের কাজে এবং ঠান্ডা পানীয় ও বোতলবন্দী জলের জন্য প্রতি মুহূর্তে গ্যালন গ্যালন জল তুলে নেওয়ার ফলে অদূর ভবিষ্যতে ভারতবর্ষের বেশ কিছু রাজ্য সহ বিশ্বের অসংখ্য বড় শহরে জলের জন্য হাহাকার পড়ে যাবে, ২০১৯ সালে ব্যাঙ্গালোর, মহারাষ্ট্রের জলচিত্র এই নির্দশন রেখে গেছে।
অর্থাৎ কর্পোরেটদের মুনাফার জন্য তাদের নির্দেশিত পথে চাষাবাদের ফলে সামগ্রিকভাবে প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশের সমূহ ক্ষতি হচ্ছে। বামপন্থী সহ সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলো নয়া কৃষি আইনের বিরোধিতা করলেও তাঁদের ভাবনাচিন্তার মধ্যে এইসব বিষয়গুলো পরিলক্ষিত হচ্ছে না, অন্তত তাদের প্রচার ও ইশতেহারে সেরকম কিছু দেখা যাচ্ছে না।
সরকার চাইছে কৃষিকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে:
দেশি বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানীদের শ্যেন দৃষ্টি পড়েছে কৃষি জমির ওপর। ব্যাংক-পুঁজির সহায়তা ও সরকারি মদতে ফুলে ফেঁপে ওঠা লগ্নি-পুঁজির ( ফিন্যান্স ক্যাপিটাল) ফানুস যে কোন সময় বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়তে পারে। ভীত সন্ত্রস্ত পুঁজিপতিরা আদিবাসী জনজাতিদের উচ্ছেদ করে অরণ্যভূমি এবং কৃষকদের জমি থেকে হটিয়ে তাঁদের চাষের জমি দখল করতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তাদের এই মনোবাসনায় আপাতত ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়েছেন লড়াকু কৃষকরা। কিন্তু আইনি ও বেআইনিভাবে কর্পোরেটের থাবা কৃষি ব্যবস্থাকে গ্রাস করতে চাইছে এবং চাইবে তাদের নতুন নতুন বিনিয়োগ ও মুনাফার অতলান্তিক লোভে।
তাই কৃষকদের বাধ্য করা হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানীদের সার, ওষুধ, বীজ ও কৃষি যন্ত্রপাতি কিনতে। চিরাচরিত দেশীয় বীজ সংরক্ষণ ও কৃষিপ্রযুক্তির বংশানুক্রমিক অভিজ্ঞতাকে ধুলোয় লুটিয়ে দিয়ে কৃষিব্যবস্থার কর্পোটিফিকেশন করা হচ্ছে। পুঁজির চলনকে বজায় রাখতে আজ ওরা সবকিছু গ্রাস করতে চায়।
অনিয়ন্ত্রিত মজুতদারি ও ফাটকাবাজির ফলে একদিকে যেমন কৃষিপণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়া হবে, পাশাপাশি দেশে খাদ্যসঙ্কট এমন কি দুর্ভিক্ষও দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে এর মধ্যেই পেপসিকো সহ আরো কিছু কোম্পানি চুক্তি চাষের মায়াজালে কিছু অঞ্চলের চাষিদের জড়িয়ে নিয়েছে। স্বভাবতই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অধিক মুনাফা ও বিদেশে রপ্তানির জন্য যে সব চাষ (বাসমতী, স্ট্রবেরি, আলফানসো আম বা আরো অন্য কিছু) বেশী সহায়ক হবে সেগুলোই চাষ করতে কৃষকরা বাধ্য হবেন এবং অতি ফলন ও ফসলের তথাকথিত গুণমান বজায় রাখার জন্য চাষীরা বাধ্য হবেন আরো বেশী বেশী কীটনাশক, রাসায়নিক সার ও জলের ব্যবহার করতে। আর তার ফলে কর্পোরেটিয় চাষ ও বহুজাতিকদের পাহাড় প্রমান মুনাফার জন্য প্রকৃতি পরিবেশের সর্বনাশ বর্তমান হারের থেকেও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাবে, প্রাণীর বিলুপ্তি হবে লাগামছাড়া, মানুষের রোগভোগ বাড়বে অরো বেশী বেশী করে।
কৃষি বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য:
উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে শস্য যেভাবে গ্রাম থেকে শহরে চালান হয়েছে ও হচ্ছে, তা মাটির স্বাস্থ্যকে সম্পূর্ণ নষ্ট করে দিয়েছে, বেড়েছে মেটাবলিক রিফ্ট। যা পুনরুদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব। ধান, গম ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে মাটির নীচের জল, জমির খাদ্যগুণ (মাইক্রোনিউট্রেন্ট) জমি থেকে একমুখী প্রবাহে যে বিপুল পরিমানে শহরে চলে গেছে ও প্রতিদিন যাচ্ছে তা রোখার জন্য কী করা যাবে সে সিদ্ধান্তের গুরুত্ব অপরিসীম। এদেশের জমির দুই-তৃতীয়াংশ পুষ্টিগুণ হারিয়ে, লবনাক্ত হয়ে পড়ার জন্য ও জমিতে জৈব কার্বনের পরিমান কমে যাওয়ার জন্য রীতিমত অসুস্থ। রোগপোকার ব্যাপক উপদ্রব বৃদ্ধি কৃষি-বাস্তুতন্ত্রের সামনে যে সমস্যা তৈরী করেছে তা এক বড় চ্যালেঞ্জ। জমিতে অনুখাদ্য সরবরাহ বাড়িয়ে বা গোবর-সার ব্যবহার করে এই বিরাট বিপর্যয় মোকাবিলা করে কৃষিবাস্তুতন্ত্র রক্ষা করা কতটা সম্ভব তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে বলেই তাঁরা মনে করছেন। এই সংকটের সমাধানে দেশজুড়ে সরকারকে এক সামগ্রিক যুক্তিগ্রাহ্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
কৃষি-রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় না এমন ধান জমি জীববৈচিত্র্যের বিচারে ক্রান্তিয় বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে তুলনীয়, যা রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের নির্বিচার ব্যবহার ধ্বংস করে ফেলায় আমরা বিভিন্ন ধরনের খাদ্যের উৎসের দিক থেকে নি:স্ব হয়েছি। এগুলি ছিল গ্রামের বহুমানুষের জীবনধারনের সহায়ক ও খাদ্যের প্রাকৃতিক ভান্ডার। বলা বাহুল্য এইসব খাদ্যউৎসের উপর ছিল না কোন মালিকানাও। কৃষি-বাস্তুতন্ত্রের বিপর্যস্ত এই অবস্থাকে পরিবেশ ও পুঁজির দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপট থেকে দেখার উপর গুরুত্ব দিতে হবে আমাদের।
মাঠে নেমে নিজেদের হাতে কাজ করা কৃষকবন্ধু ও পরিবেশবিদরা আজকের বিপর্যস্ত কৃষি বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্য এর সমাধানে জৈব চাষ, বিশেষ করে মিশ্র চাষ ও প্রাকৃতিক চাষের ওপর জোর দিচ্ছেন। এর ফলে একদিকে যেমন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ওপর নির্ভরতা কমবে,পরিবেশ বিপর্যয়কে একটা দূর পর্যন্ত মোকাবিলা করা যাবে। অন্যদিকে বিষহীন বিশুদ্ধ খাবার পেয়ে মানুষের ভগ্নস্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হবে। মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়–বেশি জল সহনক্ষম ধানের জমিতে মাছ, গেঁরি, গুগলি চাষ করলে চাষিদের সামগ্রিক লাভ অনেক বেশি হয়। শুধু তাই নয়, এই ব্যবস্থায় জলজ প্রাণীরা ফসলের পক্ষে ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফেলে, ফলে বাইরে থেকে কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না।
অন্যদিকে একই জমিতে পরস্পরের পরিপূরক বিভিন্ন শাকসব্জি ও ফলের চাষ করাও সম্ভব এবং তা অনেক বেশী কার্যকরী ও বৈজ্ঞানিক যুক্তিসঙ্গত। এই প্রসঙ্গে মার্কিন অবরোধ থেকে দেশের মানুষকে বাঁচাতে কিউবায় দেশীয় প্রযুক্তিতে জৈব চাষ ও শহরগুলোতেও সব্জি, ফল, ফুল চাষ, এমনকি “ভার্টিক্যাল গার্ডেন” এর কথা সামনে আসছে।
কৃষি বাস্তুতন্ত্র তথা পরিবেশের সংকট, ভারতের কৃষি ব্যবস্থায় তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের মারাত্মক কুপ্রভাব, জৈব ও মিশ্র চাষ, ভারতবর্ষ তথা সারা পৃথিবী জুড়ে কৃষির সংকট থেকে সমাধান কোন পথে– এইসব নানা দিক নিয়ে এই আলোচনাকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই আপনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও মূল্যবান মতামতকে পাথেয় করে। আমাদের লক্ষ্য হোক কৃষি বাস্তুতন্ত্রের সংকট নিরসন, মানুষ ও প্রকৃতি পরিবেশকে সুস্থ রাখার যুক্তিগ্রাহ্য ও বাস্তবসম্মত পথের দিশা পাওয়া। দেশীয় বীজের চাষ ও সংরক্ষণ, রাসায়নিকের পরিবর্তে জৈব সার, কম জল লাগে এবং স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারে এমন ধরনের পরিবেশ বান্ধব চাষের কথা ভাবতে হবে, ডিপ ও শ্যালোর মাধ্যমে অতিরিক্ত জল না তুলে নদী খাল বিল ও পুকুর দীঘির মত চিরাচরিত জলসেচের বিকল্প পথ সামনে আনতে হবে। চাষীদের সাথে পরিবেশ বান্ধব বিকল্প চাষ আবাদের বিষয়ে আলোচনা করতে হবে ও পুরুষানুক্রমে অর্জিত তাঁদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। দাবী উঠুক– কিছু মানুষ বা কর্পোরেটের স্বার্থে প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ ও জমি লুঠ নয়, কৃষকদের সর্বনাশ করে জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস নয়। প্রাণ্তিক চাষী, ক্ষেতমজুর, ভাগচাষী সহ সমস্ত কৃষক ও আম আদমির প্রয়োজন ও স্বার্থের কথা ভেবে এবং প্রকৃতি পরিবেশকে বাঁচিয়ে কৃষির সংস্কার হোক নয়া তরিখায়।।
সন্তোষ সেন ঃবিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক।