• March 25, 2023

ভীমা-কোঁরেগাও মামলায় জামিনপ্রাপ্ত সমাজকর্মী সুধা ভরদ্বাজের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারঃপ্রথম পর্ব

 ভীমা-কোঁরেগাও মামলায় জামিনপ্রাপ্ত সমাজকর্মী সুধা ভরদ্বাজের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারঃপ্রথম পর্ব

[ সুধা ভরদ্বাজ নামটা অধিকার আন্দোলনের জগতে বহু আলোচিত। বিশিষ্ট আইনজীবী, ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্টিভিস্ট,সমাজকর্মী সুধা ভীমা-কোঁরেগাও মামলায় অভিযুক্ত হয়ে এতদিন কারান্তরালে ছিলেন।বর্তমানে তিনি শর্তাধীন জামিনে জেলের বাইরে।ছত্তিসগড় নিবাসী সুধাকে জামিনের শর্ত মেনে মুম্বাইতে তার জীবন নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে। সম্প্রতি rediff.com এ তার এক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নীতা কোলহাতকর।সেই কথোপকথনের নির্বাচিত অংশের অনুবাদ রইল পূর্বাঞ্চলের পাঠকদের জন্য। অনুবাদ করেছেন সুমন কল্যাণ মৌলিক ]

সুধা,আপনি এখন শর্তাধীন জামিনে মুক্ত।বাস্তবিক অর্থে এই মুক্তির অর্থ কি?

( হাসি) আমি নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত মনে করতে পারছি না।মুম্বাই শহর আমার কাছে পুরোপুরি অচেনা।আমার বেশিরভাগ কাজ ছত্তিসগড়ে।আমি সেটা উপেক্ষা করতে পারছি না।সেখানে আমার ইউনিয়ন রয়েছে ( ছত্তিসগড় মুক্তি মোর্চা, মজদুর কার্যকর্তা কমিটি),ওখানকার হাইকোর্টে আইনজীবী হিসাবে কাজ করতাম,আমার মেয়ে সেখানে পড়াশোনা করে।আমাকে মুম্বাইতে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।কাজ খুঁজতে হবে,নতুন আস্তানাও।তাই বলা যায় ষাট বছর বয়সে আমি জীবন নতুন করে শুরু করতে চলেছি।এটা বেশ কঠিন।

ষাট হল তাহলে নতুন যৌবন?

  • ( আবার হাসি) আমার নিজেকে বুড়ো মনে হয় না।কিন্তু পঁচিশ বছর বয়সে যখন আমি ছত্তিসগড়ে কাজ করতে যাই তখন আমার যে প্রাণশক্তি ছিল, আজ তা আর নেই।

আইন ও জেলবন্দীদের বিষয়ে আপনার পূর্ব অভিজ্ঞতা ( আইনজীবী হিসাবে দীর্ঘদিন মানুষকে সাহায্য করার কারণে) কি আপনাকে প্রস্তুত করেছিল পরবর্তী অভিজ্ঞতার জন্য ( মানে আপনি যখন গ্রেপ্তার হলেন)?

  • ঠিক। জেলে যাওয়ার আগে পনের বছর আমি আইনজীবী হিসাবে কাজ করেছি।যদিও গ্রেপ্তার হওয়ার প্রাথমিক ধাক্কা এবং গোটা পদ্ধতির মধ্যে যে অসম্মান তা যে কাউকে তাড়িত করবে।আমার মনে আছে ইয়ারদা জেলে আমাকে যখন প্রথম আনা হল তখন রাত আটটা-সাড়ে আটটা।চারদিক অন্ধকার। আমাকে বলা হল পাশের ঘরে যেতে, সেখানে আমার তল্লাশি হবে।তখনই আমি প্রথম উপলব্ধি করলাম যে আমাকে অপরাধী বলা হচ্ছে এবং আমার সাথে সেইমত ব্যবহার করা হবে।ওরা আমার ব্যাগ খুলে প্রায় সব জিনিস ছুঁড়ে ফেলে দিল কারণ সেগুলো নিয়ে প্রবেশের অনুমতি নেই। আমাকে দেওয়া হল বিছানার চাদর, পোষাক। অ্যালুমিনিয়ামের একটা থালা ও মগ দেওয়া হল যা ভিক্ষা পাত্রের কথা মনে পড়ায়।এরপর আমাকে ব্যারাকে নিয়ে যাওয়া হল।সেখানে যে সমস্ত বন্দীরা ছিল তারা কিছুটা অনিচ্ছা নিয়েই আমাকে সামান্য জায়গা ছেড়ে দিল।এভাবে প্রথম দিনটা কাটল।পরের দিন সকাল সাড়ে পাঁচটায় ওঠা ছিল খুব কষ্টকর কারণ সারা রাত ঘুম হয় নি বললেই চলে।তখনো অন্ধকার,ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে লাইনে দাঁড়ালাম।এবার গুনতি শুরু হবে।জোর ধাক্কা লাগল যখন দেখলাম আমার নাম ধরে না ডেকে, বলা হল ‘ এক নয়া মাওবাদী আয়া হ্যায়’।তারপর আমাকে একটা আলাদা সেলে পাঠানো হল।ধীরে ধীরে সব কিছু মানাতে হল।সবাই অভ্যস্ত হয়ে ওঠে…যেভাবে আমার সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে তার জন্য নয়,তার চেয়েও বেশি আশে পাশের মানুষদের সঙ্গে যে ব্যবহার করা হচ্ছে তার জন্য। বাইকুল্লা জেলে বন্দীদের ডাকার এক পরিচিত পদ্ধতি হল তাদের ‘ থোবড়া’ ( কারোর মুখমন্ডল নিয়ে অপমানজনক শব্দ) ধরে ডাকা।বলা হত’ থোবড় লাইন পে আ যাও’।যদিও আমার সঙ্গে এটা কখনো ঘটে নি,রক্ষীরা সম্মান দিয়েই কথা বলত।আমার মনে হয় সেটা বয়স,আমার নামের পরিচিতি ও শ্রেণি অবস্থানের জন্য। এছাড়া বন্দীদের ‘ তু'( মারাঠি ও হিন্দিতে কাউকে সন্মান না দিতে চাইলে তু বলে সম্বোধন করা হয়।খুব ঘনিষ্ঠদের মধ্যে তু অন্য অর্থে ব্যবহৃত হয়) বলে সম্বোধন করা হত।

আপনার কি সেই ধরনের মহিলা বন্দীদের সঙ্গে কথা হয়েছে যারা দীর্ঘ দিন ধরপ জেলে পচছে কারণ অর্থাভাবে তারা জামিন পাচ্ছে না?

ইয়ারদা জেলে আমার সে সুযোগ হয় নি কারণ আমাকে ও অধ্যাপিকা সোমা সেনকে ( নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান,সুপরিচিত সমাজকর্মী ও ভীমা-কোঁরেগাও মামলাশ সহ অভিযুক্ত) ফাঁসির ব্যারাকে রাখা হয়েছিল। ঐ ব্যারাকে থাকত ফাঁসির সাজা প্রাপ্ত সীমা গাভিত ও রেনুকা সিন্ধে।এই দুই বোন পাঁচ জন বাচ্চাকে অপহরণ ও খুনের মামলায় ফাঁসির আদেশ পায়।যদিও টানা পঁচিশ বছর জেল খাটার কারণে তাদের ফাঁসির সাজা মকুব হয়ে যাবজ্জীবন হয়।কিন্তু বাইকুল্লা জেলে আমরা এরকম বহু বন্দীদের দেখি যারা আইনি ( প্রিভেনশন) অ্যাক্টে গ্রেপ্তার হয়েছেন। আর যারা৷ স্বামী খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন তারা শ্বশুর বাড়ি ও নিজের বাড়ি– উভয় পরিবার দ্বারা পরিত্যাক্ত।এছাড়া আছে বাংলাদেশের মেয়েরা যারা পয়সার অভাবে উকিল দিতে পারে না।আমি অবশ্য সৌভাগ্যবতী ছিলাম( হাসি)।আমার সংগঠন, ইউনিয়ন, সন্তান ও বন্ধুরা ছিল যারা আমার ব্যাপারে চিন্তিত। আমার হয়ে লড়ার জন্য ভালো আইনজীবী ছিলেন।যদিও বহু সময় লেগে গেল তবুও আমি জানতাম তারা আছেন।কিন্তু যাদের কোন সাহায্য নেই তারা অসহায়।তারা জানে না তাদের মামলার কি অবস্থা। বিশেষ করে করোনাকালে যখন মামলার গতি প্রায় স্তব্ধ।কোন সাক্ষাৎকার ( মোলাকাত) নেই, আদালতে মামলার তারিখ নেই। তাদের হতাশা ও অসহায়তা অবর্ণনীয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Related post